স্মৃতির শহর পর্ব-১১

0
547

#স্মৃতির শহর
#পর্বঃ১১
#তানিশা সুলতানা

খুব ভালোই যাচ্ছে দিন। দুই দিন কেটে গেছে। আজকে আদি রাইকে নিয়ে ওই ফ্লাইটে চলে যাবে। রাইয়ের মনটা ভীষণ খারাপ। তার সাথে পুরো পরিবারেরই মন খারাপ। এই দুটো দিন সবাই রাইকে নিয়ে মেতে ছিলো। এতো ভালোবাসা আগে কখনো পায় নি রাই।
চুপচাপ বসে আছে রাই। আদি রাইয়ের চুল আচড়ে দিচ্ছে। কোনো কথা বলছে না। অন্য সময় হলে রাই বাধা দিতো কিন্তু এখন মুড নাই।
“মন খারাপ?
আদি জিজ্ঞেস করে।
আদির কথায় রাইয়ের রাগটা বেরে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ কন্ট্রোল করে।
” না তো খুব খুশি আমি। দেখে বুঝতে পারছেন না?
শক্ত গলায় বলে রাই।
আদি চিরুনি রাখে। রাইয়ের সামনে গিয়ে বসে। রাই মুখ ফিরিয়ে নেয়।
“তুমি বিহানের মুখোমুখি হতে চাও না। আর আমি তোমাকে বিহানের মুখোমুখি করতে চাই৷ আমি বিহানকে দেখাতে চাই তুমি আমার সাথে খুব ভালো আছো। আর আমি তোমাদের খুব ভালোবাসি।
রাইয়ের চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। তাচ্ছিল্য হাসে।
” এতোদিনে আমি এটা বুঝতে পেরেছি বিহান আর আপনি শএু। কিন্তু শুধুমাত্র বিহানকে দেখানোর জন্য আমাদের দায়িত্ব আপনি নিয়েছেন সেটা আজ খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন।
সারাজীবন কৃতিঙ্গ থাকবো আপনার প্রতি। তবে আমাদের দয়া দেখাতে গিয়ে নিজের লাইফ বরবাদ করে দিচ্ছেন। খুব তারাতাড়ি সেটাও রিলাইজ করতে পারবেন আর আমাদের ছেড়ে দেবেন।
আমি না হয় সেই দিনটারই অপেক্ষায় রইলাম।
বলতে বলতে চোখের পানি গড়িয়ে পরে রাইয়ের। আদি চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয়। এই মেয়েটা সব সময় উল্টো বুঝে। কি ধাতু দিয়ে গড়া এই মেয়ে?
রাই চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ায়।
“আমি গাড়িতে বসছি আপনি আসেন।
বলেই রাই রুম থেকে চলে যায়।
” তুমি কবে চিনবে আমায়? কবে বুঝবে? আমি যে তোমাকে কতোটা ভালোবাসি সেটা তুমি বুঝতে পারো না? সব সময় ভুল বোঝো কেনো? বলোতো? অভিমান তো আমারও হয়। অনেক অভিযোগ তো আমারও আছে। কিন্তু সেগুলো প্রকাশ করতে পারি না আমি।
কারণ তুমি তো শুধু ভুল বুঝতেই পটু।

চোখ মুখ মুছে রাই সামনে তাকাতেই বুকের ভেতর মোচর দিয়ে ওঠে রাইয়ের। বিহান আর বিহানের মা বসে আছে।আর ওদের মুখোমুখি বসে আছে আদির বাবা মা। ওনাদের মুখ শুকনো। আর বিহানের ঠোঁটে ঝুলে আছে মিষ্টি হাসি।
“আজকেই নিশ্চয় এই বাড়িতে আমার শেষ দিন।
বুকটা ভারি হয়ে আসে রাইয়ের। তবে রাই ঠিক করে নিয়েছে আর যাই হোক রাই কখনোই বিহানের সাথে যাবে না। প্রয়োজন পড়লে আত্নহত্যার পথ বেছে নেবে।

” রাই এদিকে এসো
শশুড় মশাই গম্ভীর গলায় বলে।
কেঁপে ওঠে রাই। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে যায়। মাথা নিচু করে শশুড় মশাইয়ের পাশে দাঁড়ায়।
“বসো এখানে।
নিজের পাশে জায়গা দিয়ে বলেন শশুড়।
রাই বসে। মাথা নিচু করে আছে। কারো দিকে তাকানোর সাহস নেই।
” কেমন আছো রাই?
বিহান জিজ্ঞেস করে।
রাই উওর দেয় না।
“বলো কেমন আছো? আমরা তোমাকে কেমন রেখেছি। রাইয়ের হাতের ওপর হাত রেখে বলেন শশুড় মশাই।
রাই এক পলক তাকায় ওনার দিকে। চোখের ইশারায় বোঝায় “ভয় নেই তোমার আমি আছি”
রাই ভরসা খুঁজে পায়। কৃতজ্ঞতার হাসি হাসে।
“আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। এমন ভালো শশুড় বাড়ি হলে সব মেয়েরাই ভালো থাকবে।
মুচকি হেসে বলে রাই।
বিহানের হাসি মুখটা চুপসে যায়। মায়ের দিকে তাকায়। মা ইশারায় সান্ত্বনা দেয়।
” এবার বলুন আপনি? সাধারণ কোনো মেয়ে প্রেগন্যান্ট থাকলে তার ওপর পুরো অধিকার থাকে তার বাচ্চার বাবার। তো আমিই
হাত উঁচু করে বিহানকে থামিয়ে দেয় রাইয়ের শশুড়।
আদি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনছে। রাগে হাত দুটো মুষ্টিবন্ধ করে ফেলে।
“আমার ছেলের সাথে রাইয়ের বিয়ে হয়েছে তিন সপ্তাহ। আর ওর বাচ্চার বয়স দুই সপ্তাহ। আর তুমি এই তিন সপ্তাহ এখানে বা এর আশেপাশে ছিলে না। এখান থেকে প্রায় বারো কিলোমিটার দুরে ছিলে।
আর আমাদের প্রমাণ আছে যে আমাদের বউমা এই তিন সপ্তাহে বারো কিলোমিটার দুরে যায় নি। তো বিষয়টা পানির মতো পরিষ্কার।
ঠান্ডা গলায় খুব সুন্দর ভাবে বলেন উনি।
রাই শশুড়ের দিকে তাকায়। এটা কি বলছে? রায়ের প্রেগ্ন্যাসির এখন চার সপ্তাহ মানে এক মাস চলছে। তাহলে?
বিহানের মাথায় জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এটা কিভাবে পসিবল? আদি বিহানের হাতের ওপর রিপোর্ট রাখে। রিপোর্ট দেখে বিহান চমকে ওঠে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে।
খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে এসব আদির কারসাজি। একটা সাধারণ মেয়ের জন্য এতো লড়াই করার কি আছে বুঝতে পারছে না বিহান? আদি চাইলে তো রাইয়ের থেকে অনেক ভালো কাউকে পেয়ে যাবে। তাহলে?
বিহান হাত দিয়ে কপাল চাপকে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নেয়। তারপর হাতের রিপোর্টটা মায়ের হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
আদির দিকে এগিয়ে যায়। বিহনাকে এগোতে দেখে আদি সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ঠোঁটে চওড়া করে হাসির রেখা টানে।
” আদি আই এম সরি। তুই চাইলে আমি তোর পায়ে ধরবো। হেরে গেছি আমি। তুই আমার থেকে অনেক বেটার। শুধু বেটার না বেটারের থেকেও যদি ভালো কিছু থাকে। তুই সেটাই।
তবুও প্লিজ রাইকে আমাকে দিয়ে দে। আমি খুব ভালো ভাবে জড়িয়ে গেছি রাইয়ের সাথে। বাজে ভাবে ফেসে গেছি। এই কয়দিনে বুঝতে পেরেছি ও ছাড়া আমি শূন্য। থাকতে পারছি না আমি। একটু বোঝ?
দুই হাত এক করে অসহায়ের মতো বলে বিহান।
রাইয়ের হাত পা কাঁপছে। কি বলবে আদি? উঠে দাঁড়ায়। নিরবে চোখের পানি বিসর্জন দেয় রাই। আদি যেনো বিহানের কথায় গলে না যায় এটাই প্রার্থনা করে রাই।
আদি মুচকি হাসে। বিহানের এলোমেলো চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দিয়ে বিহানকে পাশ কাটিয়ে রাইয়ের মুখোমুখি দাঁড়ায় আদি।
“আমি আপনার সাথে থাকতে চাই। প্লিজ আমাকে যেতে বলবেন না। আমি কখনোই কারো থেকে ভালোবাসা পায় নি। আমার যা যা মনে আছে তাকে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই নেই। এখানে আসার পর থেকে আমি ভালোবাসা পেয়েছি। মায়ের ভালোবাসা পেয়েছি। প্লিজ এই ভালোবাসা থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না। আমি না হয় সারাজীবন আপনাদের বাড়িতে কাজ করবো। কোনো কাজের লোক রাখার দরজার নেই। আমার বাচ্চার পেছনেও কোনো টাকা খরচ করতে হবে না। ওর দায়িত্ব নিতে হবে না আপনাকে। আপনি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে নতুন বিয়ে করে নেবেন। আমি কিচ্ছু বলবো না। কোনো অধিকার দেখাবো না। প্লিজ
রাই কাঁদতে কাঁদতে আদির পা জড়িয়ে ধরে।
সবাই চমকে ওঠে।
বিহান তাচ্ছিল্য হাসে। সত্যিই মেয়েটার বিশ্বাস্ত হয়ে উঠতে পারে নি। কি ভালোবাসা? সব ভুলে গেছে কিন্তু তবুও কতো বিশ্বাস আদির প্রতি।

আদি রাইকে দাঁড় করায়। রাইয়ের চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। এক হাতে রাইকে আগলে নিয়ে বিহানের দিকে তাকায়।
” আশা করি তোর উওর পেয়ে গেছিস। ভালোবাসার “ভ” ও জানিস না তুই। শুধু পারিস জেদ করতে। জেদ হিংসা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।
বিহান মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায়। বিহানের পেছন পেছন ওর মাও চলে যায়।

চলবে