সোনালী আলোর ঘ্রাণ পর্ব-৪৬+৪৭

0
442

“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৪৬
(নূর নাফিসা)
.
.
“এটা কি আলোদের ঘর? উনার সাথে একটু কথা বলার ছিলো।”
আজমাইনের জিজ্ঞাসায় লোকটা শান্ত গলায় জবাব দিলো,
“হ্যাঁ, আলোদের ঘর। ভেতরে এসো।”
ঘরের ভেতরে যেতে আজমাইন একটু ইতস্তত বোধ করলো। এতো সকালে কারো বাড়ি এসেছে। এইটুকু একটা ঘর। ভেতরে কে না কে আছে। তার কি যাওয়া উচিত হবে এভাবে? সে স্থির থেকেই ভাবতে লাগলো। লোকটা ভেতরে দুই পা এগিয়ে আবার পিছু ফিরে বললো,
“এসো।”
“আলো নামের উনি কি ঘরে আছেন?”
“জ্বি, আছে। এসো।”
আজমাইন ভেতরে প্রবেশ করলো। লোকটা ঘরের ছোট্ট জানালাটা খুলে দিলেন ঘরটা প্রাকৃতিক আলোতে আলোকিত হওয়ার জন্য। পরক্ষণে ঘুণপোকাতে খাওয়া একটা পুরনো কাঠের চেয়ার এগিয়ে হাতেই ঝেড়ে দিলেন বসার জন্য৷ মাটিতে পাটির উপর কাথাবালিশ ফেলে বিছানা পাতানো। পুরনো মশারীর মধ্যে বেশ কয়েক তালি লাগানো। মশারীর ভেতর থেকে চোখ কচলাতে কচলাতে আরেকটা লোক বের হতে দেখলো আজমাইন। বয়সে প্রথম দেখা লোকটার চেয়ে একটু বড় হবে। মুখের ভাষাও কেমন টানা টানা। বড় সড় হাই তুলে প্রথম দেখা লোককে জিজ্ঞেস করলো গোসল করতে যাবে কি না। তিনি এখন যাবেন না জানালেই বেশি বয়সের লোকটা কাঁধে গামছা ফেলে একা একাই বেরিয়ে গেলেন। এছাড়া ঘরে অতিরিক্ত কেউ নেই। তাহলে আলো কোথায়? উনি যে বললেন, ঘরে আছে! আজমাইনকে এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকটা বললো,
“বসো, বাবা। নাম কি তোমার?”
আজমাইন বসতে বসতে জবাব দিলো,
“আজমাইন।”
“আমজাদ ভাইয়ের ছেলে না তুমি?”
“জ্বি। কিন্তু আপনি চিনলেন কি করে?”
“চিনি বহু আগে থেকেই। কিন্তু জানতাম না তোমাকে। চেহারা দেখে অনুমান করলাম। কয়েকদিন আগে দেখে সন্দেহও করেছিলাম।”
“আপনি আমাকে দেখছেন? কিন্তু আমি আপনাকে দেখছি বলে তো মনে পড়ে না।”
লোকটা মৃদু হেসে বললো,
“আমি তো আড়াল থেকে দেখেছি। তুমি দেখবে কি করে?”
“আড়াল থেকে কি কারণে?”
“কারণ অনেক আছে রে বাবা।”
বলে ধীর নিশ্বাস ছাড়লেন। পাতানো বিছানার একপাশে বসলেন। পরপরই বললেন,
“বাড়ির সবাই কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“নতুন কাজে এসেছো, না?”
“জ্বি, কিন্তু আপনি আমাদের চিনেন কি করে?”
“সম্পর্কের টানে।”
“কেমন সম্পর্ক?”
“ঘরের লোক বললে কেমন মনে করবে?”
আজমাইনের যেন মাথায় ধরছে না। উনি ঘরের লোক হলে সে চিনবে না কেন তাকে? উনি ঠিকঠাক বলছেন তো? নাকি মাথায় গণ্ডগোল আছে? এতোসব ভাবনা আপাতত বাদ দিয়ে সে তার প্রয়োজনীয় কথায় এলো৷
“আলো কোথায়, বললেন না যে? আপনি যে বললেন ঘরে আছে। কাউকে তো দেখছি না ঘরে।”
লোকটা আবারও জবাব দেওয়ার আগে মৃদু হাসলেন। ঠিক হাসি নয়। ঠোঁট টানা দিয়ে যেন ব্যাথা নিংড়ে ফেললেন। বললেন,
“তুমি যে আলোর খোঁজে এসেছো, সে ঠিকই আছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই ঘরে আলোর অভাব রে খোকা। সেই যে ঝড়ের আঘাতে নিভে গেলো, এখন আর জ্বলে না আলো। বসে থাকে আঁধারের সঙ্গী হয়ে।”
আজমাইন ভাবুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো। সে ঠিক বুঝতে পারছে না তিনি কি বলছেন। কিন্তু কথার গভীরে রহস্য লুকিয়ে থাকার একটা ঘ্রাণ পাচ্ছে। তিনি কোনো ঘটনাকে ইঙ্গিত করছেন নিশ্চিত। পরিচয়টা প্রত্যক্ষ প্রকাশ করতে চাইছেন না। কিন্তু তার তো সেই পরিচয়টুকুই জানা দরকার। তাই অনুগ্রহপূর্বক বললো,
“আপনি কি আলোর পরিচয়টুকু দিবেন দয়া করে? বেশ কিছুদিন যাবত আমার বোনকে চিঠি পাঠায় সে৷ নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চায়। কেন যেন পারে না আবার। আপু আমাকে এখানে পাঠালো একটু খোঁজ করার জন্য। আমি আলোর সাথে দেখা করতে চাই। জানতে চাই, কে সে?”
লোকটা চোখেমুখে দৃঢ়তার প্রকাশ ঘটিয়ে উদাস ভঙ্গিতে বললো,
“আমি জানতাম, সেখান থেকে কেউ আসবে। কেউ আসবে আলোর খোঁজ নিতে। কিন্তু যার ডাকের প্রত্যাশায় ছিলাম, তিনিই আমায় স্মরণ করলেন কি না জানতে পারলাম না এখনো। আমি পাঠাতাম আফরোজার কাছে চিঠি। আমিই সেই আলো। নূর আলম। তোমার দাদাজান আমাকে আদর করে আলো নামে ডাকতেন তখন। সেই আলো আজ যেন তুচ্ছ ছাই কালো!”
আজমাইনের ধারণা ছিলো কোনো মেয়ে হবে হয়তো আলো। আপুর সন্দেহ তো এমন কিছুই প্রকাশ করেছিলো৷ তা নিয়ে কিছুটা বিস্মিত হলেও দাদাজানের কথা জেনে তার বিস্ময়ের রেশটুকু কেটে গেলো সাথে সাথেই। দাদাজান আদর করে ডাকতেন মানে দাদাজানের আপন কেউ তো হবেই। তিনি দাদাজানের ডাকের প্রত্যাশাই করছিলেন তবে? কথার মাঝে আজমাইন প্রশ্ন করে বসলো,
“আপনি আলো? দাদাজানের সাথে তবে আপনার কি সম্পর্ক?”
তিনি মন গহীনে লুকায়িত বেদনার পিঠে সামান্য হাসি ঢেলে বললেন,
“আমি তোমার দাদাজানের এতোটা প্রিয় এবং বিশ্বস্ত ব্যাক্তি যে, তোমার দাদাজান তার একমাত্র মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিতে পারেন।”
আজমাইন যেন শান্তরূপের স্তব্ধতা ধারণ করলো। তাকিয়েই রইলো শুধু লোকটার চেহারায়। মাহতাবের বাবার নাম যে নূর আলম, সেটা জানে সে। কিন্তু লোকটা নিজের নাম বলার পর একবারও মনে হয়নি মাহতাবের বাবার কথা। মনে হওয়ার কারণই বা কি হতে পারে? তিনি তো মৃত। নূর আলম তো কত লোকের নামই হতে পারে। কিন্তু মৃত ব্যক্তি জীবিত দাবি করতে পারে কিভাবে? ঠিক শুনছে তো? নাকি ভাগ্যের দোষে কোনো গোলযোগে পড়ে গেলো সে?
