হট চকোলেট পর্ব-০৭(শেষ পর্ব)

0
48

#হট_চকোলেট
পর্ব-৭ (শেষ পর্ব)

কলিংবেল চেপে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো অর্কর। শারিকা ঘুমাচ্ছিল। ঘুম ঘুম চোখে উঠে দরজা খুলল সে। হাই তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল, “তুমি না রাতে থাকবে বলেছিলে?”

অর্ক সংক্ষেপে বলল, “মাথা ব্যথা বলে চলে এলাম।”

“তোমার বন্ধুর অবস্থা কেমন?”

“ভালো।”

শারিকা আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পরল। অর্কর অস্থির লাগছে। মনে হলো গোসল করলে হয়তো একটু ভালো লাগবে। সে সময় নিয়ে গোসল করল। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছিল। রাতে একটা ব্রেড খেয়েছিল শুধু৷ খাওয়ার মতো কিছু না পেয়ে একটা ডিম ভাজি করে টোস্ট দিয়ে খেয়ে ফেলল। তারপর শুতে গেল। কিন্তু ঘুম এলো না। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে তমালের কথাগুলো ভুলে যেতে। কিন্তু যত যাই করুক না কেন ভাঙা ক্যাসেটের মতো তার মগজে সেই কথাগুলোই বেজে চলেছে। মনে হচ্ছে অন্তকাল ধরে এগুলোই শুনে যাচ্ছে সে। কোনোদিন এই লুপ থেকে সে আর বের হতে পারবে না। চিৎকার করতে ইচ্ছে হলো অর্কর। মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। দুটো ঘুমের ঔষধ আর মাথাব্যথার ঔষধ একসাথে খেয়ে নিল সে। একবার ইচ্ছে হলো শুভর মতো সবগুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিতে। ভালোই হতো তাহলে। তিতকুটে কোনো সত্য তার দোরগোড়ায় তাহলে আর অপেক্ষায় বসে থাকত না। সে সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে পারত।

তমালকে বহুদিন ধরে চেনে অর্ক। ওদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধীসম্পন্ন মানুষ হলো তমাল। সে বাড়তি কথা বলে না, আজেবাজে কথা বলে না, কখনো কারো ক্ষতিও চায় না। আজ সকালেও যদি অর্ককে জিজ্ঞেস করা হতো পৃথিবীর কোন মানুষটাকে সে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে? সে হয়তো তমালের নামই সবার আগে বলত। কিন্তু এখন তার ইচ্ছে হচ্ছে তার সম্পূর্ণ সত্ত্বা দিয়ে তমালকে অবিশ্বাস করতে। এই সত্যের মুখোমুখি হওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। এরচেয়ে শেষ হয়ে যাক বন্ধুত্ব। সে জানতে পারুক, কোনো কারনে তমাল মিথ্যে বলছে। তার ভালোবাসা সত্যি হোক। নিষ্পাপ প্রমাণিত হোক তার প্রিয়তমা।

পাশে তাকাল অর্ক। ঘুমিয়ে আছে শারিকা। কী সুন্দর মুখটা! জানালা গলে স্ট্রিট লাইটের আলো ঢুকছে ঘরে। সেই আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে মুখটা। গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা এই নিষ্পাপ মেয়েটি কিছুতেই খারাপ হতে পারে না। দুশ্চরিত্র হবার প্রশ্নই ওঠে না৷ এই মেয়ের জন্য অর্ক মায়ের সাথে সম্পর্ক খারাপ করেছে, বন্ধু কোন ছাড়!

মাথার ওপর আরেকটা বালিশ চাপা দিয়ে মাথাব্যথা থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে লাগল সে। কিছু হলো না। মাথায় এখনো তমালের কথা ঘুরছে।

শারিকা ঘুমের মধ্যেই তার দিকে এগিয়ে এলো। ওর বুকে মুখ গুঁজল। অর্ক জড়িয়ে ধরল শারিকাকে। কী মিষ্টি ঘ্রাণ আসে ওর শরীর থেকে! শারিকা নাক ঘষছে ওর বুকে। অর্কর সেই মুহূর্তে মনে হলো, শারিকার জন্য পুরো পৃথিবীর সাথে লড়তে হলে সে লড়বে। তবুও সবাইকে ভুল প্রমাণ করতেই হবে।

********

ভোরে শুভর জ্ঞান ফিরলে তমাল কেবিনে ঢুকল। তমালের চেহারা গম্ভীর। রোগীর সাথে দেখা করতে আসার সময় চেহারায় সহমর্মিতা ফুটিয়ে তোলার কোনো প্রয়োজন সে বোধ করছে না। বরং ওর ইচ্ছে করছে এই ব্যাটাকে হাসপাতালের বেড থেকে তুলে ইচ্ছেমতো ধোলাই দিতে।

শুভ সামান্য হেসে বলল, “গুড মর্নিং।”

“গাধার বাচ্চা, তুই এই কাজ কেন করলি?”

শুভ হাসল, “আর করব না।”

“কেন করবি না?”

“শিক্ষা হয়ে গেছে ভাই। অনেক কষ্ট।”

“তোর শিক্ষা হওয়ার দরকার ছিল।”

“হুম জানি।”

“তুই কি মেয়ে? তোকে কি সমাজ থেকে বের করে দিত? এই ন্যাকামিটা কেন করলি তুই?”

শুভ একটু ভেবে বলল, “দোস্ত, আমি জানি না তুই বুঝবি কি না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল আমি নিজে কিছু করছি না। অদৃশ্য কিছু দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি। আমি তো এত খারাপ না যে বন্ধুর সাথে এরকম বেঈমানী করব। তবুও করেছি। সবকিছু জেনে বুঝে করেছি। নিজেকে কন্ট্রোল করার ক্ষমতা আমার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অর্ককে ফেইস করা দূরের বিষয়, আমি নিজেকে ফেইস করতে পারছিলাম না। ঘরের আয়না ভেঙে ফেলেছিলাম রাগে। এরপর হঠাৎ বাথরুমে গিয়ে আয়না দেখে মনে হচ্ছিল নিজেকে না, কোনো পিশাচকে দেখছি। এই জীবন রাখলে আমি হয়তো আরো বড় বড় পাপ করে ফেলব, এই আশঙ্কায় আর কিছুটা ভয়েও বলতে পারিস, কাজটা করে ফেলেছি। আমার তো কোনো পিছুটান নেই। আমি মরে গেলেও কারো কিছু হতো না।”

কথাগুলো বলে তমালের দিকে চাইতেই মনে হলো, তমাল কষ্ট পেয়েছে তার পিছুটান নেই কথাটা শোনার পর। সে তমালের হাত ধরে বলল, “স্যরি, আমি বাঁচতে চাই। তোদের জন্য বাঁচব আমি।”

তমাল বলল, “এখনো কি গিল্ফ ফিল আছে?”

“কিছুটা।”

“বাদ দে বিষয়টা।”

“বাদ দেব?”

“পুরোপুরি বাদ দিবি।”

“ওকে।”

“যা হয় হবে।”

“ওকে।”

“প্রমিজ কর, এমন আর করবি না?”

“প্রমিজ করলাম।”

“আর শোন, অর্ক দেখা করতে একে শারিকার প্রসঙ্গ একেবারে তুলবি না৷ তুই এই কাজ কেন করেছিস জিজ্ঞেস করলে বানিয়ে কোনোকিছু বলে দিস।”

“তুই তো এতদিন ওকে সব বলতে চাইতি৷ এখন উল্টো গান গাইছিস কেন?”

“বলার চেষ্টা করেছিলাম ওকে। শোনেনি। উল্টে রেগে বাস্ট হয়ে চলে গেছে।”

“এজ এক্সপেক্টেড। ওই মেয়ে আমার বউ হলে আমিও বিশ্বাস করতাম না।”

“সিরিয়াসলি? কী আছে ওর মধ্যে?”

“হয়তো বুঝতে পারছি কী আছে। পরে বলব তোকে।”

“আচ্ছা।”

**********

অর্ক অফিসে যাবার আগে শুভকে দেখতে এলো। অর্ককে দেখে শুভর কষ্ট হলো খুব। কেমন যেন দেখাচ্ছে ওকে। অনুশোচনাটা ফিরে আসছে ভেতরে ভেতরে। তবে সে স্বাভাবিক রইল।

অর্কের প্রশ্নের উত্তরে ব্যবসায়ে ভরাডুবির আশঙ্কা নিয়ে বানিয়ে একটা কাহিনী বলে দিল শুভ। অর্ক তাকে বেশকিছু উপদেশ দিয়ে চলে গেল সেখান থেকে।

অফিসে গিয়ে তার কাজে মন বসল না মোটেও। কেবলই ভেতরে ভেতরে অশান্তিতে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। মাথাব্যথাটা কেবল বেড়েই চলেছে। চোখের সামনে প্রায়ই সে দেখতে পাচ্ছে লাল নীল আলো জ্বলছে আর নিভছে।

সে বহু চেষ্টা করল অফিসের কাজে মনোযোগ দেবার৷ পারল না৷ এরপর মোবাইল নিয়ে এলোমেলো চাপতে লাগল। অডিও ফাইলগুলোতে গিয়ে মনে হলো এগুলো শোনা যায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডাগুলো খুব মজার হয় বলে সে শুভ আর তমালের নাম্বারে কল রেকর্ড অপশন চালু করে রেখেছে। ওদের সাথের প্যাচালগুলো অটোমেটিক রেকর্ড হয়ে থাকে। অর্ক প্রায়ই শোনে। মজা লাগে। মনে হয় স্মৃতি জমাচ্ছে।

সেই রেকর্ড শুনতে গিয়েই সে আবিষ্কার করল একটা ফোনকল যেখানে তার আর শুভর মধ্যে না, বরং শুভ আর শারিকার মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছে। কথাগুলো শুনতে শুনতে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যেতে থাকল তার৷

——————

“হ্যা…হ্যালো।”

“ব্লক করেছ কেন? ব্লক খোলো বলছি!”

“কেন খুলব?”

“না খুললে আমি তোমার বন্ধুকে বলে দেব যে তুমি আমাকে কল করে ডিসটার্ব করেছ। উল্টোপাল্টা ছবি পাঠিয়ে হ্যারাস করেছ। ভিডিও কলে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে দেখিয়েছ।”

“হুম আর এসব যে বলবে তার কোনো প্রমাণ আছে তোমার কাছে?”

“আছে তো। তোমার ভিডিও কলের স্ক্রিনশট যত্নে রাখা আছে আমার কাছে। সেই রাতের কথা মনে আছে না? শেষ রাতের দিকে উত্তেজনার চরমে পৌঁছে গিয়েছিলে? ঠিক সেই মোমেন্টের স্ক্রিনশট আছে আমার কাছে। আশা করি তোমার ফ্রেন্ড সার্কেল বা পরিচিতজনের মধ্যে যারা মেয়ে আছে তাদের তোমার ন্যুড দেখতে দারুণ লাগবে! ড্রাইভে আপলোড করাই আছে। জাস্ট লিংকটা পাঠানো বাকি।”

“তোমার স্ক্রিনশটও আছে আমার কাছে।”

“তাই নাকি? কে বিশ্বাস করবে? আমার মুখে সবসময় ফিল্টার দেয়া ছিল। তোমার ওই স্ক্রিনশট কোনো কাজে আসবে না।”

“কী চাই তোমার?”

“আপাতত একটা মোবাইল ফোন। খুব পুরানো হয়ে গেছে আমারটা বলেছিলাম তো।”

“ঠিক আছে।”

“আর আগে ব্লক তো খোলো।”

“খুলব না।”

“ওহ আচ্ছা। তাহলে ড্রাইভ লিংক…”

“খুলছি।”

“গুড বয়।”

“তুমি অর্কর মোবাইল থেকে ফোন করেছ কিভাবে?”

“অর্কর মোবাইলে আমার এক্সেস আছে। ও নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। খুব পরিশ্রম গেছে কি না! তোমাকে যা বলছি তাই করো। আজ রাতে ব্লক না খুললে সকালে তোমার সম্মান চিরতরে ব্লক হয়ে যাবে।”

____________________

কথাগুলো রিপিটেডলি কতবার শুনল অর্ক বলতে পারবে না। তার মগজ কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। চোখ জ্বালা করছে। চোখের সামনে এখন আর কিছুই নেই, কেবল লাল নীল হলুদ আলো জ্বলছে, নিভছে, মাথা ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে।

অফিসের ডেস্কে বসেই প্রচন্ড চিৎকার দিয়ে উঠল সে।

*************

চোখ খুলে তমালকে দেখতে পেল অর্ক। তার অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মাথা ধরে বসে এলোমেলো বকছিল সে। বিপি প্রচন্ডরকম হাই হয়ে গিয়েছিল বলে ওর কলিগরা হাসপাতালে নিয়ে এসেছে তাকে। শুভও একই হাসপাতালে ভর্তি। শুভর কাছেই এসেছিল তমাল, হঠাৎ অর্ককে দেখতে পেয়ে ওর কাছে এসেছে। ও পরিচয় দেয়াতে অর্কর অফিস কলিগরা চলে গেছে কাজে।

অর্কর স্বাভাবিক হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চোখ খুলে তমালকে দেখতে পেয়ে সে খানিকটা ভীত হলো। কেন হলো বলতে পারবে না। তমালকে ভয় লাগছে। গা শিরশির করছে ওর।

তমাল বলল, “কেমন আছিস?”

“জানি না।”

“সবাই মিলে অসুস্থ হওয়া শুরু করেছিস কেন তোরা?কয়জনকে দেখব?”

“জানি না।”

“জানিসটা কী?”

“তমাল, শুভ সু ই সা ই ড করতে গিয়েছিল কেন?”

“ওর কী একটা ঝামেলা ছিল।”

“কী নিয়ে? শারিকা?”

তমাল চমকে উঠে বলল, “তুই… জানিস?”

“সবটা জানি না। কিছুটা জানি। বাকিটা তুই বল।”

“আগে সুস্থ হয়ে নে।”

“আমি সুস্থ আছি।” সে উঠে বসল।

এর মধ্যে ডাক্তার এসে একবার দেখে গেলেন তাকে। ব্লাড প্রেশার এখনো হাই। তবে ঠিকমতো বিশ্রাম করলে ঠিক হয়ে যাবে। হাসপাতালে আর না থাকলেও চলবে।

তমাল বলল, “বাড়ি যাবি না?”

অর্ক উঠে বসে বলল, “নাহ। তোর বাসায় ভাবি আছে?”

“না। বাপের বাড়ি।”

“নিয়ে চল আমায়।”

তমাল একটা উবার ডেকে অর্ককে তার বাড়ি নিয়ে চলল। হালকা খাবার দিয়ে রাতের খাওয়া সারল দু’জন নিঃশব্দে।

খাওয়া শেষে তমাল বলল, “তুই ঘুমিয়ে পড়। যা কথা হওয়ার সকালে বলব।”

অর্ক তমালের হাত খামচে ধরে বলল, “আজই বলবি। এক্ষুনি বলবি। আমি শুনব। আমার কিছু হবে না। না বললে চলে যাব। কোথায় যাব জানি না।”

তমাল কয়েক পলক তাকিয়ে রইল অর্কর দিকে। মনে হচ্ছে না বলতেই হবে। অর্কর চোখে এতটা কাঠিন্য আগে কোনোদিন দেখেনি সে।

তমাল ওর সামনে বসল। বলল, “ঠিক আছে বলছি। কিন্তু তুই প্লিজ ঠান্ডা মাথায় শোন।”

“আমার মাথা ঠান্ডাই আছে। শুরু থেকে বল। কাল যেটা বলতে চাইছিলি সেটাই। একদম ডিটেইলসে।”

তমাল শুরু করল স্কুলের কাহিনী থেকে যেটা সে শুভকে বলেছিল। তারপর বলল, “সেদিন শারিকাকে তোর বাড়িতে তোর বউ হিসেবে দেখার পর আমার মাথাই ঘুরে গিয়েছিল। ও আমাকে ম্যাসেজ করত। ম্যাসেজগুলো দেখাই দাঁড়া৷ এইযে এগুলো লিখত। কল করত, কল রেকর্ডও আছে। শুধু বলত ওর পাস্ট তুই জানলে ও আমাদের ফ্রেন্ডশিপ নষ্ট করে দেবে। আমি তোকে এসব জানাতে চেয়েছিলাম। আবার ভয়ে জানাইনি। জানিয়েছিলাম শুভকে। জানাতে গিয়ে আমি জানতে পারলাম আরো ভয়ানক সত্য।

শুভকে প্রতি রাতে কল দিয়ে সিডিউস করত শারিকা। বিনিময়ে টাকাপয়সা চাইত এটা সেটা কেনার জন্য। ভিডিও কলে অসভ্যতা করত৷ শুভও কন্ট্রোল করতে পারেনি। সাড়া দিয়েছিল। তারপর নিজেই আর নিজের কাজগুলো সহ্য করতে না পেরে খেয়ে নিল ঘুমের ঔষধ।”

এই পর্যায়ে এসে অর্ক বলল, “শারিকা শুভকে ব্ল্যাকমেইল করছিল।”

“তুই কী করে জানলি?”

“সেটা বিষয় না। তুই তারপর বল।”

তমাল গতকালের লেখা শুভর নোটটা এনে অর্কর হাতে দিল। তাতে লেখা, “আমার মৃ ত্যুর জন্য কেউ দায়ি নয়। আমি একটি ভন্ড, চরিত্রহীন আর শয় তান লোক। আমার মতো বেঈ মানের ম রে যাওয়াই উচিত।”

“শুভর তারপর কী হলো তা তো জানিসই। তবে শুভর জীবনেই যে এরকম ঝড় এসেছে তা না। ইউনিভার্সিটিতে ও একজনের সাথে এরচেয়েও বড় ব্লান্ডার করেছিল।”

“কী করেছিল?”

“ছেলেটার নাম রুমন৷ ফার্স্ট ইয়ারেই শারিকার সাথে পরিচয়। বেশ হ্যাপি কাপল ছিল দু’জন। রুমন ওকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। আর বিশ্বাসও করত। দু’বছরের সম্পর্কে এমন কিছু নেই যা ছেলেটা ওর জন্য করেনি।

থার্ড ইয়ারে উঠে একদিন সে শারিকাকে এক সিনিয়রের সাথে আজেবাজে চ্যাট করতে দেখে। ধরার পর অনেক কান্নাকাটি করে শারিকা। ঘটনা শেষ হয়।

এর কিছুদিন পরেই মেয়েটা ওদের ইউনিভার্সিটির কোনো এক গেস্ট টিচারের সাথে কক্সবাজার যায় দু’দিনের জন্য। রুমনকে বলেছিল গ্রামে যাবে। সেটাও রুমন জানতে পেরে যায়। পাগলের মতো হয়ে যায় সে। প্রচুর রিয়েক্ট করে। এই ঘটনা নিয়ে ক্যাম্পাসেই অনেক ঝামেলা হয়।

শারিকা এরপর রুমনের সাথে সম্পর্ক শেষ করে অন্য সিনিয়রের সাথে রিলেশনে যায়। কয়েকদিনের ভেতরেই আবার দেখা যায় তাকে ছেড়ে অন্য কারো সাথে ঘুরছে। এরপর বিষয়টা কমন হয়ে যায় যে শারিকা একেকদিন যেমন একেক কাপড় পরে আসবে, তেমনই একেকদিন একেক ছেলের সাথে ঘুরবে। এমনকি এটাও কানাঘুঁষা শোনা গেছে যে ও টাকার বিনিময়ে সার্ভিস দিত।

সবকিছু আমি জেনেছি আমার বন্ধু শাফিনের থেকে৷ ও ওই ইউনিভার্সিটিতেই পড়ত। একই এলাকার ছিলাম বলে আমাদের কমন ফ্রেন্ড ওর কলেজ আর ইউনিভার্সিটি দুই জায়গাতেই পেয়ে গেছি৷ তুই চাইলে ওর আরো ব্যাচমেটদের সাথে কথা বলে শিওর হতে পারিস।

তো যা বলছিলাম, এসবের মধ্যে রুমন বেচারা প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিল। সে মানসিক ট্রমার মধ্যে চলে গিয়েছিল। পড়াশুনা করত না, পাশ করতে পারত না৷ ফেল করে করে রয়ে গিয়েছিল সেই থার্ড ইয়ারেই। এদিকে শারিকা পাশ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। তোকে বিয়ে করে নিয়েছিল। তখন তোকে হয়তো রুমন কল করত মাঝে মাঝে। তুই ওকে বিশ্বাস করিসনি। শারিকাকে ফিরে যেতে বলত ওর কাছে। ওর মানসিক অবস্থা তখনো খারাপ ছিল। কয়েকবার সু ই সা ই ডও করতে গিয়েছিল৷ এখন অবশ্য ভালো হয়েছে। অনার্স পাশ করেছে শুনলাম।”

অর্ক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কোনো মন্তব্য করল না। তার ভেতরটা বিষে ভরে আছে। আজ সারাদিন শারিকার সাথে কোনো কথা হয়নি। ফোনটা বহু আগেই সুইচড অফ করে রেখেছে সে।

কথা শেষে তমাল তাকে গেস্ট রুমে শুইয়ে দিয়ে নিজে শুতে গেল।

***********

মাঝরাতের দিকে রোবটের মতো উঠে বসল অর্ক। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল তমালের বাড়ি থেকে। তমালকে জাগাল না।

বেরিয়ে সোজা হাঁটতে লাগল রাস্তা দিয়ে। তার মাথাটা আবার প্রচন্ড ব্যথায় ছিঁড়ে যেতে যাচ্ছে। চুলগুলোর গোড়ায় গোড়ায় যেন কেউ সুঁই বিঁধিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। মাথাব্যথার সাথে সাথে চোয়াল ব্যথা করছে। চোখ জ্বালা করছে। চোখে এলোমেলো দেখতে শুরু করেছে।

এসব নিয়েও কেমন করে নিজের বাসা পৌঁছে গেল জানে না অর্ক৷ যেন এখানে পৌঁছানোরই ছিল তার। তাই অদৃশ্য শক্তি টেনে নিয়ে এসেছে তাকে।

কলিংবেল চাপল সে। শারিকা দরজা খুলে রাগে ফেটে পড়ে বলল, “কোথায় ছিলে তুমি? সারাদিন খোঁজখবর নাই! আমাকে কি পাগল করে ছাড়বে নাকি?”

অর্ক কোনো কথা না বলে প্রচন্ড এক থা প্পড় দিল শারিকার গালে। শারিকা সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ে গেল। অবাক হয়ে চেয়ে রইল সে অর্কর দিকে। ঠোঁট কে টে র ক্ত বের হচ্ছে। অর্ক নিজেই ওকে টেনে তুলল। তারপর দেয়ালের সাথে আটকে ফেলে গলা চে পে ধরল ওর৷ শারিকা প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল নিজেকে ছাড়াতে, পারল না।

ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার আগ মুহুর্তে ছেড়ে দিল অর্ক৷ ওর পাতলা শরীরটা ছুঁড়ে দিল ঘরের অন্যদিকে। প্রচন্ড জোরে বাড়ি খেল শারিকা শোকেসের গায়ে। কাচ ভেঙে হাতে ঢুকে গেল তার। র ক্ত দিয়ে মাখিয়ে গেল হাত। চিৎকার করে উঠল শারিকা।

অর্কর মাথায় এখনো এলোমেলো শব্দ বেজে চলেছে৷ একঘেয়ে কোনো রেকর্ড বেজে চলেছে। বুক জ্বলে যাচ্ছে। শারিকার কথা বা চিৎকার কোনোটাই তাকে স্পর্শ করতে পারল না। সে শারিকার কাছে গিয়ে ওর মুখ চেপে ধরল। চুলের মুঠি ধরে টেনে বলল, “অনেক শখ না তোর একেকবার একেক লোকের সাথে শোয়ার? যদি তোর এই শরীরটাই নষ্ট হয়ে যায় তাহলে কিভাবি যাবি? কেউ ফিরেও চাইবে না তোর দিকে।”

শারিকা আর্তনাদ করে উঠল।

অর্ক শারিকার জামাকাপড় টেনে খুলে ফেলল। রান্নাঘরে ঢুকে একটা ছু রি নিয়ে এলো। শারিকা প্রাণভয়ে কোনোরকমে উঠে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল।

অর্ক দরজা ধাক্কাল, ভাঙার চেষ্টা করল, কাজ হলো না৷ একসময় ওর মাথার যন্ত্রণা বাড়তে বাড়তে চরম পর্যায়ে চলে গেল। সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রইল মেঝেতে।

********

অর্কর আজকাল ঠিকমতো জ্ঞান ফেরে না। সে কেবল এলোমেলো দৃশ্য দেখে চোখের সামনে। চোখ মেলতে ইচ্ছে করে না৷ মনে হয় সারাক্ষণ কোনে স্বপ্ন দেখছে সে। সে কোথায় আছে, কী করে আছে কিছুই জানে না। একেকবার কে এসে তাকে বসিয়ে খাইয়ে দিয়ে যায় বুঝতে পারে না। চোখ মেললে চারপাশের সবকিছু ছোটো হয়ে আসে। মনে হয় কোনে ডিলিউয়শনের মধ্যে আছে সে।

পুরোপুরি জ্ঞান ফিরতে এক সপ্তাহ লাগল অর্কর। যেদিন সে ভালোভাবে চোখ মেলল, মাথা কাজ করতে শুরু করল, সে বুঝতে পারল এটা একটা হাসপাতাল।

সেদিনই তার সাথে দেখা করতে এলো তমাল আর শুভ।ওর শরীরের অবস্থা জেনে ওরা চলে গেল। আর কিছু বলল না৷ অর্করও কিছু জানার ইচ্ছে হলো না৷

অর্ক হাসপাতালে রইল আরো দিন তিনেক। এরপর হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল তমাল। তমালের বউ ফিরে এসেছে। ভালোমন্দ রান্না হলো সেদিন। খাওয়াদাওয়া করে তিনজন ড্রইংরুমে গিয়ে বসল।

এতক্ষণে প্রথম শারিকার কথা জানতে চাইল অর্ক। “কোথায় ও?”

ওরা দু’জন কোনো কথা বলল না। অর্ক আবারো জিজ্ঞেস করল, “শারিকা কোথায়?”

ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে তমাল বলল, “শী ইজ নো মোর।”

চমকে তাকাল অর্ক৷ ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার চেহারা। “হোয়াট! আমি… আমি কি ওকে খু..”

“না। তুই ওকে জখম করেছিলি শুধু।”

“তারপর?”

শুভ বলল, “তোকে সেদিন সকালে না পেয়ে তমাল তোর বাসায় যায়। সেখানে গিয়ে তোকে জ্ঞানহীন অবস্থায় আর শারিকাকে আহত অবস্থায় পায়। দু’জনকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তোর ট্রমা না কাটলেও শারিকা সেরে ওঠে তিনদিনের ভেতর৷ তুই যে সবই জেনে গেছিস সেটা জানতে পারে। আমরা ওকে অনেক অপমানও করেছিলাম।

সেদিন বাসায় ফিরে ও নিজের হাতের শি রা কে টে ফেলে। অতিরিক্ত র ক্ত ক্ষরণে মারা যায় সেদিনই। তার আগে অবশ্য একটা চিঠি লিখে যায়। চিঠিটা পুলিশের কাছে আছে৷ আমি ছবি তুলে রেখেছিলাম৷ এইযে।”

কাঁপা হাতে শুভর মেবাইলটা নিল অর্ক। স্পষ্টই শারিকার হাতের লেখা।

“I love you Arko.

তুমি আমাকে বিশ্বাস করো, আর না করো, আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসি। ভালোবাসি বলেই তোমাকে বিয়ে করেছি। ভালোবাসি বলেই তোমার কাছে নিজের কাজগুলো খোলাসা হয়ে যাবার পর বেঁচে থাকার ইচ্ছে শেষ হয়ে গেছে আমার। তুমি কেন আমাকে মে রে নিজে জেলে যেতে বলো? আমি নিজেই কাজটা করে নিজের পাপের বোঝা থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করে গেলাম।

কিছু কথা বলে যাই তোমাকে। আমি এসব কেন করতে শুরু করি সেটাই বলি। ছোটোবেলায় যখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখন একটা চকোলেট দিয়ে পাশের বাড়ির আঙ্কেল আমাকে ছুঁয়েছিল! কী নোংরা লেগেছিল আমার জানো? কিন্তু ওইযে চকোলেটের লোভ, সেজন্য আমি কাউকে কিছু বলিনি। তবে তার আবার ডাকাতেও আমি যাইনি কাছে। এরপর ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমার প্রাইভেট টিচার শাসন করা কিংবা আদর করার নামে আমার গায়ে হাত দিত। আমি প্রথমে ভয়ে কিছু বলতাম না। কিন্তু একদিন মনে হলো একেই যদি আমি উল্টো ভয় দেখাই? আমি ভয় দেখাতে শুরু করলাম সবাইকে বলে দেবার। বললাম, যা করছে তা করে যেতে চাইলে আমাকে রোজ চকোলেট কিনে দিতে হবে। সে দিত৷ বিনিময়ে রোজ সবার চোখ এড়িয়ে যতটা পারে নিজের শখ মিটিয়ে নিত। আমারও এসব আস্তে আস্তে মজা লাগতে শুরু করেছিল। একদিন খালি বাড়ি পাওয়ার সুযোগে যা বাকি ছিল তাও হয়ে গেল।

ক্লাস এইটে একটা প্রেম করতে শুরু করার পর আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা স্বাভাবিক হয়ে গেল। বহুগামী হতে তখন একটুও খারাপ লাগত না। বরং উপভোগ করতাম। সুবিধা আদায়ের জন্য কিংবা এমনিতেই শুধু ভালোলাগা থেকে কত মানুষের সাথে জড়িয়েছি হিসেব নেই।

কিন্তু আমারও তো একটা মন আছে। সেই নিষ্পাপ মনটা আমি ছোট্টবেলাতেই তোমাকে দিয়ে দিয়েছিলাম অর্ক। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসায় তুমি কোনো সন্দেহ করো না। তাহলে যে আমি মরেও শান্তি পাব না। আমি চাইলে ধনী, তোমার থেকেও হ্যান্ডসাম কাউকে বিয়ে করে ফেলতে পারতাম। কত ছেলে ছিল! কিন্তু তোমাকে ছাড়া যে আমি অপূর্ণ ছিলাম। আমার ভালোবাসায় কোনো খাঁদ ছিল না অর্ক।

তোমায় আমি কষ্টে দেখতে পারছি না। হাসপাতালে তোমার কষ্টে জর্জরিত মুখ দেখেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে মানুষটার জন্য আমার ভালোবাসার মানুষ এভাবে কষ্ট পাচ্ছে তাকেই শেষ করে দেব।

তুমি ভালো থেকো অর্ক। খুব ভালো থেকো। আমাকে ভালোবাসতে না পারো, শুধু ঘৃণা করো না৷ আমি সত্যিই তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসতাম।”

অর্ক চিঠি পড়ে মূর্তির মতো বসে রইল।

শুভ বলল, “পুলিশি ঝামেলা আমরা মিটিয়ে নিয়েছি। তোর কিছু হবে না। তুই ক’দিন আমার বাড়িতে গিয়ে আমার সাথে থাক। তারপর তোকে একটা নতুন বাসায় শিফট করিয়ে দেব। ওই বাসায় থাকতে হবে না।”

অর্ক কিছু বলল না।

তমাল ওর হাত ধরে বলল, “অর্ক, প্লিজ চেষ্টা কর স্বাভাবিক হতে।”

অর্ক প্রাণহীন গলায় বলল, “আমি তোর বাসায় যাব না শুভ। আমাকে আমার মায়ের কাছে দিয়ে আয়৷ অন্য কোথাও থাকলে হয়তো আমি আর বাঁচব না।”

************

অর্ক মায়ের কাছে থেকে মাসখানেক পর বেশ স্বাভাবিক হয়ে ফিরল। নিজেই বাসা বদলে ফেলল। সেখানে মা’কে নিয়ে এলো গ্রাম থেকে।

ওদের বন্ধুত্বও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এলো। একদিন অর্কর মায়ের দাওয়াতে ওদের বাসায় গিয়ে জমিয়ে খাওয়াদাওয়া আর অনেকদিন পর একটু খোলামেলা হাসিঠাট্টা হলো।

ফেরার পথে সেদিন হঠাৎ তমাল শুভকে জিজ্ঞেস করল, “তুই একবার বলেছিলি তুই বুঝতে পেরেছিস শারিকার মধ্যে কী আছে। কী ছিল বলতো?”

শুভ উদাস গলায় বলল, “নির্লজ্জতা। আমাদের সবার মনে একটা অন্ধকার অংশ থাকে। ভালো অংশের মতো সেই খারাপ অংশটাও বের হয়ে আসতে চায়, যাকে আমরা দাবিয়ে রাখি। ‘ড. জেকিল এন্ড মিস্টার হাইড’ গল্পটা পড়েছিলি না? সেই মিস্টার হাইডের মতো আমাদেরও খারাপ প্রবৃত্তি সুযোগ পেলে বের হয়ে আসতে চায়। আর শারিকা সেটাই ওর নির্লজ্জ কথাবার্তা আর কাজকর্ম দিয়ে বের করে আনত। ওটাই ছিল ওর আকর্ষণী ক্ষমতা। যেটা এড়িয়ে যাবার মতো শক্তি সবার আলোকিত অংশের থাকে না। আমারও ছিল না৷”

“অর্ককেও কি এভাবেই ফাঁসিয়েছিল?”

“চিঠি পড়ে তো সেটা মনে হয় না। হয়তো ও অর্ককে সত্যিই ভালোবাসতো। নয়তো এমন মেয়েরা তো সহজে ম রে না। শুধু রূপ বদল করে।”

“যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।” বেশ জোর দিয়েই বলল তমাল।

শুভ আপনমনে বলে উঠল, “হয়তো!”

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু