“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৩৪
(নূর নাফিসা)
.
.
সন্ধ্যার পর রান্নাবান্নার কাজ এগিয়ে দিয়ে পড়ার জন্য ব্যস্ত হয়েছিল রোজা। এমনি ফুপুর ফোনটা বেজে উঠলো। রিংটোন শুনেই রোজার সন্দেহ হয়েছিলো মাহতাবের ফোন এসেছে। দু-এক দিন পরপরই তার ফোন আসে। এছাড়া মাঝে মাঝে বাবার ফোনও আসে বিদেশ থেকে, খুব বেশি প্রয়োজন হলে দাদাজানের ফোন থেকে কল আসে। এছাড়া কাউকে পাওয়া যায় না এই ফোনে। এখনো মাহতাবই ফোন করেছে। মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো রোজার। রিংটোন শুনে ওদিক থেকে মরিয়ম গলা বাড়িয়ে বললেন,
“আফরোজা, দ্যাখ গো কে ফোন করছে।”
“দেখেছি ফুপু। তোমার ছেলে।”
বলতে বলতে ওদিকে ফোন কানে চেপে সালাম দিলো রোজা। মাহতাব সালামের জবাব দিয়েই বললো,
“ডেকেছিলাম নিরবে, তুমি পাওনি শুনতে।
যদিও ডাকিনি সেভাবে, তবুও তোমাকেই পেলাম অজান্তে।”
“আচ্ছা?”
“জ্বি, আচ্ছা। ফোনের অপেক্ষায় ছিলে? নাকি পাশে ফেলে রেখেছিলে অবহেলায়?”
“কোনোটাই না। পড়তে বসছিলাম, এমনি তোমার ডাক।”
“ওহ্! পড়ার সময় বিরক্ত করলাম বুঝি?”
“বিরক্ত?”
মাহতাব মৃদু হাসলো।
“নাহ, মজা করলাম। এ সপ্তাহে কিন্তু চিঠি পেলাম না। বুঝলাম, তোমার পরীক্ষা। তাই অপেক্ষাকে অপেক্ষায় থাকতে বলে দিলাম।”
“অপেক্ষাকে অপেক্ষায় রাখতে হবে না। আমি পাঠিয়েছি চিঠি। পেয়ে যাবে শীঘ্রই।”
“তাই নাকি!”
“হুম। কি করছিলে?”
“এইতো ইশার আজান পড়লেই নামাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিবো।”
“আজ সন্ধ্যাতেই যেন ফোন? ফুপুর সাথে বিশেষ প্রয়োজন? কথা বলবে?”
“কথা তো বলবোই। তবে তোমার সাথেই একটু প্রয়োজনে ফোন দেওয়া। আজমাইন কি বাড়িতে গেছে? নানাজানের ফোনে কল দিলাম, রিসিভ হচ্ছে না।”
“আজমাইন? এখন বাড়িতে কেন আসবে? সেদিন না গেলো?”
“হ্যাঁ, হঠাৎ কি মনে করে যেন পাগল হয়ে গেলো। গত সপ্তাহে এসেই পাগলামো শুরু করেছে, তার নাকি কয়েক ঘন্টার জন্য হলেও বাড়ি যাওয়া প্রয়োজন। মামীর জন্য নাকি খারাপ লাগছে।”
“কেন? মায়ের কি হয়েছে?”
“মামীর কিছুই হয়নি। সে নাকি বাজে আচরণ করে এসেছে। সেজন্য এখানে এসেই অস্থির হয়ে গেছে আবার যাওয়ার জন্য। এক দিনের ছুটিও নিয়ে নিয়েছে কাজ থেকে।”
“এ আবার কোন পাগলামো! কখনো তো দেখলাম না তার বাজে আচরণের ফলে অনুতপ্ত হতে!”
“হতেই পারে। মানুষ কি একরকম থাকে সবসময়? বয়স বাড়ছে৷ বোধশক্তিও বাড়ছে।”
“কখন রওনা হয়েছে?”
“দুপুরে। গতকালই যেতো। ধর্মঘটের কারণে যানচলাচল বন্ধ ছিলো তাই যাওয়া হয়নি।”
“এতোক্ষণে চলে আসার কথা না?”
“যাওয়ার তো কথা। জ্যামে পড়লে একটু দেরি হতে পারে। দেখো তো, খোঁজ নেওয়া যায় কি না।”
“আচ্ছা, দেখছি।”
মায়ের সাথেও স্বল্প সময়ের কথাবার্তায় ভালোমন্দের খবর নিয়ে ফোন রেখে দিলো মাহতাব। তার পরপরই ফুপুর ফোন থেকে রোজা কল দিলো দাদাজানের ফোনে। ঠিকই রিসিভ হচ্ছে না। ব্যাপারটা কি হলো? ফোন তো দাদাজানের পাশেই থাকার কথা। একটু পরপরই ফোন দেওয়ার জন্য ফুপুর ফোনটা পাশেই রাখলো সে। হতেও তো পারে, আজমাইন বাড়ি এসেছে আর সবাই গল্পেসল্পে মেতেছে তাই ফোনের দিকে কারো মনযোগ নেই। ভেবেও যেন না চাইতেই টেনশন হচ্ছে কিছুটা।
আজ সারাদিন তেমন না খাওয়ায় শরীরটা দুর্বল লাগছিলো মৌসুমীর। কিন্তু মনটা তাজা। উদ্ভট সব ভাবনার সাথেই মনের খেলাধুলা। তবে বিকেল থেকে মাথাটা একটু ব্যাথা করছিলো। তাই সন্ধ্যার পর মায়ের কাছে গিয়ে বসে ছিলো। সেলিনা বেগম ছোট দুইজনকে পড়ার জন্য বকে যাচ্ছেন আর মৌসুমীর মাথায় ঘঁষে ঘঁষে তেল লাগিয়ে দিচ্ছেন। প্রতি টানেই মৌসুমী বারবার বলছে,
“ওফ্ফ! মা, আস্তে দাও তো। আমার মাথাটাই যেন ছিঁড়া ফেলতাছো!”
“এমনে না দিলে মাথা ব্যাথা যাইবো না।”
“এমনে আরও বাড়বো। বেশি বুঝো খালি। আস্তে দাও। আমি ব্যাথা পাই।”
“হো, দিতাছি।”
ওদিকে সিয়াম বায়না করছে আজ পড়বে না। সেলিনা বেগম মোটা লাঠি এনেই বসেছেন। না পড়লে এই লাঠি ভাঙবে তার পিঠে! সেলিনা বেগমের রান্নাবান্না আজ সন্ধ্যার আগেই শেষ। না পড়ে বাঁদর ছেলে যাবে কই? একদম নড়বে না সে ঘন্টা দুয়েকের আগে।
খুব রাগ আর ভাব নিয়ে তো একটা দিন কাটিয়ে গেলো আজমাইন। ইচ্ছাকৃত গম্ভীরতা প্রকাশ করে রেখেছিলো। এরপর বাড়ির সীমানা ছাড়তে না ছাড়তেই কেমন অস্থিরতা বিরাজ করছিলো। যদিও তার কারণ স্পষ্ট হচ্ছিলো না মনে। গন্তব্যে ফিরেই যেন সেই কারণ অনুভব করলো তীব্র অস্থিরতার বেগে। উপলব্ধি করলো একটা বিরাট অন্যায়ের। মায়ের এতো আদরে সায় না দেওয়া তার ভারি অন্যায় হয়েছে। মায়ের মুখটা কেমন হয়েছিলো, যখন সে চলে আসছিলো! দৃশ্যটা যেন মনের অজান্তেই চোখের সামনে বারবার ভাসতে লাগলো। হৃদয় জ্বালিয়ে দিতে লাগলো প্রখরভাবে। অথচ এতোগুলো দিন, এতোগুলো বছর পাড় হলো জীবন থেকে। কখনো এর অর্ধাংশও অনুভব করেছে বলে মনে পড়ে না। কত যে বাজে ব্যবহার করলো মায়ের সাথে, কত অবাধ্য হলো কথার। কখনোই তার বিপরীতে এতোটা রাগ জন্মেনি, কখনোই বাড়ি ছাড়ার মতো জেদ হয়নি তার। তবে আজ কেন? আজ কেন এতোটা তীক্ষ্ণতা অনুভব হচ্ছে তার? আগে কেন হয়নি? সবটাই বয়সের দোষে? নাকি রাগ করে আগে কখনো বাড়ি ছাড়া হয়নি বলে? কাজের প্রতি এতো জেদ এলো কবে থেকে? মন খারাপ তো শুধু হতো একটু বাবা যাওয়ার সময়। চলে যাওয়ার পরে আবার ভুলেও যেতো শীঘ্রই। কিন্তু এবারের মতো খারাপ তার অনুভব হয়নি কখনোই। পরিবর্তনগুলো যেন মনের অজান্তেই হয়ে থাকে দিনেদিনে। এক জায়গায় বেঁধে কাজ করানোর মতো ছেলে তো সে ছিলো না। আজ কিভাবে পারলো টানা দেড় মাস একই কাজে একই স্থানে পড়ে থাকতে? একটা দিনের জন্য উঁকি দিয়েও পরিবারের উপর অভিমান রাখতে? অসম্ভব! এই অস্থিরতা এবার কমাবে কি করে? ভারি অন্যায় যে করেছে মাকে হতাশ করে! সেই ছোটার জন্য পাগল হয়েছে। তার অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ মাহতাবের চোখেও পড়েছে। জিজ্ঞেস করতেই পুনরায় বাড়ি আসার পাগলামো প্রকাশ পেয়েছে। মাহতাব তাকে পরবর্তী শুক্রবার ঘনিয়ে আসার অপেক্ষায় রেখেছিলো। নতুন নতুন কাজে ফাঁকি দিলে কাজের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু শুক্রবারের ধর্মঘট যানচলাচল বন্ধ রেখে দিয়েছে। পরবর্তী সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষার জন্য মন মানছে না। কাজ থেকে রবিবারের ছুটি নিয়েই শনিবার চলে এসেছে। ইশারের আজানের পরপর বাড়ি ফিরেই মায়ের ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো আজমাইন। শ্বশুরকে নামাজের জন্য সাহায্য করে এসে হালিমা খাতুন মাত্রই ওযু করে জায়নামাজটা বিছিয়ে ছিলেন। দোয়া পড়তে শুরু করার আগেই চাপানো দরজাটা হুট করে খুলে গেলো। হালকা কেঁপে উঠেছেন তিনি। আজমাইনকে দেখে বিস্ময় চোখে তাকিয়েছেন। কিছু বলার সুযোগ হলো না। আজমাইন জায়নামাজে দাঁড়ানো মাকে হুট করেই জড়িয়ে ধরলো। ভেতর থেকে যেন সাথে সাথেই অস্বস্তিকর ভাবটা এক নিশ্বাসে বেরিয়ে এলো। দুনিয়াটা যে কি শান্তিময় রূপে অনুভব হলো, তা এই প্রথমবার উপলব্ধি করলো। ওদিকে মায়ের মনে ভয় বেড়ে গেলো তার হুটহাট আগমন এবং বর্তমান কর্মকাণ্ডের কারণে। কি হলো ছেলের? এক হাতে পিঠ চেপে ধরে আরেক হাত মাথায় রেখে ভয়ার্ত গলায় মা বললো,
“কিরে বাপ? কি হইছে তোর?”
“আমার আচরণে তোমার খুব কষ্ট লাগছে, তাই না মা?”
“না, না। আমার কিসের কষ্ট? তোর কি হইছে হঠাৎ? এইসময় এমনে দৌড়ায় আইলি ক্যা?”
আজমাইনের স্বস্তিকর মুখে ভারি স্বস্তির হাসি ফুটলো। সোজা হতেই মুখের হাসিটা দেখলো মা। মনের ভয়টা বৃদ্ধি পেতে বাধা পেলো এই হাসি দেখে। তবে চোখ ভরা বিস্ময়! আজমাইন মায়ের বিস্ময় কাটাতে বললো,
“খুব খারাপ লাগছিলো চলে যাওয়ার পরে। তাই সুযোগ পেতেই আবার চলে এলাম তোমার সাথে দেখা করতে। এখন ভাল্লাগছে।”
কথার সাথে যেন হাসিও মুক্ত ঝরালো নিশ্বাসে নিশ্বাসে! ছেলের হাসিমাখা মুখের কথায় মায়ের মনের ভয়টুকু কেটে চোখদুটো আনন্দের জলে টইটম্বুর হয়ে এলো। তিনি হাসিমুখেই তার মাথায় এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে বললেন,
“তাই বলে এমন পাগলামি করবি? এতোদূর থেকে দৌড়ায় আইবি? কাছের কথা!”
“আইলাম তো।”
“কইলে তো শুনছ না। ডাকলে দেমাক দেখাছ। এখন কেমন লাগে মায়ের থেকে দূরে থাকলে? বুঝা যায় আমার ব্যাথাটা? যা হাতমুখ ধু গিয়া।”
“যাইতাছি। তুমি নামাজ পড়ো। আমি কিন্তু কালকেই আবার চলে যামু, আগেই বলে রাখি। কাজ আছে। চাইলেও বেশি থাকা যাইবো না। আবার দুই সপ্তাহ পরে আইতেই হইবো অনেক দিনের জন্য। পরীক্ষা আছে।”
“আচ্ছা, যা। আমি নামাজটা পড়ে আইতাছি।”
আঁচল চেপে আনন্দের অশ্রুটুকু মুছে নিলেন হালিমা খাতুন। নামাজেও এবার কাঁদলেন পরম করুণাময়ের কাছে অন্যরকম মায়া জড়িয়ে। হঠাৎ কি এমন জাগিয়ে দিলেন ছেলের মনে যে, ছেলেকে পাগল হয়ে মায়ের কাছে ছুটে আসতে হয়? এই মায়া যে জীবনের জন্য অতৃপ্তিকর। এর শেষ না হোক। মায়ের ঘর থেকে আজমাইন পরপরই পা ফেললো নিজের ঘরে। সেদিকে যেতে যেতে ভাবছিলো মৌসুমীকে। দুপুরে পথে বের হওয়ার সাথে সাথেই এই মেয়েটাকে তার মনে পড়েছে। গত সপ্তাহে আলতা ফেলে দেওয়ায় কি মন খারাপটাই না করে ফেলেছিলো। তাই আজ আসার পথে তার ঘরের সুন্দরীর জন্য ফেরি থেকে আলতা কিনে নিয়ে এসেছে। তবে শুরুতেই আদরে আলতা সপে দিয়ে বাঁদর বানাবে না। সবসময়কার মতো আজকেও ভাব নিয়ে রাগাবে ভেবেছে। তবে একটু অন্যরকমভাবে। তাকে ক্ষেপানো এবং কারণে অকারণে শাস্তি দেওয়াটাও যেন তার কাছে অন্যরকম স্বস্তিদায়ক। সেদিন ভাবের পর তো ভীষণ মন খারাপ করেছিলো ঘরসুন্দরী, আজ যেন সেই মন খারাপটুকু না থেকে যায় তার জন্য। কিন্তু ঘরে পা দিয়ে তার দেখা পেলো না। দরজার বাইরে ফিরে এসে উঁকি দিয়ে লক্ষ্য করে দেখলো রোজার ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। তবে আর কোথায়? দাদাজানের ঘরে, নাহয় তাদের ঘরেই আছে। যাক, হাতমুখ ধুয়ে সতেজ হয়ে খোলামনে নিশ্চিন্তে রাগানো যাবে পরে।
“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৩৫
(নূর নাফিসা)
.
.
মাথায় তেল লাগিয়ে বিনুনি করে দিয়ে সেলিনা বেগম মৌসুমীকে পাঠিয়েছে তার দাদাজানের নামাজ হয়েছে কি না দেখার জন্য। খাবার দিবেন তিনি। মৌসুমী দাদাজানের ঘরের দরজা ঠেলে উঁকি দিয়ে দেখলো তসবি হাতে নিয়ে বসে আছেন আহমদ আলী। রাজ্যের চিন্তায় যেন চিন্তিত। মৌসুমী সুর ধরে ডাকলো,
“ও দাদাজান৷ দাদাজান?”
ধ্যানভঙ্গ আহমদ আলী ফিরে তাকালেন দরজার দিকে। মৌসুমীকে দেখে সাড়া দিলেন,
“কি?”