লোকটা তার চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি ভাবছো? মরে গিয়ে বেঁচে এলাম কিভাবে?”
লোকটার নিশ্বাসে তাচ্ছিল্যতা ভেসে এলো।
“আমি বেঁচে থেকেই মরে ছিলাম রে, বাবা। কি এক অসহনীয় জীবন রে বাবা। এতো বছর কাটিয়ে দিলাম ভিটে বাড়ি ছাড়া। মৃত সেজে রইলাম হয়ে পরিবার হারা৷ ছেলেকে চোখের সামনে দেখেও লজ্জায় দেখা দিতে পারি না। বলতে পারি না, আমি রে তোর বাবা। আমায় চিনেছিস খোকা?”
“কি বলছেন আপনি এসব?”
“আমার জীবনের ব্যাথা। জীবন থেকে চলে যাওয়া পুরনো পাতা।”
“কোথায় ছিলেন তবে এতোদিন আপনি? বাড়ি যাননি কেন?”
“পথে যে ছিটানো কাটা। দূরত্বে নামিয়েছে ফাঁদ। উপায় পেলাম না তো খোকা। সব দরজা বন্ধ রাখা।”
“মানে?”
“ভাগ্য আমার কারাগারে স্থগিত রে বাবা। এক কলঙ্ক বেঁধে নিয়েছিলাম গলায়। এইতো, তোমাদের মতো করেই কাজের জন্য শহরে ছুটে এসেছিলাম। ভালো উপার্জন করছিলাম। শহরের নামকরা কিছু মাস্তান ছিলো তখনও। এখন যেমন রাজত্ব করে বেড়ায়, দেখো না? এ সবসময়ই। তখনও পথে ঘাটে হুট করেই গণ্ডগোল বেঁধে যেতো। তাদের ক্ষমতার ঢলে ভাঙচুরে বিনষ্ট হয়ে যেতো আশপাশের মহল্লা। যত ক্ষয়ক্ষতি ঘটে যায় খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের পেটে। তেমনই এক ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলাম সেদিন। ঘটনাস্থলে খুনাখুনি হয়। কোন দিকে ছুটবো, রাস্তা পাচ্ছিলাম না খুঁজে। বিশিষ্ট নেতার হত্যাকাণ্ড ঘটলে যাকে পেয়েছে, খুনের দায়ে বন্দী করেছে আইন। প্রমাণস্বরূপ কেউ কেউ মুক্তি পেয়েছে, নিরীহ কেউ কেউ শাস্তি নিয়েছে মাথা পেতে। আমার জালটা অন্যভাবে পেতে গেছে।”
“কিভাবে?”
ভারি উৎসুকভাব আজমাইনের চেহারায়। এর আগে এমনটা তার হয়নি কখনো। কারো মুখে গল্প শোনার সময় তো দূর, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকেও যথারীতি এড়িয়ে গেছে। মনযোগ পেতেছে কেবল খেলার আড্ডায়। এই মুহুর্তের গল্পটা যেন হঠাৎ হৃদয় থেকে ঝেকে ধরলো গভীরতা জানার জন্য। যাকে ছোটকাল থেকে মৃত জেনে এসেছে, আকস্মিক তার দেখা পাওয়া এবং একই পরিচয় দাবি করা লোককে তো এড়িয়ে যাওয়া যায় না কোনোভাবেই। তা-ও অকল্পনীয় ঘটনা যখন তাদেরই পরিবারের সদস্যের! তার জিজ্ঞাসায় নূর আলম বললেন,
“বিপক্ষ দলের কারো নাম ছিলো নূর আলম৷ আর পুলিশের হাতে আটক হওয়া আমি নুর আলম। এক নুর আলমকে বাঁচাতে অন্যকে মেরে ফেলা হলো৷ এক পরিবারকে শান্ত করতে আরেক পরিবারে শোক নামিয়ে দিলো। সবই ক্ষমতায়ন। সময় নিয়ে সবারই স্বজন আসে ছুটে, আমার কেউ আসে না। শহরে আমার কেউই নেই। গ্রামে খবরও পাঠাতে পারছিলাম না। খবর না পেয়ে আসবেই বা কে? দিনের পর দিন যাচ্ছে, চিঠির আদানপ্রদান হচ্ছে না। গ্রাম থেকে চিঠি এলে গ্রহণ করছে না কেউ, প্রত্যুত্তর হচ্ছে না চিঠির। সন্দেহপূর্বক তোমার দাদাজান ছুটে এলেন। আমার ঠিকানায় এসে খোঁজ করলেন। জানলেন, আমি হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে গেছি। ভাগ্যক্রমে আদালতের রায় ঘোষণার আগের দিন তিনি আমার সাথে দেখা করতে এলেন। আমার খুব খুশি লেগেছিলো সেদিন। এতোটা উৎফুল্ল হয়ে গিয়েছিলাম না কারাগারের ভেতরে! মনে হচ্ছিলো, সেই ছোট্ট আমি মেলায় বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে গেছি জনমানুষের ভীড়ে। এরপর হঠাৎ করেই দেখা পেয়েছি পরিবারের। ভীত প্রাণটা খুশির ঢলে নেচে উঠছিলো। এইতো সময়ের আগে আমার পরিবার এসেছে আমার সম্মুখে। আমার বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে বুঝি। কেউ তো আমার সন্ধান পেলো। কিন্তু সন্ধানের ফলাফল সন্ধ্যার আন্ধার হয়ে নেমে এলো…

“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৪৭
(নূর নাফিসা)
.
.
“আমার বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে বুঝি। কেউ তো আমার সন্ধান পেলো। কিন্তু সন্ধানের ফলাফল সন্ধ্যার আন্ধার হয়ে নেমে এলো। তিনি আমায় দেখলেন। ঘটনা আমার মুখেও শুনলেন পুনরায়। ভারি চিন্তিত হয়ে উঠলেন তিনি। ব্যাপারটা আসলেই খুব চিন্তার। উনার মুখখানা দেখে আমিই উল্টো সান্ত্বনা প্রদান করতে লাগলাম, কয়েকটি নেতার নাম বললাম। কিছু আইনী লোকের কথাও বললাম। তারা পারে মামলা থেকে নাম কাটিয়ে দিতে৷ কারাবন্দী অবস্থায় দেখেছি বিশেষ ব্যক্তিবর্গের আত্মীয়স্বজন যারা আটক হয়েছে, এভাবেই তাদের কাছে আবেদন করে সন্দেহের দায় থেকে মুক্তি নিতে পেরেছে। সেখানে আমার প্রাণপ্রিয় শ্বশুর আব্বা তো মুক্তিযোদ্ধা। আমি উনাকে বললাম, আপনি তাদের কাছে গেলে, মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিলে বিশেষ গুরুত্ব দিবে আপনার বিষয়াদি নিয়ে। তিনি হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। চিন্তিত ভঙ্গিতেই চুপ করে ফিরে এলেন। আমি তবুও আশাহত হইনি। ভেবেছি তিনি মনে মনে ভাবছেন, কোনো ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করছেন। সে রাতে আমার ঘুম হলো না। মনে হচ্ছিলো তিনি আবার আসবেন৷ একটা খবর দিবেন, কয়েকজনের সাথে কথা বলেছেন। কেউ কেউ রাজি হয়েছেন। কারো সাথে এখনো কথা বলার চেষ্টা করছেন। এমন কিছুই এসে শুনাবেন আমাকে। কিন্তু তিনি এলেন না। রাত ফুরিয়ে গেলো নির্ঘুম চোখে। তবুও দ্বিতীয়বার উনার দেখা পাওয়া হলো না। যখন আদালতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বের করা হচ্ছিলো, মনের ভয় বড্ড বাড়ছিলো রে বাবা। তুমি বুঝবে কি না জানি না। আমার শ্বাস আটকে যাচ্ছিলো। তবুও মন বলছিলো আদালত পর্যন্ত যেতে যেতে কোনো চমক হাজির হবে আমার জন্য। আমি আদালত থেকেই আবার মুক্তি নিয়ে ফিরবো। ঠিক ওই মুহুর্তে চমক ঠিকই এলো। আমার ভয় কেড়ে নিলো। মুক্তি নয়, আমাকে স্তব্ধ করে দিলো এক টুকরো কাগজ। শ্বশুর আব্বা নিজে আসতে পারেনি। এক টুকরো কাগজ পাঠিয়ে দিয়েছেন।”
কথা থামিয়ে নূর আলম হাত বাড়ালেন বিছানার পাশেই বেড়ার দিকে। বাঁশের চিপে গেঁথে রাখা মলিন একটা ছোট্ট কাপড়ের ব্যাগ নামালেন। ব্যাগ থেকে পুরনো একটা কাগজের টুকরোর ভাজ খুলে আজমাইনের সামনে ধরলেন। গম্ভীরমুখে বিস্ময় বহাল রেখে আজমাইন কাগজটা পড়তে লাগলো মনে মনে। ওদিকে নূর আলমও বলতে লাগলো মুখুস্ত পাঠের মতো। হ্যাঁ, মুখুস্তই। খুব মুখুস্ত করে রেখেছেন বাক্যের পর বাক্য।
“আমি জানি না তুমি কি ভাবছো, আলো। কিন্তু আমি উপায় পেলাম না। কারো ধারে ধারে ঘুরে আমার অর্জনটুকুর বিসর্জন দিতে পারলাম না। তোমার খুনের দায়ের আঁচড় যদি আমার মুক্তিযোদ্ধা খেতাবে পড়ে, এই মুক্তিযোদ্ধা হয়ে আমি বাঁচতে পারবো না। এই যোদ্ধার পিঠে সম্মানটুকু আমার আর পাওয়া হবে না। পেলেও আনন্দ দিবে না। তারা জানবে, হাসবে আমার খেতাব নিয়ে। আমি দেশ বাঁচাই, আমার জামাতা দেশের নাগরিক হত্যা করে! শহর ছেড়ে এই বার্তা গ্রামগঞ্জের বাতাসেও মিশবে। প্রত্যেকটা সুপারিশ পত্রিকায় ছাপা হবে, পুরো দেশ জানবে। তোমার আমার গ্রামও জানবে। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যে কারোই জানা হবে না। কেউই জানতে আগ্রহী হবে না। যথারীতি সম্মানহানিটুকু ঠিক করে যাবে। তোমার মুখে দেখা গতকালের হাসিটার কথা আমি কখনো ভুলবো না। ভেতরে ভেতরে ঠিক ব্যথিত হয়ে থাকবো, তোমার আনন্দকে মুক্তি করতে পারলাম না। কিন্তু এ যে বড় সত্য, এক যোদ্ধা খেতাবে কলঙ্কের ছাপ ফেলতে আমি ইচ্ছুক না। তার আগে আমার মরণ হোক। আমি চাই না তোমার কারাবন্দীর খবর কেউ জানুক। তোমার কিংবা তোমার বউ বাচ্চার উপর হাসুক যে তুমি জেল খেটে ফিরেছো! কোনো মুক্তিযোদ্ধার উপর হাসুক, তার জামাতা জেল খেটে ফিরেছে! পরিবার নিয়ে চিন্তা করো না। আমি বেঁচে থাকতে অভাব শব্দের সাথে পরিচিত হতে হবে না তোমার স্ত্রী সন্তানকে। বাড়ি ফিরে যাচ্ছি আমি। সম্ভব মোতাবেক ভালো থেকো।”
কাগজের লেখা পড়ার পরপর নূর আলমের মুখে তাকালো আজমাইন। নূর আলম চোখ মুছে গেলেন কথার ফাঁকে। বিরতিহীন বললেন,
“তারপর সেদিন আদালতের রায় হলো আমার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের। বিপক্ষে লড়ার কেউই রইলো না। কারো নিকট কোনো সুপারিশও জমা হলো না। তোমার দাদাজান আবার এলেন মাস ছয়েক পরে। আমি উনাকে সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করলাম মন থেকেই। কিন্তু চেয়েও কেন জানি হাসতে পারলাম না। উনার সম্মুখীন হওয়া বরাবরের উৎফুল্লতাটা ধরে রাখার খুব চেষ্টা করেছিলাম৷ আমি আজও সফল হলাম না এই যাত্রায়। সেই হাসি আমার প্রাণে আর জাগলো না। বুঝলাম, হাসিটা মারা গেছে। দেহটা বেঁচে আছে। আব্বা এলেন, কারো কাছে সুপারিশ না করার প্রেক্ষিতে ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু আমি তো উনাকে মোটেও দায় করে রাখিনি। উনি বীর। উনাকে আমি কিসের ক্ষমা করবো? আমার কাছে তো উনার সম্মান প্রাপ্য। তারপর এই চিঠির কথাগুলোই আবার আমাকে সামনে থেকে বুঝালেন। এ-ও জানালেন, তিনি আমার আদালতের রায় জেনেছেন। আর তা জেনেই শহরে সড়ক দুর্ঘটনায় আমাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছেন। আমার কোনোরকম ব্যাথা অনুভব হয়নি। যাবজ্জীবন কারাবন্দী থাকার রায়টা যেন মৃত শব্দের চেয়েও বিষাদ ছিলো আমার জীবনে। তাই একটুও ব্যাথা অনুভব করলাম না নিজেকে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়ও মৃত জেনে। যেটুকু ব্যাথা পাওয়ার, দণ্ডিত রায়েই পাওয়া হয়ে গেছে। সেখানে আমি থাকা আর না থাকাই বা কি? মৃত জেনেও আমার পরিবারের থেকে এক বাক্স দোয়া উঠে আসবে। দেহের মরণকালে এই দোয়ার বাক্সটা তো যাবে অন্তত আমার সাথে। আমি খুব শান্ত রইলাম। তোমার দাদাজান প্রায়ই দেখা করতে আসতেন বছরে একবার কিংবা দুইবার। তিনি বাড়ির খবর দিতেন, আমিও সবার খবর নিতাম। একদমই নারাজ হইনি উনার উপর। দোষ তো আমার ভাগ্যের। কষ্টটা হতো একটা জায়গায়ই। আগের মতো সম্মানটুকু যে প্রদর্শিত হয় না আমার দ্বারা। যখন শুনতাম, তারা ভালো আছে, সুখে আছে। শুনে শুনেই শান্তি পেতাম। তাদের সুখে অসুখী হয়ে দাঁড়ানোর সাধ মনে একদমই জাগাতাম না। এভাবে কেটে গেলো আমার বিশ বছর। এই বিশটা বছর আমার মাহতাবকে আমি এইটুকুই ভেবে এসেছি, কল্পনায় কত খেলা করেছি ওই বিশ বছর আগে যেমন করতাম ঠিক তেমনই। একটাবারও ভাবিনি ছেলেটা আমার বড় হয়েছে। তোমার দাদাজান এসে যখন তার বড় হওয়ার গল্প শুনাতেন, বিস্ময় নিয়ে শুনতাম। গল্প শেষে আবার আগের ভাবনায় ফিরে যেতাম। আমার ছেলে ওইটুকুই। এইটুকু বাচ্চার কিসের এতো দায়িত্ব? সে তো মাঠে ছুটে খেলা করবে আর সন্ধ্যা হলে বইয়ে মুখ গুজে ছড়া পড়বে। বছর দুয়েক হয় নতুন স্কুলে ভর্তি করে এলাম যে। কি আগ্রহ নিয়ে ছেলে আমার স্কুলে যায়। নতুন বই বছর শেষেও নতুনত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে। অথচ ওই বয়সের ছেলেপুলেরা দেখতাম বই ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে। আমার মাহতাব কত যত্নে তুলে রাখতো তার বই খাতাপত্র।”
এতোক্ষণ মনযোগে তো শুনছিলোই বসে বসে, শেষ কথাগুলো যেন হঠাৎ বুকের মধ্যে ধুকপুক আওয়াজ তুলতে শুরু করলো আজমাইনের। হঠাৎ কেন এমন হচ্ছে, তার সংজ্ঞা জানা নেই তার। কিন্তু অনুভূতিটুকু স্পষ্ট। এইটুকু ধারণা করে নিয়েছে যে, কথাগুলো তার হৃদয়ে নাড়া ফেলছে। তবে সামনে বসা এই লোকটার কেমন লেগেছে বা লাগছে? অকল্পনীয়!
নূর আলম এতোক্ষণ মেঝেতে স্থির তাকিয়ে কথাগুলো বললেন। অতি অল্প সময়ের জন্য থেমে আজমাইনের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন,
“তোমাকে এইটুকু দেখে এসেছিলাম। কোলের শিশু। আফরোজা ছোট্ট হাতে কাচের চুরি পরে চুলের ঝুটিতে লাল ফিতা বেঁধে সারা বাড়ি দৌড়াতো তখন। মাঝে মাঝে ফিতা ধরে খুব বলতাম তো, লাল টুকটুক বউ করে বাড়ি নিয়ে যাবো। তোমার মা, দাদীজান শুনে হাসতো। বিশ বছর পর কারামুক্তি পেয়ে খোঁজ নিয়ে শুনলাম আমাদের ছেলেমেয়েদের সংসার গড়ছে। আব্বা নিজে সব বন্দোবস্ত করছে। শুনে খুব খুশি লাগলো। এধার ওধার মাহতাবের অফিসের কত লোকের কাছে ছুটতাম একটু খোঁজ নেওয়ার জন্য। পেলেই ভালো লাগতো। মোয়াজ্জেম ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। খুব দুষ্ট নাকি সব। আব্বার কাছে অল্প অল্প গল্প শুনতাম। ছোট্ট মেয়েটা হলো না? তার কিছুদিন পর যে তোমার দাদাজান শেষ দেখা করে গেলেন, আর দেখা হলো না। মনের সন্দেহ হলো শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে গেছে হয়তো। তাই পাচ্ছি না দেখা। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, ঠিক তা-ই। মনটা চায়, আবার ছুটে যাই। সবার সাথে দেখা করি, সুখ দুখের কথা বলে মনটাকে হালকা করি। কলঙ্কের দাগ পড়ার ভয়ে ইচ্ছে মরে যায়। সময় সুযোগে খুব যাই ছেলেটার কর্মস্থলে, আড়ালে থেকে এক পলক দেখে আসি। কি ব্যাথা যে পাই ওই সময়টাতে। তুমি বাবার অভিজ্ঞতা পেলে হয়তো কিছুটা বুঝতে পারতে আমার ব্যাথাটার যন্ত্রণা কিরূপ হতে পারে। ছেলেকে দেখতে গিয়ে তোমার দেখাও সেখানে পেলাম।”
বড়সড় নিশ্বাস ফেললেন নূর আলম। আজমাইনের মনযোগেই যেন তিনি গল্প করতে উৎসাহ পেয়েছেন। বুঝদার লোক থাকলে হয়তো আরও নিদারুণভাবে গল্প করতেন। গল্পের সমাপন করতে তিনি বললেন,
“বলতে বলতে কত গল্পই করলাম তোমার সাথে। তোমার বুঝার বয়স হয়নি, তবুও কত আলাপ সেরে ফেললাম তোমার সাথেই। কেন বললাম, জানো? ওইযে, বাড়ি গেলেই আফরোজা তোমায় জবাব দিতে বলবে। তাকে জানিয়ো, ওই লাল টুকটুক রাঙার চেহারা আমার এখনো মনে আছে। তোমার আব্বা তো দেশের বাইরে আছেন এখন। তাই না?”
“জ্বি।”
“তোমার ফুপুর ওবাড়ি আসাযাওয়া হয় নিয়মিত?”
“জ্বি।”
“তোমার দাদাজান কেমন আছেন? চিকিৎসা নিচ্ছেন ঠিকঠাক?”
“দাদাজানের অবস্থা তো ভালো নেই। অনেক বেশিই খারাপ।”
কিছুটা চমকে উঠলো নূর আলমের চেহারা।
“কেন? চিকিৎসা হচ্ছে না ভালো?”
পাল্টা প্রশ্নে আজমাইন কেমন একটা চিরন্তন বাক্য জুড়ে দিলো হঠাৎ।
“চিকিৎসা কি মৃত্যু দমিয়ে রাখতে পারে?”
পরপরই বললো,
“দাদাজান গত সপ্তাহে পড়ে গিয়েছিলেন হঠাৎ। ডাক্তার জানালো স্ট্রোকে প্যারালাইজড হয়ে গেছেন। এখন বিছানায় লেপ্টে পড়ে। কথা বলতে পারে না। ডাকলে সাড়া দেয় চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। ইশারায় অনেক কিছুই বলার চেষ্টা করে। সবটা বুঝাতে সক্ষম হয় না।”
নূর আলমের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। যে মানুষটা গোটা পরিবারকে শক্ত মুঠোয় আগলে রেখেছিলেন, সে নাকি আজ বিছানায় লুটিয়ে। তবে তো খুবই খারাপ অবস্থা। এমনিতেই মনের আনচান, বাড়ি ফেরার। আবার ফেরা হয় না নিয়ে লজ্জা, কলঙ্কের ছায়া তো সে ফেলবে না ওবাড়ি। এখন আবারও যেন মনটা উতলা হলো আহমদ আলীকে একবার দেখার। ছেলেকে তো ব্যস্ত শহরে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে আসতে পেরেছে। সেখানে কি আর উঁকি দিয়ে ফেরা যাবে?
আলোর পরিচয় জানা হয়ে গেছে আজমাইনের। পরিণতিও ভালো জানা হলো। এবার উঠতে হবে তাকে। কথা শেষে একটু থেমে উঠে যাওয়ার আগে আবার জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কি আর কখনোই যাবেন না গ্রামে? জানাবেন না আপনি আছেন এখনো?”
মনে ইচ্ছে থাকায় যেন মুখ থেকে ‘না’ শব্দটা বের হতে চায় না। আহমদ আলীর প্রিয় আলো নিশ্বাসে ব্যাথা নিংড়ে সামান্য মাথা নাড়লেন, তিনি যাবেন না। আজমাইন যেন মুখভঙ্গিতেই মনের ব্যাথাটুকু আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। মলিন মুখেই উঠে বিদায় নিলো,
“ফুপা, আমি আসি তবে।”
একটা সম্বোধন যেন বুকে লাগলো তার। কত দিন হয়, পরিবারের লোকদের কারো মুখের সম্বোধন শুনে না! নূর আলম শুকনো মুখে প্রস্তাব করলো,
“দোকানে চলো। চা, রুটি নাস্তা করো?”
আজমাইন নিশ্চুপ মাথা নেড়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলো। কাগজটা তার হাতের মুঠোয় আছে। ওই যে, আহমদ আলীর দেওয়া সেই পুরনো চিঠিটা আলোর হাতে পৌঁছাতে সপে দিয়েছেন। আর যত্নে তুলে রাখবেন না তিনি এই চিঠি। মেয়েটা পরিচয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলো। এটা এখন লাল টুকটুক রাঙার হাতেই সংরক্ষিত থাকুক।
চিন্তিত বেশে বাইরে বেরিয়ে সামনে হাটতেই একই রাস্তায় কিঞ্চিৎ দূরে একটা পাথুরে মানবকে ধীর পায়ে হেঁটে যেতে দেখা গেলো। আজমাইন ক্ষণিকের জন্য থেমে গেলো। ভারি বিস্ময় আর ভয় চেপে গেছে। বুকের ভেতরের ব্যাথাটা যেন আরও একবার উপলব্ধি হতে শুরু করলো। এ কাকে দেখলো! মাহতাবও এসেছে! শুনেছে সব? তার আসাটা আর গোপনে গোপনে হলো না তবে? কি ধীর পায়ে অসহায় ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে মানুষটা! যেন একটা ঝড় এসে তার শক্তি কেড়ে নিয়েছে। ভেঙে দিয়েছে পাকাপোক্ত দেহটাকে! পেছন থেকে দেখেই যেন বুঝতে পারছে আজমাইন, হাঁটার গতি ঠিক নেই। মাহতাব মোটেও ঠিক নেই। সে আজ বড় ব্যথিত।

চলবে।