হয়তো তোমারি জন্য পর্ব-০২

0
101

#হয়তো_তোমারি_জন্য ( দ্বিতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
এই মেয়েটা কি নিজের বিয়ে থেকে পালিয়ে এসেছে! এইভাবে গয়না গাটি বেনারসি শাড়ি পরে নইলে কে এইভাবে ভোর রাত্রে রাস্তা দিয়ে দৌড়ায়! না কি মেয়েটা সুইসাইড করার চেষ্টা করছিল! কিন্তু ব্যাগপ্যাক নিয়ে নিশ্চয়ই কেউ মরতে আসবে না! কথাগুলো ওই গাড়িতে আসতে আসতেই মনে হচ্ছিল উজানের। তবে এর থেকে বেশি ভাবনা না বাড়িয়ে ও সেই মুহুর্তে নিজের ছোটবেলার বন্ধু ডক্টর অতনু বোসকে কল করেছিল। অতনুই পারবে এখন হেল্প করতে! মেয়েটার মাথা কেটে গেছে। এই সময় ফাস্ট এড খুব দরকার। এইসব চিন্তার মধ্যেই ও বাড়ির ভিতর গাড়িটা পার্ক করে মেয়েটাকে কোনভাবে ধরে নিয়ে গেল গেস্ট রুমে। তারপর কিছুটা সময়ের ভিড়ে অতনু এসে হাজির। তবে ও এইভাবে কনের সাজে একটা মেয়েকে শুয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয়েই বলেছিল,
———” তুই হসপিটালে না নিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে একেবারে বাড়িতে আনলি কেন? চেনা নেই জানা নেই! আর এরকম বেনারসি পড়ে সেজে গুজে আছে! দেখে তো মনে হচ্ছে নিজের বিয়ে থেকে পালিয়েছে। দেখিস বাবা! তুই কোন কেস খাস না যেন! ”
কথা গুলো বেশ চিন্তা নিয়েই বললো অতনু। কিন্তু উজান বেশ বিরক্ত হয়েই বললো,
———” আরে, উপায় থাকলে কি আর বাড়িতে আনতাম এরকম একটা ঝামেলাকে! আমি ড্রিঙ্ক করেছিলাম আজ। যদিও আমি আমার পুরো সেন্সেই ছিলাম। মেয়েটা আমার গাড়ির সামনে হঠাৎ চলে আসে! কিন্তু হসপিটালে নিয়ে গেলে কি কেউ আমার কথা বিশ্বাস করতো! একসিডেন্ট কেস দেখলেই পুলিশকে জানাতো। আর পুলিশ এসে ড্রিঙ্ক এন্ড ড্রাইভিং এর কেস দিয়ে দিত সাথে সাথে। সেই জন্যই বাড়িতে নিয়ে এলাম। এবার বল, কেমন দেখলি? কিছু সিরিয়াস না তো? তাহলে হসপিটালাইজই করতে হবে! আর কোন উপায় নেই। ”
এই কথায় অতনু মেয়েটার মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বললো,
——–” না, সেরকম সিরিয়াস কিছু হয়নি। মাথাটা কেটে গেছে শুধু। আর পা টা ফুলেছে দেখছি। মনে হয় পায়েও চোট লেগেছে। আমি পায়েও ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি। কিছুদিন রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে। ”

এই কথায় উজান একটু অবাক হয়ে বললো,
———” কিন্তু চোট যখন বেশি লাগেনি, তাহলে এইভাবে সেন্সলেস হয়ে আছে কেন মেয়েটা? এতক্ষণ ধরে! ”
এই প্রশ্নে অতনু সহজভাবেই বললো,
———” সেটা শক পেয়ে হয়েছে। অনেক সময় হঠাৎ এরকম একটা এক্সিডেন্ট হলে নার্ভে চাপ পড়ে লোকজন সেন্সলেস হয়ে যায়। ডোন্ট ওরি..আমি একটা ইঞ্জেকশন দিচ্ছি। কিছুক্ষণ বাদে সেন্স চলে আসবে। কিন্তু সেন্স এলে না দেখিস এই মেয়ে নিজেই তোর এগেনস্টে কেস ঠুকে দেয়! তার ওপরে আবার এইভাবে বাড়ি নিয়ে এলি। কিডন্যাপিং এর ও কেস দিয়ে দিতে পারে। ”

কথাটায় উজান এবার একটু ঘাবড়ে গিয়েই বললো,
——-” এই তুই থামবি। ভয় দেখানোর একটা লিমিট থাকে! আর সেরম হলে আমি ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেব। টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করা যায়, বুঝলি। ”
এটা শুনে অতনু আর কথা না বাড়িয়ে বললো,
——-” বুঝলাম। অল দ্যা বেস্ট..”

কথাটা বলে ওষুধপত্র দিয়ে সেদিন অতনু চলে গেছিল। কিন্তু উজান বেশ টেনশনেই সামনের সোফাটায় বসেছিল। কে জানে মেয়েটার সেন্স আসলে কি হবে! আর এক্সিডেন্ট করার জন্য আর কারোর গাড়ি পেল না! ছুটে ছুটে ওর গাড়ির সামনেই আসতে হলো! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বেশ রাগ আর বিরক্তি নিয়ে কিছুক্ষণ বাদে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছিল ক্লান্তিতে সোফায়। তবে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেছিল একটা চিৎকারে। ও হকচকিয়ে জেগে দেখেছিল মেয়েটা খাট থেকে নিচে নামতে গিয়ে পড়ে গেছে মাটিতে। এটা দেখে উজান তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়েছিল ওর কাছে। কিন্তু ওকে ধরতে যাওয়ার আগেই মেয়েটা আচমকা একটা সেফটিপিন বার করে ওর হাতে ফুটিয়ে দিয়ে বলেছিল,
———-” খবরদার। দূরে থাকবেন আমার থেকে! রাজু নিশ্চয়ই আপনার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে আমাকে! কিন্তু প্লিজ আমাকে যেতে দিন। দরকার হলে আমার এই যা গয়না আছে নিয়ে নিন। কিন্তু প্লিজ আমাকে যেতে দিন। ”
কথাগুলো বলতে বলতে মেয়েটা কেঁদে ফেলেছিল ওর সামনে। তবে উজানের এবার মনে হয়েছিল তাহলে অতনুর কথাটাই সত্যি হলো। মেয়েটা ভাবছে ওকে কিডন্যাপ করে আনা হয়েছে এখানে! কথাটা ভেবেই ও বেশ জোর দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে বললো,
———–” রাজু! কে রাজু! আর আমি আপনাকে কিডন্যাপ করে আনিনি মিস.. আপনি দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ আমার গাড়ির সামনে চলে এসেছিলেন। মনে করে দেখুন একটু। তাই আমি আপনাকে বাড়িতে নিয়ে এসে ট্রিটমেন্ট করিয়েছি। এবার দয়া করে সেফটিপিন না ফুটিয়ে হাতটা দিন আমাকে। আপনার পায়ে চোট লেগেছে। একা একা উঠতে পারবেন না। ”
কথাগুলো বলে উজান হাতটা বাড়ালো ওর দিকে। মেয়েটা এই মুহূর্তে নিস্পলক ভাবে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে যেন অল্প আশ্বস্ত হলো। তারপর কিছু না বলে নিজের হাতটা দিল ওর হাতে। উজান এবার মেয়েটাকে আস্তে করে মাটি থেকে তুলে ধরে খাটে বসালো। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর ধৈর্য্য শেষ কেমন। তাই একটু এলোমেলো হয়ে বলে উঠলো,
——–” না, এর থেকে বেশি আর ড্রামা আমি নিতে পারছি না একদিনে। আই নিড সম স্লিপ.. আমি আমার মেডকে বলে কিছু খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে মাথাটা একটু ঠাণ্ডা করুন। আর হ্যাঁ, আমার মেড এর কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে দরকার হলে আপনি পুলিশকেও কল করতে পারেন। বাড়িতে এই ঝামেলা থাকার চেয়ে আমার পুলিশের কেস খাওয়াও অনেক ভালো। তবে পুলিশকে কল করলে প্লিজ দু তিন ঘণ্টা বাদে করবেন। বিকজ আই জেনুইনলি নিড সম স্লিপ নাও.. নইলে আমি মরে যাবো। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে উজান আর দাঁড়ালো না। সেই মুহুর্তে ঘরটা খালি করে দিয়ে চলে গেল। তবে মেয়েটা এখনও কেমন থমকে চুপ হয়ে বসে রইলো এক জায়গায়। যেন কোন ঝড় বয়ে গেছে ওর ওপর থেকে।

সেদিন এরপর সন্ধ্যের দিকে উজান এসেছিল এই গেস্ট রুমে। না, কোন পুলিশ আসেনি এখনও অব্দি ওর কাছে। তার মানে মেয়েটা কোন কমপ্লেন করেনি কোথাও। কথাটা ভেবে একটু নিশ্চিন্তই লাগছিল যেন। তবে সন্ধ্যেবেলা ঠাণ্ডা মাথায় উজান এসেছিল ওর কাছে। মেয়েটা সেই সময় উজানকে দেখে একটু যেন ঘাবড়েই বসেছিল চুপচাপ। তখন উজান ওর কাছে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে বলেছিল,
——–” ডোন্ট ওরি.. আমি ওমেনাইজার হতে পারি। কিন্তু রেপিস্ট নই। আপনার কোন ক্ষতি করবো না। ”
এই কথায় মেয়েটা থমথমে দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে জলটা নিয়েছিল। তারপর কিছুটা জল খেয়ে যেন শান্ত করেছিল নিজেকে। এরপর উজান সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেছিল,
——-” আপনার নাম কি? বাড়ি কোথায়? আপনি আপনার বাড়ির লোকের নাম্বার দিন। আমি ফোন করে আপনাকে বাড়ি পাঠানোর ব্যাবস্থা করছি। ”
এই কথায় মেয়েটা খুব স্থির গলায় বলেছিল,
——–” আমি শারদীয়া। শারদীয়া সেন। বর্ধমানে থাকি। আমার নিজের কেউ নেই। কাউকে খবর দেয়ার দরকার নেই। কাল আমি চলে যাবো। আজকের রাত টুকু শুধু থাকতে দিন এখানে! ”
এই কথায় উজান একটু চিন্তা করে বললো,
——–” আপনি কি আপনার বিয়ে থেকে পালাচ্ছিলেন কাল? ইফ আই অ্যাম নট রং! আর বর্ধমানের মেয়ে তো কলকাতায় কি করছেন! আর আপনার বাবা মা? ”
অনেকগুলো প্রশ্ন বেশ কৌতূহলী হয়েই করে বসলো উজান। তবে শারদীয়া এত কথায় কিছুটা সময় নিয়ে উত্তর দিল,
——–” আমার মা বাবা ছোটবেলায় মারা গেছে। বর্ধমানে আমি মামার বাড়িতে থাকতাম। কিন্তু মামা মামী আমায় কোনদিনই পছন্দ করতো না! তবে ভাবিনি যে ওরা আমার এত বড় ক্ষতি করার চেষ্টা করছে! সাতদিন আগে ওরা আমায় কলকাতা নিয়ে এসেছিল বিয়ে দেবে বলে! ছেলে কে আমি চিনতাম না! কিন্তু কাল বিয়ের দিন জানতে পারলাম মামা আসলে কলকাতা আমাকে বিক্রি করতে এনেছে। বিয়েটা একটা নাটক ছিল, যাতে আমি কোন ঝামেলা অশান্তি না করি! সেটা আমি জানার পর কোন রকমে পালিয়ে বেড়িয়েছি ওই বাড়িটা থেকে। কাল ভোর রাত্রে ওই লোকগুলো আমাকে খুঁজছিল! তাই আমি রাস্তার মধ্যে ওইভাবে ছুটছিলাম। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল শারদীয়া। তবে উজান বুঝতে পারছিল না এইসব সত্যি কথা না কি মিথ্যে! তাই একটু যাচাই করার জন্যই বলেছিল,
——–” আপনি কোথা থেকে পালিয়ে এসেছেন সেই বাড়ির এড্রেস বা কিছু দিতে পারবেন? আর আপনার মামা মামীর নাম কি? একটু ডিটেলস এ বললে আমি পুলিশে ইনফর্ম করতে পারি। কারণ আপনাকে তো ওই লোকগুলো খুঁজছে। আপনি রাস্তায় বেরোলে একটা রিস্ক থেকে যাবে যদি না ওরা এরেস্ট হয়। ”
কথাটা শুনে শারদীয়া যেন একটা আশার আলো দেখতে পেল হঠাৎ! ও তাই না ভেবেই বললো,
———” আপনি সাহায্য করবেন আমাকে? ”
এই কথায় উজান কি বলবে ঠিক বুঝতে না পেরে কিছুটা হিসাবী হয়েই বললো,
———–” আমার পুলিশে ইনফর্ম করতে কি আছে! এরপর বাকি কাজ তো ওদের। এখানে আমার তো আর কিছু করার নেই! ”
কথাটা শুনে শারদীয়া সেদিন ওর মামা মামীর নাম, ওই বাড়িটার এড্রেস যতটুকু মনে আছে, সব বলেছিল উজানকে। তবে এতকিছু শুনে উজান আর অবিশ্বাস করেনি শারদীয়াকে। আর সত্যিই তো, একটা পুলিশে ইনফর্ম করতে তো ওর কিছু যাবে আসবে না! এইটুকু হেল্প ও কাউকে করতেই পারে। কথাটা ভেবেই সেদিন পুলিশকে কল করেছিল। হয়তো জীবনে প্রথম এইভাবে হিসাবের বাইরে বেরিয়ে কারোর জন্য কিছু করছে উজান! কেন ঠিক জানে না।

চলবে।