#হট_চকোলেট
পর্ব-২
শারিকার ভিডিও কল রিসিভ করতে গিয়ে শুভর বেশ ছোটোবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। তার বাবা একবার তার আর তার বোনের একটা পরীক্ষা নিয়েছিল। পরীক্ষাটা ছিল এমন, দুটো চকোলেটের বক্স ওদের বাড়ির ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা থাকবে। দুজনেই হাত বাড়ালেই সেগুলো নিতে পারবে। কিন্তু যদি তারা সম্পূর্ণ একদিন সেই বক্সদুটো স্পর্শ না করে থাকতে পারে তাহলে তাদের কাঙ্ক্ষিত কোনো একটি দামী উপহার কিনে দেয়া হবে।
শুভর বোন সুপ্তি চেয়েছিল একটা সাইকেল আর সে নিজে চেয়েছিল ভিডিও গেমস। দু’জনেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল চকোলেটের বক্স স্পর্শ করবে না। এদিকে চকোলেট দুটো তাদের দুজনেরই বেশ পছন্দ ছিল। বয়সও ছিল কম। তার মোটে আট বছর, সুপ্তির দশ। এই সময়ে লোভ সামলানো সহজ নয়। তবুও কেমন করে যেন সুপ্তি সারাদিন পার করে দিল। শুভ কিন্তু পারল না। বিকেলের দিকে সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। চকোলেট শুধু নিজেরটাই না, সুপ্তিরটাও চেটেপুটে শেষ করল।
খুব বেশি ভালো মনে নেই শুভর। তবুও এটা মনে আছে যে তার হেরে যাওয়ায় বাবা খুব মন খারাপ করেছিলেন। বাবার হতাশা দেখে শুভ কথা দিয়েছিল, আবার টেস্ট নিলে সে জিতে দেখাবে। কিন্তু বাবা বলেছিলেন, এই পরীক্ষা শুধু একবারই নেয়া যায়।
বাবা চলে গেছেন অনেকদিন হয়ে গেল। বাবা যাবার পর তার ছোটোখাটো ব্যবসাটা যখন শুভর হাতে পড়ল তখন সেটা আরো ফুলেফেঁপে তিনগুণ হলো। শুভ এখন ভালো টাকা কামায়। বোনের বিয়ে সে নিজেই দিয়েছে। সুপ্তি এখন বিদেশে সেটেলড। নানা ঝামেলায় তার নিজের বিয়ে করা হয়নি।
ইউনিভার্সিটি লাইফে এক প্রেমিকা ছিল, সেও ওর সময় না দেবার অযুহাতে চলে গেছে তাকে ছেড়ে। অবশ্য ব্যাপারটাকে অযুহাত বলা যায় না। সে আসলেই অনুকে সময় দিত না। অনু বেশি কিছু চাইত না ওর কাছে, শুধু একটু সময় চাইত, কথা বলতে চাইত। সে তাও দিতে পারত না। অনু যখন বলত এরকম করলে সে ছেড়ে চলে যাবে, তখন শুভর বন্ধুরা ওকে বলত, তোর যা টাকাপয়সা, কোনো পাগলেও তোকে ছেড়ে যাবে না। অনুর মতো লোয়ার মিডল ক্লাস মেয়ের তো যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এত পাত্তা দিস না ওর কথার। শুভ ওদের কথা শুনে আরো অনুকে পাত্তা দিত না। টেকেন ফর গ্র্যান্টেড ধরে নিয়েছিল। অনু তারপর তাকে আর তার বন্ধুদের অবাক করে দিয়ে একদিন ছোটো এক চাকুরিজীবীকে বিয়ে করে ফেলল। সেদিন কষ্টের সাথে সাথে শুভর অনুর প্রতি সম্মানটাও বেড়ে গিয়েছিল। হয়তো সেই সম্মান অনু ওর সাথে ঝুলে থাকার চেষ্টা করলে পেত না। বিয়ের পর একবার অনুকে দেখেছিল সে। রাস্তার পাশে স্বামীর সাথে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে আর খুনসুটি করছে৷ সেদিন তার বাস্তবিকই মনে হয়েছিল, অনু চলে গিয়ে ভালো করেছে।
অনুর পর আর কোনো মেয়ের দিকে সে নজর দেয়নি। দিতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু আজ এটা কী হচ্ছে? একটা মেয়ের প্রতি সে প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে যে কি না তার অতি কাছের বন্ধুর বউ!
বাবার সেই পরীক্ষার কথা মনে পড়ছে। পারেনি সে সেদিন নিজেকে সামলাতে। আজ কি পারবে? কলের রিসিভার অপশনটা বড্ড লোভনীয় মনে হচ্ছে। যেন রিসিভ করলেই সে দেখতে পাবে লাস্যময়ী এক তরুণী স্বল্প পোশাকে তাকে দেখাবার জন্যই তৈরি হয়ে বসে আছে। কয়েক মুহূর্তেই শুভর প্রচন্ড মাথা ধরে গেল।
***********
এই শেষরাতে কার সাথে কথা বলতে পারে শারিকা? প্রশ্নটা মাথায় বারবার ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে অর্কর। সে একটা বাজে স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠে গেছে। শারিকাকে ভীষণ মনে পড়ছে বলে তাকে কল করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করেছে শারিকার নাম্বার এনগেজড। তাও আবার দেড় ঘন্টা ধরে। রাত চারটার সময় কার সাথে তার এত গল্প চলছে যে ফুরাতেই চাইছে না?
সে অনেকবার নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করল যে সে যা ভাবছে তা ভুল। হয়তো কানেকশনে কোনো গন্ডগোল হচ্ছে। কিংবা শারিকা কারো সাথে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছে, কল কাটেনি। যে কোনোকিছু হতে পারে। সবসময় নেগেটিভ চিন্তা করা উচিত নয়। তার অন্যদিকে মন দেয়া উচিত।
মোবাইল এলোমেলো ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে সে কী মনে করে শারিকার ইমেইল আইডিতে ঢুকল। ওর আইডিটা কোনো এক কারনে তার মোবাইলে সেভ করা ছিল। প্রথম মেইলটা দেখে চোখ কপালে উঠল অর্কর। কোনো একটা ওয়েবসাইট থেকে একটা শাড়ি অর্ডার করেছে শারিকা। সেটার কনফার্মেশন মেসেজ এসেছে। শাড়িটার দাম বাইশ হাজার টাকা! এত টাকা কোথায় পেল শারিকা? ওর বাবা মায়েরই তো চলে ভাইয়ের পাঠানো অল্প কিছু টাকায়। হঠাৎ করে এত টাকা দেবার মতো কেউ নেই শারিকার। সে নিজেও কোনোকিছু করে টাকা কামাবে এমন উপায় নেই। অন্তত অর্ক দেখেনি। তবে?
আবারও কল করল অর্ক। এবার কল ঢুকল। শারিকা ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, “এ সময় ফোন করলে যে?”
“এতক্ষণ কার সাথে কথা বলছিলে শারিকা?”
“ওহ! আগেও ফোন করেছ? আমার বান্ধবী জিনিয়ার সাথে কথা বলছিলাম। ও কানাডা থাকে। বলেছিলাম না তোমাকে? সদ্যই দেশে এসেছে৷ সেই এগারোটায় কথা শুরু করেছি, এখন রাখলাম। ওর আবার জেট লেগের কারনে রাতে ঘুম আসে না। তাই এত গল্প করছিল। আমি ঘুমে পড়ে যাচ্ছিলাম জানো?”
“ওহ।”
“ও আমাকে একটা দামী শাড়ি গিফট করেছে। ওর কাছে টাকাপয়সা কোনো ব্যাপার না। আমি কত না করলাম, শুনলই না।”
“ওহ!” স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল অর্কর বুক থেকে। সে কী না কী ভেবে মগজ এলোমেলো করে ফেলছিল ভেবে হাসি পাচ্ছে।
শারিকা বলল, “ঘুমাই আমি এখন। এত্ত ঘুম পাচ্ছে! উফ!”
“ওকে বেবি। বাই।”
“লাভ ইউ।”
“লাভ ইউ টু৷ মিস ইউ!”
“মিস ইউ টু!”
***********
শুভ জানালার ভারি পর্দা টেনে দিয়ে ঘরটা অন্ধকার করার চেষ্টা করল। আয়নাটা সবার আগে ঢেকেছে সে। নিজের মুখোমুখি হতে ভয় করছে তার৷ ভীষণ ভয়। প্রবৃত্তির বশে একটা কাজ করে ফেলার পর এত আফসোস করে কী লাভ? করার আগে মনে হয়নি? প্রশ্নগুলো নিজেকে ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিচ্ছে।
এসির তাপমাত্রা কমিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল সে। ছোটোবেলায় কোনো অপরাধ করলে সে খাটের নিচে লুকিয়ে পড়ত। মা বাবার মারের ভয় পেত। এখন ভয় পাচ্ছে নিজের বিবেকের। আবার এটাও একটা প্রশ্ন যে, তার বিবেক কি আদৌ বেঁচে আছে?
সে ভেবেছিল আজ হয়তো শারিকা কোনো ভয়ানক পোশাক পরে তার সামনে আসবে। কিন্তু সে খুব সাধারণ একটা টিশার্ট পরে হাসিমুখে কল করেছিল। শুভ স্বস্তিই পেয়েছিল সেটা দেখে। গল্প হচ্ছিল ভালোই। টুকটাক কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে হঠাৎ করেই ক্যামেরাটা সামনে রেখে শারিকা নিজের টিশার্টটা খুলে ফেলেছিল। ভেতরে একটা কালো রঙের অন্তর্বাস ছিল কেবল। না, সেদিক থেকে বহু চেষ্টাতেও চোখ সরাতে পারেনি শুভ।
যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে শারিকা বলছিল, এত গরম লাগছে না! আমার বাড়িতে আপনার বাড়ির মতো এসি নেই বুঝলেন!
শুভর মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিল না। শারিকা একাই বকবক করে যাচ্ছিল। এরপর আস্তে আস্তে শুভও কথা বলতে শুরু করল৷ এবং খুব দ্রুতই সেই কথাবার্তা নিষিদ্ধ পর্যায়ে চলে গেল।
তাদের মধ্যকার উত্তেজনা কমতে কমতে ভোর হয়ে এলো। যখন শারিকা হাই তুলতে তুলতে কল রাখল, তখন ওর শরীরে একটা সুতোও ছিল না।
**********
শুভর লাল টকটকে চোখ দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেল তমাল। “তোর কি কোনো সমস্যা চলছে?” জিজ্ঞেস করল সে। সে নিজেই একটা সমস্যা শেয়ার করতে এসে দেখেছে শুভর অবস্থা তার থেকেও খারাপ।
শুভ ক্লান্ত গলায় বলল, “হুম। কিন্তু কী সমস্যা জিজ্ঞেস করিস না প্লিজ! বলতে পারব না।”
তমাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমিও বলতে পারব না টাইপ একটা সমস্যায় ফেঁসে গেছি। সেজন্য তোর কাছে এসেছিলাম।”
“কী হয়েছে?”
“ওইযে বলতে পারব না এমন।”
“ধুর ব্যাটা! বলে ফেল।”
“তাহলে তোর সমস্যাও বল।”
“আমারটা খুব বাজে, নোংরা!”
“আমারটাও।”
শুভ সরু চোখে তাকাল। “কাহিনী কী?”
তমাল হাতদুটো কচলে বলল, “ওকে, আমরা দু’জন দু’জনকে সমস্যা শেয়ার করি, কিন্তু আর কাউকে এসব কথা বলব না।”
“ওকে।”
“অন্য কোনো বন্ধুকেও না।”
“ঠিক আছে।”
“আচ্ছা, তোর…. তোর অর্কর বউয়ের কথা মনে আছে তো? গত সপ্তাহেই গেলাম ওদের বাসায়।”
শুভ সতর্ক হয়ে উঠল। অর্কর বউ! তমালের সমস্যার মূলেও কি তবে শারিকা!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু