স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা পর্ব-২৪+২৫

0
49

#স্বপ্নে_দেখা_রাজকন্যা
#২৪তম_পর্ব

“আমি তোমাকে কখনো বলেছি তুমি নীল রঙ পড়বে না”
“মানে কি?”
“মানে হলো নীল পড়লে তোমাকে সবচেয়ে সুন্দর লাগে। আমি চোখ ফেরাতে পারি না। নীল রঙ তুমি শুধু আমার সামনেই পড়বে এছাড়া নয়”
“আজব, আমি আপনার কথা শুনবো কেন?”
“তাহলে আমি তোমার কথা শুনবো কেন?

জাওয়াদের দৃঢ় কণ্ঠ। তার এমন বেপরোয়া উত্তরে দীপশিখা মুহূর্তের জন্য ভাষাহীন হয়ে গেলো। চোখের ভাষা বদলে গেলো। থমথমে চোখে তাকিয়ে রইলো। তার চোখে এতোসময়ের বিরক্তিগুলো উবে গিয়ে তীব্র ক্ষোভ দেখতে পেল যেনো জাওয়াদ। এই ক্ষোভের অর্থ সে জানে। সেই ক্ষোভের সাথে মিশে ছিলো অভিমান, বিষাদ আর হৃদয়ের চেপে রাখা ক্ষুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস। ইচ্ছে হলো মেয়েটিকে টেনে জড়িয়ে ধরে রাখতে। বুকের মধ্যিখানে চেপে ধরে বলতে,
“আমার হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছো চিংকি? এ কেবল তোমার জন্য। তোমাকে না দেখলে আমার এই স্পন্দন বেসামাল হয়ে যায়। আমি জানি তুমি বুঝতে চাইছো না। আমি জানি তুমি বুঝতে চাইবে না। সেই অধিকার সম্পূর্ণ তোমার আছে। তবে আমাকে অন্তত আমার প্রেমটুকু বুঝাতে দাও”

কিন্তু কথাগুলো বলতে পারলো না জাওয়াদ। তারপূর্বেই দীপশিখা তার শাট ডাউন মুডে চলে গেলো। কথা না বলে নিজের কাজে মনোনিবেশ করা। জাওয়াদকে সে আর পাত্তা দিবে না। তার বলয়ের মাঝে জাওয়াদকে প্রবেশ করতে দিবে না। জাওয়াদ তার জন্য আর পাঁচটা মানুষের মত অপ্রাসঙ্গিক একজন মানুষ। অপ্রাসঙ্গিক মানুষদের জন্য নিজের সময় নষ্ট করার মানে নেই। দীপশিখা তাকে ছেড়ে নীলক্ষেতের বইয়ের গলির ভেতরে ঢুকে গেলো। দীপশিখার পরিচিত কিছু বইয়ের দোকান আছে। নীল পলিথিনের ছাওনি আবৃত দুধারে বইয়ের স্তুপ। মানুষের চলাচলের পথ সরু। তবুও মানুষের কমতি নেই। কে যেন বলেছে এই জেনারেশন বই পড়তে জানে না। ভুল, বইপোকা জেনারেশনকে হয়তো তারা দেখে নি। নীলক্ষেতে বিভিন্ন ধরনের মানুষ আসে। কেউ আসে শৌখিনতায়, কেউ আসে পেসাদারীতায়। দীপশিখা এই দু ধরনের মানুষের মধ্যেই পড়ে। আজ সে শৌখিনতায় আসে নি। সে এসেছে পেসাদারীতায়। নতুন কিছু বই এর রিভিউ করা প্রয়োজন। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ধরনের বইকেই সে তালিকাবদ্ধ করেছে। কিছু থ্রিলার বইও আছে। রোমান্টিক বই এখন বিরক্ত লাগছে। সে একটু নতুনত্ব স্বাদ চায়। পুরানো স্বাদগুলো বিস্বাদ লাগছে। দীপশিখা আর লিস্টগুলো পরিচিত বইবিক্রেতাকে ধরিয়ে বললো,
“এগুলো দিন”
“আচ্ছা আফা”

