#হয়তো_তোমারই_জন্য
#পর্বসংখ্যা_৬
#সাদিয়া_তাসনিম
সৌহার্দ্যের এমন আকস্মিক আগমন পুরো পরিবেশটাকে বদলে দিলো। সাঁঝ একটু আগেও তার দাদুভাইয়ের কাছে তার সমস্ত অভিমান উগড়ে দিচ্ছিলো কিন্তু হঠাৎ সৌহার্দ্যকে দেখে সাঁঝ এমনভাবে চুপ হয়ে গেল যেন কেউ তার মুখের শব্দগুলো কেড়ে নিয়েছে।সাঁঝকে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে কামরুল তালুকদারও খানিকটা অবাক হলেন। তিনি চোখ তুলে সাঁঝের দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনের দিকে তাকাতেই সৌহার্দ্যেকে দেখতে পেলেন । সৌহার্দ্য দিকে দৃষ্টি দিতেই কামরুল তালুকদার তার সৌহার্দ্যের গম্ভীর মুখ দেখে তিনি কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
সৌহার্দ্য ধীরে ধীরে রুমে ঢুকে সোজা তার দাদুভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। সাঁঝের দিকে একবারও না তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ দাদুভাই, আমাকে এখনই ঢাকায় ফিরে যেতে হবে খুবই আর্জেন্ট । ‘
কামরুল তালুকদার সৌহার্দ্যের এমন ধারার কথা শুনে নিজের ভ্রু কুঁচকে নিলেন তারপর সৌহার্দ্যর দিকে অবাক দৃষ্টি দিয়ে বলে উঠলেন,
‘ আজই তো এলে, বললে তো অনেকদিন থাকবে। তাড়াছাড়া এতো রাতে হঠাৎ এমন কী কাজ পড়লো যে এখনই যেতে হবে? খেয়েছো কিছু?’
সৌহার্দ্য তার দাদুর কথা শুনে মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
‘ না, দাদু এখনও খায়নি। তবে এখনই যেতে হবে আমাকে।’
সৌহার্দ্য স্বাভাবিক কন্ঠে কথাটা বললেও তার গলায় একটা অদ্ভুত রকমের চাপা অভিমান লুকিয়ে ছিলো। সাঁঝ এক দৃষ্টিতে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে ছিলো। সাঁঝ ঠিকই সেটা বুঝতে পারলো সৌহার্দ্যের কন্ঠস্বর আজ অস্বাভাবিক কিন্তু সে কিছু বললো না। সাঁঝ নিজের মুখে দৃঢ়তা ধরে রাখার চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে তার বুক কাঁপছিলো। সৌহার্দ্য কি সব শুনে ফেলেছে? যদি শুনেই থাকে তাহলে সেটা নিয়ে কিছু বলবে কি তাকে? সাঁঝ আজ একটু বেশিই বলে ফেলেছে? এখন কী হবে? সৌহার্দ্য কী তাকে খারাপ ভাববে? তার কী কথাগুলো দাদাভাইকে বলা উচিত হয়নি? সৌহার্দ্য সত্যি যদি চলে যা তখন? সাঁঝ সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে আপন মনে কথাগুলো চিন্তা করতে লাগলো।
কামরুল তালুকদার সৌহার্দ্যের কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি সৌহার্দ্যের মুখ দেখে বুঝতে পারলেন সৌহার্দ্য কিছুটা অস্বস্তিতে আছে কিন্তু সে সেটা প্রকাশ করছে না। তিনি নরম গলায় সৌহার্দ্যকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
‘ সৌহার্দ্য, আমার মনে হয়, তুমি একটু শান্ত হও। আচ্ছা যাও খাওয়াদাওয়াটা করে নেও। আর কাজ যদি খুব জরুরি না হয় তাহলে না হয় কাল সকালে যেও। এত রাতে রাস্তায় বের হওয়া ঠিক হবে না।’
সাঁঝ মনে মনে ধরেই নিলো যে সৌহার্দ্য আড়িপেতে তার আর তার দাদুর সকল কথা শুনে নিয়েছে যার ফলে সাঁঝ আনমনেই অজানা কারণে রেগে গেলো। লোকটা যে আজ এবং এই সময়েই চলে যাবে তা সাঁঝ সৌহার্দ্যের মুখ দেখেই বুঝতে পারলো। সে একবার তার দাদুর দিকে তাকালো। সাঁঝ কামরুল তালুকদারের দিকে তাকাতেই, সাঁঝের সৌহার্দ্যের উপর জমে থাকা রাগ যেনও তিরতির করে বেড়ে গেলো। সে আজ প্রথম দেখলো কামরুল তালুকদার মুখটা ছোট করে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ ভালো করেই বুঝতে পারলো তার দাদামশাই -এর মনটা এই সৌহার্দ্যের জন্য খারাপ হয়ে গেছে। সৌহার্দ্য ভাইয়ের জন্য তার দাদামশাই কষ্ট পেয়েছে কথাটা ভাবতেই সাঁঝ রাগে গড়গড় করতে লাগলো। এদিকে সৌহার্দ্য তার দাদাভাইয়ের কথা শুনে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু ঠিক তার আগেই সাঁঝ নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে না পেরে হঠাৎই উচ্চ শব্দে বলে উঠে,
‘ হ্যাঁ, এক্ষুণি চলে যান আপনি। আর কোনো দিন এখানে আসার দরকার নেই আপনার। আপনি এলে শুধু ঝগড়া আর চিৎকার চেচামেচি হয়,সকলের সাথে মন কষাকষি হয়। এই যে দেখুন আপনার জন্য দাদুভাই মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আপনার জন্য দাদুভাই মন খারাপ করলো। ‘
সাঁঝ সৌহার্দ্যের উপর রাগে গড়গড় করতে করতে কথাগুলো এক নাগালে বিরতিহীনভাবে বলে উঠলো। সাঁঝের এই কথায় রুমের পরিবেশ সম্পূর্ণ বদলে গেল। কামরুল তালুকদার অবাক দৃষ্টিতে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে রয়লো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সব যেন থমকে গেল। কামরুল তালুকদার সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো কিন্তু তিনি এই কঠোর আবরণে ঢাকা সৌহার্দ্যের মনোভাব বুঝে উঠতে পারলো না। সুবহা এতক্ষণ দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলো। সেটা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিলো যার ফলে সাঁঝের কথাগুলো শুনে সেও হতবাক হয়ে গেল। সাঁঝ কী জানে সে কী বলছে? সাঁঝ কী পাগল হলো নাকি? মেয়েটা সৌহার্দ্য ভাইয়ের সাথে এমন ভাবে কথা কী করে বলতে পারে? সে কী ভুলে গেছে সৌহার্দ্য ভাই তাদের কাছে কী আর সৌহার্দ্য ভাইয়ের কাছে তারা কাজিনরা কতটা প্রিয়? সুবহার এবার সাঁঝের উপর রাগ লাগলো।
সাঁঝের কথাগুলো শুনে সৌহার্দ্য ধীরে ধীরে সাঁঝের দিকে তাকালো। তার চোখে একটা গভীর অস্বস্তি ছাপ ফুটে উঠেছিলো, কিন্তু সে কিছু বললো না শুধু নিচু গলায় সাঁঝকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
‘ ঠিক আছে সাঁঝ, তুই চিন্তা করিস না। পরেরবার থেকে তোদের আর বিরক্ত করতে আসবো না।’
এই কথাটা সাঁঝকে উদ্দেশ্য করে বলেই সে কামরুল তালুকদারের দিকে ফিরে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ দাদুভাই, তুমি বিশ্রাম নেও। আমি ঢাকাতে ফিরে তোমাকে সব বলবনে।’
কামরুল তালুকদার এবার সত্যিই বিরক্ত হলেন তিনি একবার সাঁঝের দিকে তাকালেন তারপর সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,
‘ সাঁঝ ছোট সৌহার্দ্য তুমি যদি ওর কথায় রাগ করো তাহলে সেটা তোমাকে মানায় না। তুমি বড় হয়েছ আশা রাখি বিষয়টা বুঝবে।’
কামরুল তালুকদারের কথাগুলো সৌহার্দ্য এক মনে শুনে গেলো কিন্তু সৌহার্দ্য কোনো উত্তর দিলো না। সে আস্তে আস্তে পেছন ফিরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।সৌহার্দ্যকে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে সাঁঝ এবার একটু নড়েচড়ে বসল। তার মনে এক অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করছিলো। সে চুপচাপ সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে রইলো। সৌহার্দ্য কী এবার সত্যি সত্যি চলে যাবে? এমন হাজারও প্রশ্ন তার মনে খেলে গেলো। সে তো চেয়ে ছিলো সৌহার্দ্য চলে যায় কিন্তু এখন সৌহার্দ্য এমন চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে সাঁঝের কেন কষ্ট হচ্ছে?
সুবহা পুরোটা দেখছিলো কিন্তু এবার আর সে চুপ থাকতে পারলো না। সে দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ সাঁঝ, তুই কী বললি এগুলো? সৌহার্দ্য ভাইয়া তোকে কত ভালোবাসে আর তুই তাকে এমন কথা বলে দিলি? ভাইয়া তো আমাদের সবার আপনজন তাহলে সে কেন বাড়ি থেকে যাবে?’
সুবহার কথাগুলো শুনে সাঁঝ এবার সুবহার দিকে তাকালো। তার চোখ রাগে টকটক করছিলো। সে কিছুটা গর্জে উঠে বলে উঠলো ,
‘ তুমি চুপ করো, সুবহা আপু । তুমি কিছু জানে এতক্ষণ রুমের মধ্যে কী হয়েছে। সবসময় সৌহার্দ্য ভাইয়ের পক্ষে কথা বলো। ‘
সাঁঝের কথাটা শুনে সুবহা এবার সত্যিই রেগে গেল। সেও গর্জে উঠে বলে উঠলো ,
‘ তুমি যা করলে সেটা অন্যায়, সাঁঝ। তুমি ছোট হয়ে কখনো তাকে এমন ভাবে এই কথাগুলো বলতে পারো না।’
‘ আর সৌহার্দ্য ভাইয়ের জন্য দাদু যে কষ্ট পেলো যেটা তোমার চোখে পরেনি সুবহা?’
সাঁঝের কথা শুনে সুবহা এবার চুপ হয়ে গেল। তার সাঁঝের এমন ব্যবহারে তার মুখটা লাল হয়ে উঠলো। সে কিছু বলতে যাবে কিন্তু ঠিক কামরুল তালুকদার তার হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিলেন। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,
‘ থামো তোমরা। সৌহার্দ্য এখানে বস। সাঁঝ, তুমি চুপ কর আর একটা কথা বলবে না।’
সৌহার্দ্য রুম থেকে বের হতে গিয়েও সুবহা আর সাঁঝের কথাগুলো শুনে থমকে রুমে উপস্থিত ছিলো। কিন্তু সৌহার্দ্য তার দাদুভাইয়ের কথাটা শুনে মাথা নেড়ে বলে উঠলো ,
‘ না, দাদুভাই। আমি এখানে থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তাছাড়া আমাকে আজই ঢাকায় পৌঁছাতে হবে। তুমি চিন্তা করবেন না।’
সৌহার্দ্যের কথাগুলো শুনে সাঁঝ এবার সত্যিই অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে ধীরে ধীরে সৌহার্দ্যকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
‘ সত্যি?’
সৌহার্দ্য সাঁঝের কথার কোনো উত্তর দিলো না। শুধু একবার চুপচাপ সাঁঝের দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে যেন হাজারটা কথা লুকিয়ে ছিলো। তারপর সে আস্তে আস্তে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।সৌহার্দ্যের এমন দৃষ্টি দেখে সাঁঝ এবার সত্যিই অসহায় বোধ করলো। তার বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো। সে তার দাদুভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠলো ,
‘ দাদুভাই, আমি কী খুব বেশি বলে ফেললাম সৌহার্দ্য ভাইকে?’
কামরুল তালুকদার সাঁঝের কথাটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন,
‘সৌহার্দ্য এমন ছেলে না যে শুধু শুধু তোমার কথায় রাগ করে চলে যাবে। ঢাকায় হয়তে কোনো সমস্যা হচ্ছে।তাছাড়া সাঁঝ কথা বলার সময় তোমার কথাগুলো ভেবে বলা উচিত। তুমি জানোই তো সৌহার্দ্য তোমাদেরকে কতটা ভালোবাসে? তোমার কথাগুলো ওর মনে কতটা আঘাত দিয়েছে সেটা তুমি বুঝতে পারছো না।’
কামরুল তালুকদার কথাগুলো বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।সাঁঝ তার দাদুভাইয়ের কথাগুলো শুনে নত মুখে বসে রইলো। সে বুঝতে পারছিলো তার দাদুভাই বলা কথাটা সঠিক। কিন্তু সে কী করতো?সৌহার্দ্য ভাইয়ের জন্যই তো তার দাদুর মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তাছাড়া এর আগেও সুবহার সৌহার্দ্যের উপর অভিমান জমে ছিলো যা এখন সৌহার্দ্যের জন্য তার দাদুর মন খারাপ হয়েছে বলে সাঁঝ সবটা সৌহার্দ্যের উপর প্রকাশ করে ফেললো। সুবহা সাঁঝের বিষয়টা বুঝতে পেরে সাঁঝের হাতটা ধরে দাঁড়ালো। সে সে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো ,
‘ আমার মনে হয় তুই যদি এখন গিয়ে ভাইয়ার কাছে ক্ষমা চাস তাহলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে।’
সাঁঝ মনে মনে কথাটা ভাবলেও নিজের আত্মসম্মানের জন্য মাথা নাড়িয়ে বলে উঠলো,
‘ না। আমি কেন ক্ষমা চাইবো? আমি তো সত্যি কথাই বলেছি।’
সুবহা এবার সাঁঝের কথাটা শুনে রেগে গেলো। সে আর কিছু বললো না, শুধু সাঁঝের হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলো,
‘ তুই যেটা করলি, সেটা ভুল সাঁঝ।’
সুবহা আর কোনো কথা বাড়ালো না। সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সাঁঝ এবার রুমের মধ্যে একা হয়ে গেল। সে চুপচাপ বসে রইলো। তার মনে একটা অদ্ভুত দোলাচল চলতে লাগলো। সে কি সত্যিই ভুল করেছে? সৌহার্দ্য কী সত্যিই তার ওপর রাগ করে চলে যাবে?
রুমের ভেতর একটা অদ্ভুত নীরবতা ছেড়ে ধরলো। সাঁঝ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়লো। নিজের মনে কোনো একটা কথা ভাবতেই সাঁঝ ধীরে ধীরে সামনের দিকে পা বাড়ালো দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
চলবে….