স্বামী পর্ব-০১

0
1039

#গল্পঃস্বামী
#পর্বঃ১
#লেখকঃপারভেজ_ইসলাম

করূণ চাহনীতে সোফায় বসে থাকা দুইজন ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে তাদের প্রেমলীলা দেখেই যাচ্ছি।দুইজন ব্যক্তির একজন হলেন আমার স্বামী রাইহান চৌধুরী আর অন্য একজন হলেন আমার স্বামীর অফিসের বস হৃদিতা তাসমিন।হৃদিতা আমার স্বামীর বুকের উপর শুয়ে তাকে কিছু বলে চলেছে।আর রাইহান হৃদিতার বাহু ধরে গভীর মনেযোগে তার কথা শুনছে।আমি নামের এক প্রাণী যে তাদের সামনে তাদের প্রেমলীলা দেখছি দুইজনে খুব ভালো করেই জানে।তাও তাদের আমার উপস্থিতি নিয়ে কোনোরকম মাথাব্যথা নেই।কারণ একটু আগেই আমি ডিভোর্স পেপারসে সাইন করে রাইহানকে চিরদিনের জন্য মুক্ত করে দিয়েছি।রাইহান হেসে হেসে হৃদিতার কথা শুনতে শুনতেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

রাইহানঃতুমি এখনো আমার বাসায় দাঁড়িয়ে আছো?এখনি নিজের সবকিছু নেও নিয়ে বেরিয়ে যাও।

আমিঃ……

রাইহানঃকিহ হলো আমি কিছু বলেছি শুনতে পাওনি জান্নাত?

“জান্নাত” ৭ বছরের পরিচয়ে প্রথম রাইহানের মুখ থেকে নিজের সম্পূর্ণ নাম শুনলাম।কাল অবধি সে আমাকে জান বলেই ডেকেছে।কিন্তু আজকে আমি এক দিনের ব্যবধানেই অন্য সবার মতো তার কাছেও জান্নাত।আমি কাঁদতে কাঁদতে তাকে বললাম,

আমিঃআমি চাইতেও আমার সব নিতে পারব না রাইহান।আমার সব কিছু যে তুমিই।আর সেই তুমিই যে আজ অন্যকারো।

রাইহান বিরক্তি মাখা চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললঃএসব সিনেমার ডায়ালগ আমার সামনে বলে কোনো লাভ নেই।তোমার উপর থেকে মন অনেক আগেই উঠে গেছে।এখন সবই শুধু হৃদিতা।

কথাটুকু বলেই হৃদিতার মুখের উপরে থাকা চুল গুলো আলতো করে সরিয়ে দিয়ে হৃদিতার নাকের সাথে নিজের নাকটা ঘষে নিলো।

আমি আর কিছু বললাম না।নিজের চোঁখ মুছে আমার রুম না এখন আর আমার রুম বলে সম্বন্ধোন করা চলে না।হৃদিতা আর রাইরানের রুমের দিকে পা বাড়ালাম।রুমে ঢুকতেই চোঁখ পড়ল দেয়ালে টাঙানো আমার আর রায়হানের ছবিটার দিকে।প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে রাইহানের থেকে উপহার পেয়েছিলাম।এখন সবই শুধুমাত্র স্মৃতি।

রাইহানের সাথে পরিচয় হয়েছিল বাসের মধ্যে।দুইজনি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ার খাতিরে বাসেই যাতায়াত করতাম।বাসের মধ্যে এক লোক বেয়াদবি করলে আমিও প্রতিবাদ করি।কিন্তু সেই লোক উলটো আমাকে কথা শুনাতে শুরু করে।বাসের মধ্যে কেউ আমার হয়ে সেই লোককে কিছু বলে না।আমিও সেই লোককে কিছু বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছিলাম।কিন্তু হঠাৎ করে দেখি একজন আমার সামনে এসে আমার ঢাল হয়ে দাঁড়ায়।সেই অসভ্য লোকটার কলার ধরে অনেক বকুনি দিয়েছিল।তাকে বলেছিল”যখন কোনো নারীকে দেখে মনে অসভ্যতামি জন্ম নেবে তখন সেই মনকে বলবি আল্লাহ চাইলে তুইও কিন্তু সেই নারীর গর্ভ থেকেই দুনিয়ায় আসতিছ”কথাটুকু বলেই লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেই।প্রথম দিন তাকে ভাইয়া বলেই ডেকেছিলাম।এরই পর থেকে রোজ বাসে দেখা হতো।প্রায় দিন তার পাশে বসতাম,আবার প্রায় দিন সে উঠে আমাকে বসার জায়গা করে দিতো।একসাথে যাতায়াত করতে করতেই প্রথমে ভালোলাগা তারপরে ভালোবাসা।

এসব ভাবতে ভাবতেই আলমাড়ি খুললাম।খুলতেই চোঁখ আটকে গেল বিয়ের শাড়িটার দেখে।একটা সবুজ রঙের সুতির শাড়ি।আসলে আমরা পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম।আমার আব্বু মেনে নেননি আমাদের সম্পর্ক।অনেক বড় এক ঘরের ছেলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়।তার সাথেই ঠিক হয়েছিল বিয়েটা।লোকটাকে একবারই দেখেছিলাম।সে নাকি আমাকে একদিন রাস্তায় দেখে।তারপর প্রস্তাব পাঠায়।কিন্তু আমরা দুইজন জানতাম পরস্পরকে ছাড়া সুখী থাকা অসম্ভব।তাই তো পালিয়ে আসি বিয়ের আগের দিন রাতে।প্রথম প্রথম খুব কষ্টে দিননিপাত করেছি।আমি আর রাইহান মিলে টিউশনি করেছি সংসার চালিয়েছি।তখন আমাদের টাকা না থাকলেও দুইজনের জন্য দুইজনের মনে অনেক ভালোবাসা ছিল।কিন্তু আজ রাইহানের কাছে টাকা থাকলেও ভালোবাসাটা আছে শুধু আমার একার মনেই রয়ে গেছে।আম্মু আব্বু আর আমাকে মেনে নেননি।বিয়ের এই ৩ বছরে একবারের জন্যও আব্বু আম্মুর মুখ দেখা তো দূরে থাক কণ্ঠ পর্যন্ত শুনতে পায়নি।আম্মু আব্বু কার এক্সিডেন্ট এ মারা গিয়েছেন ৪ মাস।তাদেরকে শেষ দেখা দেখিনি আমি।খুব কেদেছিলাম সেই দিন রাইহানকে জড়িয়ে ধরে।রাইহান আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেছিলঃপ্লিজ এইভাবে কেদো না জান।তুমি জানো না তুমি কাদলে আমার খুব কষ্ট হয়।আমি তো আছি তোমার সাথে এই যে তোমাকে জড়িয়ে ধরে।

আমিঃতুমিও যদি ছেড়ে চলে যাও তখন?

রাইহানঃতোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব কল্পনাতেও আনতে পারিনা।

আজকেও এই আমি কাদছি তাও রাইহানের সামনে,রাইহানেরি জন্যে।কিন্তু রাইহানের কাছে আমার চোঁখের পানির আর কোনো মূল্য নেই।আমার এই কান্না মাখা চাহনি এখন আর তার হৃদয়ে আঘাত হানে না।বেশ কয়েকদিন ধরেই তার অবহেলা নজর কেড়েছিল আমার।ভেবেছিলাম অফিসের কাজে ব্যস্ততার জন্য।কিন্তু আজ সকালে তার অফিসে গিয়ে অজন্তেই তার কেবিনে ঢুকে পরি সারপ্রাইজ দিতে।কিন্তু কে জানত তাকে সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে যাবো।হুম রাইহান চেয়ারে আর তার বস তার কোলে বসে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে দুইজনে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠ।হঠাৎ করে রাইহানের চোঁখ পড়ে আমার উপর।আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার কারণে এবার হৃদিতাও ঘুরে আমার দিকে তাকায়।আমাকে দেখেও সে রাইহানের কোলে বসে থাকে।আসলে আমার স্বামী মাশাল্লাহ যেকোনো রমণীই তার প্রেমে প্রথম দেখাতেই পড়ে যেতে পারে।আমি আর কিছু না বলেই কাঁদতে কাঁদতে চলে আছি।

ড্রয়ংরুমের সোফায় বসেছিলাম।ভেবেছিলাম রায়হান এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলবে”ভুল করে ফেলেছি।অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি প্লিজ মাফ করে দেও।শেষবারের মতো মাফ করে দেও।আমিও আমার মনকে রাইহানকে মাফ করার জন্য মানিয়ে নিয়েছিলাম।একটু পরেই কলিংবেল এর শব্দ পেতেই গেটের দিকে ছুটে যাই।গেট খুলতেই দেখি রাইহান।তার পাশেই দাঁড়িয়ে হৃদিতা।হৃদিতার পাশে দেখি তার ট্রলি ব্যাগ।রাইহান আমাকে কিছু না বলার সুযোগ দিয়েই ভিতরে চলে যাই।পিছন পিছন হৃদিতা সবার শেষে আমি গেট লাগিয়ে এসে দাঁড়ায় দুইজনের সামনে।আমি যেতেই রাইহান আমার সামনে একটা কাগজ রাখে।আমি গিয়ে কাগজটা উঠাতেই দেখি ডিভোর্স পেপার।রাইহানের দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই বলে,

রাইহানঃসাইন করে দেও।

আমিঃরাইহান তোমার কিহ মাথা ঠিক আছে?কি বলছো কি তুমি?ডিভোর্স পেপারস।

রাইহানঃতুমি বাচ্চা না।সব বুঝো।আজকে অফিসে আমাদের দেখার পর আশা করি বুঝেছো।তুমি জানো খুব ভালো করেই জানো আমি যা বলার সরাসরি বলি।আমি তোমার থেকে ডিভোর্স চাই।

আমিঃকিন্তু হঠাৎ করে।কালকেও তো সব ঠিক ছিল।সকালেও যাওয়ার সময় বললে রাতে জলদি ফিরে আসবে এখন?

রাইহানঃএতো কথা না বাড়িয়ে সাইনটা করে দেও।

আমিঃকারণ না বললে আমি সাইন করবনা রাইহান।

রাইহানঃতাহলে শোনো এখন আমার আর ভালো লাগে না তোমাকে।বোর হয়ে গেছি তোমার সাথে থাকতে থাকতে।স্মার্টনেস বলতে কিছু নেই তোমার মধ্যে।তোমাকে নিয়ে যখন লোকজনের সামনে যাই লজ্জা লাগে আমার।

আমিঃকিন্তু রাইহান আমি তো এমনি।আর এইজন্যই তো তোমার আমাকে এতো পছন্দ।

রাইহানঃতখন ভিন্ন পরিস্থিতি ছিল।আমি তখন সামান্য ইমপ্লই ছিলাম আর এখন আমি এতো বড় অফিসে কাজ করি।তোমার মতো আনস্মার্ট,মিডিলক্লাশ ফ্যামিলির মেয়ের সাথে কোথাও গেলে আমার নাক কাটা যাই।শুনেছো আমার নাক কাটা যাই।

আমিঃতুমি এই সামান্য কারণে আমাকে ডিভোর্স দিবে?

রাইহানঃকারণটা তোমার কাছে সামান্য হলেও আমার কাছে সামান্য নয়।আর তাছাড়াও আই ডিজার্ভ সামওয়ান লাইক হৃদিতা।সো সাইন করে দেও।আর ডিভোর্স এর সব ফর্মালিটি পূরোণ করে দেবো আমি।টাকাও দিয়ে দেবো।

আমি আর কথা নাহ বলে সাইন করে দিলাম।এর পরেই সব ঘটনা উপরেই বলেছি।

নিজের বলতে যা ছিলো সবই হৃদিতাকে দিয়ে দিয়েছি।এখন আর নিজের বলতে কিছুই নেই।আমি একটু একটু করে পরম যত্নে সাজিয়েছিলাম এই সংসারটাকে।কিন্তু এই এক হৃদিতা নামের ঝড়ের কোবলে পড়ে সাজানো গোছানো সংসারটা ধ্বংস হয়ে গেল।আলমারির ড্রয়ার খুলে প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্টটা ব্যাগে ভরে নিলাম।আমি প্রেগন্যান্ট জেনেছি সপ্তাহ খানেক আগে।রাইহানের ব্যস্ততা আর অবহেলা সামলাতে গিয়ে বলার সময় হয়ে উঠেনি।এখন চাই না রাইহান আর জানুক।নিজের কয়েকজোড়া কাপড় নিতে নিতেই আওয়াজ পেলাম রাইহান বলছেঃআর কতোক্ষন।প্লিজ একটু জলদি করো।আমি আর হৃদিতা একান্তে কিছু সময় কাটাতে চাই।

আমি আবার জোরে জোরে কেদে দিলেও নিজেকে সামলে নিলাম।ভাবতেই বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠছে যার জন্য একদিন সবছেড়ে এসেছিলাম,,আজকে তার জন্যই সব ছেড়ে চলে যাচ্ছি।এটাই আমার ভাগ্য।

রুম থেকে বের হতেই দেখি দুইজনে টি টেবিলের উপর পা তুলে বসে আছে।হৃদিতা আপেল খাচ্ছে আর রাইহান টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছে।আমি তাদেরকে কিছু বললাম না চুপচাপ চলে আসলাম।

কাঠফাঁটা রোদের মধ্যে ফুটপাত দিয়ে হাটছি।অন্যদিনের তুলনায় আজকে গরমটা অনেক বেশি।বেসামাল গরম আজকে।সহ্য হচ্ছে না।তাও হাটছি।কোথায় যাবো জানি না।পরিচিত বলতে এই পৃথিবীতে কেউ নেই।রাইহান এতিম।তাই শ্বশুরবাড়ি বলতে কোনো বাড়ি আমার জন্যে নেই।আল্লাহ রিজিকের মালিক।আর হাটতে পারছি নাহ।হঠাৎ করে মাথার মধ্যে কেমন একটা পরিবর্তন ঘটেছে।মাথা ঘুরছে প্রচুর।আর কিছু বুঝতে পারলাম না।

চলবে।