তার পেছন পেছন জাওয়াদও বইয়ের দোকানে প্রবেশ করেছে। বইয়ের প্রতি জাওয়াদের কখনোই আগ্রহ ছিলো না। এখনো নেই। মানুষ নতুন বই কিনলে তার গন্ধ শুঁকে। কিন্তু এসব কিছুই জাওয়াদের কাছে অহেতুক লাগে। ছোটবেলায় কমিক বই পড়তো। নেশা ছিলো তার। বইয়ের ফাঁকে কমিক বই রেখে পড়াও শুরু করলো সে। কিন্তু বিধিবাম, একদিন আব্বার হাতে ধরা পড়লো। ছাতা দিয়ে যে মারটা খেয়েছিলো এখনো সেই স্মৃতি অম্লান। সেই থেকে গল্পের বইয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিলো না জাওয়াদের। গল্পের বই এবং দোকান সম্পর্কেও তাই তার ধারণা ক্ষীন। জাওয়াদ ঠিক দীপশিখার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। দোকানে মানুষ গিজগিজ করছে। ছোট একটা দোকান অথচ খদ্দেরের অভাব নেই। জাওয়াদ তার পেছনের সারি করে রাখা বইয় থেকে একটা বই হাতে নিয়ে বললো,
“এই বইটা কি সংক্রান্ত? প্রেম টেম?”

দীপশিখা প্রথমে অন্য দিকে চেয়ে থাকলে জাওয়াদ দোকানীকেই শুধালো,
“এটার কাহিনী কি?”
“এইটা প্রেমের গল্প না ভাইজান। এইটা মার্ডার মিস্ট্রি”
“নাম এমন কেন? হিজ এন্ড হারস”
“দুজনের গল্প তাই”
“কাহিনী কি? এই চিংকি তুমি পড়েছো এটা?”

দীপশিখার একটি বাজে দূর্বলতা আছে। কেউ তার সামনে বই নিয়ে কথা বললে সে এড়াতে পারে না। যতই শত্রুতা থাকুক কেউ বই নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে তার মুখ উশখুশ করে উত্তর দেবার জন্য। এখনও তাই হলো। মুখ ফসকে বলে ফেললো,
“এটা মার্ডার মিস্ট্রি। প্রতি পর্বে এক একটা টুইস্ট। শুনে সেই মজা নেই”
“তুমি পড়েছো?”
“হুম”
“আচ্ছা, তাইলে এইটা নিলাম। আর কিছু ভালো বই বলতো। আমি আবার ইন্টারেস্টিং বই ছাড়া পড়তে ভালো লাগে না। তোমার ইউটিউব চ্যানেল আর পেজ থেকে তো আমাকে ব্যান করে দিয়েছো। নয়তো সেখানেই দেখে নিতাম”
“আমার ইউটিউব চ্যানেল আছে, আপনি জানলেন কি করে?”
“জ্যোতি বলেছে”

দীপশিখা আর কথা বাড়ালো না। সম্পর্কটা আগের মত হলে এখানে আরোও কিছু খোঁচা মেরে মজা নিত হয়তো। কিন্তু এখন ইচ্ছে হচ্ছে। জাওয়াদ একমিনিট শান্ত হলো না। এক এক বই হাতে নেয় আর শুধায়,
“এই বইয়ের কাহিনী কি? ভালো বইটা? তুমি পড়েছো? মার্ডার মিস্ট্রি নাকি এমনেই?”

দীপশিখা বই কেনার সময় বেশি কথা বলতে পছন্দ করে না। একারণে সবসময় বইয়ের দোকানে সে আসে একা। নিরিবিলি এক একটা বই হাতে নিবে, এক-দুই পেজ পড়বে, আগ্রহ হলে কিনে দিবে। এই প্রথম তার মনে হলো একটা জেদী মশা তার কানের কাছে ক্রমাগত ভ্যান ভ্যান করছে। বই কেনার সময় বারবার এমন উপদ্রব তার ভালো লাগছে না। লোকটিকে কড়া করে কিছু বলতে ইচ্ছে হলেও সেটা সম্ভব নয়। মানুষের ভিড়ে অহেতুক একটা সিন ক্রিয়েট হবে। দীপশিখা সেটা চায় না। দীপশিখা তাই ধৈর্য ধরে উত্তর দিচ্ছে। পড়ার মধ্যে কোনো বই হলে বলছে,
“এটা ভালো, পড়ে মজা পেয়েছি”

আর সেটা না হলে বলছে,
“জানা নেই”

একটা সময় দেখা গেলো দীপশিখার বইয়ের থেকে জাওয়াদের বইয়ের সংখ্যা বেশি। দীপশিখা বিস্মিত স্বরে শুধালো,
“এগুলো আপনি পড়বেন?”
“সন্দেহ আছে?”
“আছে। আপনার মতো মানুষের মধ্যে বইয়ের প্রতি আবেগ হবে এটা কল্পনা করাও ভুল”
“কি বলতে চাইছো? আমি আবেগহীন মানুষ?”
“না আপনি উচ্চতর পর্যায়ের গরু কিসামের মানুষ”

অনেকদিন বাদে দীপশিখার মুখে গালমন্দ শুনছে জাওয়াদ। তার রাগ হওয়ার কথা, তার যে দাম্ভিক সত্তা তাতে তার কথাটায় রাগ করা উচিত। অন্তত একটু চোখ কুঁচকানো তো আবশ্যক। কিন্তু এমন কিছুই হল না। বরং জাওয়াদের ঠোঁট বিস্তৃত হলো। একটা চমৎকার হাসি তার ঠোঁটে হল। ভেতরটা এমন অলীকমায়ায় টুইটুম্বুর হলো। দীপশিখা তার হাসিকে অগ্রাহ্য করলো। সব বই বাদ দিয়ে “গোরা” বইটা রেখে বলল,
“এটা পড়ুন। শেষ হলে অন্য একটা কিনবেন”

জাওয়াদ মাথা নাড়ালো। দীপশিখা পাকা ক্রেতার মতো দামদর করলো। টাকা জাওয়াদ দিতে চেয়েছিলো কিন্তু দীপশিখা অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“আমি আপনার দেওয়া কোনো কিছু নিব না”

কথাটা রুক্ষ্ণভাবে বললো দীপশিখা। জাওয়াদ পকেট থেকে বের করা টাকাটা আবার পকেটেই রেখে দিলো। বের হবার সময় দীপশিখার অমত সত্ত্বেও হাতখানা শক্ত করে ধরলো। খুব সাবধানে সরু গলি থেকে তাকে বের করলো। দীপশিখা হাত ছাড়াতে চাইলে গম্ভীর স্বরে বললো,
“দিনকাল ভালো না চিংকি, জেদ করো না”

দীপশিখা জাওয়াদের সাথে যাবে না এই ব্যাপারটি জাওয়াদের অজানা নয়। ফলে একটি সি.এন.জি ঠিক করে দিলো সে। দীপশিখা তার দিকে কঠিন নজরে তাকালেও সে সহজ গলায় বললো,
“উঠো, আমার সাথে তো যাবে না। এই সন্ধ্যেবেলা আমি তোমাকে একা ছাড়বো না। তুমি সি.এন.জি তে উঠো, আমি পেছনে আছি”
“এগুলো কেন করছেন?”

দীপশিখা থমথমে গলায় শুধালো। তার দৃষ্টি জাওয়াদে আবদ্ধ। দৃষ্টিতে উত্তর শোনার তীব্র আকাঙ্খা। জাওয়াদ মৃদু হাসলো। ধীর স্বরে বললো,
“এই রাতে আমি তোমাকে একা ছাড়বো না”
“কেনো?”

জাওয়াদ কিছুসময় চুপ করে খুব আস্তে বললো,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি চিংকি”

দীপশিখা তীব্র বিদ্রুপ নিয়ে হাসলো, হাসি অক্ষত রেখে বললো,
“এটা আপনার অনুশোচনা”
“না, আমার অনুশোচনা নয়। আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি”

দীপশিখার দৃষ্টি বিচলিত হলো। হয়তো শক্ত করে শাসন করে হৃদয়টা আবারো নড়েচড়ে বসলো যেন। চোখের দৃষ্টি নেমে এলো ঘোর আধার। টলমলে করে উঠলো যেন। সে “ভালোবাসি” শব্দটার জন্য কতগুলো বছর অপেক্ষা করেছে। কতগুলো বছর কাঙ্গাল হৃদয় এই এক শব্দের জন্য হাঁসফাঁস করেছে। ভেবেছিলো প্রতীক্ষিত মানুষটির মুখে শব্দটা না জানি কতটা শ্রুতিমধুর লাগবে। হৃদয় মায়ায় ভরে যাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হল না। বরং চিনচিনে ব্যথায় অস্থির হয়ে গেলো অন্তস্থল। এতোটা বিষাক্তও লাগে বুঝি কোনো শব্দ? দীপশিখা এখনো তাকিয়ে আছে। দুজনের মাঝে কোনো কথা হলো না। শুধু দৃষ্টির বিনিময়। ঘাত-প্রতিঘাত হলো যেন সেই দৃষ্টিতে। একটা সময় দীপশিখার চোখ বেয়ে নেমে গেলো অশ্রুধারা। খুব শান্ত স্বরে বললো,
“মাইকেল ড্রেইটনের এই কবিতাটা পড়েছেন?
“Since there’s no help, come let us kiss and part.
Nay, I have done, you get no more of me;
And I am glad, yea glad with all my heart,
That thus so cleanly I myself can free”
আমাদের অবস্থাটা ঠিক তেমন জাওয়াদ সাহেব। আমাদের মাঝের সমীকরণে এখন শুধু নৈরাশ্য ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। অহেতুক চেষ্টা করা ছেড়ে দিন”

বলেই সি.এন.জিতে উঠে বসলো দীপশিখা। সি.এন.জি চলছে। দীপশিখার চোখ ভিজে যাচ্ছে। শরীরের প্রতিটি অংশ থেকে নিঙড়িয়ে আসছে যেন এই অশ্রু। এতোটা দুঃখ সে আগলে রেখেছিলো। অন্তঃস্থলে আগলে রাখা টুকরো টুকরো আবেগগুলো গলে যাচ্ছে সেই অশ্রুর সাথে। একটা সময় বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগলো সে। সি.এন.জিওয়ালা বললো,
“আপনি কি অসুস্থ আফা?”

উত্তর দিলো না দীপশিখা। বাসা অবধি সে কেঁদেছে। মনের যন্ত্রণাগুলো বিষাদসিন্ধুর ঢেউ এ ভাসিয়ে দিয়েছে। সি.এন.জি থেকে নেমে দেখলো ঠিক তার পেছনে জাওয়াদের বাইক। সে সত্যি এসেছে? কি চাইছে সে? চিংকি সব ভুলে তাকে ক্ষমা করে দিবে? এতোই সহজ? আঘাত করে সরি বলে দিলেই সব মাফ? এতোই সহজ ভালোবাসা? ভাঙ্গা কাঁচ যতই লাগানোর চেষ্টা করা হোক চিরের দাগ ঠিক থাকে। চিংকির এই দাগটা গাঢ়। খুব গাঢ়। চিংকিকে একচোখে দেখছে জাওয়াদ। মেয়েটা ভেতরে চলে গেছে। অথচ তার তৃষ্ণা মেটে নি। আরোও দেখতে ইচ্ছে করছে। কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। প্রেম জঘন্য জিনিস। সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। প্রেমের মতো ঘুনপোকা জগতে দ্বিতীয়টি নেই। সে শুধু শরীরের খাঁচাটা রাখে, বাকিসব ধ্বংস করে ফেলে।

*****

শুক্রবার বিকেল। ছোট একটি কফি শপে বন্ধুদের সাথে বসে রয়েছে জাওয়াদ এবং পাভেল। আজ তাদের এক কলেজের বন্ধুর বিয়ে ছিলো। বিয়ের পরও আড্ডা শেষ করতে ইচ্ছে হলো না। কলেজের পর এমন একত্রিত হবার সুযোগ হয় না। জাওয়াদের বিয়ে হলে হয়তো তারা আবার একত্রিত হত। জাওয়াদের বিয়ে ভাঙ্গা নিয়েও অনেক কৌতুহল সবার। তাই এই কফিশপে বসা। যদিও গল্পের মাঝে জাওয়াদ খুব অন্যমনস্ক। দশটা প্রশ্নের একটির উত্তরও সে দিচ্ছে না। তার ইচ্ছে ছিলো এখানে আসার। কিন্তু পাভেলের জোরাজুরিতে আসতে হলো। গল্পের মাঝে ফোঁড়ন দিলো সোহেল নামের ছেলেটি। সে কৌতুহলী স্বরে শুধালো,
“এই এটা আমাদের সেন্টিখোর আদিব না?”

সাথে সাথেই সকলের নজর কফিশপের জানালার দিকের টেবিলে গেলো। পাভেল কৌতুক করে বললো,
“আসলেই তো, জাওয়াদের বেস্টু আদিব। ফেয়ারওয়েলের স্মৃতি তাঁজা হয়ে গেলো রে। কি সিনটাই না করেছিলো জাওয়াদের সাথে। যা জাওয়াদ, প্রাক্তন বেস্টুর সাথে অন্তত করমর্দন করে আয়। আফটার অল একমাত্র এই পাবলিকের জন্যই আমরা তোকে মারামারি করতে দেখেছি”

পাভেলের কৌতুক অন্যসময় কাজে দিত। কিন্তু আজ দিলো না। জাওয়াদের চোখ মোটেই আদিবকে দেখছে না। দেখছে আদিবের সম্মুখে নীল শাড়ি পড়া রমনীর দিকে। চিংকি আদিবের সাথে কি করছে?…………

চলবে

#স্বপ্নে_দেখা_রাজকন্যা
#২৫তম_পর্ব

জাওয়াদের চোখ মোটেই আদিবকে দেখছে না। দেখছে আদিবের সম্মুখে নীল শাড়ি পড়া রমনীর দিকে। চিংকি আদিবের সাথে কি করছে? জাওয়াদের মুখশ্রীতে আষাঢ়ের মেঘ জমলো। চোয়াল শক্ত হলো। আদিব জাওয়াদের বাল্যবন্ধু। বন্ধু শব্দটা আদিবের ক্ষেত্রে খাটে না। সে বন্ধুত্বের মর্ম বুঝে না। বন্ধুত্ব হতে হয় নিঃস্বার্থ। কিন্তু আদিবের বন্ধুত্বে স্বার্থন্বেষী চিন্তাধারা আর ঈর্ষা লক্ষ করেছে জাওয়াদ। সে সর্বদা মুখে মিষ্টতা আর হৃদয়ে বিষ নিয়ে ঘোরা মানুষ। হরহামেশা জাওয়াদের সফলতায়, জনপ্রিয়তা ছিলো তার চক্ষুশূল। শুধু চক্ষুশূল হলে হয়তো জাওয়াদ ব্যাপারটিকে উপেক্ষা করে যেত। কিন্তু সে রীতিমত সুযোগ খুজতো জাওয়াদকে হেনস্তা করতে। জাওয়াদের এখনও মনে আছে আদিব একটি মেয়েকে পছন্দ করতো। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত মেয়েটি তার প্রেমকে প্রত্যাখান করে। উপরন্তু সে জাওয়াদের উপর মোহিত ছিলো। আদিব বিশ্বাস করেই নিয়েছে মেয়েটি জাওয়াদের জন্য তাকে প্রত্যাখান করেছে। জাওয়াদ তার গভীর প্রণয় জানা সত্ত্বেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বন্ধু হয়ে তার পিঠে ছোরা মেরেছে। যা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। জাওয়াদ মেয়েটি সম্পর্কিত কিছুই জানতো না। কি অদ্ভূত! জাওয়াদের এখনো কলেজের ফেয়ারওয়েলের দিনটি মনে আছে। ক্লাসের সামনে এই আদিব তাকে বিশ্রীভাবে অপমান করেছিলো। সবার সামনে জাওয়াদকে বিশ্বাসঘাতক বন্ধুরুপে প্রতীয়মান করতে চেয়েছে। অথচ জাওয়াদ কখনো তার বন্ধুদের খারাপ চায় নি। আদিবের এহেন কাজ জাওয়াদকে আঘাত করেছিলো। শুধু তাই নয়, জাওয়াদের মতো গোছানো, পরিপাটি, স্থিরচিত্তের মানুষ মারামারি করেছিলো। কারণ সে ধৈর্য্যচ্যুত হয়েছিলো। আহত হয়েছিলো। আদিবকে সে ঘৃণা করে। সেই মানুষের সাথে চিংকি কি করছে—চিন্তা করতেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেলো।

*****

দীপশিখা চুপ করে বসে রয়েছে। একপ্রকার বাধ্য হয়ে সে এখানে এসেছে। মা উঠে পড়ে লেগেছেন বিয়ের জন্য। এই পাত্রের খোঁজ বড়খালা দিয়েছেন। পরশু সকালে তিনি হুট করে ফোন করেছেন। কণ্ঠে অসীম ব্যস্ততার ভঙ্গি এবং জোরালো ভাব। নিরুপমা ফোন ধরতেই ধমকের স্বরে বললেন,
“সকাল সকাল কি হিমালয়ে গিয়েছিলি? ফোন ধরতে এতো সময় লাগে কেন?”

নীরুপমাও খামখেয়ালি স্বরে বললো,
“আপা কেউ সারাদিন কাজকর্ম ছেড়ে ফোনের পাশে বসে থাকে না”
“ওরে আমার কামের বেটি। বকিস না বেশি। শোন, একটা সুসংবাদ আছে। সুসংবাদ দেওয়ার জন্য ছটফট করে মরছি অথচ তোদের কাছে আমার দাম নেই। মরে গেলে বুঝবি কি অমূল্য জিনিস হারিয়েছিস। বুঝলি! আজকাল কারোর সময় আছে অন্যের জন্য কিছু করার? আমি করছি। তোদের উচিত আমার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকা।”
“তুমি বেশি কথা বলো আপা। আসল কথা বল”
“কথা হল তোর ছোট মেয়ের জন্য একটা লাখে একটা ছেলে পেয়েছি। তোর ঐ নাবিক জামাইয়ের মত কোনো গরুকে তুলে আনি নি। এই ছেলে যে সে ছেলে নয় ডাক্তার ছেলে। তাও আবার এভারকেয়ারের ডাক্তার। বুঝতে পারছিস? দামী হাসপাতাল। শুনেছি ডাক্তাররা নাকি তাদের পরিবারের লোকদের ফ্রি চিকিৎসা দেয়। কি সুবিধা বুঝতে পারছিস? ধর হুট করে মোস্তফার বুকে ব্যথা শুরু হল, ডাক্তার জামাই চট করে একটা ব্যবস্থা করে ফেলবে। আইসিউ, সিসিউ তো ওদের হাতেই। নাবিক জামাইয়ের মত না, আসতে আসতেই শ্বশুর পটল তুলেছে আর জামাই সাগরে সাঁতরাচ্ছে”

চিংকির বড়খালার বেশি কথা বলার বাতিক। ছেলে তার যে খুব পছন্দ হয়েছে এটা সেটারই লক্ষণ। সে সর্বদা নিজেকে উচু পর্যায়ে রাখতে চান। এতে তিনি অসীম আনন্দবোধ করেন। এই আনন্দ পেতে অন্যকে নিচু করতে দ্বিধাবোধ করেন না। নীরুপমা ধিমি স্বরে বললো,
“ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বুঝি না, ছেলে কেমন?”
“ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বুঝিস না মানে? ছেলে ডাক্তার, মানুষ বাঁচায়। এতেই স্পষ্ট ছেলে ভালো। আর বদ অভ্যাসের কথা বলতে গেছে শূন্য। ছেলে অতিভদ্র। আমি কথা বলেছি। অমায়িক আচরণ। তোর খাটাস মেয়ে যা বলবে মাথা নাড়াবে। এমন ছেলেই তো চাই। নীরু দেরি করিস না। ছেলের মার্কেট এখন উত্তপ্ত। ডাক্তার ছেলে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না বললে চলে। তাই লুফে নে”
“আচ্ছা, আমি মোস্তফার সাথে কথা বলছি”
“ঐ ছাগল কি বুঝে?”
“কিছু না বুঝলেও মেয়ের বাবা সে”
“আবার বলছি, ছেলের চাহিদা আকাশছোঁয়া। আমি অনেক কষ্টে ঠেকিয়ে রেখেছি। নয়তো মেয়ের মায়েরা কিন্তু লাফাচ্ছে ছেলেটাকে জামাই করতে”

নীরুপমা ফোন রেখে দিলেন। দীপশিখা তখন বাটিতে মুড়ি ঢালছিলো। সকাল এগারোটায় মানুষ নাস্তা খাবে। হয় পাউরুটি নয় রুটি নয় পরোটা। অনেকে ভাত খায়। কিন্তু দীপশিখা মুড়ি মাখছে। তাও মাংসের আচারের ঝোল দিয়ে। এই আচারটা মোস্তফা নিয়ে এসেছেন। অমৃত স্বাদ বলে সে আখ্যা দিয়েছে। তাই দীপশিখা সেই অমৃত দিয়ে মুড়ি মাখছে। অস্বাভাবিক কাজ। স্বাভাবিক মানুষ অস্বাভাবিক কাজ করে না। কিন্তু আজ দীপশিখা অস্বাভাবিক কাজ করছে। তার মনে অসীম আনন্দের লহর বইছে। এমন হওয়ার কথা নয়। তার জীবনে কোনো আনন্দের ঘটনা ঘটে নি। অথচ তার সকালের ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই আনন্দ লাগছে। তার ধরনীতে কোনো দুঃখ নেই। দুঃখ অলীক কল্পনা তার অস্তিত্ব তার পৃথিবীতে নেই। দীপশিখা সেই সুখেই মুড়ি মাখিয়ে খাবে। খুব ঝাল দিলো যেন ঠোঁট পুড়ে যায়। মাঝে মাঝে ঝালে নাক মুখ আঁধার করে খেতে ইচ্ছে করে। মাথা থেকে ধোঁয়া ছুটবে এমন ঝাল। নীরুপমা তার এমন মুড়ি খেতে দেখে কঠিন গলায় বললেন,
“তোমার জন্য চিয়া পুডিং ফ্রিজে আছে। সেটা ছেড়ে কি খাচ্ছো এগুলো?”

দীপশিখা চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকালো। মৃদু হেসে বললো,
“আমার মুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে”

নীরুপমা কাঠ গলায় বললেন,
“তোমার এসব অনিয়মের জন্য স্বাস্থ্যের এই হাল। আজকালকের মেয়ে তুমি। হবে ফিগার কন্সাস। অথচ কি অবস্থা?”

দীপশিখা উত্তর দিলো না। সে মন দিয়ে মুড়ি খাচ্ছিলো। নীরুপমা তখন বললেন,
“তোমার বড়খালা একটি ভালো ছেলে খুঁজেছে। ছেলেটির সব ডিটেইলস উনি আমাকে পাঠাবেন বলেছে। তাই নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলো”
“আমি বিয়ে করবো না মা”
“কি বললে?”
“আমি বিয়ে করবো না। আমার এসব ভালো লাগছে না”
“বুঝেছি। আমি ছেলেটির ছবি তোমাকে পাঠাচ্ছি। দেখা করে আসবে”
“তুমি জোর কেন করছো মা?”
“কারণ আমার মানসম্মান এখানে জড়িত। বাকিটা তোমার ইচ্ছে”

দীপশিখা মায়ের কথায় আহত হলো। মায়ের জেদ সে জানে। এখন যদি দীপশিখা অমত করে তবে তিনি অখুশি হবে। মুখে কিছু বলবেন না। কিন্তু তার অভিমান, রাগ ছলকাবে ঘরময়। বাবাও তখন কিছু করতে পারবেন না। ফলে মনের বিরুদ্ধে একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই পাত্রের সাথে দেখা করা।

দীপশিখার সম্মুখে কতিপয় ডাক্তার পাত্র বসে আছে। আদিব মাহতাব তার নাম। আদিব মাহতাবের প্রশংসায় বড়খালা পাঁচশত শব্দের রচনা লিখে পাঠিয়েছে দীপশিখাকে। দীপশিখা অবশ্য তা পড়ে নি। লোকটির মধ্যে একটা ব্যস্ত, ব্যস্তভাব আছে। পাত্রী দেখার আগ্রহ হয়তো নেই তার। দীপশিখা লাস্যময়ী রমনী নয় যে কেউ তাকে দেখে মুগ্ধ হবে। ফলে লোকটি আসার পর থেকে যে একটিবারও তাকে ভালো করে লক্ষ করে নি ব্যপারটি লক্ষ করেছে দীপশিখা। সে একবার ঘড়ি দেখছে, মেন্যু দেখছে। একবার কৃত্রিম হাসি লেপ্টে শুধালো,
“কি খাবেন?”

দীপশিখা বললো,
“যা আপনার ইচ্ছে অর্ডার করুন”
“ওকে”

দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলো না। দীপশিখা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সময়টা কাটলে হয়। কিন্তু এর মধ্যেই তার সম্মুখে খাম্বার মতো দাঁড়ালো সুউচ্চ যুবক। তার কন্ঠে অসীম বিরক্তি এবং কৌতুহলের সংমিশ্রণ,
“দীপশিখা, কেমন আছো? তোমাকে এখানে দেখবো কল্পনা করি নি”

দীপশিখা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। জাওয়াদকে এখানে দেখবে সে আশা করে নি। থতমত কণ্ঠে বললো,
“আপনি?”

এর মধ্যেই আদিব মাহতাব নামক পুরুষটি বলে উঠলো,
“জাওয়াদ যে, হোয়াট এ্যা প্ল্যাজেন্ট সারপ্রাইজ! কেমন আছিস?”

জাওয়াদ একবার চোখ ছোট ছোট করে চাইলো আদিবের দিকে। তারপর তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দীপশিখাকে শুধালো,
“তুমি কি একে চেনো?”

কণ্ঠে কেমন যেন খবরদারিভাব অনুভূত হলো দীপশিখার। ফলে সে সহজ গলায় বললো,
“চেনার জন্যই আসা। আমার সাথে আপনার বোধহয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা নেই, তাই দয়া করে আমাদের ডিসটার্ব করবেন না”
“মানে?”
“মানে উনার সাথে বিয়ের কথা চলছে। আমরা কাইন্ডা ডেটে এসেছি টু নো ইচ আদার। সো আপনি ইন্টারাপ্ট করছেন”
“তুমি একে বিয়ে করবে?”

জাওয়াদের কণ্ঠে স্পষ্ট রাগ প্রতীয়মান হলো। সে চেঁচিয়ে বললো কথাটা। ফলে রেস্টুরেন্টের সকলের দৃষ্টি তার উপর চলে এলো। দীপশিখার অস্বস্তি লাগছে। এর মধ্যিখানেই আদিব বলে উঠলো,
“তোরা একে অপরকে চিনিস?”

জাওয়াদ কঠিন স্বরে বললো,
“সেটা দিয়ে তোর কোনো কাজ নেই। নিজের চড়কায় তেল দে”
“এক্সকিউজ মি”

জাওয়াদ আবার দীপশিখাকে শুধালো,
“আমি জানি আমাকে তোমার জীবনে কোথাও তুমি রাখতে চাও না। কিন্তু তাই বলে……

জাওয়াদের কথাটা শেষ হতে দিল না দীপশিখা। সে উঠে দাঁড়ালো। আদিবকে সরল গলায় বললো,
“মিস্টার আদিব, আপনি মাইন্ড না করলে আমি এখান থেকে যেতে চাচ্ছি। আমার এখানে ভালো লাগছে না”

জাওয়াদের বুকের চিনচিনে ব্যথাটা তীব্র হলো। অসহনীয় হয়ে উঠলো যেন। একেই দীপশিখার থেকে চোখ সরতেই চাইছে না তার। উপর থেকে দীপশিখার এই আদিবের সাথে বিয়ের কথা হচ্ছে ব্যপারটি তার অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ তার চোখে পেঁয়াজের রস ঢেলে দিয়েছে। দীপশিখা দাঁড়ালো না। সে বেরিয়ে গেলো। তার পিছু পিছু আদিবও বেরিয়ে গেলো।

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই আদিব শুধালো,
“আপনারা একে অপরকে চিনেন?”
“আমার সাথে বিয়ের হবার কথা ছিলো। কিন্তু বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে”
“কেন ভাঙ্গলো?”

দীপশিখা চুপ করে রইলো। উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না। সে হাটতে শুরু করেছে। বাতাস বইছে। চৈত্র সমীরণ। দীপশিখার এই সমীরণের স্পর্শ ভালো লাগছে। কারণ অবশ্য আছে। আদিব পেছনে চাইলো। জাওয়াদের মুখশ্রীতে তীব্র বিষাদের ছায়া। তার চোখ টলমল করছে। কিছু একটা ভেবে সে পা বাড়ালো দীপশিখার সাথে।

***

আদিব যতটা ব্যস্ত ভঙ্গি দেখিয়েছিলো। পড়ে অবশ্য তেমন ব্যস্ততা দেখালো না। একঘন্টা কাটানোর পর তাকে বাসায় পৌছে দিলো সে। বাসার গেটের কাছে আসতেই জাওয়াদকে দেখতে পেলো দীপশিখা। তাদের চোখাচোখি হলো। দীপশিখা কেঁচিগেট খুলতে যাবে ঠিক তখনই পেছন থেকে জাওয়াদ তাকে জড়িয়ে ধরলো। শক্ত সে বাধন। কপাল কাঁধে ঠেকিয়ে কাতর স্বরে বললো,
“প্লিজ তুমি আমাকে একটি সুযোগ দেও”…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি