হয়তো তোমারি জন্য পর্ব-০৪

0
88

#হয়তো_তোমারি_জন্য ( চতুর্থ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৬>
যাইহোক, এইভাবেই চলছিল দিনগুলো। এর মধ্যে একদিন সকালে একটা ঘটনা ঘটলো। রুবি তার আগের রাতটা এই বাড়িতেই ছিল। সেদিন সকালে এরপর ঘুম ভাঙার পর মাথাটা খুব ধরেছিল ওর। আসলে এলকোহলের সাইড এফেক্ট। সেই জন্য এলোমেলো পায়ে রান্নাঘরে এসেছিল রুবি। সেই মুহূর্তে সেখানে শারদীয়া কাজ করছিল। রুবির এক পলকে দেখে শারদীয়াকে বেশ চোখে লাগলো যেন! ফর্সা, লম্বা চুল, বড় বড় চোখ, কিছু না সেজেও খুব সুন্দর একটা মুখ। যদিও আগে শারদীয়ার ব্যাপারে শুনেছিল ও উজানের কাছ থেকে। এই মেয়েটার রান্না খুব ফেভারিট ওর। মাঝে মাঝে মেয়েটাকে রাত্রে দরজাও খুলতে দেখেছে। তবে এতটা মন দিয়ে এই প্রথম খেয়াল করলো। যাইহোক, সেদিন ও শারদীয়ার কাছে গিয়ে বলেছিল,
———” এক কাপ স্ট্রং ব্ল্যাক কফি বানিয়ে দাও এক্ষুণি। বুঝেছো? ”
শারদীয়া সেই মুহূর্তে কথাটা অর্ধেক বুঝলো। আসলে ও ব্ল্যাক কফি কি অতটা জানে না! তাই দুধ মিশিয়ে এমনি কফি করেই নিয়ে গেল উজানের ঘরে। উজান সেই মুহূর্তে বাথ রুমে ফ্রেশ হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই একটা কাপ ভাঙার আওয়াজ শুনলো ভিতর থেকে। তারপর রুবির গলা। রুবি এই মুহূর্তে বেশ হাইপার হয়েই বললো,
——–” এটা স্ট্রং ব্ল্যাক কফি হয়েছে! কি এনেছো কি এটা! ব্ল্যাক কফির মানে বোঝো না? না কি ওই সিম্পল ভাত ডাল ছাড়া আর কিছুই করতে জানো না! উজান যে কি করে এরকম লোকজনদের কাজে রাখে কে জানে! ইললিটারেট না কি? ”
কথাগুলো বেশ রাগের মাথায় বলেছিল রুবি। মাথার যন্ত্রণায় মেজাজটা ভীষণ গরম হয়ে গেছিল। কিন্তু উজান এই মুহূর্তে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো,
——–” মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ রুবি.. কেউ ব্ল্যাক কফি করতে না জানলেই ইললিটারেট হয়ে যায় না। এন্ড ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন শারদীয়া ফিলজ্যোফি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। একটা সমস্যায় পড়েছে বলে এই বাড়িতে রান্নার কাজ করতে হচ্ছে ওকে। কিন্তু তার মানে এই না যে যে কেউ যেভাবে খুশি বিহেভ করবে ওর সাথে। ”

কথাগুলো বেশ রেগে বলেছিল উজান। আসলে প্রায় দু মাস হলো শারদীয়াকে দেখছে এই বাড়িতে। মেয়েটা ভীষণ ভদ্র। কাজের বাইরে কখনো একটা কথা বলে না। তাই সব সময়েই মেয়েটাকে বেশ অন্য রকম লাগে উজানের। আর এরকম সামান্য একটা কফির জন্য কেউ কি করে কারোর ওপর এতটা রিয়্যাক্ট করে! কথাগুলো ভেবেই ও রেগে গিয়েছিল। তবে রুবি এই মুহূর্তে বেশ অবাক হয়েছিল। একটা সামান্য কাজের লোকের জন্য এত কনসার্ন! না কি মেয়েটা শুধু কাজের লোক নয়। রান্নার সাথে অন্য অনেক রকম ভাবে এন্টারটেন করে উজানকে। তাই একেবারে চব্বিশ ঘণ্টা বাড়িতে রেখে দিয়েছে। অবশ্য মেয়েটাকে যা দেখতে; এরকম হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। উজানের ভালো লেগে যেতেই পারে! কথাগুলো ভেবেই ও আর কোন তর্কে না গিয়ে আস্তে গলায় বলেছিল,
——-” না, আসলে মাথাটা এত ধরে আছে! তাই রিয়্যাক্ট করে ফেলেছি। এনিওয়েজ আমি আসছি। ”
কথাটা বলেই ও চলে যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে শারদীয়া কিছু না বলে কাঁচের কাপের ভাঙা টুকরো গুলো তুলতে গেছিল মাটি থেকে। তবে সঙ্গে সঙ্গে উজান বলে উঠলো,
——-” এসব তোমার করার দরকার নেই। বাড়িতে তো ডাস্টিং ক্লিনিং এর লোক আছে আলাদা। সে করে দেবে। তুমি নিজের কাজে যাও। এন্ড প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড.. মানে আজকে যেটা হলো তার জন্য! ”
কথাটা শুনে শারদীয়া আস্তে গলায় বলে উঠলো,
——–” না না। ভুলটা তো আমারই ছিল। ”
কথাটা বলেই ও চলে গেছিল। তবে রুবির এইসব শুনে যেন শরীরটা আরো জ্বলে উঠলো। একে এই মেয়েটার সামনে উজান এতগুলো কথা শোনালো ওকে, তারপর আবার মেয়েটাকে সরিও বললো! এটা যেন খুব বাড়াবাড়ি মনে হলো রুবির। তাই খুব জোরে পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল ঘরটা থেকে।

