“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৩৬
(নূর নাফিসা)
.
.
আজমাইন এসেছে জেনে সকালেই রোজা এসে হাজির হয়েছে বাবার বাড়িতে। তার পরীক্ষা আছে আজ। এদিকে আজমাইনের সাথে আছে বিশেষ কথা। কিন্তু আজমাইন চলে যাবে জেনেছে। পরীক্ষা দিয়ে ফিরতে ফিরতে তাকে পাবে কি না অনিশ্চিত। তাই পরীক্ষার সময়ের আগেই সে হাজির হয়েছে এখানে। তাকে প্রথমে মৌসুমী দেখে উৎফুল্ল হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।
“আপু! তুমি আইছো! ইশ, বাড়িটা ভরো ভরো লাগতাছে।”
রোজা মুচকি হেসে বললো,
“হুম, এসেছি। চলে যাবো আবার। কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু চলে যাইবা ক্যা?”
“একটু কাজে এসেছি। পরীক্ষা আছে না? চলে যেতে হবে। আজমাইন কোথায়?”
“ঘুমায়।”
“এখনো ঘুমায়?”
“তোমার ভাইয়ের ঘুম এগারো, বারোটার আগে ভাঙে নাকি!”
“এখনো অভ্যাস রয়ে গেছে। মা কোথায়?”
“পুকুরে গেছিলো, কালীর পাতিল মাজতে। দাঁড়াও, ডাকতাছি।”
মৌসুমী নাচি নাচি পায়ে চলে গেলো পুকুরের দিকে। রোজা এগিয়ে গেলো আজমাইনের ঘরে। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তার ভাই। দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিয়ে রোজা ডাকলো আজমাইনকে। যেন চোখ খুলে তাকাতে পারছে না সে। তবুও সাড়া দিচ্ছে। রোজা তার ঘুম কাটাতে মাথা ধরে ঝাকালো। ঘুমঘুম কণ্ঠেই সে জিজ্ঞেস করলো,
“আপু ভালো আছো?”
“হ্যাঁ, আছি। উঠ তাড়াতাড়ি। জরুরী দরকার।”
আজমাইন আড়মোড়া ভেঙে লেপ সরিয়ে উঠে বসলো। চোখ ঝিমাচ্ছে এখনো। রোজা তার ভঙ্গির উপর কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে আবার ধাক্কা দিলো।
“এই ছেলে, ঘুম ভাঙে না তোর?”
“কি হইছে তোমার?”
“বললাম না জরুরী কথা। মনযোগ দিয়ে শোন।”
“বলো।”
“দেখতে হবে। ভালো করে চোখ খুল।”
আজমাইন দুহাতে চোখ ঢলে তাকিয়ে হাই তুলতে তুলতে রোজার দেওয়া চিঠির খামটা দেখলো। রোজা বললো,
“দ্যাখ তো। এই ঠিকানাটা চিনতে পারিস কি না? ঢাকার এলাকা। তোদের ঠিকানার কাছাকাছিই হবে।”
আজমাইন পড়ে পড়ে এলাকার নামটা ঠিক চিনতে পারছে না। তবে পোস্ট অফিসের ঠিকানাটা চিনে উঠতে পেরেছে।
“হ্যাঁ, আমরা যেখানে থাকি এর আশেপাশের এলাকাই।”
“একটু খোঁজ করতে পারবি? একজনের খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন।”
“মাহতাব ভাইকে বললেই তো হয়। ভাই আশেপাশের সবই চিনে।”
“না না, তাকে বলা যাবে না। সে যেন কোনোভাবেই না জানে। তোকে লুকিয়ে লুকিয়ে খোঁজ করতে হবে। খুবই জরুরি। সে কেন, কেউই যেন না জানে।”
“ক্যা?”
শুরু থেকে মোটামুটি সবটাই বললো রোজা। দাদাজান কেন লুকাতে চাইলো, এই ব্যাপারটা আজমাইনের কাছেও বিস্ময়কর লাগলো। এই বিস্ময় খুঁজে বের করতে আগ্রহী হলো। রোজার প্রথম সন্দেহটা যে মাহতাবের উপর পড়লো, এটা আজমাইনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে রইলো না। কেননা এমন কিছু কখনো মাহতাবের মাঝে সে দেখেনি এতোদিন থাকা স্বত্তেও। তবুও মনের ব্যাপার, বলা যায়না অনিশ্চিত থেকে। কিন্তু দাদাজানের ব্যাপারটা একটু ভাবনাজনক হয়ে রইলো। রোজাকে জিজ্ঞেস করলো, সে একবার দাদাজানের মুখে ফুটানোর চেষ্টা করে দেখবে কি না? জোরজবরদস্তিতে দাদাজানের রাগ হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাই নিষেধ করলো রোজা। তাকে গোপনে এই তথ্যটা খুঁজে বের করতে বলে দিলো। সে বিশেষ গুরুত্বের সাথেই নিলো ব্যাপারটা, যতটা গুরুত্বের সাথে নেওয়ার প্রত্যাশায় রোজা ছুটে এসেছে। ঠিকানাটা হাতে দিয়ে কথা শেষেই বেরিয়ে এলো রোজা। মায়ের সাথে দেখা হলো রান্নাঘরে। পুকুর থেকে পাতিল ধুয়ে এনে গুছিয়ে রাখছে হালিমা খাতুন। পেছন থেকে রোজা জিজ্ঞেস করলো,
“মা, আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছো?”
হালিমা খাতুন হাসিমুখে ফিরে তাকিয়ে সালামের জবাব দিলো।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। এইতো, মা। কই ছিলি এতোক্ষণ? মৌসুমী ঘরে ঘরে খুঁজে গেইটের বাইরেও দেখতে গেলো।”
“আমি তো আজমাইনের ঘরে ছিলাম। গেইটের বাইরেও চলে গেলো? এসেছি, দেখা না করেই চলে যাবো নাকি।”
“হঠাৎ কি মনে কইরা?”
“আজমাইন এসেছে শুনলাম গত রাতে। তাই দেখা করতে এলাম। আজই নাকি চলে যাবে?”
“হু। দুপুরের পরেই বের হইয়া যাইবো। বোরকা খুল। নাস্তা কর।”
“না, আমি নাস্তা করে এসেছি। পরীক্ষা আছে। ভাবলাম দেখা করে যাই আগে। দাদাজানের ওষুধ ঠিকঠাক দিচ্ছো তো?”
“হো, দেই। আরেক অসুখী হইছে তো ঘরে। বাচ্চা হইবো মৌসুমীর।”
মুহুর্তেই রোজার চেহারা বিস্ময় রূপ ধারণ করলো।
“বলো কি!”
“হো।”
রোজা ভারি আপত্তিকর সুর তুলে বললো,
“এই বয়সে বাচ্চা! একটু সতর্ক করবে না আগে থেকে! এজন্যই বিয়েটা এতো তাড়াতাড়ি না হওয়া উত্তম ছিলো। তোমাদের যত লাফালাফি! বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই তো ছিলো। এখন একটা সমস্যা বেঁধে গেলে কেমন হবে? না শরীর ঠিক আর না বয়স!”
“হইছে, চুপ থাক। কিছু হইবো না আল্লাহ ভালো রাখলে। এর চেয়ে কত ছোট থাকতে আগে বিয়ে হইতো। এখনো তো হয় আশেপাশে।”
“আশেপাশে সমস্যাও খুব হয় মা। আগেও হতো। অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে, বাচ্চা। এরপর মা, বাচ্চার সমস্যা হলেই বানোয়াট উক্তি ছড়ায় ভুতপ্রেতের নজর করেছে। আসল সমস্যাটা মানতে নারাজ।”
“থাক, এখন এইসব বলিছ না। ভয় লাগে। যা হওয়ার হইছে, কি আর করতাম এখন?”
আপত্তিনাশের দিকে ঢলে খানিক হতাশাজনকভাবে রোজা বললো,
“কি আর করবে। যত্ন নাও ভালো। পুষ্টিকর খাবার খেতে দিয়ো। খাওয়াদাওয়ার কারণে যদি শরীরে পরিপক্বতা আসে কিছু।”
“এই ক’দিন তো ভালোই খাইলো। গতকাল থেকে খেতেই চায় না।”
“না চাইলেও খাওয়াতে হবে। আল্লাহ তারই ভালো করবেন, যার প্রচেষ্টা থাকে। ভুখা থেকে শরীর সুস্থ থাকার প্রত্যাশা করা অযৌক্তিক। আমি আসি। যেতে যেতে আবার দেরি হয়ে যাবে। খেয়াল রেখো নিজেরও। আর মৌসুমীকে ছোটাছুটি করতে নিষেধ করো। সারাক্ষণই দৌড়াতে থাকে মেয়েটা।”
“হো, করি তো। সবসময়ই তো কই, দেখোছ না। কিছু কইল কতক্ষণ মানলে পরেই ভুইলা যায়। যা, সাবধানে যাইছ।”
রোজা যেন খুশি হতে পারলো না আগমনী বার্তায়। মৌসুমীর জন্য চোখেমুখে আরও দুশ্চিন্তা ছেপে উঠেছে তার। চিন্তিত মুখ নিয়েই গেইটের বাইরে গেলো। মৌসুমীকে তিড়িংতিড়িং হাটতে দেখতে পেলো এখানেই। বাড়িতেই আসছিলো।
“কই গেছো আপু তুমি? আমি খুঁজতাছি।”
“বাড়িতেই ছিলাম। তুই এমন ছোটাছুটি করছিস কেন? হাটাচলা নিয়ন্ত্রণ কর। এসময় এতো ছোটাছুটি করলে হয় না। বাড়ি যা।”
চিন্তিত গম্ভীরমুখেই পরামর্শ দিয়ে গেলো রোজা। মৌসুমী কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধ করলো রোজা জেনে ফেলেছে বলে। ধীরে ধীরে সবাই জেনে যাচ্ছে, আহা কি লজ্জা আর লজ্জা! এই লজ্জা নিয়েই সে বাড়িতে প্রবেশ করলো। আজমাইনকে দেখতে পেলো হাতমুখ ধুয়ে ঘরে যাচ্ছে। এই লোকটাই নাকি এখনো জানতে পারলো না শুধু। বড় মা-ও জানায়নি নিশ্চয়ই। না জানুক। সে-ও দেখুক, কিভাবে জানে! আজমাইনকে নাস্তা দিলো সে নিজেই। আজমাইন খাচ্ছে আর সে আলতা রাঙা পা দুটো সামনে রেখেই হাঁটু জড়িয়ে বসে আছে। খাওয়ার মাঝে তার দিকে লক্ষ্য করে আজমাইন বললো,
“আমার খাওয়ার দিকে নজর দেস ক্যা? খাইতে মন চাইলে খা।”
“উহুম। খেয়েছি।”
তার শুদ্ধ উচ্চারণে আজমাইন ব্যঙ্গ করে বললো,
“খেয়েছো? তবে আমার দিকে রাক্ষসী চোখে দেখছো কেন? চোখ সরা! মাঝ রাস্তায় আমার পেট ব্যাথা শুরু হইতো আবার!”
“এহ! আমি তোমার খাওয়ার দিকে নজর দিছি? আমি তো তোমার দিকে নজর দিছি।”
“আরও বেশি সর্বনাশ করছোস!”
নিচু স্বরে খিলখিলিয়ে হাসলো মৌসুমী। গ্লাস ধরতেই জগ থেকে সে পানি ঢেলে দিলো গ্লাসে। আজমাইন দুই ঢোক পানি পান করে আবার খাওয়ায় মনযোগ দিলো। মৌসুমী বললো,
“আজমাইন, যাওয়ার আগে আমাকে বাদাম কিনে দিয়ে যাইবা।”
নাম ডাকাতে তার দিকে এক পলক তাকিয়ে প্লেটে মনযোগ দিয়েই বাম হাতে আচমকা কান টেনে ধরলো আজমাইন। সরে যাওয়ার সময়টুকুও পেলো না মৌসুমী। তার হাত ধরে চেঁচাতে লাগলো,
“আল্লাহ! ওই ছাড়ো, ব্যাথা পাইতাছি। আমার কান ছিঁড়ে গেলো! ছাড়ো, নইলে বড় মার কাছে বিচার দিমু।”
“দে।”
“না, না। দিতাম না। ছাড়ো!”
এখন কাঁদানোর ইচ্ছে নেই তাই ছেড়ে দিলো আজমাইন। কান লাল হয়ে গেছে এইটুকুতেই। মৌসুমী নিজের কান চেপে ধরে বললো,
“হুহ্! যেই না চেহারা, নাম রাখছে পেয়ারা! তার নাম বললে একেবারে ক্ষয় হইয়া যায়! আমার নাম বলো ক্যা তবে? আজ থেকে আমারে আপু ডাকবা, আপু। নইলে আমিও তোমার কান টেনে ছিঁড়ে দিবো।”
আজমাইন মিচকে হেসে খেতে খেতে বললো,
“দে তো দেখি।”
এইটুকু সাহস এবং ইচ্ছা নিজের মধ্যে আদৌও জন্ম দেয়নি মৌসুমী। তাকে একটু আবেগে ডুবাতে আদুরী গলায় বললো,
“আমি তোমারে মায়া করলেই কি, তোমার একদম মায়া নাই আমার প্রতি। আমি ব্যাথা পাইলে তোমার মজা লাগে। কিন্তু তুমি ব্যাথা পাইলে এই মজা আমি একদম পাই না। উল্টা কষ্ট পাই।”
তার কথার প্রেক্ষিতে কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না আজমাইন। কোমড়ে লুঙ্গির পাড়ে গুঁজানো টাকা নিলো হাতে। মাদুরে টাকা রেখে এক হাতেই দুইটা একশো টাকার নোট পৃথক করলো। সাথে কিছু ভাংতি টাকা আছে। ভাংতিগুলো পুনরায় কোমড়ে গুঁজে নোট দুটো মৌসুমীর দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,
“নে।”
মৌসুমী খুশি হয়ে মাদুর থেকে ঝটপট টাকা হাতে নিয়ে নিলো। ভেবেছে, তার আদুরী গলায় কাজ হয়েছে। তাইতো বাদাম খাওয়ার আবদারে দুইশো টাকা দিয়ে দিলো! এতো টাকা দিয়ে তো সে কত বাদাম খেতে পারবে! ফেরিওয়ালা থেকে কিছু সাজুগুজুও কিনতে পারবে! খুশিতে আটখানা হয়ে টাকা নিয়ে বললো,
“এই টাকা দিয়ে বাদাম খাইতাম?”
“বাদাম খা, আর মাটির চাকা খা। তোর ব্যাপার। প্রথম দিন ঢাকা যাওয়ার সময় তোর মাটির ব্যাংক থেকে খোঁচায় খোঁচায় দুইশো টাকা বের করছিলাম রাতে। ওইটা ফেরত দিলাম।”
মৌসুমীর খুশির টুকরো যেন নিমেষেই মাটি হয়ে গেলো!
“হালার বেডা! এইজন্যই কই, ব্যাংকটা আমার পাতলা পাতলা লাগে ক্যা!”
সে টাকা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো এখান থেকে। রাগে গজগজ করছে শরীর! বকা দেওয়াতেও আজমাইন রাগ হলো না একদমই। বরং ঠোঁটের ধারে হাসি ফুটেছে। হাসি মুখেই খাওয়ার শেষ পর্যায়ে চুমুক দিয়েছে প্লেটের ঝোলে। প্লেটে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে প্লেট মাদুরেই রেখে গামছায় হাত ও মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলো নিজের এলাকার আলোবাতাস মাখাতে। এই আলোবাতাসে একটু ঘুরাফেরা না করলে ভালো লাগে না। মনেই হয় না, এসেছিলো যে আপন গাঁয়ের ধুলো উড়াতে!
“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৩৭
(নূর নাফিসা)
.
.
প্রহর গড়ালে আবারও যেতে হচ্ছে চলে। যাওয়ার আগে মৌসুমীকে বিশ টাকার বাদাম কিনে দিয়ে গেলো। অনেকগুলো বাদাম পাওয়া হলো মৌসুমীর। দুই টাকার বাদামই তো কিনে দিতে চাইতো না আগে। এখন বউয়ের প্রতি মায়া হয়েছে, বরের হাতে টাকা হয়েছে। দিবেই তো, দিবে না তবে? মৌসুমী খুশিই হয়েছে। এবারের যাত্রায় আর কোনো রাগারাগি কিংবা মনোমালিন্যতা নেই। যদিও পরিবারের সদস্যদের একটু মন খারাপ হয় দুরত্বের কারণে। তবে মন থেকে দোয়া উদিত হয় প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জনে। সেলিনা বেগমের আরও নানান পিঠা খাওয়ানোর সময় হলো না। আজমাইনের দেখা পেলো বিদায় নিয়ে যাওয়ার সময়। প্রথমে দাদাজানকে, পরে মায়ের কাছে বলে বের হওয়ার সময় চাচীর দেখা পেলো। চাচীকেও বললো,
“আসছি, চাচী মা।”
“হু, বাবা। সাবধানে যাও। আমরা আব্বা বইলা ডাক দিলে তো শুনো না। একদিকে ডাকলে, মুখ ফিরাইয়া আরেকদিকে দৌড় দেও। এইবার? এইবার দেখমু, দুদিন পরে আব্বা ডাকলে দৌড়াইয়া আইয়ো কি না।”
চাচীমার রসিকতায় আজমাইন মৃদু হেসে বেরিয়ে গেলো। হাতে বাদাম আছে কয়েকটা। খেতে খেতেই যাচ্ছে। তৎক্ষনাৎ মাথায় ধরলো না, চাচীমা কি বললো। হালিমা খাতুন গেইট পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে রইলো। মৌসুমীও উঠুন পর্যন্ত ছিলো। আজমাইন দূর রাস্তা পর্যন্ত উঠলেই গেইট ছাড়লো হালিমা খাতুন। ভ্যানের জন্য দাঁড়িয়ে থাকাকালীন আজমাইনের মাথায় একটু হোচট খেলো। চাচী মা কার কথা বললো? কে আব্বা বলে ডাকলে তাকে ছুটে আসত হবে? অদ্ভুত ব্যাপার তো! মৌসুমী কাল খাচ্ছিলো না কেন তবে? অসুখবিসুখ তো ছিলো না তার! কোন অসুখ বাঁধিয়েছে তবে? আকস্মিক ব্যাপারটা মাথায় আসতেই আবার দৌড়ে চললো বাড়ির দিকে। ব্যাগটা কাঁধেই চেপে আছে। ছুটে চলার মাঝেই হাতের অবশিষ্ট বাদাম দুটো খোসা ছাড়িয়ে মুখে পুরে দিলো। থামলো এসে গেইটের কাছে। মৌসুমী তখন বারান্দার মেঝেতে পা ঝুলিয়ে বসে। এখান থেকেই সে স্বাভাবিক গলায় ডাকলো,
“মৌ, এদিকে আয়।”
মৌসুমী তার দিকে তাকিয়ে দ্রুত উঠে এগিয়ে এলো। আবার ফিরে এলো কেন? কিছু নিতে ভুলে গেছে?
“আবার কি?”
আজমাইন তার জবাব দিলো না। মৌসুমী এগিয়ে কাছ পর্যন্ত গেলেই গলার স্বর তুলনামূলক কিছুটা নিচু করে শান্ত গলায়ই জিজ্ঞেস করলো,
“চাচী মা কি বললো?”
“কি বললো?”
“কে আব্বা ডাকবো?”
প্রশ্নের সাথে সাথে তার ঠোঁটের কোণে যেন এক টুকরো হাসির ঝিলিক ফুটতে লাগলো। চোখ জুড়ে জাগ্রত হতে লাগলো বিস্ময়। তার মুখের ওই হাসি জিজ্ঞাসার ইঙ্গিতকে যেন খুব সহজেই ধরিয়ে দিলো মৌসুমীকে। আজমাইন বুঝে গেছে তবে! সর্বনাশ! তার যে এখন কেমন কেমন লাগছে! ওই হাসির বিপরীতে মৌসুমীর ঠোঁটের ধারেও তথ্য লুকিয়ে যাওয়ার লাজুক হাসি ফুটলো। সে তো ঢের অপরাধী, তাই সাজা পাওয়ার লক্ষণ আন্দাজ করে নির্দিষ্ট স্থান থেকে পিছিয়ে যেতে লাগলো ধীর পায়ে। তার মুখও হাসে, চোখও হাসে। এই হাসির নিরবতাই নিশ্চিত প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দেয় আজমাইনকে। বাড়িয়ে দেয় চোখের বিস্ময়! কি জ্বলজ্বল করছে লোকটার আনন্দিত চোখ! মৌসুমীর পিছিয়ে যাওয়ার গতির সাথে তাল মিলিয়ে যেন আজমাইনের হাসির প্রশস্ততাও বেড়ে গেলো। কি প্রাণোবন্ত সেই হাসি! সে এগিয়ে এলো না। মুখভরা হাসিটা নিয়ে মৌসুমীর শাস্তি জমা রেখে জানিয়ে গেলো,
“তুই অপেক্ষা কর, আমি আবার আসছি।”
মুখ টিপে হাসলো মৌসুমী। ওই মুখের হাসিটা দেখেই যেন মন বলছে,
“আবার কেন? এখনই থেকে যাও না!”
গালভরা হাসি নিয়ে আজমাইন দুয়ার ছেড়ে কদমে কদম ফেলে হাঁটতে লাগলেই যেটুকু পিছিয়েছিলো মৌসুমী, তার চেয়েও বেশি এগিয়ে এসে দাঁড়ালো গেইটের বাইরে। তাকিয়ে রইলো অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত চোখ জুড়াতে। করতেই হয় আবার ফিরে আসার অপেক্ষা। অন্তর জমিনে যদিও হয় প্রতিনিয়তই দেখা! তবুও ভরে না মন, ভরে না চোখ। শুধুই বেড়ে যায় হৃদয়ের আকুলতা!
বসন্তের দিনগুলোও ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কোকিল কণ্ঠে বিমোহিত হওয়ার সুযোগ সারাবছর পাওয়া যায় না। অথচ এসেও হারিয়ে যাচ্ছে সুযোগ। দক্ষিণা দুয়ার সারাবছর খুলে না। বসন্তী হাওয়ায় বুক ভরে যায় না নিশ্বাসে নিশ্বাসে। বসন্তের ভাঁটফুলগুলোও যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এইতো সেদিন ফুটলো। এখনই তাদের রূপ ফুরিয়ে নেওয়ার তাড়া! হৃদয় সুগভীরে আবারও জাগায় পরবর্তী বসন্তের অপেক্ষা। পরীক্ষা শেষ হতেই রোজা এসেছে আবার বাড়িতে। আগেরদিন মৌসুমী গিয়েছিলো ফুপুর বাড়ি। একদিন কাটিয়ে পরবর্তী দিন রোজাকে সাথে নিয়েই ফিরেছে। তার অন্তঃসত্ত্বার বার্তা জেনে মরিয়মও ভীষণ খুশি। তার যেন আরও তাড়া পড়ে গেলো নাতিনাতনি কোলে পাওয়ার। কাটানো একদিনে ভারি সেবায় মত্ত হয়েছিলেন মৌসুমীর। ফুপুর যত্নশীলতা দেখে ভালো লাগলেও মৌসুমীকে নিয়ে রোজার মাথায় চিন্তা জমা। আরও দুশ্চিন্তা সেই আলোকে নিয়ে। সব দুশ্চিন্তারা যেন দলবেঁধে ভীড় করছে তার মাথার ভেতর এসে। আজমাইনকে তো ঠিকানা দিলো, সে কি খুঁজে বের করতে পারবে? মাহতাব জানতে পারলে তো ব্যাপারটা ভীষণ খারাপ হবে। তাকে কোনোরকম জিজ্ঞাসা কিংবা ইঙ্গিত না জানিয়ে সন্দেহের ঢেঁকি গেড়ে বসা ভারি দুঃসাহসিকতা। সন্দেহ যেমন তেমন, এর বাইরের উৎসসম্পৃক্ত ব্যাপার হলেও তো তার দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে গোপনে গোপনে আলোর সন্ধানে মনের ভেতর খুটখুট করছে ভীষণ। মনে হচ্ছে কোনো ঝড় আসতে চলেছে সামনে। তার সাজানো সংসারে যেন এর প্রভাব না পড়ে, সেই প্রার্থনা করে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। তবুও ভয়, ভয়ে ভয়ে সংশয়!
রবিবার ঢাকা এসে পরের দিন হতে কর্মস্থলে ব্যস্ত ছিলো আজমাইন। পরবর্তী বৃহস্পতিবার সকালে কাজের ফাঁকে সে পোস্ট অফিসে গেলো। খামটা দেখিয়ে পোস্ট অফিসের এক কর্মচারীর সাথে কথা বললো আলোর ব্যাপারে। এই কর্মচারীকে সে চিনে। প্রায়ই দেখা যায় আশেপাশে হাঁটতে চলতে গেলে। আবার মাহতাবের কাছে চিঠিও দিয়ে আসে মাঝে মাঝে। লোকটাও যেন তাকে দেখার ভিত্তিতে চিনতে পেরে আলোচনার সময় দিলো। প্রেরকের ঠিকানা দেখে তিনি একজন পুরুষ লোককে স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। ওই লোকটা মাঝে মাঝে আসে এখানে চিঠি দিতে। পাশের মহল্লায় থাকেন। কিন্তু ইনিই সেই লোকটা কি না, নিশ্চিত বলতে পারছেন না। যেহেতু আলো একটা মেয়ের নাম, কিন্তু এই ঠিকানা থেকে কোনো মেয়েকে আসতে দেখেছে বলে তিনি ঠিক মনে করতে পারছেন না। হতেও পারে আলো মেয়েটি ওই মধ্যবয়সী লোকটাকে দিয়ে পোস্ট অফিসে চিঠি পাঠায়। আজমাইন তাকে তালিকা খুঁজে দেখতে বললো। কিন্তু ওই মহল্লার আরেকজন যুবকের চিঠির ঠিকানা ছাড়া আর কোনো চিঠি বিলির ঠিকানাই তিনি পেলেন না খুঁজে। মহল্লার ওপাশটায় মূলত দরিদ্র লোকেদের ঘনবসতি। সেখান থেকে চিঠির মানুষ আসারও কথা না তেমন। কিন্তু ওই যুবক তো আলো নামে চিঠি পাঠায় না বললো কর্মচারী। তবুও প্রয়োজনে ওই যুবকের খোঁজও নিবে আজমাইন। আগে যেতে হবে মধ্যবয়সী লোকটার কাছেই। মহল্লার কোন গলির কোন পাশে লোকটার বসবাস, একটু বিস্তারিত জেনে নিলো আজমাইন। লোকটাকে কাল অবসর থাকলে সাথে যাওয়ার অনুরোধ করলো। একটু চিনিয়ে দিলেই হবে তাকে। তিনি নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না। যদি সময় হয়, তবে দেখিয়ে দিবেন। তবুও কাজের ফাঁকে যেটুকু তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছে তাকে, সে কৃতজ্ঞ। পোস্ট অফিস থেকে বের হতেই আরেক বিপদ! অফিসের প্রবেশ পথে মাহতাব এসে হাজির! মাত্রই এসেছে সে। আজমাইনকে এখানে দেখে একটু বিস্মিতই হলো। জিজ্ঞেস করলো,
“কাজে যাওনি?”
“না, যাইনি এখনো। যাবো।”
“এখানে কেন হঠাৎ? চিঠি পাঠাচ্ছো নাকি?”
“নাহ। প্রক্রিয়া জানতে এসেছি। যদি কখনো পাঠাতে হয়!”
মাহতাব মৃদু হেসে বললো,
“জেনেছো? নাহয় চলো, শিখিয়ে দেই।”
“না, না। জানা হইছে। তুমি এখানে কি কাজে?”
“এইতো, চিঠি নিয়েই এলাম।”
“ঠিক আছে। আমি গেলাম।”
যেতে যেতে মনে কিছুটা সংকোচ তৈরি হলো তার। মাহতাব ভাইয়ের সাথে তো লোকটার পরিচয় আছে। তিনি না আবার কিছু বলে দেয় তাকে এই খোঁজাখুঁজির ব্যাপারে! নিষেধ করে আসতেও তো মনে ছিলো না। আপু তো বললো, গোপনে খোঁজ করতে! মাহতাব ভাইও যেন না জানে!
চলবে।