#স্বপ্নে_দেখা_রাজকন্যা
#১৬তম_পর্ব
বুড়ো আঙ্গুলটা লাল হয়ে গেছে। ফলে উৎকন্ঠিত চিংকি সাথে সাথে নিজের ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরলো আঙ্গুলটা। জাওয়াদ স্তব্ধ হয়ে গেলো। তার শিরদাঁড়ায় উষ্ণ রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। নরম ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো শরীর। শিরা উপশিরায় রক্তের বেগ বাড়লো। স্পন্দিত হল হৃদয়। জাওয়াদের উচিত স্বভাববশত হাতটি সরিয়ে নেওয়া। অতিরিক্ত পরিষ্কার স্বভাবের কারণে এসব তার পছন্দ নয়। তার প্রাক্তন শাম্মী যখন তার কাছে আসতে চাইতো সে এড়িয়ে যেত। ফলে শাম্মীর মনে হতো জাওয়াদ তার প্রতি আকৃষ্ট নয়। এ নিয়ে তাদের মাঝে অনেক ঝগড়া হত। প্রতিবার জাওয়াদের একটা কথা থাকতো,
“আমার এগুলো পছন্দ নয়। হাত ধরে রাখা অবধি আমি টলারেট করতে পারি কিন্তু এর থেকে বেশি আমার থেকে আশা করো না”
কথাটা শাম্মীর কাছে অপমানজনক মনে হত। ফলে ঝগড়ার রেষ বাড়তো। কিন্তু চিংকির এমন কাজে তাকে ঠেলে দিতে পারলো না জাওয়াদ। মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো এক অদ্ভূত ঘোরের মাঝে সে রয়েছে। চিংকির চিন্তিত মুখবিবরের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো সে। নয়ন সরাতে পারছে না। নিঃশ্বাস ভারী হলো। তার ঠোঁটজোড়াকে স্পর্শ করার ইচ্ছে হলো। আনমনেই দুরত্ব ঘুঁচিয়ে নিলো। জাওয়াদ নিজের স্বভাব বহির্ভূত একখানা কাজ করে বসলো। নিজের আঙ্গুল মুক্ত করে আবার বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করলো চিংকির নরম ঠোঁট। চিংকি কেঁপে উঠলো তার স্পর্শে। পরিস্থিতির আভাস পেতেই রক্তিম হয়ে উঠলো তার গাল। লজ্জা ঘিরে ধরলো তাকে। দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো। ওড়না হাতের ফাঁকে শক্ত করে ধরলো। জাওয়াদের গাঢ় দৃষ্টি আঁচ সে না তাকিয়েও পেলো। গভীর সেই দৃষ্টি। চিংকির হৃদয় কাঁপছে। দোদুল্যমান তার অনঢ় প্রহরী। জাওয়াদ লাজুক চিংকির লজ্জাকে পরিহাস করতে পারলো না। বরং তার হৃদয় কৌতুহলী হলো। জাওয়াদের মনে হলো সে কোনো নিশিপদ্মকে দেখছে যাকে ছুঁয়ে দেখার প্রলোভন জাগলো মনে। দুহাতে তার মুখখানা তুলে ধরলো। চিংকির মুখমন্ডলে আছড়ে পড়লে জাওয়াদের উষ্ণ নিঃশ্বাস। চিংকি চোখ তুলে তাকালো জাওয়াদের চোখে। তার ঘোরলাগা চোখের ভাষা পড়তে সময় নিলো। অন্তস্থলে বিশাল কালবৈশাখী দলা পাকালো। সেই ঝড়ের প্রলেপে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে সমস্ত জড়তা। কাঁপছে তার ঠোঁট। নাকের উপর জড়ো হয়েছে ঘর্মকণা। তাদের মাঝের দুরত্ব খুব ক্ষীণ। হয়তো সেই দুরত্বও ঘুচে যেত হয়তো কিন্তু সেই সময় জ্যোতির গলার স্বর শুনতে পেল জাওয়াদ। সাথে সাথেই দূরে সরে গেলো। চা নিয়ে বেরিয়ে গেলো রান্নাঘর থেকে। জ্যোতি রান্নাঘরে আসতেই চিংকিকে শুধালো,
“ভাইয়া কি চা নিয়ে গেছে?”
চিংকির গলায় দলা পাকাচ্ছে কথা। শ্বাস ঘন হয়ে গেছে। হৃদস্পন্দনের বেগ বেসামাল। জ্যোতি তাকে পুনরায় শুধালো,
“তুমি ঠিক আছো ভাবি? এমন দেখাচ্ছে কেনো তোমাকে?”
চিংকি কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তার গাল গরম হয়ে গেছে। একটু আগের ঘটনা ভাবতেই লজ্জায় মিশে যাচ্ছে। ভাগ্যিস জ্যোতি এসেছিলো!
***
জাওয়াদ নিজের রুমে চেয়ারের উপর বসলো। তার সামনে পড়াবাবার লাল-পানীয়। তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। চিংকির সামনে গেলেই সে কেনো দুনিয়া ভুলে যায়? জ্যোতির কন্ঠ না পেলে সে কত বড় একটা ভুল করে বসতো! সে তো কখনোই এমন ছিলো না। জাওয়াদের জীবনে নারী সঙ্গের অভাব কখনোই ছিলো না। এখনো নেই। অফিসেও তার জনপ্রিয়তা অন্যরকম। জুনিয়র মেয়েরা তার সাথে কথা বলার ছুঁতো খুঁজে। কিন্তু জাওয়াদ কখনোই তাদের প্রতি এভাবে সব ভুলে চিন্তা চেতনা মুদে ডুবে যায় নি। তবে কি পড়া-বাবার কথা সঠিক! চিংকির সাথে এমন কিছু আছে যা তাকে প্রতিনিয়ত আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে? যদি সেটাই সঠিক হয় জাওয়াদকে এই অখাদ্য নোংরা পানি খেতে হবে। এবং তাও অতিসত্ত্বর।
*****
বিয়ের সব কাজ স্ফুর্তির সাথে শুরু হয়েছে। জাওয়াদের মামী দুদিন যাবৎ কনের জন্য শাড়ি পছন্দ করছে। এসবের মাঝে জাওয়াদকেও জোরপূর্বক ফাঁসানো হয়েছে। যতই হোক বউ তার, তাই তার দায়িত্ব বিয়ের শাড়ি পছন্দ করা। পাভেলের উপর যদিও রাগ কমে নি জাওয়াদের। কিন্তু তার পার্টনার অফ ক্রাইম বলতে এই একটি ছেলেই আছে। তাই রাগ থাকলেও তাকে কাঁধছাড়া করতে পারছে না জাওয়াদ। পাভেলও হবু স্ত্রীর বড় ভাইকে সম্মান করছে। আগে নানারকম টিপ্পনী করলেও এখন সেগুলো করছে না। ফলে যখন জাওয়াদ বললো,
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি পড়াবাবার পানি খাবো”
পাভেলের অনেককিছু বলার থাকলেও সে সব গিলে হাসি মুখে বললো,
“কিন্তু চিংকির লালা পাবি কি করে?”
জাওয়াদ গম্ভীর মুখে বললো,
“তোর অনেক বুদ্ধি, তাই আমাকে বুদ্ধি দে”
পাভেলের ইচ্ছে হয়েছিলো জাওয়াদকে বেধরক পিটাতে। কিন্তু নিজেকে সামলালো। বেজারমুখে বললো,
“আমার অনেক ভাগ্য ভালো, তোর বোন তোর মতো গান্ডু না”
“গালি দিচ্ছিস আমাকে? বেশি কথা বললে কিন্তু বিয়ে ক্যান্সেল”
“না জাহাপনা, আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা? যাক গে, ওকে চুমু খেয়ে নে”
জাওয়াদ মুখ বিকৃত করে রাগী চোখে তাকাতেই পাভেল বুঝে গেলো তার বুদ্ধি জাওয়াদের পছন্দ হয় নি। ফলে গলা খাকারি দিয়ে বললো,
“মজা করছিলাম”
“তুই আমার সাথে কাল শপিং এ যাচ্ছিস। আর খবরদার জ্যোতির আশেপাশেও থাকবি না। যদি আমার বোনের আশেপাশে তোকে দেখি একদম মেরে ভর্তা করে ফেলবো”
“জি জাহাপনা”
শাড়ির দোকানে বসে আছে সবাই। একের পর এক শাড়ি দেখা হচ্ছে। চিংকির পছন্দের রঙ লাল। কিন্তু মামীর ভাষ্য,
“এখন সবাই লাল পড়ে, তুমি পড়বে আলাদা কিছু”
ফলে একের পর এক দোকান ই বদল হচ্ছে কিন্তু কনের শাড়ি এখনো কেনা হয় নি। চিংকি খুব-ই ক্লান্ত। শপিং করা, দোকান ঘোরা তার অপছন্দ। আগে জানলে আজ দুটো ভিডিও শ্যুট করে ফেলতো। জাওয়াদ একবার শুধালো,
“তোমার কি ক্লান্ত লাগছে? কিছু খাবে?”
চিংকি মাথা নাড়িয়ে না বলল। ভাগ্যিস মানুষটা পাশে ছিলো। ক্ষণে ক্ষণে তার খোঁজ খবর নিচ্ছে, কথা বলছে। নয়তো চিংকি অস্বস্তিতেই শেষ হয়ে যেত। জ্যোতিও মামীর কাজে বিরক্ত। ফলে বিরক্তি নিয়ে বললো,
“মামী, আলাদা আলাদা করতে করতে তুমি তো ভাবিকে মঙ্গল গ্রহের জীব বানিয়ে দিচ্ছো। শাড়ি তো না যেনো হিরে খুঁজছো। আর তো এনার্জি নেই”
“চুপ কর তুই”
বিবাদের মধ্যে চিংকির নজর আটকালো হালকা আকাশী একটা শাড়িতে। শাড়িটা গায়ে ফেলতেই দোকানদার বললো,
“আফা, আপনের গায়ে মানাইবো”
জ্যোতিও সাথে সাথে বললো,
“ভাবি, এটাই নাও”
চিংকি প্রথমেই তাকালো জাওয়াদের দিকে। জাওয়াদের চোখও তখন চিংকিতে নিবদ্ধ। চিংকিকে নীলে খুব-ই চমৎকার লাগে। শুধু চমৎকার বললে ভুল, নীলে চিংকিকে নিজের নিজের লাগে। তার হৃদস্পন্দন বেসামাল হয়ে যায়। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সে। ফলে দৃষ্টি সরিয়ে বললো,
“ভালো লাগছে না। অন্যকিছু দেখো”
ফলে অনেক পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও চিংকি শাড়িটা কিনলো না। জ্যোতি বিদ্রুপ টেনে বললো,
“ভাবি, তুমি এখনই ভাইয়ার কথায় সিদ্ধান্ত নিচ্ছো?”
চিংকি মৃদু হাসলো। কিন্তু উত্তর দিল না। অবশেষে খুঁজতে খুঁজতে একটি হালকা গোলাপি শাড়ি পছন্দ করা হলো। সেটাই বিয়ের জন্য কেনা হলো। কেনাকাটা শেষে একটি দোকানে হালকা কিছু খাওয়া দাওয়া করার জন্য বসলো তারা। এর মধ্যেই পাভেল জাওয়াদের কানে কানে বললো,
“দোস্ত উপায় পেয়ে গেছি চিংকির লালা জোগাড়ের”……………
চলবে
#স্বপ্নে_দেখা_রাজকন্যা
#১৬তম_পর্ব (বর্ধিতাংশ)
এর মধ্যেই পাভেল জাওয়াদের কানে কানে বললো,
“দোস্ত উপায় পেয়ে গেছি চিংকির লালা জোগাড়ের”
জাওয়াদ উদ্গ্রীব স্বরে শুধালো,
“কি উপায়?”
পাভেল মুচকি হেসে বললো,
“খুব ইজি, একটা আইসক্রিম কেন। ওকে সাধ। ও খেলেই ওর লালা লেগে যাবে। তারপর ওই ড্রেনের পানিতে আইসক্রিম গুলিয়ে খা”
পাভেলের দিকে তাকিয়ে কঠিন চোখে তাকালো জাওয়াদ। দাঁতে দাঁত খিঁচে বললো,
“এই শীতকালে তো গাধারাও আইসক্রিম খায় না। আর আমি খাবো আইসক্রিম? মাথা খারাপ তোর?”
“পড়াবাবার কথা মত তুই তোর হবু বউ যাকে তুই বিয়ে করতে চায় তার লালা খুঁজছিস! অন্তত তোর মত মানুষের মুখে গাধা শব্দ মানায় না”
জাওয়াদ কিড়মিড় করে তাকালো। পাভেল সাথে সাথেই জ্যোতির উদ্দেশ্যে বললো,
“জ্যোতি, কিছু খাবি? মামীর সাথে শাড়ি দেখতে দেখতে আমার দুকেজি ওজন কমে গেছে। মহিলা মানুষ এতো দোকান ঘুরে জানলে কোনোদিন আসতাম না”
মামীর পাভেলের কথা পছন্দ হলো না। ফলে ভেংচি কেটে বললেন,
“তোমাকে আসতে বলেছে কে বাপু?”
“আপনার মত সুন্দরী রমনীকে জাওয়াদের উপর ছেড়ে দিতে ভয় হচ্ছিলো মামী”
মামীর দূর্বলতা হল প্রশংসা। সেটা যেই করুক না কেন, তিনি গলে যান। তাই পাভেলের ঠাট্টায় রাগ হলেও সেটা গলে পানি হয়ে গেল। লজ্জা লজ্জা স্বরে বললেন,
“হয়েছে হয়েছে। চল, খাওয়া দাওয়া করা যাক। দীপশিখারও ক্ষুধা লেগেছে নিশ্চয়ই”
পাভেল চাইলো জাওয়াদের দিকে। ইশারা করে বুঝালো,
“সুযোগ দিয়েছি, লুফে নে”
*****
দোতালা ফুড কোর্টের একেবারে শেষ টেবিলে বসলো তারা। পাভেল দুটো চেয়ারে শপিংয়ের জিনিসগুলো রাখলো। একে একে যে যার পছন্দের খারাপ অর্ডার করলো। জাওয়াদ শুধু আইসক্রিম কিনে আনলো। তার হাতে আইসক্রিম দেখে জ্যোতি বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো,
“ভাইয়া তুই এই ঠান্ডায় আইসক্রিম খাবি? কিছুদিন আগে তো হাসপাতালে ভর্তি ছিল, এবার কি বিয়ের আগে নিউমোনিয়া বাঁধাবি?”
জাওয়াদ অগ্নিদৃষ্টি ছুড়লো পাভেলের দিকে। পাভেল সাথে সাথেই জ্যোতির উদ্দেশ্যে বলল,
“আরে কিছু হবে না। ঠান্ডা ঠান্ডায় ঠান্ডাক্ষয়”
“হ্যা?”
“বিষে বিষে বিষক্ষয় শুনিস নি?”
“শুনেছি”
“অমনই কিছু একটা। তুই খা না, নয়তো আমাকে দে”
“পাভেল ভাই, খাওয়া বাদে কিছু মাথায় থাকে আপনার? এতো কে খায়?”
“আমাকে খাওয়ার খোঁটা দিবি না জ্যোতি, আমি কখনো বলেছি তুই রাস্তার মোড়ের চাঁদাবাজদের মতো সুযোগ পেলেই টাকা চাস? বলি না তো। আমার খাওয়ায় নজর দিবি না”
জ্যোতি নাক মুখ কুচকে বললো,
“একশোবার দিব, হাজারবার দিব। খাদক একটা”
জাওয়াদ ওদের উপেক্ষা করলো। যা পারে করুক, হেদিয়ে মরুক। তার যায় আসে না। সে চিংকির দিকে আইসক্রিমটা এগিয়ে বললো,
“খাবে?”
চিংকি বেশ অবাক হল। তার বিস্ময় তার চোখে মুখে স্পষ্ট প্রকাশ পেলো। সে জানে জাওয়াদ শুচিবাই ধরনের মানুষ। সে কারোর খাওয়া খাবার খায় না। এক স্ট্র কখনো ব্যবহার করে নি তারা। এমনকি পানির বোতলের মুখেও যদি মুখ দিয়ে খাওয়া হয় জাওয়াদ সেটাও উপেক্ষা করে। ফলে বিস্মিত স্বরে শুধালো,
“এটা তো আপনার জন্য কিনে এনেছেন”
“হ্যা… তুমি টেস্ট করবে একটু?”
চিংকি ঈষৎ দ্বিধান্বিত স্বরে বললো,
“সমস্যা নেই, আপনি খান”
“খাও না তুমি একটু”
“হ্যা?”
“হ্যা, ওরা বললো এটা অনেক টেস্টি”
“আইসক্রিমে আবার কি টেস্ট? সব তো একই রকম”
“এটা বিদেশী আইসক্রিম। সাড়ে তিনশটাকা এক স্কুপ। খাও প্লিজ”
জাওয়াদ যেন একপ্রকার জোর করলো চিংকিকে। চিংকির সংশয় বাড়লো। জাওয়াদের আচারণ অস্বাভাবিক ঠেকলো যেন। জাওয়াদের মুখবিবরে অনিশ্চিত অস্থিরতা। চিংকির মনে হলো সে যেন জোরপূর্বক কাজটা করছে। ফলে নিচু স্বরে বললো,
“মামীকে দেখানোর জন্য আপনার অভিনয় করতে হবে না। এমনিতেও আমার আইসক্রিম খাওয়া বারণ। ডায়েট করছি তো”
জাওয়াদ হতাশ হল। ফলে সাড়ে তিনশ টাকা জলে। পাভেলের মাথা থেকেই এমন অদ্ভুত বুদ্ধি বের হতে পারেই। সেই এমন আজব কিছু চিন্তা করতে পারে। ভুল তার ছিলো। পাভেলের বুদ্ধি গ্রাহ্য করার পূর্বে তার ভাবা উচিত ছিলো। পাভেল জাওয়াদের দৃষ্টি দেখে মিনমিন করে বললো,
“একটু খাও, এতো সুন্দর করে সাধছে”
“আমি জানি পাভেল ভাই, জাওয়াদ সাহেব একটু হাইজিন মেইনটেইন করেন। আমি উনাকে এভাবেই পছন্দ করেছি। আমার জন্য উনাকে বদলাতে হবে না”
“আরে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে খাবার শেয়ারে ভালোবাসা বাড়ে। এক কামড়ে কি ওর ডায়রিয়া হবে নাকি? ইশ! আমার প্রেমিকা এমন না, আমাকে এভাবে আদর করে খাবার সাধে না। সেও জ্যোতি ফাজিলের মতো শুধু আমার খাবারে নজর দেয়। চায় আমার পেট খারাপ হয়ে টয়লেটেই আত্মহুতি দেই”
বলেই জ্যোতির দিকে তাকালো পাভেল। জ্যোতি সাথে সাথেই উপহাস করে বললো,
“এতো নজরেও আপনার কিছু হবে না পাভেল ভাই। আপনি হল গন্ডার। মোটা চামড়ায় ওই নজর ঢুকতে পারবে না। বেচারি আপনার প্রেমিকা”
“তোর মত চাঁদাবাজ হওয়ার থেকে গন্ডার হওয়া ভালো। তোর বরের কষ্টে আমার রাতে কান্না পায়। যাক গে, দীপশিখা আমার বন্ধুতে ফিরিয়ে দিও না।”
পাভেলের কথায় মুখ চেপে হাসলো চিংকি। সাথে খানিকটা লজ্জাও পেলো। জাওয়াদ ভাবলো চিংকি সরাসরি আইসক্রিম খাবে, ফলে লালা পাওয়ার মিশন সম্পূর্ণ হবে। কিন্তু এমন কিছুই হলো না। চিংকি একটা চামচ দিয়ে হালকা একটু খেলো। তারপর বললো,
“নিন, আপনার অনুরোধ রেখেছি। এবার আপনি নিশ্চিন্তে খান”
এমন কাজের সাথে জাওয়াদ এবং পাভেলের প্রথম পরিকল্পনা একেবারেই ভেস্তে গেলো। খাওয়া দাওয়া শেষে কটমটিয়ে পাভেলকে বললো,
“বিল দে”
“আমি কেন? তোর বউয়ের শপিং তুই দে”
“আইসক্রিমে লালা লাগিয়ে পানির সাথে খাওয়ার বুদ্ধিটা কার?”
পাভেল কাচুমাচু স্বরে বললো,
“দোস্ত, মাসের শেষ। পকেটে টানাটানি”
“জান নিয়ে টানাটানির আগে বিল দে”
পাভেল জানে জাওয়াদ এখনই ওকে উঠিয়ে আছাড় দিবে। ফলে তাকে চেঁতিয়ে লাভ নেই। হাত কামড়ে দোকানদারকে বললো,
“কত হয়েছে ভাই?”
“দু হাজার সাতশ স্যার”
“কার্ড চলবে?”
“নো, স্যার অনলি ক্যাশ”
পাভেল অসহায় চোখে তাকালো। তার পকেটে টাকা নেই। নিজেই সাতশটাকার খাবার খেয়েছে। জাওয়াদকে বললো,
“দোস্ত, আজকে দিয়ে দে। আমি বিকাশ করে দিব”
“আমিও জ্যোতির বিয়ে অন্য জায়গায় দিয়ে দিব”
পাভেল পাথর চোখে তাকালো। জাওয়াদ তার তুরুপের এক্কা বানিয়েছে জ্যোতিকে। লোক ঠিকই বলে, “বউয়ের ভাই মানেই কুমির”। পাভেল আকাশ পাতাল চিন্তা করতে লাগলো, কিভাবে টাকা দেওয়া যায়। সাথে সাথেই মাথায় বুদ্ধি এলো। আগ্রহী স্বরে বললো,
“দাঁড়া”
বলেই ছুটলো টেবিলের দিকে। চিংকির প্লেট থেকে চামচটা নিয়েই পকেটে পুরে ফেললো। তারপর এসে বলল,
“তোর সমস্যা মিটিয়ে দিয়েছি, বিল দে”
জাওয়াদ খেঁকিয়ে বললো,
“কি এমন খোরাফাতি কাজ করেছো শুনি”
সাথে সাথেই চামচ বের করলো পাভেল। গর্বিত স্বরে বলল,
“দেখ”
“বিল দিতে বলেছি বলে চামচ চুরি করেছিস?”
“ধ্যাত, আরে এটা চিংকির চামচ। এই চামচে ওর লালা আছে তো। এই চামচে তুই পানি খেলে একের ভেতর তিন কাজ হবে”
পাভেলের বুদ্ধি মন্দ নয়। জাওয়াদ অভিভূত হলো। না, বন্ধু তার অকর্মণ্য নয়। পাভেল অসহায় স্বরে বললো,
“এবার বিলটা দিয়ে দে”
জাওয়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিল দিল। জ্যোতিরা অপেক্ষা করছিলো একটা ঘড়ির দোকানের সামনে। একটি ঘড়ি দীপশিখার খুব ভালো লেগেছে। দামটা অনেক বেশি। তার কাছে বর্তমানে এতো টাকা নেই। কিন্তু এই ঘড়িটা জাওয়াদের হাতে দেখেছিলো সে। ঘড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে। একদিন দীপশিখার সাথে দেখা করতে আসার সময় তার মোটরসাইকেলের হালকা দূর্ঘটনা হয়েছিলো। ওভারটেক করতে যেয়ে একটি সিএনজির সাথে ধাক্কা লেগে গেছিলো। তখন ঘড়িটা ভেঙ্গে গেছে। জাওয়াদ বিদ্রুপ করে বলেছিলো,
“শোনো মেয়ে, তোমার সাথে একটু সময় পাওয়ার জন্য আমার প্রিয় ঘড়ির জ্বলাঞ্জলি দিয়েছি। এবার অন্তত সময় দেও”
জ্যোতি দুষ্টু স্বরে শুধালো,
“এখনই বরের জন্য পছন্দ করছো?”
“দশটা নয় পাঁচটা নয়, একটাই তো বর”
“এতো দাম দিয়ে মাথায় চড়িও না”
“ভাইকে এভাবে বলছো?”
“ভাই বলেই বলছি। পুরুষ মানুষকে তোল্লাই করলে মাথায় উঠে ডুগডুগি বাজায়”
“তোমার ভাই হয়তো তেমন পুরুষ নয়”
“বাহ বা, এখনই পক্ষ নিচ্ছ?”
“নিলাম, যাকে ভালোলাগে তার পক্ষ নিতে কিসের কার্পণ্য!”
এর মধ্যেই জাওয়াদরা চলে এলো। জ্যোতি মিনমিন করে বললো,
“ভালোলাগাটা প্রকাশ করে ফেলো ভাবী, এরেঞ্জ কাম লাআআআআভ ম্যারেজ হয়ে যাক”
চিংকি হাসলো শুধু। উত্তর দিলো না। মন্দ বলে নি জ্যোতি। কিশোরী চিংকির প্রেমপত্রকে অগ্রাহ্য করলেও হবু বউয়ের প্রেমপত্র তো অগ্রাহ্য করবে না। জাওয়াদ মৃদু স্বরে বললো,
“চল”
“চলুন”
****
নীল আকাশের রঙ শুষে নিয়েছে রাত্রি। জ্বলজ্বল করছে বাড়ির আলোগুলো। দূরের চায়ের স্টল থেকে গান ভেসে আসছে,
“তুই আমার হিরো
তুই আমার হিরো”
জাওয়াদের বাইক থামলো ঠিক দীপশিখার বাড়ির সামনে। দীপশিখা বাইক থেকে নামলো। জাওয়াদ হেলমেট খুললে মৃদু স্বরে বললো,
“শাড়ি পছন্দ হয়েছে তোমার?”
“হ্যা, হয়েছে তো”
“আসলে মামী অনেক চুজি টাইপের। একটু বিরক্তিকর। কিন্তু উনি ছোটবেলা থেকে আমাদের দু ভাইবোনকে খুব যত্ন করেছেন। তাই উনাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আই হোপ তুমি মাইন্ড কর নি”
“জাওয়াদ সাহেব, আপনার কি হয়েছে বলুন তো?”
জাওয়াদ কিঞ্চিত ভ্যাবাচেকা খেলো। বিহ্বল স্বরে শুধালো,
“কি হবে?”
“আপনি আমার জন্য এতো চিন্তিত, আমার তো ভয় হচ্ছে আপনি আমার প্রেমে ট্রেমে পড়লেন কিনা”
জাওয়াদ মৃদু হেসে বললো,
“তোমার কি ধারণা?”
“কেস জন্ডিস”
বলেই হাসতে হাসতে ভেতরে চলে গেলো চিংকি। জাওয়াদ তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। আজ থেকে তার পড়াবাবার পানি সেবন শুরু। হয়তো পরিত্রাণ খুব সন্নিকটে।
****
পড়াবাবার সামনে বসে আছে জাওয়াদ। তার চোখে মুখে অসীম বিরক্তি। টানা দশ দিন সে নাক চেপে, চোখ বুজে পড়াবাবার পানি খেয়েছে। কাজ হচ্ছে কি না পরীক্ষার জন্য গতকাল চিংকির সাথে দেখা করে নি সে। আজ সকালেই আবারও বিয়ের স্বপ্ন দেখেছে। শুধু স্বপ্নে তার জীবন সীমাবদ্ধ নয়। সকাল সাতটায় ইনচার্জের ফোন,
“জাওয়াদ তোমাকে আপকামিং প্রজেক্ট থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই.ও”
প্রজেক্টটা জাওয়াদের অনেক কষ্টের ছিলো। সব কাজ সে করেছে। অথচ তাকেই বরখাস্ত হবে। পাভেল তার পাশে বসা। মিনমিন করে বলেছে,
“বলেছিলাম ভন্ড, ড্রেনের পানি খেয়ে বমি করেও লাভ হলো কি?”
পড়াবাবার মুখ শান্ত। তাকে মোটেই উদ্বিগ্ন লাগলো না। স্বাভাবিক মুখমন্ডল। সে ধীর স্বরে বললো,
“তুমি কিভাবে পানি সেবন করেছো?”
“যেভাবে আপনি বলেছেন!”
“পানিতে চিংকির লালা মিশিয়েছো, তাও কাজ হচ্ছে না?”
“একটু চিটিং করেছি। লালা কি করে মিশাবো, ওর খাওয়া চামচ দিয়ে কাজ চালিয়েছি”
“এজন্যই কাজ হয় নি বৎস। তোমরা এতো শর্টকাট কেনো কর? উফফ”
পড়াবাবার মুখে বিরক্তি ফুটে উঠলো। জাওয়াদ পাভেলের দিকে তাকালো। পাভেল অপ্রস্তুত স্বরে বললো,
“আমি কি লালা বানাই নাকি? যা মাথায় আসছে সেটাই বলেছি”
জাওয়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“এখন উপায়। আমার জীবনে তো খড়া ঝুলছে”
“একটাই উপায়”
“কি?”
“একটু অশ্লীল উপায়টা”
“কি?”
“সরাসরি তোমাকে চিংকির লালা সেবন করতে হবে”
“পাগল আপনি, আমি এখন চিংকিকে বলবো নাকি আমার মুখে থুথু মারো?”
“এখন স্বপ্ন থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই। কি করার?”
জাওয়াদের মাথা ফেটে যাচ্ছে। পেট মোড়াচ্ছে। কোন আক্কেলে এই বাবার কাছে এসেছিলো সে? ইচ্ছে করছে পড়াবাবার গায়ে বমি করে দিতে। উজবুকের মতো মামীর পরামর্শ নেওয়াই উচিত হয় নি। রাগী স্বরে বললো,
“আমার পাঁচশত টাকা ফেরত দিন”
“ওটা তো অফেরতযোগ্য”
“মানে কি?”
“মানে আমি তোমাকে উপায় বলেছি। সেটার দাম ওই টাকা”
জাওয়াদ এবার রেগে পড়াবাবার কলার চেপে ধরলো। রাগী স্বরে বলল,
“ফাজলামি করস?”
“উত্তেজিত হচ্ছো তুমি জাওয়াদ। আমার উপায় কিন্তু তোমার বন্ধু কাজে দিয়েছে। বিশ্বাস না হলে চিংকিকে বিয়ে করেই দেখতে পারো। অবশ্য এছাড়া আর উপায় নি। তুমি চাইলেও ওকে সব খুলে বলতে পারবে না। সাহস থাকলে বলে দাও। ভেঙ্গে দাও বিয়ে, নাকি তুমি নিজেই এই স্বপ্ন থেকে পরিত্রাণ চাইছো না?”
পড়াবাবার ঠোঁটের হাসি খসলো না। জাওয়াদ তার কলার ছেড়ে দিলো। সত্যি তো, সে কেনো চিংকির সাথে বিয়ে ভাঙ্গতে চাইছে না। পড়াবাবা হাসি বিস্তৃত করে বললো,
“তোমার সাহস নেই বিয়ে ভাঙ্গার? তুমি আসলে চাইছোই না চিংকি থেকে পরিত্রাণ পেতে। তুমি মেয়েটির প্রেমে পড়েছো”
জাওয়াদের কপালের শিরা দপদপ করছে। ইচ্ছে করছে পড়াবাবার মুখ ভেঙ্গে দিতে। কিন্তু পারছে না। লোকটির চোখের দিকে তাকালেই কেমন কেমন যেন লাগছে। এমন অদ্ভুত দৃষ্টি। জাওয়াদ রাগী স্বরে বললো,
“আপনাকে আমি ভুল প্রমাণ করে দিব, জাস্ট ওয়েট”
পড়াবাবা বিকৃতচিত্তে হাসছেন। তার হাসি ঝংকার তুলছে শান্ত ঘরে। মৃদু কন্ঠে বললো,
“আই এম ওয়েটিং”
জাওয়াদ পাভেলের সাথে বেরিয়ে গেলো। জাওয়াদ চোখ মুখ কঠিন হয়ে আছে। পাভেল রয়ে সয়ে বললো,
“কি করবি এখন?”
“বিয়ে ভাঙ্গবো সেই সাথে স্বপ্ন থেকেও পরিত্রাণ পাব”…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি