#হয়তো_তোমারই_জন্য
#পর্বসংখ্যা_৮
#সাদিয়া_তাসনিম
সময়টা সব সময় নিজের গতিতে চলে যায় এখনও তাই হচ্ছে। সেদিন সৌহার্দ্য চলে যাওয়ার পরে কেটে গেছে তিন মাস। সবাই নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে।
গভীর রাত। চারদিকে এক অদ্ভুত নীরবতা। ঘরের বাইরে শুধু মৃদু বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ আর দূরের কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রাত গভীর হচ্ছে তবুও সাঁঝের রুমের আলো নিভছে না। তার সামনে খোলা জীববিজ্ঞানের প্র্যাকটিক্যাল খাতা পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা রং পেন্সিল, স্কেল, আর টেবিলের একপাশে রাখা পানির গ্লাস। সাঁঝ প্রাণপণ চেষ্টা করছে খাতায় ছবিগুলো আঁকা শেষ করতে। তার খাতার পাশেই তার আরেক বান্ধবীর খাতা, যেই খাতা দেখে নিজের প্র্যাকটিকালটা করছে সাঁঝ। তার মাথায় একটাই চিন্তা আজ রাতের মধ্যে লেখা শেষ করতে হবে আর কাল ম্যাডামকে কাজ জমা দিতেই হবে।কাল জমা না দিলে সাইন পাবার কোনো উপায় নেই। সাঁঝ নিজের হাতের কাজটা করলেও তার মন বসছে না কাজে। বরাবর সেদিনের ঘটনাগুলো তার মনে উঁকি দিচ্ছে। সেদিন সৌহার্দ্য বলা কথাগুলো, তার অভিমানী দৃষ্টিতে তাকানো আর সেই দৃষ্টির আড়ালে লুকানো একরাশ কষ্ট সবকিছুই সাঁঝকে আজও পীড়া দিচ্ছে। সাঁঝের বারবার মনে হচ্ছে সে কি সত্যিই এতটা খারাপ? সে কেন সেদিন সৌহার্দ্য এত কঠিন কথা বলতে গেলো? সে নিজের রাগ সামলাতে না পেরে কেন তাকে এমনভাবে আঘাত করল? সৌহার্দ্য কী এখনও এসব কথা মনে রেখে? সাঁঝ যখন কথাগুলো ভাব ছিলো ঠিক তখনই সাঁঝের টেবিলের উপর থাকা পেন্সিলটা টেবিল থেকে নিচে পড়ে গেলো।সাঁঝ সেটা লক্ষ্য করলেও কিছু করলো না। সে তো এখনও একমনে সৌহার্দ্যের কথাগুলো ভেবে যাচ্ছে।সে সেদিন সৌহার্দ্যের শেষের দিকে বলা কথাগুলো শুনে নিজের মনে আঙুল কচলাতে লাগল। সৌহার্দ্য হয়তো এতো দিনে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে, কিন্তু তার মনের গহীনে এখনো একটা অপরাধবোধ কাজ করছে। তবে সৌহার্দ্যের কথাটা মনে পড়তেই সাঁঝের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠে। তার মনের মধ্যে অন্য দিনের মতোই আজ এক অদ্ভুত আবেগের ঘূর্ণি তৈরি হয়। তার বারবার মনে পড়ে ঘটনাগুলো। সৌহার্দ্য সাথে ঝগড়া শেষে তার বলা স্নেহমাখা কথাগুলো “তোর কথায় হালকা রাগ হলে এই রাগ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার মতো না সাঁঝ। আর একটু বেশি রাগ হলেও সেই রাগ তোদেরকে, তোকে ছেড়ে যাওয়ার মতো না কখনো।” সেই মমতায় ভরা কথাগুলো সাঁঝের মনের ভেতর একটা অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দেয় বারংবার আবার খানিকটা অপরাধবোধও সৃষ্টি করে। সৌহার্দ্য কতটা ভালো মানুষ আর সে কিনা তার সাথে এমন কঠিন কথা বলে ফেলেছিল! নিজের ভুলের কথা মনে পড়তেই সাঁঝ নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে। সে নিজের চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে আবারও লিখতে যাবে ঠিক তখনই দেখে তার পেন্সিলটা নিচে পড়ে আছে তাই সাঁঝ পেন্সিলটা নিচ থেকে তুলে আবারও লেখা শুরু করে। সাঁঝ লেখা শুরু করতে না করতেই দরজার ধাক্কানোর আওয়াজ আসে। সাঁঝ কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুমের ভিতরে লুবনা ঢুকে পরে। সাঁঝ তার ছোট বোনের মুখে দুষ্টু হাসি দেখে নিজের লেখা বাদ দিয়ে লুবনার দিকে নিজের কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালো। লুবনা সাঁঝকে নিজের দিকে এমন কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে গুটিগুটি পায়ে সাঁঝের কাছে এগিয়ে আসলো। তারপর লুবনা আদুরে কন্ঠে তার বোনের হাতটা জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,
‘ আপু, কাল মেলায় যাবি না?’
সাঁঝ বিরক্ত হয়ে হলো লুবনার এমন কাজে সে একবার চোখ ঘুরিয়ে লুবনার দিকে তাকালো। তারপর মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ না, আমি অনেক ব্যস্ত। তুই তো জানিস, এই কাজটা শেষ করতে না পারলে ম্যাডাম সাইন করবে না।’
লুবনা আবারও জেদ ধরে বলে উঠলো,
‘ কিন্তু আপু তুই তো বলে ছিলি যাবি আর তুই না গেলে আমি একা একা কীভাবে যাব? আম্মুকে বললে তো সে আমার উপর রাগ করবা। আমার যাওয়ার খুব ইচ্ছে করছে রে আপু, প্লিজজজ চল।’
‘ শোন, মেলায় যাওয়ার সময় নেই এখন। আর যদি বেশি কথা বলিস, আম্মুকে ডেকে আনব। তখন দেখিস কী হয়। এখন চুপচাপ আমার রুম থেকে বের হয়ে যা। আমাকে আমার কাজটা করতে দে।’
লুবনা সাঁঝের কথা শুনে নিজের মুখ ফুলিয়ে নেয়। সে বারোটা সময় এসেছিলো তার বোনকে কথাটা বলতে কিন্তু সাঁঝ কী করলো তাকে আম্মুর ভয় দেখালো। লুবনা একবার তার বোনের দিকে তাকালো তারপর নিজের মুখটদ ফুলিয়ে চলে গেলো সাঁঝ। সাঁঝ মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয়লো তারপর আবার কাজের দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার মন যেন বসতেই চাচ্ছে না। কিছুক্ষণ লেখার পরই সে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। ঘরের বাতাসে একধরনের অদ্ভুত আরামদায়ক অনুভূতি তৈরি করেছে যার ফলে সে টেবিলের উপর মাথা রেখে সে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল, তা সে নিজেও বুঝলো না।
রাত আরও গভীর হলো। সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ। এমন নীরবতা যে টেবিলের উপর রাখা ঘড়ির কাঁটার টিকটিক আওয়াজও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। বাইরে থেকে হালকা বাতাস আসছে ফলে জানালার পর্দা ধীরে ধীরে দুলছে। ঠিক তখনই কেউ একজন সাঁঝের রুমে প্রবেশ করল খুব আস্তে, যেন তার পদচারণায় কোনো শব্দ না হয়। সেই মানুষটি রুমে ঢুকে সাঁঝকে দেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।তার মুখে এক অদ্ভুত কোমল অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো। সে যেনও এখানে এসেছিল একটাই উদ্দেশ্যে, সাঁঝকে দেখে তার মনে মধ্যে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করতে। সাঁঝ টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। তার ঘুমন্ত মুখটির উপর চাঁদের আলো পড়ছে।সাঁঝের মুখ চাঁদের আলোয় যেন আরও নরম আর কোমল হয়ে উঠেছে। তার মুখের অবয়বে ক্লান্তির রেখা স্পষ্ট কিন্তু তবুও সেই মুখে একধরনের শান্তি। সাঁঝের এলোমেলো চুলগুলো গালের ওপর এসে পড়েছে। সেই মানুষটি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল। তার ঠোঁটে এক মৃদু হাসি, সাঁঝের এমন ঘুমন্ত অবস্থা তার হৃদয়ের গভীরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিচ্ছে। সে সাঁঝের খুব কাছে এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ সাঁঝের দিকে তাকিয়ে থাকল। এই মুহূর্তটা উপভোগ করতে লাগলো। তারপর সে নিচু হয়ে সাঁঝের মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিল। তার আঙুলের স্পর্শে সাঁঝ সামান্য নড়েচড়ে উঠল কিন্তু ঘুম ভাঙল না তার। মানুষটি তার ঠোঁটে আবার সেই মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলল। কিছুক্ষণ সাঁঝের দিকে তাকিয়ে থেকে সে হঠাৎ নিচু হয়ে সাঁঝকে কোলে তুলে নিল। সাঁঝ এত গভীর ঘুমে ছিল যে সে কিছুই টের পেল না। সেই মানুষটি খুব সাবধানে যেন সাঁঝের ঘুম না ভাঙে এমন ভাবে সাঁঝকে কোলে তুলে তাকে খাটে শুইয়ে দিল। তারপর সাঁঝের উপর একটি নরম কম্বল দিয়ে ঢেকে দিল।
সে সাঁঝকে খাটে শুয়িয়ে সাঁঝের টেবিলের কাছে চলে আসলো।টেবিলে রাখা খাতার দিকে নজর দিল। প্র্যাকটিক্যাল খাতাটা খোলা ছিল। খাতার বেশিরভাগ কাজ অসমাপ্ত এখনো। লোকটি খাতার দিকে তাকিয়ে বুঝল সাঁঝ কাজ শেষ না করেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে হাত বাড়িয়ে খাতাটা তুলে নিল, একঝলক পৃষ্ঠা উল্টে দেখলো খাতাটা তারপর সে আস্তে আস্তে খাতার খাতার অসমাপ্ত অংশগুলো পূরণ করতে শুরু করল। তার হাতের লেখাগুলো ছিল নিখুঁত, স্পষ্ট ও গোছানো।
প্রায় আধাঘণ্টা পর খাতার কাজ শেষ করল। খাতা টেবিলে রেখে সে আবার সাঁঝের দিকে তাকাল। সে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সাঁঝের দিকে এগিয়ে গেলো।
তারপর সে পকেট থেকে একটি চিকন রুপার নুপুর বের করল। নুপুরটি চিকন তাতে ছোট্ট ঘণ্টাও লাগানো। ঘণ্টাটি এতই ছোট যে তার আওয়াজ খুব মৃদু। রুপার নুপুরটি সে সাঁঝের পায়ে পরিয়ে দিল। নুপুর পরানোর সময় তার ঠোঁটে এক মৃদু হাসি দেখা যাচ্ছিল। এই ছোট্ট উপহারটা দিয়ে সে সাঁঝের প্রতি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করছে।
নুপুর পরানোর পর সে কিছুক্ষণ সাঁঝের পাশে বসে রইল। তার চোখ সাঁঝের শান্ত মুখের উপর স্থির। তারপর সে খুব ধীরে সাঁঝের কপালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিল। সেই চুম্বন ছিল মৃদু কিন্তু তাতে ভালোবাসার গভীরতা ছিল অসীম। সে সাঁঝের কপালে নিজের ওষ্ঠ ছুয়িয়ে মনে মনে বলে উঠলো, “তোর উপর আমি কখনোই রাগ করতে পারি না। তুই আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা তুই কখনোই বুঝবি না গাধী।”
সে আর রুমের মধ্যে থাকলো না, তাড়াতাড়ি সাঁঝের রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।
পরের দিন সকালে,
সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি সাঁঝের মুখের উপর পরতেই সাঁঝ ঘুম থেকে জেগে ওঠলো। সাঁঝ ঘুম থেকে জেগে ওঠে নিজেকে খাটের উপর দেখে কিছুটা অবাক হলো। কাল রাতে সে কখন ঘুমিয়ে ছিলো? সে কখন খাটে এসেছি? সাঁঝ নিজের মনে কথাগুলো চিন্তা করতে করতে যখন পায়ের উপর থেকে চাঁদর সরিয়ে নিচে নামার জন্য পা তুলো তখন সে তার পায়ে একটা অদ্ভুত ঠাণ্ডা অনুভূতি অনুভব করলো। সাঁঝ পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার পায়েএকজোড়া চিকন রুপার নুপুর। সাঁঝ সেটা দেখার পর নিজের চোখ মুখ কুঁচকে নিলো।
সাঁঝ অবাক হয়ে মনে মনে বললো,
‘ এটা কী? এটা কে দিল? আর কখনই বা দিল? ‘
সাঁঝ তাড়াতাড়ি নিচে নেমে দাঁড়ালো। সে টেবিলের দিকে চোখ দিতেই টেবিলের উপর রাখা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো আটটা পয়ত্রিশ বাজে। সাঁঝ এবার লাফ দিয়ে উঠলো। সে তাড়াতাড়ি নিজের এসব চিন্তা বাদ দিয়ে রেডি হতে গেলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয় সাঁঝ নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে ছুট লাগালো।
আসমা বেগম তখন বাড়ির ছেলেদের খাবার দিচ্ছিলেন। তিনি সাঁঝকে উপর থেকে বিদুৎ বেগে দৌড়ে আসতে দেখে বলে উঠলেন,
‘ আজকেও মনে হয় দেরি হয়ে গেছে মেয়েটার। এই সাঁঝ খেয়ে যা কিছু।’
সাঁঝ সিঁড়ি দিতে নামতে নামতে তার চাচিমণির কথাগুলো শুনতে পেলো কিন্তু সেদিকে না তাকিয়ে বাড়ির বাহিরে দিকে দৌড় লাগাতে লাগাতে বলে উঠলো,
‘ এসে খাবো চাচি, এখন না। ক্লাসে ঢুকতে দেরি হলে বিটকেল স্যার সারা ক্লাস বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখেনি। এই স্যারটা প্রতিদিন বউয়ের সাথে ঝগড়া করে আসে, আর তার রাগ আমাদের উপর দেখায়য়। ‘
টেবিলে বসে থাকা সকলে সাঁঝের কথাশুনে হেঁসে উঠলো তবে এক জোড়া চোখ সাঁঝ চলে যাওয়া পর্যন্ত তার দিকে তাকিয়ে রয়লো।
চলবে….