স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা পর্ব-১৩

0
49

#স্বপ্নে_দেখা_রাজকন্যা
#১৩তম_পর্ব

“একটু শোনো” বলার অবকাশ পেলো না জাওয়াদ। তার পূর্বেই চেতনা হারালো। যখন চোখ মেললো, নিজেকে আবিষ্কার করলো হাসপাতালের বিছানায়। আর প্রথম যে মুখখানা দেখলো সেটা হলো চিংকির, গোলগাল, শ্যামলা, স্নিগ্ধ সেই মুখ। মুখখানার দিকে অবলীলায় তাকিয়ে রইলো জাওয়াদ। তার চোখের দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত। চোখের কোন ভেজা। ঠোঁট বিরবির করছে বটে তবে সেই স্বর কান অবধি আসছে না। দীপশিখা উৎকন্ঠিত স্বরে শুধালো,
“আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?”

জাওয়াদ কিছু বলার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। তার শরীর নিস্তেজ লাগছে। তার ঘুম পাচ্ছে। তাকে কি ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে? হতে পারে। তাইতো চোখের পাতা শুধু বুজে আসছে। আচ্ছা, চোখ বুঝলে কি চিংকি হারিয়ে যাবে? সে কি আর দেখা দিবে না? ভাবতে পারছে না জাওয়াদ। খুব কষ্ট হচ্ছে। তাই চিংকির হাতটা সে চেপে ধরলো। হাত ধরলে সে যেতে পারবে না। চিংকির হাতটা বুকের কাছে চেপে ধরেই দ্বিতীয়বারের মত জ্ঞান হারালো সে।

জাওয়াদের জ্ঞান ফিরলো দুপুরের সময়। সূর্যের তাপ তখন মিইয়ে এসেছে। আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে দূর মসজিদ থেকে। নার্সের ক্যাচক্যাচে তীক্ষ্ণ স্বর কানে আসছে। শরীরে এক শিহরণ অনুভূত হচ্ছে। ডান হাতে চিনচিনে ব্যাথা। ঘামে জবজবে হয়ে গেছে শুভ্র দেহ। চোখ মেলতেই দেখলো তার হাতে একটি নরম তুলতুলে হাত। দূর্বল চোখে পাশে তাকাতেই ক্ষীণ ধাক্কা লাগলো। মস্তিষ্ক এখন সতেজ, ফুরফুরে। ঝাপসা স্মৃতি এখন পরিষ্কার। অস্পষ্ট শ্লেষ্মাজড়িত স্বরে বলে উঠলো,
“তুমি?”

দীপশিখা চমকে উঠলো। নার্সের দৃষ্টি আকর্ষিত হলো। তীক্ষ্ণ, সরু স্বরে বললো,
“রোগী উঠে গেছে? আমি স্যারকে জানিয়ে আসছি”

জাওয়াদ বেশ অবাক হলো। সে হাসপাতালে! সত্যি সত্যি হাসপাতালে। কিন্তু চিংকি এখানে কি করছে। দীপশিখা আস্তে করে তার হাত ছাড়িয়ে নিলো। কপালে শীতল হাত ছোঁয়ালো। খুব নরম স্বরে বলল,
“জ্বর কমলো অবশেষে”

জাওয়াদ বোকার মতো চেয়ে রয়েছে। তার কি হয়েছিলো? সে হাসপাতালে কেন? চিংকি বা এখানে কেন? কিছু শুধাবার পূর্বেই পাভেলের গদগদ স্বর কানে এলো,
“ওরে দোস্ত, বাঁইচ্চা আছোস তাইলে?”

পাভেলের স্বর কানে আসতেই আশপাশ তাকালো সে। ঘর ভর্তি মানুষ। বাবা, জ্যোতি, বড়মামা, পাভেল, তরঙ্গিনী আপু আর চিংকি। আর কাউকে কি আনা বাকি আছে? মনে হচ্ছে প্রতিবেশীদের ফোন করার সময় পায় নি, নয়তো তাদেরও দেখা যেত। কেবিন বেশ বড়সড়। দুটো বিছানা। মাঝে বেশ জায়গা। ফ্রিজ আছে ছোট। রোগীর বিছানার সাথে একটি টেবিল যেখানে জড়ো করে রাখা ঔষধের প্যাকেট। এর মধ্যে আব্দুল হামিদ সাহেব রাশভারী স্বরে বলে উঠলেন,
“এখন শরীর কেমন তোমার?”
“জি আব্বা ভালো”

ভাঙ্গা স্বরে উত্তর দিলো জাওয়াদ। তিনি তবুও আশ্বস্ত হতে পারছেন না। এতো তাগড়া ছেলের কাপুনি দিয়ে জ্বর আসা আর বেহুশ হওয়া দেখে তিনি বেশ ঘাবড়ে গেছেন। ফলে অপ্রসন্ন স্বরে বললো,
“তোমাকে বারবার বলি মশারী টাঙ্গিয়ে ঘুমাও। মশার যা উপদ্রব। কিন্তু তুমি মোটেই শুনো না। এখন দোয়া কর যেন ডেঙ্গু না হয়। বংশে তুমিই প্রথম যে জ্বরের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছো। একটা সময় জ্বর কি জিনিস আমরা জানতাম-ই না। কখন আসতো, যেত বুঝতেই পারতাম না। অথচ তোমাদের জেনারেশন! শুধু জিমে বডি বানাতে পারো কিন্তু ইমিউনিটির ইও নেই। এক মশার কামড়ে কাইত”

বাবার এমন বাক্যে বেশ লজ্জা পেলো জাওয়াদ। ছ ফুট লম্বা তাগড়া যুবক জ্বরে এমন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে ব্যপারটা খুব লজ্জাজনক লাগছে তার কাছে। এর মাঝে বড় মামাকে খুব দুশ্চিন্তিত ঠেকলো। তার ধারণা জাওয়াদের টাইফয়েড বা ডেঙ্গু হয়েছে। করোনাও হতে পারে। এখন যদিও করোনার খুব বেশি শক্তি নেই। তবুও তিনি মাস্ক পড়ে বসে আছে। একটু পর পর স্যানিটাইজার দিয়ে হাত মুছছেন। ডাক্তার এলো কিছুক্ষণ বাদে। জাওয়াদের স্যালাইন শেষ হয়েছে। ডাক্তার তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“এখন কেমন লাগছে?”
“জি ভালো? শুধু গলা শুকিয়ে আসছে”
“জ্বর ছাড়ছে সেকারনে এমন লাগছে। আপনার এখন জ্বর নেই। টেমপারেচার নরমাল। তবে জ্বর আবার আসতেও পারে। কিছু টেস্ট করতে দিয়েছি। সেগুলোর রিপোর্ট আসতে দুদিন সময় লাগছে। আপনার কি শ্বাসকষ্ট আছে?”
“জি না। হালকা গলা ব্যাথা”
“পেট খারাপ?”
“বুঝতে পারছি না”
“আচ্ছা”

বলেই ডাক্তার কাগজে কিছু ঘষাঘষি করে চলে গেলো। চিংকি তখনও জাওয়াদের পাশে দাঁড়ানো। তার বেশ বিব্রতবোধ হচ্ছে। তার ধারণা এই জ্বর তার জন্য। পরশুদিন ওমন ঠান্ডায় জাওয়াদ বের না হলে এমন হতো না। জাওয়াদ উঠে বসলো। সংকুচিত স্বরে বললো,
“আমার কি হয়েছিলো?”
“মৃগী বেড়াম”

জ্যোতি ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিলো। জাওয়াদ অবাক স্বরে শুধালো,
“কিহ?”
“ভোরে তোর ঘর থেকে ফোনের শব্দ পাচ্ছিলাম। আমি যেয়ে দেখি তোর ফোন বাজছে অথচ তুই কাঁপছিস। গায়ে হাত দিয়ে দেখি জ্বর। ডাকছি সাড়া দিচ্ছিস না। ভয় পেয়ে গেছিলাম। বাবা বললেন, জুতো শুকাতে। লাভ হলো না। ভয়ে তো আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। ভাগ্যিস পাভেল ভাইকে ফোন দিলাম। সে তাড়াতাড়ি ছুটে এলো। তারপর তোকে এখানে নিয়ে এসেছি। দীপশিখা আপু তোকে ফোন করছিলো বিধায় আমি তাকে হাসপাতালের এড্রেস দিয়েছি। আচ্ছা ভাইয়া, তোর আজকাল কি হয়েছে বল তো। এমন ভয়ংকর জ্বর বাঁধালি কি করে?”
“আমি কি জ্বরকে নেমন্তন্ন দিয়েছি? বলেছি আয় আমার গায়ে বস? আমি কি করে জানবো?”

ঝগড়ার স্বরে উত্তর দিলো জাওয়াদ। জ্যোতি মুখ ভেংচি কেটে বললো,
“তোর মত অকৃতজ্ঞ বাপু জীবনে দেখি নি। কোথায় থ্যাংকিউ বলবি না ঝামটি দিচ্ছিস। এজন্য বলে কারোর উপকার করতে হয় না। শোন তোর উচিত আমাকে আর পাভেল ভাইকে রেস্টুরেন্টে ট্রিট দেওয়া। কোথায় জীবন বাঁচালাম, শুকরিয়া করবি! তা না”
“ভ্যান ভ্যান করিস না তো। গা গুলাচ্ছে। বমি করে দিব তোর গায়ে”

আব্দুল হামিদ গলা খাকারি দিতেই ভাইবোন থেমে গেলো। তিনি দীপশিখা আর তরঙ্গিনীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“মা, তোমরা কিছু খেয়ে নিবে চল। দুপুর হয়ে গেছে। সেই কখন থেকে বসে আছো”
“না না আংকেল, ব্যস্ত হবেন না। জাওয়াদ সাহেবের জ্ঞান ফিরেছে, জ্বর কমেছে তাই আমরা এখন বাসায় যাব। বাবা-মা চিন্তা করছে”

বিনয়ী স্বরে উত্তর দিলো দীপশিখা। আব্দুল হামিদ তার হবু পুত্রবধূর উপর বেশ প্রসন্ন। কি ভালো মেয়ে? এখন থেকেই তার অকর্মণ্য পুত্রের প্রতি কতটা যত্নশীল। তিনি বেশ প্রসন্ন কণ্ঠে বললো,
“তোমার বাবা-মাকে আমার সালাম দিও। আর বলিও আমার সাথে কথা বলতে”

তরঙ্গিনী এবং দীপশিখা বুঝলো কি বিষয়ে তিনি কথা বলতে চাইছেন। দীপশিখা খুব নরম স্বরে বললো,
“আচ্ছা, আংকেল”

তারপর জাওয়াদের দিকে ফিরে বললো,
“আপনি বিশ্রাম করুন। আমরা আসছি”
“চলে যাবে?”

করুন স্বরে শুধালো জাওয়াদ। দীপশিখা বেশ লজ্জা পেলো। লোকটি এমন ভাবে কথা বলছেন যেন তাদের মাঝে গভীর প্রণয়। দীপশিখার হৃদস্পন্দন প্রগাঢ় হলো। খুব জড়তা নিয়ে বললো,
“বিকেলে একবার দেখে যাব। আপনি বিশ্রাম করুন”

জাওয়াদ মাথা নাড়ালো। কেবিন থেকে বের হতেই তরঙ্গিনী হাসতে হাসতে বললো,
“জুলিয়েটের বুক থেকে পাথর নেমেছে?”
“ধ্যাত আপু, কি সব বলিস তুই?”
“বলবো না? তুই যেভাবে প্যানিক করছিলি? ঘেমেনেয়ে একাকার হাল করেছিলি”
“করবো না? একটা মানুষ হুট করে এতো অসুস্থ হয়ে যায় নাকি?”
“ভয় পেয়েছিলি বুঝি?”

দীপশিখা কিছুসময় চুপ করে থেকে বললো,
“খুব ভয় পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো আমি বুঝি মারা যাচ্ছি। এতোটা ভয় আগে কখনো পাই নি আপু”

তরঙ্গিনী হাসলো শুধু। কিছুই বললো না। তার হাসি দেখে দীপশিখার গা জ্বলছে। এই আপুটা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধুরন্দর মহিলা। এই মহিলা শুধু হাসবে কিন্তু কিছু বলবে না। অসহ্য!

****

জাওয়াদের গায়ে জ্বর নেই। সে পা লম্বা করে শুয়ে আছে। শরীরে ব্যাথা করছে। বিশ্রী জ্বর হয়েছে তার। এই জ্বরে খাবারের রুচি চলে যায়। জাওয়াদের মুখে রুচি নেই। তার সামনে বসে পাভেল বিরিয়ানি খাচ্ছে। ব্যাপারটি দেখে অত্যন্ত রাগ হলেও সে কিছুই বলতে পারছে না। কারণ সে তার প্রাণ বাঁচিয়েছে। তাই তার হাভাতেপনা দেখতে হচ্ছে। কিন্তু সেটা চিন্তার বিষয় নয়। চিন্তার বিষয় বিয়ের ব্যাপার নিয়ে বাবা বেশ উত্তেজিত। তিনি চিংকিকে যতটা পছন্দ করেছেন তার থেকে বেশি পছন্দ করা শুরু করেছেন। ব্যাপারটি জাওয়াদের জন্য মোটেই সুখময় কিছু নয়। কারণ সে চিংকিকে বিয়ে করতে চাইছে না। চিংকিকে বিয়ের কথা ভাবতেই তার হাতপা ঠান্ডা হয়ে যায়। দুঃস্বপ্নের ভয়ে সে চিংকির সাথে দেখা করে। গতরাতের স্বপ্নের মেয়েটা চিংকি-ই ছিলো। যার জন্য এমন ভয়ানক জ্বর এসেছে তার। চিংকির স্বপ্নগুলো এখন আরো ভয়ংকর হয়ে যাচ্ছে। এখন তো জীবনের ঝুঁকিও হয়ে যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে চিংকিকে বিয়ে করা অতি উত্তম উপায়। এতে করে সে এসব ঝামেলা থেকে পরিত্রাণ পাবে। কিন্তু কোথাও না কোথাও বেশ অপরাধীও লাগে নিজেকে। কারণ সে চিংকিকে ভালোবাসে না। চিংকিকে সে শুধু নিজের জন্য ব্যবহার করছে, ব্যাপারটি মোটেই মন সায় দিতে চাইছে না। তাকে চিন্তিত দেখে আব্দুল হামিদ সাহেব ভারী গলায় বললেন,
“এতো চিন্তা করো না। সুস্থ হয়ে যাও। আর অফিসে জানিয়ে দাও তুমি যেতে পারবে না”

****

বারান্দায় খোলাচুলে দাঁড়িয়ে আছে দীপশিখা। তমসার কৃষ্ণ রঙ্গ পৃথিবীর সব আলো শুষে নিয়েছে। তাদের এলাকায় কারেন্ট নেই। ফলে ঘুটঘুটে আঁধারে ডুবে আছে সব। তাদের বিপরীতের বড় ছ তালার বারান্দায় দুটো মানব মানবী গুজগুজ করে গল্প করছে। তারা কি গল্প করছে? নিশ্চয়ই কোনো বিশেষকিছু। এরা এই বাড়িটায় নতুন এসেছে। বিবাহিত দম্পতি। শুধু স্বামী-স্ত্রী ই থাকে। মেয়েটি অসম্ভব সুন্দরী। ছেলেটি অতটা সুন্দর নয়। অথচ কি চমৎকার লাগে তাদের। আচ্ছা তাকে আর জাওয়াদকেও কি বিয়ের পর এমন লাগবে? তারাও কি এমন খোলা আঁকাশে কৃষ্ণ আঁধারে গল্প করবে? কি গল্প করবে? জাওয়াদ কি তার কপালে আসা চুলগুলো পরম আদরে কানে গুঁজে দিবে? ভাবতেই ঠোঁটের কোনে উঁকি দিলো স্নিগ্ধ হাসি। তখন বাবার স্বর শোনা গেলো,
“চিংকি মা আসবো?”

বাবা খুব কম অনুমতি নেয়। অনুমতি নেওয়া মানেই সে কোনো বিশেষ কারণে এসেছে। চিংকি বারান্দা থেকেই উত্তর দিলো,
“বাবা এসো”

মোস্তফা মেয়ের ঘরে ঢুকলেন। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবে মেয়ে যে বারান্দায় অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সেটা বুঝতে পারলেন। মোস্তফা তার দু মেয়েকেই ভালোবাসেন তবে চিংকিকে বেশি ভালোবাসেন। কারণ মেয়েটি তার প্রতিচ্ছবি। দুনিয়া বলে মেয়েরা যদি বাবার মত দেখতে হয় তবে অত্যধিক সুখী হয়। কথাটা চিংকির ক্ষেত্রে বেশ ভুল। কারণ সে সমাজের কাছে তাচ্ছিল্য ছাড়া কিছুই পায় নি। বাবা-মা তার দূর্বল সন্তানের প্রতি বেশি যত্নশীল হন। চিংকি দূর্বল না। তবুও মোস্তফা তাকে বেশি আদর করেন। মেয়েটিকে সমাজ বুঝে না। কঠোর নারীর তুলতুলে হৃদয়টাকে তারা মূল্য দেয় না। মোস্তফা মেয়ের পাশে দাঁড়ালেন। মৃদু স্বরে বললেন,
“অন্ধকারে ভয় লাগে না মা?”
“না বাবা, লাগে না। কারণ আমি জানি তুমি আছো”
“সেটাও ঠিক। আমি তোর জন্য মিষ্টি এনেছি, লুকিয়ে রেখেছি দু পিস। খাবি?”
“বাবা, তুমি কিছু বলবে? সংকোচ কর না”

মোস্তফা জানেন মেয়ে তাকে ঠিক ধরে ফেলবে। তাই সংকুচিত স্বরে বললেন,
“জাওয়াদের বাবা ফোন করেছিলো। মা উনি তোমার মত জানতে চাইছে”

দীপশিখা কিছু সময় চুপ থেকে ধীর স্বরে বললো,
“আচ্ছা বাবা, ধর কেউ যদি তোমাকে একবার কাঁদায়, তাকে কি দ্বিতীয়বার সুযোগ দেওয়া যায়?”

মোস্তফা কোনো প্রশ্ন করলেন না। মেয়ের হেয়ালির অর্থও খুঁজতে চাইলেন না। হেসে খুব ধীর স্বরে বললেন,
“পুরুষমানুষ খুব অদ্ভুত প্রাণীরে মা। তাদের পৃথিবীটা বিশাল নয়; তারা বিশাল পৃথিবীর ভেতর একটি ছোট পৃথিবীকে আগলে রাখতে ভালোবাসে। সেই পৃথিবীর চোখে জল তাদের সহ্য হয় না। এখন যে তোমাকে কাঁদিয়েছে তুমি যদি তার সেই ছোট পৃথিবীর একজন হও তবে তাকে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া যেতেই পারে”

দীপশিখা হাসলো। শুধালো,
“জাওয়াদকে তোমার কেমন লাগে বাবা?”
“ভালো”
“আমারও ভালো লাগে”
“আমি কি হ্যা বলে দিব?”
“দাও”

মোস্তফা খুশি হলেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
“তুই কি আমাকে খুশি করতে বললি মা?”
“না, বাবা। আমি সত্যি উনাকে পছন্দ করি”
“একটা কথা মনে রাখবে মা, তোমরা আমার পৃথিবী। তোমাদের চোখে জল আমার সহ্য হয় না”

বাবা কি বুঝাতে চাইলো চিংকির তা বুঝতে কষ্ট হলো না। অন্ধকারে তার হাসি দেখা গেলো না, তবে সে হাসছে। মন খুলে হাসছে।

*****

জাওয়াদের সব রিপোর্ট স্বাভাবিক এলো। তার ডেঙ্গু হয় নি। সামান্য জ্বর। ডাক্তার জানালেন সে অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিয়ে ফেলেছে বলে এমন হয়েছে। যা শুনে আব্দুল হামিদ মুখ বাকালেন। দাঁত খিঁচিয়ে বললেন,
“অপদার্থ”

জাওয়াদ অবশ্য গা মাখালো না। জ্বরের বাহানায় হাসপাতালের নথি দেখিয়ে সাতদিন ছুটি নিলো জাওয়াদ। ইনচার্জ বেচারা চায়না যাবার আনন্দ ভুলে জাওয়াদের কাজ করছে। সে অনুতপ্ত। তার ধারণা জাওয়াদের জ্বরের কারণ সে। হবেই না কেনো! জাওয়াদের মত ছেলেকে সে বকেছে শুধুমাত্র দেরিতে আসার জন্য। চাকরীর এতোদিনে কেউ তার ভুল ধরার সুযোগ পায় নি। তার নামে কোনো অভিযোগ নেই। সবকিছুতেই পারদর্শী ছেলেটিকে সামান্য দেরিতে আসার জন্য বকাঝকা করা মোটেই উচিত হয় নি তার। তাই সে নিজ থেকেই তার ছুটির আর্জিকে সমর্থন জানিয়েছে। এখন সাতদিন জাওয়াদের কাজ পায়ের উপর পা তুলে কাটানো। তাকে কেনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেটাও একটা রহস্য। তার বিশ্বাস হচ্ছে না আব্দুল হামিদ সাহেবের মত মানুষও ভয় পেয়েছে। অবশ্য জাওয়াদের এই ছুটি নেবার আরেকটি কারণ আছে। সেটা হলো সে একজন সম্মানিত জাদু টোনা ভাঙ্গানোর মানুষ খুঁজে পেয়েছে। মানুষটিকে ঠিক কি বলা যায় জাওয়াদের জানা নেই। তবে বড় মামী তাকে বেশ মান্য করেন। তার পড়া পানি, পড়া কলম, পড়া কাগজের বেশ জনপ্রিয়তা আছে। বড় মামী বিশেষ কাজের আগেই তার পরামর্শ নেন। জাওয়াদের জ্বর শুনতেই তিনি তার এই “পড়াবাবা” এর থেকে পানি পড়া নিয়ে এসেছে। জাওয়াদের কাছে বড়মামীর এইসব কাজ অন্ধবিশ্বাস লাগতো। এটা নিয়ে বেশ হাসাহাসিও করতো সে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একবার লোকটির সাথে দেখা করা প্রয়োজন। চিংকিস্বপ্নের থেকে হয়তো সে তাকে পরিত্রাণ দেওয়াতে পারে।

বড়মামীর কাছ থেকে লোকটির ঠিকানা নিয়ে পাভেলকে বগলদাবা করে জাওয়াদ সেখানে গেলো। বকশীবাজারের এক পুরানো চুন খসা চারতালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারা। পাভেল বন্ধুর উপর ভীষণ বিরক্ত। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। জ্বর থেকে উঠে মাথা খারাপ হয়ে গেছে বলে সান্ত্বনা দিলো নিজেকে। জাওয়াদ ভেবেছিলো পড়াবাবা দেখতে মাজারের দরবেশের মতো উশকো খুশকো চুলের, পাগল পাগল ধরনের যার চোখের মধ্যে একটা বহিঃ জাগতিক ব্যাপার স্যাপার থাকবে। অথবা আচকান পরিহিত, বেশ চমৎকার দাড়ি থাকবে। মাথায় টুপি তার উপর ঘুতরা থাকবে। দীনদার চেহারা, যা দেখে মনে হবে লোকটি নিজেকে জাগতিক চাহিদা থেকে মুক্ত করে ফেলেছে। কিন্তু না। লোকটি তার একটি চিন্তার ধার ঘেষলো না। আধুনিক তার পোশাক আশাক। তিনি যেখানে পড়া জিনিসপত্র দেন এটা বেশ বড় একটা ঘর। ঢোকার সময় টিকিট কাটতে হয়। দুজন এসিসট্যান্ট আছে তার। পাভেল আর জাওয়াদ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। এই কি পড়াবাবা? লোকটির বয়স চল্লিশও না। জাওয়াদকে দেখে তার সহকর্মী শুধালো,
“আপনার নাম?”
“জাওয়াদ হামিদ”
“নাসরিন বেগমের ভাগ্নে?”
“জি”
“আসুন”

জাওয়াদ পড়াবাবার সামনে বসলো। তার চোখে মুখে ইতস্ততা। পড়াবাবা মিষ্টি হেসে বললো,
“চিন্তা করো না। ঠিক জায়গায় এসেছো তুমি”
“আপনি মন পড়তে পারেন?”

পড়াবাবা রহস্য করে হাসলেন। তার পাশে গ্লাস ভর্তি পানি। একটু পানিতে চুমুক দিয়ে বললেন,
“বলো কি সমস্যা?”

জাওয়াদের মনের সন্দেহ কাটে নি। কিন্তু পাঁচশ টাকা দিয়ে টিকিট কেটেছে সে। তাই তাকে সবটা খুলে বললো। পড়াবাবার কপালে ভাঁজ পড়লো। সে খুব গম্ভীর হয়ে বললেন,
“তোমার সমস্যাটা খুব জটিল। এমন সমস্যা আমি খুব কম-ই শুনেছি। আমার একটু ভাবতে হবে”

তিনি বিড়বিড় করে কিছু বললেন। তারপর ধীর স্বরে বললেন,
“তোমার সমস্যার কারণটা আমি মনে হয় ধরে ফেলেছি। আমার কাছে তা সমাধানের দুটো উপায়ও আছে। একটি সহজ অন্যটি জটিল”………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি