#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
দ্বাদশ পর্ব
পরিবারের বড়দের কথা চলছে ড্রইংরুমে। রুম্মান ভাইয়া আর আপুকে আলাদা কথা বলতে ছাদে পাঠিয়েছে। আমি এখানে সানাইয়ের পোঁ হয়ে এসেছি, মানে তাদেরকে পা°হা°রা দিতে এসেছি।
ছাদের দরজার কাছে বসে ফুলের পাপড়ি খুলছি। ফুলগুলো যদিও আপুর জন্য আনা হয়েছিল, কিন্তু এখন সেটা আমার দ°খ°লে।
“বসতে পারি, তন্বী?”
আমার পাশে এসে বসতে বসতে কথাটা বলল ইত্তাজা। একবার সেদিকে তাকিয়ে বললাম,
“অলরেডি বসে পড়েছেন।”
ইত্তাজা হাসলো। তারপর বলল,
“মন খারাপ নাকি?”
“না তো।”
“বোনের বিয়ে হবে মন খারাপ হতেই পারে।”
একটু থেমে পেছনে আপুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তানিমা আপু কিন্তু খুব খুশি। রুম্মান ভাইয়া ভালো মানুষ, তানিমা আপুও ভালো মানুষ। ভালো থাকবে উনারা।”
আমি কিছুই বললাম না। ইত্তাজা আবারো বলল,
“সারাক্ষণ চুপচাপ থাকো নাকি আমি বি°র°ক্ত করছি?”
“তেমন কিছু না। আসলে একটু টা°য়ার্ড, কাল থেকে ব্যস্ততায় আছি।”
“ওহ।”
ফুলগুলো পাশে রেখে খুব আগ্রহ নিয়ে বললাম,
“রুম্মান ভাইয়া কে হয় আপনার?”
ইত্তাজা খুব স্বাভাবিকভাবে বলল,
“আমার খালাতো ভাই। মানে আমার আম্মুর বোনের ছেলে।”
এমনভাবে কথাটা বলল যেন খালাতো ভাই কাকে বলে সেটা আমি জানিই না। চোখ ছোট করে তাকিয়ে আবারো ফুলের পাপড়ি বি°স°র্জ°নে মন দিলাম।
ইত্তাজা আমার হাত থেকে ফুলগুলো নিয়ে বলল,
“এগুলো এভাবে না ছিঁ°ড়ে সাজিয়ে রাখো, সুন্দর লাগবে। যদিও ফুল গাছে সুন্দর কিন্তু এভাবেও খারাপ লাগে না।”
মনে পড়ে গেল অয়নের কথা। অথৈ আপুর বিয়েতে বাগানে ফুল ছেঁড়ায় কত কথা আমাকে শুনিয়েছিল। “ফুল গাছে সুন্দর জানিস না?” এই একটা এখন আবারো কানে বেজে উঠলো।
“কি হলো, তন্বী?”
ইত্তাজার ডাকে ভাবনা থেকে ফিরে বললাম,
“নাথিং।”
আপু আর রুম্মান ভাইয়া নিচে যাচ্ছিল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে আপুকে বললাম,
“চলো।”
আপু আগে নেমে গেল। আমি সিঁড়ির কয়েক ধাপ পেরোতেই রুম্মান ভাইয়ার একটা কথা শুনলাম,
“তবে ইত্তাজা আমার পর না হয় তোর বিয়েটাও সেরে ফেল, মেয়েটা খারাপ না। মানাবে তোদের।”
দ্রুত বাসায় চলে আসলাম। রুমে গিয়ে আপুকে বললাম,
“কেমন বুঝছো?”
“কি?”
না বোঝার ভাব দেখে একটু রাগ হলো।
“রুম্মান ভাইয়াকে কেমন বুঝছো?”
“ভালোই তো, তবে কথা একটু বেশি বলে।”
আমার হাসি উঠলো। আমার রা°গিরা°গি আপুর সাথে বা°চাল ভাইয়া, বেশ ভালো কম্বিনেশন হবে। যাকে বলে “Made for each other.”
সন্ধ্যা ৭ টায় মেহমানরা সবাই বিদায় নিলো। আপুর চতুর্থ সেমিস্টার পরীক্ষার পর বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হলো। নভেম্বরের ৪ তারিখে বিয়ে। এখন সবে জানুয়ারি চলছে, মানে আপুকে আরো ১১ মাস অপেক্ষা করতে হবে।
বাচ্চার মুখ দেখতেও মাকে দশ মাসের বেশি অপেক্ষা করতে হয় না আর এখানে জামাইকে পেতেই এগারো মাস লাগবে। আপুর জায়গায় আমি হলে নি°র্ঘাত রাতারাতি বরকে কি°ড°ন্যা°প করে নিয়ে বিয়ে করতাম।
আপু ফ্রেশ হতে গেছে আর আমি ড্রইংরুম গোছাচ্ছি। মানহা এখনো আমার সাথে আছে, সেও আমাকে ঘর গুছাতে সাহায্য করছে। মানহাকে রাতে খেয়ে যেতে বলেছে আম্মু।
সোফার উপর থেকে এক টুকরো কাগজ এনে মানহা আমার হাতে দিয়ে বলল,
“দেখতো এটা।”
“কি?”
হাতে নিয়ে দেখি কাগজে লেখা, “তোমার হাতে কাগজটা পড়বে, আমি জানি। তাই তো বলছি, আজ তোমায় খুব সুন্দর লাগছিল। মন চাচ্ছিল আজই তোমাকে নিজের মনের কথা বলে দিই, কিন্তু আমি অ°পা°রগ। শীঘ্রই আসবো তোমার কাছে। ভালোবাসাটুকু তুলে রেখো।”
দুজনে চিঠি পড়ে মিটিমিটি হাসছি। আম্মুকে এদিকে আসতে দেখে দ্রুত কাগজটা লুকিয়ে ফেললাম।
দুজনে ড্রইংরুম গুছিয়ে রেখে রান্নাঘরে ডিসওয়াশ করছি। রুম্মান ভাইয়া ঠিক কখন এই চিরকুট লিখলো আর কেন এটা ওখানে রাখলো? অদ্ভুত ঘটনায় অদ্ভুত চিন্তা হচ্ছে। আদৌতেও কি চিঠিটা রুম্মান ভাইয়া লিখেছে?
“তন্বী।”
আপুর ডাক পড়লো। রুমে গিয়ে দেখি আপু ফোনে কথা বলছে। আমাকে দেখে হেসে উঠে এসে ফোনটা আমার কানে দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি বোকার মতো আপুর দিকে তাকিয়ে ফোন ধরলাম।
ফোনের ওপার থেকে অয়নের কন্ঠ ভেসে আসলো,
“তনুশ্রী, কথা বলবি না আমার সাথে?”
একটা ঢোক গিলে বললাম,
“প্লিজ, আমাকে আর কল করো না। যোগাযোগ করো না আমার সাথে।”
“কেন?”
একটু রাগি স্বরে বললাম,
“কারণ তুমি জানো অয়ন। আর তাছাড়া বাবা আমাকে অনেক বিলিভ করতেছে, আমি বাবার সাথে প্রতারণা করতে পারবো না।”
অয়ন চুপ করে আছে। আমি আবারো বললাম,
“যোগাযোগ বন্ধ করো। ধরে নাও আমার সাথে কখনো দেখাই হয়নি।”
“তুই পারবি এটা ধরে নিতে?”
“হ্যাঁ, আমি পারবো।”
অকপটে কথাটা বলে দিলেও চোখ তার সাথ দিলো না। অশ্রুধারা তো আর ফোনের ওপারে থাকা অয়ন দেখবে না।
তাই যথাসম্ভব স্বাভাবিক হয়ে বললাম,
“সবটা ভুলে যাবো আমি, তুমিও ভুলে যাও। জীবন আপন গতিতে চলে। অতীত আকড়ে পড়ে থেকে জীবন থেকে বি°চ্ছি°ন্ন হওয়ার কোনো মানে নেই।”
“যতোই বড় বড় কথা বলিস না কেন আমি জানি তুই কষ্ট পাচ্ছিস।”
অয়ন কল কেটে দিলো। আমি কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়লাম। পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তাকিয়ে দেখি আপু দাঁড়িয়ে আছে।
“স°হ্য যখন করতে পারবিই না, তবে কষ্ট দিস কেন?”
আপুর কথায় কান্নার পরিসরটাই বাড়লো। সবটা ভুলে যাওয়া কখনোই সম্ভব না। অয়নকে ছাড়া জীবন থেকে আমি নিজেই বি°চ্ছি°ন্ন হয়ে যাবো, ছি°ট°কে যাবো আমার স্বাভাবিক ছন্দ থেকে।
মানহা এসে দ্রুত আমার পাশে বসে বলল,
“কি হয়েছে আমার তনুমনু? (আপুকে বলল) কি হয়েছে আপু?”
“অয়নের সাথে…”
কথা শেষ না করেই হাত নেড়ে কিছু একটা দেখিয়ে আপু বেরিয়ে গেল।
মানহা দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“কখন পড়লি এমন প্রেমে পাগলি? এমনভাবে জড়িয়ে গেলি যে ছেড়ে আসা সম্ভব না।”
“আমি কি করবো? বাবার বিশ্বাস ভা°ঙাও তো সম্ভব না।”
মানহা আমার চোখের পানি মুছে দিলো। এমন এক সমস্যা যা ওর পক্ষে সমাধান করা এখন সম্ভব নয়।
মনের এই বি°চ্ছি°রি অবস্থায় চিঠিটা আপুকে দেখানোই হলো না। সারারাত কেঁদে কেঁদে কা°টিয়ে দিলাম। ভোরে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছি। চোখ ব্য°থা করছে, হয়তো লাল হয়ে ফুলেও গেছে। এখনো চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে।
ভুলে যাবো বললেই কি আর ভুলে যাওয়া যায়? মৃ°ত্যু ছাড়া অয়নকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব, একরাতেই তা টের পেলাম আমি। এই মানুষটাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো আমি? পারবো না তো।
এমনসময় ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে অয়নের নাম্বার দেখে রিসিভ করতে না চেয়েও রিসিভ করলাম। রিসিভ না করলে সে কল দিতেই থাকবে, আর ফোনটা বাজতেই থাকবে।
“তনুশ্রী, বাইরে আয় প্লিজ।”
দ্রুত বারান্দায় গেলাম, বারান্দা থেকে রাস্তা যতটুকু দেখা যায় দেখলাম। অয়ন নেই, তবে নিচে কেন যেতে বলছে।
“তনুশ্রী।”
“আমি..”
গলা কেঁ°পে উঠছে, কথা বলতে পারছি না।
তখনই রাস্তার অপরপাশে দেখি অয়ন দাঁড়িয়ে হাত নাড়লো। ফোনে ভেসে আসলো তার কথা,
“তুই দূরে সরাতে পারবি না, আমি বে°হা°য়ার মতো কাছে আসতেই থাকবো।”
নিজেকে করা প্রতিজ্ঞা আর রাখা হলো না।দৌড়ে নিচে নেমে গেলাম। রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই, এতো শীতের মধ্যে ভোরে কেউ রাস্তায় বের না হওয়াই স্বাভাবিক। এক দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে সোজা অয়নকে জড়িয়ে ধরলাম।
দুহাতে আমাকেও ঝা°পটে ধরে রাখলো সে। অঝোরে কাঁদছি আমি। মাথা তুলে একটু উঁচু হয়ে অয়নের দুগালে হাত দিয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলাম। তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম মিটিমিটি করে হাসছে। ওকে দেখে বুঝলাম সারারাত শুধু আমি না সেও কষ্ট পেয়েছে, কান্না সেও করেছে।
আমাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে বলল,
“আই লাভ ইউ, মাই তনুশ্রী। সম্পর্কের নাম চেয়েছিলি না, এই নে দিয়ে দিলাম নাম। ভালোবাসা হয়েছিস তুই আমার।”
পকেট থেকে টিস্যু বের করে আমার চোখ, গাল মুছে দিতে দিতে বলল,
“কি যেন বলছিলি কালকে? সব ভুলে যাবি, এভাবে ভুলবি বুঝি? সারারাত কেঁদেছিস, তাই না? নিজেকে কষ্ট দিয়ে কি°চ্ছু হবে না।”
“পারবো না তোমাকে ছাড়া থাকবে। সম্ভব না আমার পক্ষে।”
আবারো কান্নার রে°শটা চলে আসলো। অয়ন জড়িয়ে ধরে বলল,
“কাঁদিস না, আমি আব্বুকে দিয়ে আংকেলের সাথে কথা বলাবো। বিয়ের প্রস্তাব দিবো। সারারাত ভেবেছি, এরচেয়ে ভালো আইডিয়া আর পাইনি।”
অয়নকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে বললাম,
“তোমার মনে হয় বাবা এতো সহজে রাজি হবে?”
অয়ন হেসে বলল,
“হবে, হবে। আংকেল ঠিক রাজি হবে।মেয়েকে এতো ভালোবাসে, তাই মেয়ের খুশিটাই আগে দেখবে। তবে তার আগে আমার একটা জব লাগবে। ফাইনাল এক্সাম কয়দিন পরেই, নো টেনশন। মহারানী আমার।”
মন পায়রাগুলো বাক-বাকুম করে উঠলো। অয়নকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দ, বাবাকে খুশি দেখার আনন্দ, সবটাই পেয়ে বসলো আমাকে।
অয়ন আমার কপালে চুলগুলো সরিয়ে বলল,
“অপেক্ষা করবি না আমার জন্য?”
“কি বলছো তুমি এসব? অপেক্ষা করবো তো আমি।”
“আমি তো আংকেলের সামনে গিয়ে কোনোদিন চেঁ°চিয়ে বলতে পারবো না আপনার মেয়েকে আমি আপনার চেয়ে ভালো রাখবো। আংকেলের চেয়ে বেশি ভালো তোকে রাখতে পারবো না আমি।”
আমি চেয়ে রইলাম তার মুখের দিকে।
অয়ন আবারো বলল,
“যে বাবা জন্মের আগে থেকে মেয়ের জন্য পৃথিবীকে অনুকূলে আনতে চায়, তার চেয়ে বেশি তার মেয়েকে ভালোবাসাই তো অসম্ভব।”
নিচুস্বরে শুধু বললাম,
“অয়ন?”
সে হাসলো।
“ভ°য় পাস না। এতোটা কমও ভালোবাসি না যে হাতটা সহজেই ছেড়ে দিবো। অপেক্ষা করিস, বধূ করেই নিয়ে যাবো আমি। কথা দিলাম।”
আমি চুপ আর সেও। দৃষ্টি নি°ব°দ্ধ একে অপরের দিকে। মানুষটাকে আমি অদ্ভুত ভাবতাম, অথচ সে বাস্তবিক। বাস্তবতা আমার চেয়ে ভালো বুঝে৷ আমি তো আবেগ, অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেই প্রতিনিয়ত আর সে ভেবে চিন্তে বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়।
অয়নকে বিদায় জানিয়ে বাসায় চলে আসলাম। বারান্দায় গিয়ে দেখি সে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ইশারায় চলে যেতে বললাম আর সে উড়ন্ত চু°ম্বন দেখিয়ে চোখ টিপে দিলো। মনের অজান্তেই ফি°ক করে হেসে উঠলাম আমি। লজ্জারা আমার কষ্টগুলোকে নিয়ে উড়াল দিলো দূর অজানায়।
চলবে………
#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
ত্রয়োদশ পর্ব
“রুম্মান ভাইয়া তোমাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে।”
আমার কথায় আপু কপাল কুঁচকে বলল,
“একদিনেই?”
“হুম।”
“বলছে তো তোরে।”
ভে°ঙ°চি কে°টে চলে যেতে নিলে আমি আপুর হাত টেনে ধরে বললাম,
“সত্যি বলছি। ওয়েট।”
টেবিলের ড্রয়ার থেকে চিঠিটা বের করে আপুর হাতে দিয়ে বললাম,
“দেখো এটা।”
আপু চিঠি পড়তে শুরু করলো। মুখে মিটিমিটি হাসি আর গালে ঈষৎ লাল আভা দেখে রুম ত্যাগ করলাম আমি। আপাতত তাকে আর লজ্জায় না ফেলাই ভালো।
ড্রইংরুমে এসে টিভি ছেড়ে বসে পড়লাম৷ দশ মিনিটের মাথায় আপু এসে বলল,
“ভোরে কোথায় গেছিলি?”
আশেপাশে তাকিয়ে বললাম,
“অয়ন এসেছিল, দেখা করতে গেছিলাম।”
আপু চোখ বড়বড় করে বলল,
“একটু ভ°য় লাগলো না?”
“না।”
আপুকে টেনে আমার পাশে বসিয়ে বললাম,
“আপু, একটা কথা জানো?”
“কি?”
“অয়ন রাস্তার অপরপাশে দাঁড়িয়ে ছিল, আমি দৌড়ে গিয়ে একেবারে সিনেমাটিক অ্যা°ক°শ°নে জড়িয়ে ধরেছি।”
আপু ভ্রূ উঁচিয়ে তাকিয়ে রইলো। আমি বলতে থাকলাম,
“আমার খুব ইচ্ছা ছিল, অয়ন আমাকে হাঁটু গেড়ে বসে প্রপোজ করবে বাট সেটা হলো না। কিন্তুউউউ…”
আমার কিন্তু বলার সুর শুনে আপু একটু বিরক্ত হলো বোধহয়। কপাল কুঁচকে বলল,
“ডিরেক্ট তোর সিনেমায় যা।”
“কিন্তু আজকে আমাকে জড়িয়ে ধরে কি যে মিষ্টি করে আই লাভ ইউ বলল। ইশ, এখনো কানে বাজছে।”
আপু গলা চুলকে বলল,
“তুই আর গি°র°গি°টি, দুটোই সেম।”
“আরে না, অয়ন আংকেলকে দিয়ে আব্বুর সাথে কথা বলাবে।”
“মানে?”
মাথানিচু করে ঢং করে বললাম,
“ইয়ে মানে..”
আপু ধমক দিয়ে উঠলো,
“এই, কি বলবি সোজাসাপ্টা বল।”
“মানে, বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। তবে আগে অয়ন একটা জব নিবে, তারপর বিয়ে।”
আপু উঠে দাঁড়িয়ে আমার চশমা ঠিক করে দিয়ে বলল,
“পড়তে বস গিয়ে। সারাদিন প্রেম করলে ভার্সিটি জুটবে না। অয়ন তো পার হয়ে গেছে, তোমার নিজের চিন্তা করো।”
দিলো আমার রোমান্টিক মুডের চৌদ্দটা বাজিয়ে। এই কারণে আপুকে আমার ভালো লাগে না। রাগ দেখিয়ে বললাম,
“দূর।”
উঠে রুমে এসে পড়তে বসলাম। আপুর কথায় আসিনি, অয়ন তার বাচ্চার জন্য শিক্ষিত মা চায় সেজন্য এসেছি। ভারী শব্দ মা, আগে অভ্যস্ত না হলেও এখন হয়ে যাচ্ছি।
জানুয়ারির পর একেবারে আগস্ট মাস,
একের পর এক ভার্সিটি এক্সাম আসছে আর যাচ্ছে। আর আমি টে°নে°টু°নে পাশ নাম্বার তুলে আসছি। আপু ঠিকই বলেছিল, সারাদিন প্রেমের চিন্তায় থাকলে ভার্সিটি জুটবে না। দিনরাত অয়নের চিন্তাই মাথায় ভনভন করছে। সাথে তো বাবাকে মানানোর চিন্তা আছেই। কোনোভাবেই এর থেকে মু°ক্তি মিলছে না।
পাঁচদিন পর চট্টগ্রাম যাবো পরীক্ষা দিতে৷ জানি এবারেও কোনো লাভ হবে না, তবুও যেতে হবে। কারণ বাবা চায় আমি কোনো একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।
ট্রেনের টিকেট পাওয়া গেল। বাবা যাবে আমার সাথে কিন্তু আজকেই জানা গেল বাবাকে অফিসের কাজে ঢাকায়ই থাকতে হবে। অর্থাৎ আমি একা যাবো। চট্টগ্রাম মামার বাসায় গিয়ে থাকবো আর পরদিন সকালে পরীক্ষা দিতে যাবো। মামা আমাকে স্টেশন থেকে নিয়ে যাবে৷ বাবা আমাকে এসব বুঝিয়ে সুঝিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিলেন।
রুমে এসে লাফ দিয়ে খাটে বসলাম। আপু পড়ছিল, আমাকে এমন আচরণ করতে দেখে বলল,
“সমস্যা কি?”
“টিকেট দুইটা বাট আমি একা।”
“তো?”
মিটিমিটি করে হেসে বললাম,
“অয়নের এক্সাম শেষ হলো। এখন যদি যেতে বলি তাহলে তো শিউর যাবে। কতদিন দেখা হয় না ওর সাথে বলোতো ?”
আপু বালিশ নিয়ে আরাম করে বসে বলল,
“লজ্জা তোর হবে না, তাই না? এতো জায়গায় পরীক্ষা দিয়ে কোনোমতে পাশ নাম্বার তুলিস, এখন আবার পরীক্ষা দিতে যাবি তাও অয়নকে নিয়ে?”
আপুর কোলে থাকা বালিশে শুয়ে বললাম,
“নো টেনশন আপু। এসব ব্যাপার না।”
“তোর তো আসল ব্যাপার অয়ন।”
ন্যাকামি করে বললাম,
“হ্যাঁ।”
“ঢং যতসব।”
রাত শেষে সকাল হলো। সারারাত অয়ন ফোন রিসিভ করেনি। সকালে কলব্যাক করে বলল,
“রাতে কল দিয়েছিলি?”
অভিমান নিয়ে বললাম,
“হুম, কিন্তু তুমি তো সেই বিজি।”
“সরি, বাট কল কেন দিয়েছিলি?”
অয়নের কথা খাপছাড়া লাগলো। যেন কোনোমতে কথা শেষ করতে পারলে বাঁচে৷ একটু খারাপ লাগলো, তবুও বললাম,
“অয়ন, আমি চট্টগ্রাম যাবো। বাবা সাথে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু যাবে না। তুমি কি যাবে আমার সাথে?”
অয়নের উত্তর না পেয়ে বললাম,
“কি হলো, যাবে কিনা বলো না।”
“না রে, আমি একটু ব্যস্ত আছি।”
“কিসের এতো ব্যস্ততা?”
অয়ন ধ°মকের সুরে বলল,
“ব্যস্ত মানে ব্যস্ত থাকবো। আর তাছাড়া পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিস, ভালো করে পরীক্ষা দে। বেস্ট অফ লাক।”
ধমক খেয়ে কল কে°টে দিলাম। এতোটা বাজে ব্যবহার কেন করলো অয়ন। ওর এইটুকু আচরণ আমাকে কষ্ট দিতে থাকলো৷ কয়েকবার কল দিলেও আর রিসিভ করলাম না। বরং ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দিলাম।
কোনোরকমে কেটে গেল দিনগুলো, চট্টগ্রাম যাবো আজ। বাবা আমাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে যাবে। ভোর ভোর উঠে রেডি হয়ে গেলাম।
আপু নাস্তা খাওয়াতে এসে বলল,
“অয়ন ভাই যাবে?”
“না।”
হুট করে বলা কথাটাতে আপু চমকে তাকালো। তারপর রুটি ছিঁ°ড়ে মুখে তুলে দিতে দিতে বলল,
“ওকে, সাবধানে থাকিস। অপরিচিত কারো সাথে কথাই বলিস না। তোর তো আবার সবকিছুতে অতিরিক্ত ইন্টারেস্ট।”
কিছুই বললাম না। চুপচাপ খেয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে গেলাম বাবার কাছে। পিছন ফিরে দেখলাম আপু নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে।
সকাল সাতটার ট্রেন, সাড়ে ছয়টায় পৌঁছে গেলাম কমলাপুরে। বাবা আমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে ট্রেন চলে আসলো। বাবা আমাকে সিট খুঁজে বসিয়ে দিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়।
জানলা দিয়ে বললেন,
“পাশের সিটে ব্যাগ রেখে দাও, কাউকে বসতে দিবে না। টি°টিকে ঠিকমতো টিকেট দেখাবে।”
“জি।”
“তোমার মামা স্টেশনে থাকবে, খুঁজে না পেলে কল দিও। আর পৌঁছে আমাকে অবশ্যই জানাবে।”
“জি, ঠিক আছে।”
বাবা একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। আমি এখনো ট্রেনের জানলা দিয়ে মাথা বের করে প্লাটফর্মের দিকে তাকিয়ে আছি, এখনো মনে হচ্ছে অয়ন আসবে। কিন্তু আমার চিন্তা ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে অয়ন আসলো না।
বাবা একটু জো°রে বললেন,
“এভাবে মাথা বের করো না, আম্মু। ঠিক হয়ে বসো।”
আমি সিটে হেলান দিয়ে বসে হাত নেড়ে বাবাকে বিদায় দিলাম।
ইঞ্জিনে ধা°ক্কা লাগলো, সি°টি বেজে উঠলো, ট্রেন চলতে শুরু করলো। আপন গতিতে পিছনে ফেলে আসলো প্লাটফর্মকে।
আমি বাইরে তাকিয়ে আছি। দুপাশে ছোট ছোট কুঠুরির মতো ঘরগুলোতে নাকি মানুষ থাকে, বাবা বলেছিল আমাকে এই কথা। কি করে থাকে এখানে? আমাদের এই ট্রেনের বগিটাও তো ওই ঘরগুলো থেকে বড়। সত্যিই মানুষ কত ক°ষ্ট পায় আর আমরা শুধু আমাদের কষ্টটাকেই প্রাধান্য দেই।
সেদিনের ধ°মকের পর অয়নের সাথে আর কোনো কথাই বলিনি। অয়ন হয়তো কোনো সমস্যায় ছিল, তাই ওরকমভাবে বলেছে। আমিও তো তার সমস্যাটা বুঝতে চাইনি। আমার তো বোঝা উচিত ছিল।
এসব চিন্তাভাবনার মধ্যেই ট্রেন এসে পৌঁছালো এয়ারপোর্টে। ট্রেন থামলো, বেশ কিছু মানুষ উঠছে। এবারেও আমি বাইরে তাকিয়ে আছি। কিন্তু এবারে আর অয়নের আসার অপেক্ষা করছি না, কারণ সে তো আমার ট্রেনের নাম বা সময় কোনোটাই জানে না।
ফোন বাজছে, বের করে দেখি মানহা কল দিয়েছে। রিসিভ করলাম,
“কিরে?”
“এভাবে কথা বলছিস কেন? কোথায় তুই?”
“ট্রেনে আছি।”
“চিটাগাং যাচ্ছিস?”
“হুম।”
“আচ্ছা, অল দ্য বেস্ট। বাই দা ওয়ে, অয়ন ভাই..”
মানহার কথার মাঝেই ধ°মক দিয়ে বললাম,
“আসেনি, সে আমাকে ব°কা দিয়েছিল কিন্তু আসেনি। একবার তো দেখাও করতে পারতো?”
“আচ্ছা, বাদ দে দোস্ত। মন খারাপ করিস না।”
“কল রাখ।”
বলে নিজেই কে°টে দিলাম। কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না কারো সাথে, শুধু অয়নের কন্ঠ শুনতে ইচ্ছা করছে।
পাশ থেকে চিপসের প্যাকেটের শব্দ পেলাম। পাশের খালি সিটে রাখা আমার ব্যাগটা আমার উপর কেউ ছুঁ°ড়ে মা°র°লো।
রেগে বললাম,
“দুই সিটের টিকেট আছে।”
“বাট ইটস মাইন।”
অয়ন বসতে বসতে কথাটা অবলীলায় বলে দিলো। অবাকের ঠিক কোন পর্যায়ে আছি নিজেও জানি না। মনের অজান্তেই আমার আদরের মস্তিষ্ক আমার ঠোঁটজোড়া ফাঁকা করে দিয়েছে, চোখদুটো অনবরত পি°টপি°ট করছে।
অয়ন আমার থুতনিতে হাত দিয়ে মুখ বন্ধ করে বলল,
“আমি সুন্দর, যথেষ্ট হ্যান্ডসাম তা আমি জানি। এভাবে হা করে তাকানোর কিছু নেই।”
অভিমানের রেশটুকু আবারো টেনে এনে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
“কথা বলবো না আমি তোমার সাথে।”
অয়ন চিপসের প্যাকেট খুলে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“সেদিন যাবো বললে তো সারপ্রাইজ নষ্ট হয়ে যেতো।”
চিপস নিয়ে মুখে দেয়ার সময় খেয়াল গেল অয়নের হাতের দিকে, সাদা মোটা ব্যা°ন্ডে°জটা এতোক্ষণ কিভাবে আমার চোখ এড়িয়ে গেল।
অয়নের হাতটা ধরে বললাম,
“কি হয়েছে এখানে?”
“কে°টে গেছে।”
সিটে হেলান দিয়ে তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছি৷ বাম হাতের তালু থেকে কবজি পুরোটাই ব্যা°ন্ডে°জে প্যাঁচানো৷
“প্রেমিকার জন্য হাত কা°টা°র যুগ কি এখনো আছে?”
অয়ন হো হো করে হেসে উঠে বলল,
“ওরে আমার কিউট প্রেমিকা রে, আপনার জন্য আমি হাত কা°টি নাই। এটা এ°ক্সি°ডে°ন্টলি কে°টে গেছে।”
কপাল কুঁচকে বললাম,
“একদম হাসবে না। কি করে কা°ট°লো?”
“বাসায় গিয়েছিলাম, ওখানে একটু কে°টে°ছে।”
দুহাতে অয়নের হাত ধরে বললাম,
“এইটা একটু বুঝি? আর বাসায় যাওয়ার সাথে হাত কা°টার কি সম্পর্ক?”
অয়ন হাত সরিয়ে বলল,
“বাদ দে। এটা খা।”
অয়নের কথায় পাত্তা না দিয়ে ওর হাত টেনে কাঁধে মাথা রেখে বললাম,
“ফাইনাল এক্সাম তো শেষ তোমার।”
“হুম।”
“তো এখন কি ভাবলে?”
“এখন চিল করবো কয়েকদিন।”
মাথা তুলে রাগি সুরে বললাম,
“আগে জব নেও, তারপর চিল কাক বক যা খুশি করো।”
অয়ন বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো, চেহারায় একটু চিন্তা ভাব দেখলাম। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
“হুম, জব নিবো।”
“কিছু ভাবছো তুমি? কি নিয়ে চিন্তিত?”
অয়ন হাসলো৷ তারপর বলল,
“বাসায় একটু সমস্যা হয়েছে তাই নিয়েই চিন্তায় আছি।”
“বাসায় সমস্যা, আবার বাসায় গিয়ে হাত কে°টে°ছে। আসলে হয়েছেটা কি?”
অয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তনুশ্রী আমার, জীবনে অনেক সমস্যা না চাইতেও চলে আসে। পারিবারিক সম্পর্ক সারাজীবন একরকম থাকে না। এসব তুই বুঝবি না।”
অয়ন কথাটা বলতে চাইছে না। অয়নের বুকে হাত দিয়ে কাঁধে মাথা রেখে বললাম,
“প্লিজ, এভাবে মন খারাপ করে থেকো না।”
“ব্যাপার না।”
প্রায় ৫ ঘন্টা পর চট্টগ্রাম স্টেশন এসে পৌঁছালাম। সারা রাস্তা অয়ন বেশ চুপচাপ রইলো। এতোদিন পর দেখা হলো অথচ ও কথাই বলছে না। আনমনে বাইরে চেয়ে থাকে, আমি কথা বললে হু, হা উত্তর দেয়।
ওর অবস্থা দেখে মনে হলো ও আমাকে কিছু বলতে চায়। কয়েকবার জিজ্ঞাসা করলেও তেমন কিছুই বলল না। আবার আমার দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক যেন কিছু বলবে, কিন্তু তবুও বলল না।
ট্রেন থেকে নেমে অয়নকে বললাম,
“আমাকে নিতে মামা আসবে, তুমি কোথায় থাকবে?”
অয়ন আশেপাশে দেখতে দেখতে বলল,
“যেখানেই থাকি, তোর সাথে আর না।”
“মানে?”
নিচু হয়ে বলল,
“মানে? ওরে মানে ম্যাডাম, ই°জ্জ°ত শেষ করেও আবার জিজ্ঞাসা করে মানে কি।”
কিছু না বলে সামনে এগিয়ে গেলাম। মামাকে খুঁজে পেতে বেশ কষ্ট হলো। কল করলাম এবং একসময় পেয়েও গেলাম।
মামার সাথে কথা বলার সময় পেছনে ফিরে আর অয়নকে দেখতে পেলাম না। কি হয়েছে অয়নের জানার জন্য মনটা আ°কু°পা°কু করতে থাকে। বড়সড় কিছু হয়েছে তা বেশ বুঝতে পারছি, কিন্তু হয়েছেটা কি?
পরীক্ষার চিন্তা চলে গেল আমার মস্তিষ্ক থেকে, শুধু পরে রইলো অয়ন। না তাকে দেখছি আর না তার অবস্থাটা বুঝতে পারছি।
চলবে…….