#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
ষট্ বিংশ পর্ব (অন্তিম পর্ব)
দুপুর দুইটার পর আমাকে সাজানোর জন্য রুমে আসলো আপুরা। কিন্তু তানিমা আপু নেই এখানে। রুম্মান ভাইয়া নামাজ পড়তে গিয়ে এখনো আসেনি। আপু হয়তো এখনো ভাইয়ার বলা কথাগুলো নিয়েই ভাবছে।
আয়েশা আপুকে বললাম,
“আপু, বাবা কোথায়?”
আপু একটু ভেবে বললেন,
“ফুপা তো এখনো নামাজ থেকে ফেরেনি।”
“এখনো না?”
“আসলেও দেখিনি আমি।”
শাড়ি পড়িয়ে, মেকআপ চলছে এরমধ্যে দরজায় নক পড়লো।
“তন্বু মা, একটু বাইরে আসো।”
বাবার কন্ঠ পেয়ে আমি লা°ফিয়ে বেরিয়ে গেলাম। বাবা আমাকে দেখে জোরপূর্বক একটু হাসলেন। হাত ধরে নিয়ে গেলেন তানিমা আপুর রুমে।
এরুমে রুম্মান ভাইয়া আর আপুও আছে। আমরা যেতেই ভাইয়া বলল,
“তন্বী আমাকে রিকুয়েষ্ট করেছে যেন বিয়েটা ভে°ঙে দেই।”
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তাই?”
“বাবা, অয়ন তো আসবে বলেও গাজীপুর যাচ্ছে। সে…”
আমার কথার মাঝেই বাবা বলল,
“আসবে, অয়ন না এসে পারবে না।”
আম্মু এসে দরজার কাছে দাঁড়ালো। তানিমা আপু বলে উঠে,
“সকলের মাঝে আমি একটা কথা বলি? বিয়েটা ঠিক করাই উচিত হয়নি। আমাদের ভুল হয়েছে। মানহা আমাকে বলেছে ইত্তাজা সম্পর্কে।”
রুম্মান ভাইয়া বলল,
“ইত্তাজা খারাপ নয়। হয়তো কোনো কারণে ও নিজেকে খারাপ করে প্রেজেন্ট করছে। কিন্তু তনু যেহেতু চাচ্ছে না তাই বিয়েটা হলে সবার জন্যই ক্ষ°তি।”
বাবা বোধহয় একটু চিন্তিত হলো। কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো আমার দিকে। বিষয়টা স্বাভাবিক, বিয়ের দিন বিয়ে ভা°ঙা মোটেও সহজ কিছু না।
এরমধ্যে ফারিহা আপু দরজার বাইরে থেকে বলল,
“খালু, মেহমানরা এসেছে।”
বাবা চমকে উঠলো। রুম্মান ভাইয়ার দিকে তাকালে ভাইয়া বলল,
“আমি দেখছি।”
ভাইয়া বেরিয়ে যেতেই বাবা আপুকে ইশারা করলেন আমার সাজ শেষ করানোর জন্য। উনারাও হয়তো বুঝতে পারছেন বিয়ের একঘন্টা আগে বিয়ে ভা°ঙা সম্ভব নয়। অয়ন কেন এমনটা করলো? সে কি আসতে পারতো না?
নিজের রুমে যাওয়ার সময় ড্রইংরুম থেকে একটা চেনা কন্ঠ শুনলাম। আপুর দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে ডাইনিং-ড্রইংরুমের মাঝের পর্দাটা একটু সরিয়ে দেখি যা ভেবেছি তাই, অয়ন এসেছে। একা নয়, সাথে আনোয়ার আংকেল আর ইত্তাজাও আছে।
ইত্তাজাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে বিয়ে করতে এসেছে। সাধারণ একটা কালো টি-শার্ট আর লাইট ব্লু জিন্স পড়নে, হেডফোনটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে রেখেছে, হাতে ফোন। অয়ন তো বরাবরের মতোই পরিপাটি, ফর্মাল।
ইত্তাজা বলল,
“আমি এসব নিয়ে কিছুই জানতাম না আংকেল। তন্বী, অয়ন কেউই কিছু বলেনি। আপনারা তো বলতে পারতেন, কিন্তু বলেননি। শেষমেশ বাবা আমাকে জানিয়েছে এসব।”
বাবা চুপ, অয়নও চুপচাপ আছে। ইত্তাজা আবারো বলল,
“বিষয়টা একটা এলোমেলো পর্যায়ে চলে গেছে। তন্বী যেদিন ভার্সিটিতে ভর্তি হতে গেল, সেইদিন সকালে বাবা আমাকে এসব বলেছে। প্রথমে তো বিশ্বাস করতে মন চায়নি, পরে অথৈয়ের থেকে শিউর হলাম। (একটু থেমে) রাগ বেশি অয়নের সাথেই হয়েছিল, রাগের মাথায় অনেক কিছু বলেছি ওকে।”
আনোয়ার আংকেল বললেন,
“ইকরাম ভাই এখনো সবটা মেনে নেয়নি। উনি আগে থেকে সব জানতেন তাও বলেনি। কারণটা কি জানি না।”
বাবা রুম্মান ভাইয়ার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন,
“এখন কি করতে চাচ্ছেন?”
আংকেল কিছু বলার আগেই ইত্তাজা বলল,
“শুধু শুধু সারাজীবন সাফার করার থেকে, অয়নের সাথে তন্বীর বিয়ে হলেই ভালো হবে। (একটু থেমে) আপনারা রাজি থাকলে ভালো না হলে আমি জোর করে বিয়েটা দিবো।”
সকলেই কিছু না কিছু বলছে কিন্তু অয়ন একেবারেই চুপ। হঠাৎ ওর দৃষ্টি পড়লো পর্দার ছোট ফাঁকে। ওর চাপা হাসি দেখে আমি ভেং°চি কাটলাম।
আপু পেছন থেকে বলল,
“চল, সাজবি না?”
আমি ফিরে দেখি আপুর মুখেও হাসি। আমি রুমে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলাম। তানিমা আপু কানের কাছে এসে বলল,
“ইত্তাজাকে যা বলা উচিত ছিল, বলেছি।”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম,
“কবে বলেছো?”
“আজ সকালে। ফোনে কথা হয়েছে। যখন তুই রুম্মানকে বিয়ে ভা°ঙার অনুরোধ করেছিলি তার পরেই।”
আমি হেসে আপুকে জড়িয়ে ধরলাম। আপু আমার কপালে চু°মো দিয়ে বলল,
“বস, তৈরি হয়ে নে। কিছুক্ষণ পর মিসেস অয়ন হবি বলে কথা।”
ফারিহা আপু পাশ থেকে বলল,
“মিসেস আয়মান রহমান।”
“ওই একই হলো।”
আমি ফারিহা আপুকে বললাম,
“তুমিও জানো?”
“আমরা সবাই জানি, তানিমা বলেছে।”
আমি ওদের দিকে ফিরে বললাম,
“এনাউন্স করে দাও।”
আমাকে সাজানো হলো। তবে শাড়ি আবারো পালটানো হলো, সেই শাড়িটা পড়লাম যেটা অয়ন কিনেছিল। অয়ন এখানে আসার সময় নিয়ে এসেছে এটা আর রুম্মান ভাইয়া আপুকে একটু আগেই দিয়ে গেল।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চেয়ে আছি আমি, নিজেকে কেমন লাগছে তাই দেখছি। আমার মুখ থেকে হাসি সরছেই না।
তানিমা আপু বলে উঠে,
“এমনে ভে°ট°কি মাছের মতো হাসিস না, বি°চ্ছি°রি লাগে।”
হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় আমি ফিরে তাকিয়ে বললাম,
“আপু, মানহা আসেনি?”
“না, ও কোথায় আছে কে জানে।”
আমার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। মানহা আবার কোথায় গেল। ইত্তাজার করা ভয়েজ ম্যাসেজ শোনার পর থেকে সে চুপ ছিল।
কল দিলাম মানহাকে।
“তনুমনু, আমি আজকে আসবো না।”
“তুই আয় প্লিজ মানহু। আমাকে শেষবারের মতো দেখতে আয়।”
ও হয়তো আরো কিছু বলতো তবে তার আগেই আমি কল কে°টে দিলাম। সবার আগে আগেই বেরিয়ে ডাইনিং এ আসলাম। ড্রইংরুমে এখনো কথাবার্তা চলছে। সবটা অন্দরমহলে সহজ লাগলেও আসলে তো সহজ নয়।
কিছুক্ষণ পর আবারো পর্দাটা একটু সরালাম। ইত্তাজা আর অয়ন হয়তো বাইরে যাবে। ইত্তাজা আগে আগে বের হওয়ার সময়ই মানহা এসে ভিতরে ঢুকে। একটুর জন্য ধা°ক্কা খায় না।
মানহা অবাক চোখে ইত্তাজার দিকে তাকিয়ে আছে। ইত্তাজা হেসে বলল,
“তোমার তন্বীকে ছোট ভাইয়ের বউ করে নিতে এসেছি, মানহামণি।”
কথাটা বলেই সে বেরিয়ে গেল। অয়ন মানহাকে দেখে শুধুই জিজ্ঞাসা করলো,
“ভালো আছো?”
মানহা হালকা মাথা নাড়তেই সেও বেরিয়ে গেল। বড়দের সালাম দিয়ে ভিতরে চলে আসলো মানহা। এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
“তনুমনু, কখন হলো এতো কিছু?”
“হঠাৎ করেই হয়ে গেল।”
“তোর জীবনে সব কি হঠাৎ করেই হয়। হঠাৎ করে প্রেম হয়, বিয়ে ঠিক হয়, আবার জামাই পালটে যায়।”
আপুরা সবাই হেসে উঠলো। আমিও হেসে মাথানিচু করলাম। মাত্র দুইটা বছর হলো অয়নের সাথে দেখা হওয়ার, অথচ কত কি হয় গেল এর মধ্যে?
সন্ধ্যার পরে আনুষ্ঠানিকভাবে অয়ন এলো। অথৈ আপু আর মানাফ ভাইয়াও এসেছে। অথৈ আপু এসেই আমার রুমে এসে বলল,
“তন্বু, কি সুন্দর লাগছে রে তোকে!”
আমি হাসলাম। এখন না, আমি আরো আগে থেকেই আসছি।
দরজার ওপাশ থেকে রুম্মান ভাইয়া বলল,
“তানিমা, তন্বীকে নিয়ে এসো।”
“চলো।”
জরজেটের ওড়না দিয়ে ঘোমটা টেনে দেয়া হলো। মূলত আমার হাসিটা লুকানোর জন্যই এ ব্যবস্থা। দরজার সামনে বাবা দাঁড়িয়ে আছে। আমি যেতেই আপুকে বলল,
“এতো বড় ঘোমটা কেন?”
আপু হেসে বলল,
“যেভাবে হাসতেছে তাতে কাজি, জামাই সবাই হাসবে।”
ওড়নার আড়াল হতে সবাইকে ঠিকই দেখতে পাচ্ছি আমি। ড্রইংরুমে নিয়ে সোফায় বসানো হলো আমাকে, পাশে বাবা বসেছে। মুখোমুখি সোফায় অয়ন, আনোয়ার আংকেল আর একজন অচেনা আংকেল। সিংগেল সোফায় বসেছে কাজি আর রুম্মান ভাইয়াসহ আমার কয়েকজন কাজিন ভাইয়ারা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ইত্তাজা এখানে নেই।
অয়নকে এখন দেখতে সুন্দর লাগছে। সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা, মানে পুরাই নতুন জামাই। জামাই সাজতেই বেরিয়ে গিয়েছিল, এখন আমি তাতে একদম শিউর।
বড়কাকা এসে আমার অপরপাশে বসলো। আনোয়ার আংকেল বিয়ে শুরু করার কথা বললেন। সূরা, দোয়া শেষে আসলো বিয়ের অন্তিম মুহূর্ত মানে কবুল বলার সময়।
কাজি আমাকে বললেন,
“বলুন আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
আমাকে চুপ থাকতে দেখে বাবা নিচুস্বরে বলেন,
“তন্বু?”
আমি বললাম,
“শুধু কবুল বললে হবে না? আপনারা সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলেন।”
কথাটা খুব ধীরে বললেও পুরো রুম নিশ্চুপ থাকায় মোটামুটি সবাই শুনেছে। সবাই জোরে হাসি দিয়ে দিলো, এমনকি বাবা আর কাজিও হাসছে। অয়নকেও মুখ টি°পে হাসতে দেখলাম।
রেগে গিয়ে ঠোঁট উলটে কবুল বলে দিলাম। সবার সাথে অয়নও জোরে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো। আমি চমকে উঠে ওর দিকে তাকালাম। শুধু আমি না, সবাই ওর দিকে তাকালো। সে মাথানিচু করে হেসে দিলো।
বড়কাকা আমাকে ভিতরে নিয়ে আসলো। আম্মু আমাকে বকা দিয়ে বলল,
“কিসব বলো তুমি?”
“তুমি কিভাবে শুনছো?”
আপু হাসতে হাসতে বলল,
“রুম্মান এসেছিল, বলে গেছে।”
আম্মু জুসের গ্লাস আমার হাতে দিয়ে বলল,
“বিয়েটা হয়েছে, এজন্য শুকরিয়া করে আলহামদুলিল্লাহ বলতে হয়। (একটু থেমে) যেমন মেয়ে, জামাইও তেমনই।”
মানহা এসে বলল,
“অতিরিক্ত আবেগে বেচারীর এ অবস্থা হইছে। পা°গল ছা°গল।”
আমি মাথানেড়ে খেতে থাকলাম। নিজের বোকামির জন্য নিজেরই হাসি পাচ্ছে।
মেহমানরা খাওয়া দাওয়া করলো, তারপর বিদায়ের সময় আসলো। আপুদের মতো কান্নাকাটি করে আমার বিদায় হলো না। বাবা একটু গম্ভীর থাকলেও আমার খুশিতে বাবাও প্রচুর খুশি হয়ে গেল।
মানহার একটা কথা খুব করে মনে থাকবে,
“ভালোবাসাকে ধরে রাখতে হয়, বিশ্বাস থাকলে মিলন ঠিকই হবে।”
কথাটা শুনে একটু কষ্ট হলো। মানহার অপূর্ণ প্রণয় ওকে সারাটা জীবন য°ন্ত্র°ণা দিবে৷
খিলঁগাও থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আসতে খুব বেশি কষ্ট হলো না, রাস্তা আজকে প্রায় খালি। গাড়িতে আংকেল থাকায় অয়নের সাথে মুখে কথা হলো না, তবে চোখে চোখে অনেক কথা বলেছি আমরা।
রাত দশটায় চলে আসলাম অয়নের বাসায়। আন্টি আর অয়নের ছোটচাচী এখানে আছে। দরজা খুলে কুশল বিনিময় করেই ভিতরে চলে গেলেন আন্টি।
অয়ন আমার কানের কাছে এসে বলল,
“কিছু মনে করিস না, আম্মুর অভি°মান একটু বেশিই।”
এই মানুষটার স্নেহও বেশি, তা তো আমি জানি। আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করবো আমি।
আমাকে গেস্টরুমে রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। অয়নের ছোটচাচী একজন চমৎকার মানুষ। আমাকে সুন্দরমতো রেখে উনি খোঁজখবর নিলেন।
অথৈ আপুর সাথে অয়নের চারজন মেয়ে কাজিনও এলো। দুজন হলো ওর ছোটচাচার মেয়ে আর বাকি দুজন ওর খালাতো ও মামাতো বোন।
অয়ন ডাইনিং এ আছে। অথৈ আপু একটু জোরে বলল,
“ভাইয়া, আমার বিয়ের দিন বলেছিলা তন্বুকে যে বিয়ে করবে সে হবে একটা নিরীহ প্রানী লাইক গরু। শেষে তুমিই সেই গরু হলে।”
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। আমিও হেসে উঠলাম৷ অয়ন কিছু বলল না।
অথৈ আপু বলল,
“জানিস, ভাবী আমাদের ভালো গান গায়। অনেকদিন তোমার গান শুনি না তন্বু।”
অয়নের খালাতো বোন মিম বলল,
“ভাবী, প্লিজ প্লিজ একটা গান গাও। ভাইয়ার জন্য গাও।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ।”
সবাই সম্মতি দিলো।
আমার মাথায় দুষ্টুমি চেপে বসলো। আমি অথৈ আপুকে বললাম,
“দরজা চাপিয়ে দেও।”
অথৈ আপু উঁকি দিয়ে বলল,
“ওখানে ভাইয়া ছাড়া আর কেউ নেই।”
এবারে ছাড়া গরুর মতো গান শুরু করলাম, তাও পুষ্পা মুভির সেই ভাইরাল গান “সামি সামি”। আমার সাথে সাথে সবগুলো গাইতে শুরু করলো। অয়ন এসে দরজায় দাঁড়াতেই আমি থেমে অন্যদিকে ঘুরে গেলাম।
অয়ন বলল,
“থামবি তোরা? নিজেকে সার্বজনীন স্বামী মনে হচ্ছে।”
আবারো একটা হাসাহাসির রোল পড়লো।
এগারোটার দিকে আমাকে অয়নের রুমে নিয়ে আসা হলো। অথৈ আপু আমাকে বলে গেল,
“ওয়েট করো, ভাইয়াকে পাঠাচ্ছি।”
আমি মুচকি হাসতেই অথৈ আপুও আমাকে একটা হাসি ছুঁড়ে চলে গেল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, সাজটা একটু পালটে গেছে। এতোক্ষণের ধা°ক্কা বলে কথা।
মাথার ওড়নাটা খুলে রাখলাম। বেডসাইড টেবিলে একগুচ্ছ সাদা গোলাপ রাখা আছে। প্রাণ ভরে ঘ্রাণ নিলাম আমি। মনে আবারো দুষ্টু পাখি ডানা ঝাপটালো।
“কিছু স্বপ্ন, কিছু মেঘলা, কিছু বই-টই ধুলো লাগা
কিছু ইচ্ছে সাড়া দিচ্ছে, এই বসন্ত রাত জাগা
মম চি°ত্তে, পাশ ফিরতে আজ পলাশ ফুলের কাব্য
নিতি নৃত্যে, ফুল ছি°ড়তে শুধু তোমার কথাই ভাববো
আজ হাওয়া বে°প°রো°য়া দিলো সন্ধ্যে পাখির ঝাঁক
এই বিকেল আর বেল ফুল হৃদ মাঝারে থাক
নীল দিগন্তে…”
গান গেয়ে একপ্রকার নাচ করছিলাম আমি। পেছনে অয়নের সাথে ধা°ক্কা খেতেই গানটা থেমে গেল। ফিরে দেখি সে হাসছে, আমাকে পাগল করা সেই হাসি।
“কিরে মনে খুব রং লেগেছে?”
ওর কথার জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলাম,
“তুমি যে বলেছিলে গাজীপুর যাচ্ছো, কেন বলেছিলে?”
“তোকে ভ°য় দেখাতে।”
“মানে?”
কপাল কুঁচকে গেল আমার। সে হাসলো।
“তুই বলেছিলি মুভির মতো তোকে আনতে যেতে। সকালে ইত্তাজা ভাইকে কনভেন্স করে ফেলেছিলাম তাই মুভি ক্রি°য়ে°ট করতে এই ছোট্ট নাটকটা করলাম।”
ওর হাতে মা°রতে মা°রতে বললাম,
“তুমি খুব খারাপ, আমি কতটা ভ°য় পেয়ে গিয়েছিলাম। মি°থ্যা বলেছো তুমি, কতটা কেঁদেছিলাম জানো?”
আমি রাগ করে তাকাতেই অয়ন আমার গালে চু°ম্ব°ন করে বলল,
“রাগ করে না আমার তনুশ্রী, হলদে পাখিটা।”
টেবিলের বইগুলো নিয়ে শেলফে রাখছে সে। আমি গম্ভীরমুখে বললাম,
“তুমি বাইরে যাও।”
অয়ন আলতো হেসে বলল,
“বিয়ে হয়ে গেছে, সো এখন রাত কা°টালে সমস্যা নেই।”
ধমক দিয়ে বললাম,
“অ°সভ্য, বাইরে যাও।”
“কেন?”
“আমি ঘোমটা দিয়ে বসে থাকবো, তুমি এসে ঘোমটা তুলে দেখবে।”
অয়ন ভ্রু উঁচিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি ওকে ধা°ক্কা দিয়ে বললাম,
“যাও না?”
“না গেলে কি করবি?”
“আমি কিন্তু সেই লেভেলের মা°রা°মা°রি জানি। আবার আমার খুব সুন্দর একটা শখ আছে।”
“কি?”
“আমি জিম করবো, শক্ত°পো°ক্ত বডি হবে।”
অয়ন কাশি দিয়ে বলল,
“মানে দুনিয়ায় এতো কিছু থাকতে জিমটাকেই বেছে নিলি?”
“হ্যাঁ।”
“এমনিতেই তোর হাত খুব শক্ত, মা°রলে খুব লাগে। আবার জিম লাগবে কেন?”
“আরো শক্ত হবে।”
অয়ন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“খাল কেটে কুমির তো নিয়ে এসেছিই, এখন দরজা কেটে গরু আনতে হবে।”
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম। এমন অপমান সহ্য করা যায় না। একটু জোর গলায় বললাম,
“আমাকে তুমি কুমির, গরু বললা?”
“ওমা, সেটা কখন বললাম? বলি কথা হাটের মাঝে, যার কথা তার বুকে বা°জে।”
কিড়মিড়িয়ে বললাম,
“এটা হাট না, এটা আমাদের বাসর ঘর।”
অয়ন হেসে ভণিতা করে বলল,
“ভাগ্যিস বললি, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।”
ওকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলাম। অথৈ আপু বাইরে ছিলো। আপুর কন্ঠ শুনলাম,
“আরে ভাইয়া, তুমি এখানে কি করো?”
“নাথিং, তুই তোর কাজে যা।”
“হুম যাচ্ছি।”
আমি এতোক্ষণে বড় করে ঘোমটা টেনে বিছানায় বসে পড়েছি। অয়ন ভিতরে ঢুকে আমার দিকে তাকালো, ওড়নার আড়াল থেকে আমিও তাকে দেখছি।
দরজা লাগিয়ে গিয়ে সে চেয়ার টেনে দেয়াল ঘড়িটা নামালো। ওমা, কি করছে এই লোক? ঘড়ির ব্যাটারি খুলে নিচে ফেলে দিলো। নিশ্চুপ রুমে ব্যাটারিটা কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খেয়ে স্থির হলো।
চেয়ার থেকে নেমে পাঞ্জাবির উপরের বোতামগুলো খুলে হাতা গু°টাতে গু°টাতে বিছানার কাছে এলো। হাত ঘড়িটা খুলে আমার সামনে ফেললো। আকস্মিক ঘটনায় চমকে উঠলাম। আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হাঁটু দিয়ে চে°পে ঘড়িটা ভে°ঙে দিলো। অবাক হয়ে দেখছি আমি তার কান্ডকারখানা। হাতের এক ঝাড়ায় ভা°ঙা হাতঘড়িটা পুরো রুমে ছড়িয়ে ছি°টিয়ে পড়লো।
এবারে সে আমার সামনে এসে বসলো। চঞ্চলতা থেমে গেছে আমার। একরাশ অচেনা লজ্জা কোথা থেকে যেন চলে এসেছে। তার কাছে তো বহুবার এসেছি কিন্তু এতো লজ্জা আমি আগে পাইনি।
ঘোমটা সরিয়ে সে আমার থুতনিতে হাত দিয়ে বলল,
“তনুশ্রী, তোকে মুভির মতো নিয়ে এসেছি। আজ রাতের জন্য সময়টাকেও থামিয়ে দিয়েছি।”
দেয়াল ঘড়িটার দিকে ইশারা করে বলল,
“১১ টা ৩৫ বাজে, এসময় আর নড়ছে না। ততক্ষণ নড়বে না, যতক্ষণ না আমি চাচ্ছি। আজ রাতের জন্য থামিয়ে দিলাম সময়টাকে। রাতটা শুধুই আমার আর তোর।”
মাথানিচু করে ফেললাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি সে মুচকি হাসছে। আমার গালে হাত দিয়ে বলল,
“তোর ইচ্ছা পূরণ করতে পেরেছি কি?”
আমি লাজুক হেসে বললাম,
“আরেকটা ইচ্ছা আছে।”
“হুকুম করুন মহারানী।”
“তোমার সন্তানের মা হতে চাই। ছেলে হলে নাম রাখবো অর্ণব আর মেয়ে হলে অনিয়া।”
অয়ন ঠোঁট উলটে মাথা নেড়ে বলল,
“নিজে আগে বড় হয়ে নে, তারপর বাচ্চার মা হবি।”
ধ°ম°ক দিয়ে বললাম,
“তুই করে বলবে না, এখন আমি তোমার বউ। তুমি করে বলো।”
“ওকে, আমার তনুশ্রী।”
বলে আমার নাক টেনে দিলো।
দুজনেই চুপ করলাম, চেয়ে আছি একে অপরের দিকে। এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে একে অপরের কাছে এসেছি, তবুও লজ্জার দেয়াল কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ওষ্টোধর জোড়া প্রথমবারের মতো এক হলো। ভালোবাসায় আবদ্ধ হলাম দুজনে।
বাইরের পুরো দুনিয়ায় সময় চলছে আপন গতিতে। ভালোবাসার ছোঁয়ায় এই ছোট্টরুমের সময়টুকু থমকে গেছে।
সমাপ্ত