স্মৃতির শহর পর্ব-১৬

0
607

#স্মৃতির শহর
#পর্বঃ১৬
#তানিশা সুলতানা

দিন গুলো খুব দ্রুতই চলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে রাই। চারমাস চলে গেছে। এখন রাইয়ের প্রেগন্যান্সির সাত মাস চলছে। পেটটা বেশ ফুলেছে। ফর্সা হয়েছে আগের চেয়ে অনেক। আদি অনেক খেয়াল রাখে রাইয়ের।
এর মধ্যে বিহান কয়েকবার এসেছে এই বাড়িতে। আদি বিহানের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করেছে। মনে হয় কিছুই হয় নি। রাইয়ের ও আগের মতো বিহানকে দেখলে বুক কাঁপে না। মিষ্টি হাসে বিহানের চোখের দিকে তাকিয়ে। যা ভেঙে চুরে দেয় বিহানকে।

অহির সাথে বিহানকের সম্পর্কটা আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। মনের কষ্ট গুলো অহির কাছে নিরদিধায় বলতে পারে। কখনো কখনো অহির কোলে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে বিহান। শান্তি খুঁজে অহির মধ্যে। কিন্তু পায় না। খুব বলতে ইচ্ছে করে রাইকে আমাকে ফিরিয়ে এনে দে না অহি। কিন্তু বলতে পারে না।

আজকে রাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে চেকআপ করানোর জন্য। আদি বিহাকেও সাথে করে নিয়ে যায়। বিহান অনেক করে বলেছিলো কিন্তু আদি শোনে নি।
গাড়িতে আদির পাশে বসেছিলো রাই। আদির হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে।
বিহান ড্রাইভ করছে আর তার পাশে অহি বসে আছে।

“ভয় করছে।
রাই আদির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে।

” আমি আছি তো। কোনো ভয় নেই।
আদিও রাইয়ের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে।

“পুচকুটা কিন্তু বেশ পাজি খালি লাথি মারে আমাকে। ডাক্তারকে বলবেন ওকে যে লাথি মারতে না করে। আমি ব্যাথা পাই।
রাই ঠোঁট উল্টে বলে।
আদি হাসে।
” এই এই দেখুন এখনো লাথি মারলো।
রাই চোখ মুখ খিঁচে কিছুটা জোরে বলে। বিহান গাড়ি ব্রেক কষে।
আদি রাইয়ের পেটে কান রাখে। মুহুর্তটা অনুভব করছে। আদি কান রাখতে না রাখতেই আবারও লাথি মারে। আদিও ফিল করতে পারে।

“এই পুচকু একদম আমার বউকে লাথি মারবে না। বলে দিলাম।
পেটে হাত বুলিয়ে বলে আদি।
রাই আলতো হেসে সামনে তাকাতেই হাসিটা মিলিয়ে যায়। বিহান করুন চোখে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো চিকচিক করছে। এই মুহুর্তটা তো বিহানের ফিল করার কথা ছিলো। অহি মুচকি হাসছে। হঠাৎ অহির চোখ যায় বিহানের দিকে।
বিহানের কাঁধে হাত রাখে। চমকে তাকায় বিহান অহির দিকে। অহি চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? বিহান আলতো হেসে বোঝায় কিছুই হয় নি। তারপর লুকিয়ে চোখের পানি মুছে ডাইভ করতে থাকে।

আদি এখনো রাইয়ের পেটে মুখ গুঁজে আছে।
” এই সরুন না। গরম লাগে।
রাই আবার ফিসফিস করে বলে।
আদি সরে যায়। এক হাতে রাইকে জড়িয়ে রাখে।

“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
রাই বিহানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে।

” বলো।
রাইয়ের আঙুলে আঙুল রেখে বলে আদি।

“ভালোবাসেন আমায়?
রাইয়ের প্রশ্ন শুনে চমকে ওঠে আদি। রাইয়ের চোখের দিকে তাকায়। এই চার মাসে এই প্রশ্নটা অসংখ্য বার করেছে রাই। আদি উওর দেয় নি। এটা বলে দিতে হবে? চোখ কেয়ার এসব দেখে বুঝতে পারে না?
আদি বিরক্ত হয়। কিছু বললে কান্না করা শুরু করে দেবে।

” জানি না।
আদি আমতা আমতা করে বলে।
রাই আদির থেকে সরে বসে। কেনো উওর দেবে না? বললে কি হবে? অভিমান হয় খুব। দয়া দেখাচ্ছে ওকে আবারও বুঝে গেলো। কিন্তু এটা নিয়ে সিনক্রিয়েট করতে চায় না রাই। এই দয়া নিয়েই বাঁচতে চায়। কারণ এই দয়ার মধ্যে কোনো লোভ নেই অহংকার নেই।

“মন খারাপ হয়ে গেলো? এতে মন খারাপ কোথায় পাও তুমি? কথায় কথায় মুড অফ। ইন ফিউচার হবে কি জানো? পুচকু পটি করবে তুমি আমাকে পরিষ্কার করতে বলবে। আমার হাত জোড়া কাজ থাকবে তারপর তুমি অভিমান করে বসে থাকবে।
তারপর পুচকু বড় হয়ে গেলে। আমি
রাই আদিকে থামানোর জন্য আদির হাতে চিমটি দেয়। আদি আহহহ বলে ওঠে।

রাইকে শুয়িয়ে দেওয়া হয়েছে একটা যন্ত্রের মধ্যে। রাই চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আদির হাতটা শক্ত করে ধরে আছে।
কম্পিউটারের বাচ্চার প্রতি ছবি দেখা যাচ্ছে। রাইয়ের ছোট্ট পেটে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। আদির মনের ভেতরে শিহরণ বয়ে যায়। সারা শরীর জাড়িয়ে ওঠে। রাইয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
” আমার সন্তান
চমকে ওঠে আদি।
পাশে তাকায়। বিধানের চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি ঝড়ছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্কিনে। আদি হাত শক্ত মুঠ করে ফেলে।
“আমার সন্তান সুস্থ আছে তো। আর আমার স্ত্রী?
আদি মিষ্টি হেসে ডাক্তারকে বলে।
বিহানের হুশ ফেরে। এতখন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো। আদি জানে দুজনই সুস্থ আছে তবুও বিহানকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বলে যে ‘রাই আদির স্ত্রী ‘

” দুজনই সুস্থ আছে। খুব তাড়াতাড়ি সিজার করাতে হবে। এই মাসের বারো তারিখেই সিজার করাতে চাইছি। আর আপনার মেয়ে হবে।
ডাক্তার মিষ্টি হেসে বলে।
“আলহামদুলিল্লাহ।

বিহান হনহনিয়ে চলে যায়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেলে আর কখনোই মুখোমুখি হবে না আদি আর রাইয়ের। সয্য করতে পারবে না নিজের সন্তানকে অন্যের কাছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই।
তারাহুরো করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে অহির সাথে ধাক্কা খায়। দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে যায় বিহান। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। অহির এক হাত ধরে আছে।
” কি হয়েছে বিহান?
অহি বিহানের দিকে তাকিয়ে বলে।
বলে। অহি এক পুরোনো বন্ধু সাথে কথা বলছিলো। এখন রাইয়ের কাছে যাচ্ছিলো।
বিহান অহির প্রশ্নের উওর না দিয়েই চলে যায়। নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অহি। খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে বিহানের মন খারাপের কথা। কে সেই মেয়ে? যে বিহানকে এভাবে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে? কখনোই হ্মমা করবে না অহি সেই মেয়েকে। খুব শাস্তি দেবে তাকে।

আদি তখন থেকে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। রাই আদির হাতের ভাজে হাত রেখে আদির দিকে তাকিয়ে আছে। কেনো মুড অফ বুঝতে পারছে না। আদি কি খুশি নয়? ও কি এখন আফসোস করছে? বুক ভারি হয়ে আসে রাইয়ের।
হাসপাতালে পাশের রেস্টুরেন্টে বসে আছে দুজন। খাবার খেয়ে বাসায় ফিরবে। অর্ডার দেওয়াও শেষ। এবার শুধু খাবার আসার অপেক্ষা।
“কি হয়েছে আপনার? মন খারাপ কেনো? আফসোস হচ্ছে?
আদি রাইয়ের দিকে তাকায়। রাইয়ের গলা ধরে আসছে। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। এখুনি কেঁদে ফেলবে।

” একটা সত্যি কথা বলি? মন খারাপ করবে না তো?
মুখটাকে আরও গম্ভীর করে বলে আদি।
রাই গোলগোল চোখ করে তাকায়। টুপ করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরে। আদি খুব যত্ন করে মুছিয়ে দেয়।

“আজকে যখন কম্পিউটারের স্কিনে বেবির পতি ছবি দেখছিলাম কতোটা ভালে লাগছিলো বলে বোঝাতে পারবো না। মনে হচ্ছিলো এখুনি কোলে নিয়ে আদর করে দেই। পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী ব্যক্তি মনে হচ্ছিলো নিজেকে। শ্রেষ্ঠ গিফট এই বেবিটা আমার জন্য।
কিন্তু যখন বিহানের মুখের দিকে তাকালাম
আদি থামে। এতখনে মনটা খুশিতে ভরে উঠছিলো কিন্তু এখন রাইয়ের বুকের ভেতর মোচর দিয়ে ওঠে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আদি কি এখনই ফিল করছে ও রাইকে জীবনে জড়িয়ে ভুল করে ফেলেছে? এখন কি ছেড়ে দেবে রাইকে? কোথায় যাবে রাই? এতো ভালোবাসা কোথায় পাবে?
চোখ দুটো ভরে ওঠে। গলা কাঁপছে।

” আমি তোমার প্রতি দুর্বল। খুব দুর্বল। এতোটাই দুর্বল যে তোমার থেকে আলাদা হওয়ার কথা চিন্তা করলেও হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। (রাইয়ের দুগালে হাত দিয়ে বলে আদি)
আমি বিহানকেও খুব ভালোবাসি। ও আমার বন্ধু। ওর কোনো খারাপ আমি চায় না। বিহানের চোখে মুখে এখন শুধুই হতাশা দেখতে পাই। আমি ফিল করতে পারি ও তোমাকে আমার সাথে সয্য করতে পারে না। ওর ভেতরটা ফেটে আসে।

আবার থেমে যায় আদি। রাইয়ের গাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে আসে। রাই মুখ গোমড়া করে বসে আছে। কিছু বলার নেই ওর। কিই বা বলবে? বলার মতো ভাষা নেই ওর।
আদি রাইয়ের হাতের ওপর হাত রাখে।

“আর পনেরো দিন পরেই তোমার সিজারের ডেট।
তারপরই পুচকুটা পৃথিবীর আলো দেখবে। আমি চায় না আমার সন্তানের সামনে বিহান চোখের পানি ফেলুক। মনে মনে ফিল করুক এটা আমার সন্তান। আমার বাচ্চার দিকে হাত বাড়াক।
তাই একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।

আদির কথা শুনে রাই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আদির পা জড়িয়ে ধরে। আদি ভরকে যায়। চটজলদি রাইকে ওঠানোর চেষ্টা করে।

” প্লিজ আমাকে বিহানকের কাছে যেতে বলবেন। আমিও আপনার প্রতি দুর্বল। খুব দুর্বল। আমি কোথাও যাবো না।
রাই হেঁচকি তুলে বলে।
আদি রাইকে বসিয়ে এক হাতে জড়িয়ে নেয়। রাইয়ের কান্নাই থামছে না।

“তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না আমি। তুমি আমার কাছেই থাকবে। আগে থেকেই ফালতু চিন্তা ভাবনা আসে কিভাবে তোমার মধ্যে?
খানিকটা ধমকের সুরে বলে আদি।
রাই থেমে যায়। এখন আর কাঁদছে না শুধু ফুঁপিয়ে যাচ্ছে।

” বিহানের সাথে অহির বিয়ের কথা চলছে বাসায়। অহি ভালোবাসে বিহানকে। যদিও বাবা মা রাজি না। কিন্তু অহি তো জেদ ধরেই বসে আছে।
ওরা কি সিদ্ধান্ত নেবে আমি জানি না। যাই সিদ্ধান্ত নিক তার জন্য আমি কেনো রকম রিক্স নেবো না।
বিহান খুব ভালো ছেলে অহির সাথে ওর বিয়ে হলে আমার বোনটা কখনোই অসুখী হবে না।
কিন্তু তুমি চোখের সামনে থাকলে বিহানের পহ্মে সবটা জটিল হয়ে যাবে।
তাই আমি ভাবছিলাম। কালকেই আমরা এই শহর ছেড়ে চলে যাবো। আমাটই ট্রান্সফার হয়েছে চিটাগং একটা ইউনিভার্সিটিতে।
তো আমরা দুজন ওখানেই সংসার করবো। বাচ্চাটাকে বড় করে তুলবো।
তারপর এক দুই বছর পর ফিরপ আসবো ততদিনে বিহান ভুলে যাবে সবটা।
তুমি কি বলো?

রাই কিছু না বলে আদির এক হাত জড়িয়ে ধরে।
আদি রাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

“খুব ভালো থাকবো আমরা। আমি কারো ছায়া পড়তে দেবো না আমার সন্তানের ওপর। ও আমার সন্তান।

” বাসার সবাই যদি যেতে না দেয়।
রাই রিনরিনিয়ে বলে।

“মাকে বুঝিয়ে বলেছি আমি। মাও যাবে আমাদের সাথে। কিছুদিন পরে চলে আসবে।

খাবার চলে আসে।
আদি নিজের হাতে খায়িয়ে দেয় রাই। এই চার মাসে এক বারও রাই হাত দিয়ে ভাত খাই নি। কখনো অহি শাশুড়ী নাহলে আদি খায়িয়ে দেয়। কি করে থাকবে ওদের ছাড়া রাই? ভাবতেই আবার কান্না পায়। কিন্তু রাইকে তো যেতেই হবে।
আচ্ছা যখন অহি সবটা জানতে পারবে কি হবে বিহানের? আদি থাপ্পড় মারাতেই যল বিহেব করলো আদির সাথে। আর বিহান তো ঘোর অন্যায় করেছে। সুখী হবে তো অহি? না কি বিহানকে দুরে সরিয়ে দেবে?
আর বিহান সে কি মানবে অহিকে? আবার সবটা নতুন করে শুরু করতে চাইবে?
এতে গুলো প্রশ্ন রাইয়ের মাথায়।
কিন্তু যাই হোক মিথ্যে দিয়ে কখনোই কোনো সম্পর্ক শুরু করা উচিত নয়। অহিকে জানতেই হাবে সব।

চলবে