“নামাজ শেষ হইছে তোমার?”
“হু।”
“মা জিগাইছে খাবার দিবো কি না?”
“হু, দে।”
“আচ্ছা।”
মাকে খাবার দিতে বলে চাপকল থেকে পানির জগ ভরে নিয়ে আসতে গেলো মৌসুমী। এমনি ওপাশের বাথরুমে যেন কাউকে যেতে দেখতে পেলো। সামনের দিকটা অন্ধকার থাকায় বুঝা গেলো না। দরজাটা আটকে দিতে অতি অল্প সেই সময়টুকুতে যেন শুধু মাথাটা লক্ষ্য করে বুঝা গেলো কোনো পুরুষ লোকের মাথা। নাকি বড় মা-ই গেলো আর সে ভুল দেখলো? আকস্মিক চোখের পলকে দেখার ভুলও তো হতে পারে। বড় মা-ই হবে হয়তো। নয়তো আর কে আছে বাড়িতে? খুব একটা মাথা ঘামালো না। নিজেদের কল থেকে পানি নিয়ে দাদাজানের ঘরে চলে গেলো। জায়নামাজ একপাশে সরিয়ে ফোনটা হাতে নিলো আহমদ আলী। স্ক্রিন জ্বালাতেই লক্ষ্য করলো কেউ কল করেছে। নামটাও পড়ে বুঝে নিলো মাহতাব এবং মরিয়ম। কিন্তু কারো ফোনের শব্দই সে শুনতে পেলো না কেন? মৌসুমী জগ হাতে এলেই তিনি বললেন,
“দ্যাখ তো মৌসুমী। ফোন দিলো, আওয়াজ হইলো না ক্যা?”
“কে ফোন দিছে, দাদাজান?”
“মাহতাব দিলো। তোর ফুপু দিলো।”
মৌসুমী ফোন নিয়ে কাঁচা হাতে কিছুক্ষণ খুটিনাটি করে ধরতে পারলো ফোনের ভলিউম কমে গেছে দাদার অজান্তেই চাপ পড়ে। তাই শুনতে পায়নি শব্দ। ততক্ষণে সেলিনা বেগম খাবারের প্লেট, বাটি নিয়ে এসেছে। মৌসুমী ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে চলে গেলো। আহমদ আলী কলব্যাক করতে ব্যস্ত হলেন। মৌসুমী বেরিয়েই দেখলো আজমাইনের ঘরের দরজা খোলা। কিন্তু তার যতদূর মনে পড়ে, সে দরজা লাগিয়ে গিয়েছিলো। হতেই পারে বড় মা খুলেছে। এই সন্ধ্যার ভরো বাড়িতে চোর আসার সাহস তো হবে না এখনই। তাই দ্বিধাহীন ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো মৌসুমী। ভেতরে এসে আজমাইনকে শীতের জামা পরতে দেখে যেন এখানেই থেমে গেলো। পোশাকাদি ছাড়িয়ে হাতমুখ ধোয়ার পর আবার ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিলো আজমাইনের। মৌসুমীর উপস্থিতি লক্ষ্য করে ভ্রু জোড়া হালকা কুচকে চেহারায় গম্ভীরভাব এনে বললো,
“কই ছিলি এতোক্ষণ? রাতের বেলাও টইটই করছ?”
মৌসুমীর মুখটা মলিন। আজ আর সেদিনের মতো আহ্লাদে জর্জরিত খুশিটা হতে পারলো না। হবেই কি করে? সবসময় শুধু মেজাজ দেখায়, কথা বললেই বিরক্তি ফুটে। এখনো মেজাজ চড়াই দেখলো। তাই কথা বাড়িয়ে বিরক্ত করার মানসিকতা তৈরি হলো না তার মাঝে। এমনিতেই শরীরটা ভালো না। নিরবে পরপর কয়েকবার আজমাইনের দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে সে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। আজ অল্প পোশাকাশাকের ছোটখাটো একটা ব্যাগ সাথে আছে দেখা যায়। ক’দিনের জন্য এসেছে ভাবতে লাগলো। মৌসুমীকে জবাব দিতে না দেখে যেন আজমাইনের মনে মনে ভাবনা পড়লো৷ একে আর রাগাবে কি? সে তো এমনিতেই অভিমান করে বসে আছে দেখতে পাচ্ছে। সেদিন ধমক দেওয়ার কারণেই হয়তো। এমনি সেলিনা বেগম এলো।
“মৌসুমী গো, আজমাইন আইছে বুঝি?”
“হো, মা। আইছে।”
ওদিকে নিজের রুম থেকে হালিমা খাতুনও বেরিয়েছিলেন বারান্দায়। তিনিও সেলিনা বেগমের জবাব দিলেন,
“আইলো তো একটু আগে।”
“এজন্যই তো মাহতাব ফোন করতাছে।”
তিনি দরজার বাইরেই এগোতে এগোতে জিজ্ঞাসা করেছেন। জবাব পেয়ে আবার দরজা পর্যন্ত আসার আগেই ফিরে গেছেন শ্বশুরকে বার্তা জানাতে। মাহতাবের সাথে কথা বলে আহমদ আলীই তাকে পাঠিয়েছেন ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য। হালিমা খাতুন এগিয়ে এসে তাদের বললেন,
“আয়, ভাত খাবি।”
আজমাইন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেও মৌসুমী বললো,
“আমি খাইতাম না, বড় মা। ওইঘরে চিড়া ভাজা খাইছি।”
“মাইর দিমু ধইরা একটা। এই খাওয়ায় কিছু হইবো না। তাড়াতাড়ি খাইতে আয়। সারাটাদিন খাস নাই।”
“আমার ভাল্লাগতাসে না।”
“আমি খাওয়ায় দিমু। জলদি আয়।”
হালিমা খাতুন ডেকে চলে যেতেই আজমাইন বললো,
“ক্যা, কি হইছে তোর?”
“কই কি হইছে?”
“তো খাবি না ক্যা?”
“এমনি খাইতাম না।”
“তুই খাবি, তোর ঘাড় খাইবো। আয়।”
“না।”
পেটের পীড়ার ব্যাপারে জানালো না তাকে। খুব মেজাজ দেখায় তো, একদমই জানাবে না এই বদলোককে। আজমাইন তাকে খেতে যাওয়ার জন্য টেনে নামাতে যাবে, এমনি সেলিনা বেগম আহমদ আলীর ঘরের সামনে থেকেই নিজেদের ঘরের দিকে যেতে যেতে মৌসুমীকে ডাকলেন প্রয়োজনে। মৌসুমী সেদিকেই চলে গেলো। আজমাইনও তার সাথে সাথে বেরিয়েছে বাইরে। গিয়েছে ভাত খাওয়ার জন্য। মৌসুমী এই ঘরে এলেই সেলিনা বেগম প্লেটে পিঠা তুলে দিতে দিতে বললো,
“যাক, ভালোয় ভালোয় আসায় আজ পিঠা খাইতে পারলো। আজ বাদে কাল আইলেই তো আফসোসটা করা লাগতো যে, পিঠা খাওয়া শেষে আইছে! থাকবো কয়দিন? কাল আবার অন্য পিঠা বানাইতাম?”
“কি জানি! জিগাই নাই কিছু।”
“আচ্ছা, জিগামুনে আমিই। কইছ তুই, মায় কইছে কয়দিন থাইকা পিঠা খাইয়া যাইতা।”
“হো, কাজ থাকলে থাকবো নে তোমার পিঠা খাওয়ার জন্যে।”
“সবটার মধ্যে অগ্রিম অগ্রিম কথা কছ! যা, নিয়া পিঠা দে। খাইবো নে।”
“ওই প্লেটে আমারে ছোট দেইখা একটা দাও। দেখি খাইতে পারি কি না।”
সেলিনা বেগম তার পছন্দমতোই একটা তুলে দিলেন আলাদা প্লেটে। দুই হাতে দুই প্লেট নিয়ে মৌসুমী এই ঘরে এসে আজমাইনের সামনে প্লেট রেখে বললো,
“নাও, খাও। তোমার শ্বাশুড়ি মা পিঠা বানাইছে। আরও কয়দিন থেকে পিঠা খেয়ে যেতে বলছে।”
“কালকেই চলে যামু।”
বলতে বলতে পিঠার প্লেট টানলো আজমাইন। হালিমা খাতুন মৌসুমীকে পিঠা খেতে দেখে বললো,
“কয়টা ভাত খাইবো, তা না। এখন আবার পিঠা আনছোস ক্যা? সকালের পিঠাও তো রইছে একটা।”
“তুমি খেয়ে ফেলো।”
“খাইছি আমি।”
“আবার খাও।”
এই পিঠা থেকেও অর্ধেকটা খেয়ে বাকিটা হালিমা খাতুনকে দিয়ে চলে গেলো। আর ভালো লাগছে না খেতে। আজমাইন পিঠাও খেলো, ভাতও খেলো। পরপরই পকেট থেকে টাকা বের করে তিন হাজার টাকা গুজে দিলো মায়ের হাতে। পাঁচ হাজার টাকা বেতনে কাজ করে। গত মাসের প্রথম বেতনটা মায়ের হাতে দিলো কিছু। বাকিটা রইলো তার খরচের জন্য। আসা-যাওয়ার ভাড়া, আবার পথেঘাটে খরচের প্রয়োজন হয়। খাবার দাবার তো মাহতাবের কাছেই হচ্ছে। আবার গত সপ্তাহে আসা-যাওয়ার খরচও মাহতাব বহন করেছে। হালিমা খাতুন টাকা হাতে পেয়ে আশ্চর্যান্বিত হয়ে সেই টাকা আবার ছেলের হাতে ফেরানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে বললেন,
“আরে, পোলা কি করে! এই টাকা তো তোরই লাগবো। থাকা খাওয়া, আসা যাওয়ার খরচ আছে না! আমার টাকার দরকার নাই। তুই উপার্জন কর, নিজের খুঁটিটা পাকাপোক্ত কর। ঝড় এলেই যেন পড়ে যাইতে না হয়। ওইটাই আমার খুশি।”
“আরে রাখো। এখন তো আর এতো লাগতাছে না। প্রথম বেতন পুরাটাই দিতাম৷ দুই হাজার রাখছি, খরচ করতাছি।”
“তুই ধর। এইটাও লাগবো।”
“লাগলে নিমু নে। আবার কয়দিন পরে এইমাসের বেতন পেয়েই যামু।”
ঘরে এসে দেখলো মৌসুমী বিছানা গুছিয়ে ঘুমাতে শুয়ে পড়েছে। মনে দুষ্টুমি চাপলো আজমাইনের। মাথার পাশে বসে তার মুখটা মশারীর বাইরে বের করে রাখলো মশা কামড়ানোর জন্য। মুখের উপর দিয়ে মশারী উঠানো টের পেয়েই চোখ খুলে ফেললো মৌসুমী। আজমাইন বড়সড় ঢেকুর তুলে বললো,
“সন্ধ্যা বেলাই ঘুমায় যাস ক্যা?”
“এখনো সন্ধ্যা রইছে? ঘড়িতে তাকায় দেখো কয়টা বাজে।”
“বাজুক তাতে আমার কি? আমার সন্ধ্যা শেষ হয় নাই।”
“এহ! আইছে সন্ধ্যাওয়ালা!”
মৌসুমী মশারী টেনে মাথা ভেতরে নিয়ে গেলো আবার। আবারও তুলে দিলো আজমাইন। চোখ খুললো না মৌসুমী। তার বিনুনি দিয়েই কানে খোঁচাতে লাগলো আজমাইন। সুড়সুড়িতে পুরো শরীর কেঁপে গেলো। বারবার সরিয়ে দিয়েও মুক্তি না পেয়ে যন্ত্রণায় উঠে বসেছে মৌসুমী।
“ধ্যাৎ! অযথা আইছিলাম এখানে ঘুমাইতে। বড় মার কাছেই শান্তি!”
“নেমে দ্যাখ খালি, পায়ের পাতা কেটে দিবো।”
নামতে গিয়েও হুমকির কারণে নামলো না মৌসুমী। বিকৃত মুখে বললো,
“তবে ঘুমাইতে দাও না ক্যা শান্তিতে?”
“বলছি না, সন্ধ্যা শেষ হয় নাই।”
“শেষ না হইলে তুমি বসে বসে সন্ধ্যা তারা গুনতে থাকো। আমার ঘুম পাইছে।”
“তুইও গুনবি সাথে। একটা জিনিস আনছি তোর জন্য। দেখছোস?”
বলতে বলতে ব্যাগটা টেনে নিলো আজমাইন। হাঁটু জড়িয়ে গোমড়া মুখো হয়েই বসে রইলো মৌসুমী। তবে তাকিয়ে আছে কি এনেছে, তা দেখতে। আজমাইন দুই মুঠ লাল রেশমি চুড়ি এবং আলতার কৌটা বের করলো। দেখা মাত্রই মুখের গোমড়া ভাবটা চলে গেছে তার। ঠোঁটের ধারে হাসিও উঁকি দিয়েছে। হাত বাড়িয়ে চুড়িগুলো নিতে নিতে লাজুক ভঙ্গিতে বললো,
“কত দিয়ে কিনছো?”
“তোর সেটা জানার কি দরকার? টাকা দিবি?”
“এহ!”
মৌসুমী চুড়িগুলো পরে নিতেই আজমাইন আলতার কৌটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এইটা দে হাতে পায়ে।”
“এখন না। কালকে দিবো।”
“এখনই দিবি।”
আলতার কৌটা খুলে আজমাইন হাঁটু ভেঙে মেঝেতে বসে পড়লো খাটের কাছে। অন্যহাতে একটু টেনে সামনে নিলো মৌসুমীর পা দুটো। মৌসুমীর চোখেমুখে বিস্ময়! তার বিস্ময়কে জয় করে আজমাইন আলতা পরিয়ে দিচ্ছে তাকে! দুষ্টুরাজার হাতের আলতার পরশে লজ্জারা এসে ঘিরে ধরলো নিমেষে। লজ্জায় খিলখিলিয়ে হেসেও উঠলো মৃদু স্বরে। আজমাইন নিজের ঠোঁটের কোণে হাসি রেখেও তাকে হাসতে দেখে বললো,
“ঘরসুন্দরী, হাসোছ ক্যা?”
জিজ্ঞাসার পরপরই হাসির শব্দ কমিয়ে নিলো সে। অতি ভালো লাগছে তার এখন। এইতো, কত ভালোবাসে তাকে তার এই দুষ্টুরাজা। আলতা নিয়েও এসেছে, আবার নিজ হাতেই পরিয়ে দিচ্ছে! এবার যে ইচ্ছে করছে বাবুর কথা জানিয়ে দিতে। কিন্তু লজ্জায় মরি মরি অস্থিরতা বিরাজ করছে তার মাঝে। তাই বলতে পারছে না মুখে। কি করে বলবে তাকে? আলতা পরানোর পুরোটা সময় জুড়েই প্রেমময় চোখে দেখেই গেলো দুষ্টুরাজাকে। বাড়িয়ে নিলো প্রেমের গভীরতা। এই প্রেমিক পুরুষকেই তো চেয়েছে সে৷ বেসেছে ভালো প্রকাশ ও গোপনে। আলতা রঙে পা রাঙানোর পরপরই রঙিন পায়ে ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দিলো আজমাইন। মনের অস্থিরতাটুকু যেন মুহুর্তেই সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে গেলো। শিহরণ জাগিয়ে তুললো প্রণয়ের জোয়ারে। মুখের হাসিটা স্থির নেই। হারিয়ে গেছে মৌনতায়। দৃষ্টি হয়েছে নত। লজ্জারা ঘিরে নিয়েছে লজ্জাবতীকে। পা দুটো টেনে নিয়েছে লজ্জা গুটিয়ে নিতে। অদ্ভুত প্রেম যে জমেছে ওই দুই চোখে! ঠোঁটের ধারে অস্পষ্টতরে ফুটেছে সে কি হাসি! দেখতেই পারছে না আর ঘরসুন্দরী! বুজে নিয়েছে তার লাজুক চোখ দুটি। তার প্রতিক্রিয়া দেখে মৃদু হেসেছে আজমাইন। হৃদয় গাঁথা অনুভূতিকে সুগভীর করতে প্রেমময় চোখে দেখে নিয়েছে লাজুক প্রেম প্রেয়সীকে।
[চলবে]