তবে এইসবের মাঝে শারদীয়ার বেশ অন্য রকম লেগেছিল উজানকে। যখন ও শারদীয়ার হয়ে অতগুলো কথা বলছিল মেয়েটাকে, শারদীয়া কেমন অবাক চোখে তাকিয়েছিল ওর দিকে! না, উজান আর যেরকমই হোক, খারাপ মানুষ না। লোককে সম্মান করতে জানে। কাউকেই ছোট করে দেখে না। কথাটা মনে হয়েছিল সেদিন।

<৭>
এইদিনের পর কটা দিন কেটে গেছিল শহরে। শারদীয়া এর মধ্যে পেপার দেখে কিছু জায়গায় চাকরির চেষ্টা করতে শুরু করেছে। মাইনের টাকা থেকে কিছু বইও কিনে এনেছে পড়াশোনার জন্য। আসলে এই শহরে একটা কাজ খোঁজা খুব শক্ত। শারদীয়া বাংলা মিডিয়ামের স্টুডেন্ট। গড়গড় করে ইংলিশ বলতে পারে না। তাই অনেক জায়গায়ই ইন্টারভিউতে অসুবিধা হচ্ছে। যাইহোক, তবে এই বাড়িতে রান্না করে ও ভালোই মাইনে পায়। তবে সারা জীবন তো এই বাড়িতে থেকে যেতে পারবে না! একটা হোস্টেলের ব্যাবস্থা ওকে করতেই হবে নিজের জন্য। এইসব ভাবনার ভিড়েই দিনগুলো কাটছিল। তবে একদিন এর মধ্যে একটা পার্টি ছিল এই বাড়িতে। উজানের কিছু বন্ধু, রুবি সবাই এসেছিল সন্ধ্যে থেকে। লাউড মিউজিক, নাচ, নানা রকমের ড্রিংকসের নেশায় মেতে উঠেছিল সবাই কিছুক্ষণের মধ্যে। শারদীয়ার এই সময় কাজ ছিল খাবার সার্ভ করার। তবে ওর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল এই পরিবেশে। চারিদিকের মানুষগুলো যেন ওর চেনা পৃথিবীর থেকে খুব আলাদা! এরকম উদ্দাম নাচ, মদের গন্ধ, এইসব ওর ঠিক ভালো লাগে না আসলে। সবার মধ্যে ভীষণ বেমানান লাগে নিজেকে। তবে কাজ যখন করছে এই বাড়িতে, তখন এই পরিবেশের সাথে এই মুহূর্তে মানিয়ে নিতেই হবে! এইসব ভেবেই সার্ভ করছিল স্টার্টার সবাইকে। তবে শারদীয়া খুব সাদামাটা পোশাকে থাকলেও ওর গভীর দুটো চোখ, ফর্সা সুন্দর মুখশ্রী নজর কাড়ছিল সবার। একবার প্রত্যেকেই যেন থমকে তাকাচ্ছিল ওর দিকে। তবে রুবির মুখে শারদীয়ার কথা এর আগেই শুনেছিল অনেকে, আর সবাই একটা অন্য ধারণা করেছিল ওর ব্যাপারে। তবে কথাটা নিজেদের মধ্যে আলোচনা হলেও কেউ উজানের সামনে কিছু বলেনি কখনো। তবে আজ পার্টিতে শারদীয়াকে দেখে অনীশ বলে উজানের একজন কলেজের বন্ধু নিজেকে আর সামলাতে না পেরে হঠাৎ সবার সামনে শারদীয়ার হাতটা ধরেছিল, তারপর নেশার ঘোরে থাকা চোখ দিয়ে উপর থেকে নিচ অব্দি মেপেছিল শারদীয়াকে। এরপর কিছুটা বেসামাল হয়েই বলেছিল,
——-” কত রেট তোমার পার নাইট? উজান যা দেয়, তার থেকে আমি বেশিই দেব। ”
এই কথায় শারদীয়ার যেন ধাক্কা লেগেছিল একটা। ও মূর্তির মতন স্থির হয়ে বলেছিল,
——–” এসব কি বলছেন আপনি! আর হাতটা ছাড়ুন আমার। ”
এই কথায় অনীশ অল্প হেসে বলেছিল,
——–” আরে! এত ড্রামা করার কি আছে! রুবির মুখে সবই শুনেছি। উজান তো তোমাকে বাড়িতে রেখে দিয়েছে। আর এরকম একটা মেয়ে পেলে কি কেউ ছাড়তে পারে! ”
কথাটা বলে অনীশ শারদীয়ার গালটা ছুঁয়েছিল আলতো করে। শারদীয়া এবার আর সহ্য করতে না পেরে একটা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছিল অনীশকে। উজান সেই মুহূর্তে দূর থেকে ব্যাপারটা খেয়াল করেছিল। তারপর নিজে থেকেই এগিয়ে এসেছিল ওদের দিকে। কিন্তু শারদীয়ার থমথমে মুখটা দেখে ও এই সময় বুঝেছিল কিছু একটা ঘটেছে এখানে। তাই নিজেই জিজ্ঞেস করেছিল,
——-” কি ব্যাপার? কি হয়েছে? এনি প্রব্লেম! ”
তবে সেই মুহূর্তে শারদীয়ার কিছু বলার আগেই অনীশ বলেছিল,
——-” ব্রো এক রাতের জন্য ক্যান আই বরো দিজ গার্ল? আই রিয়ালি লাইক হার.. আমি ওকে বললাম আমি ওকে তোর থেকে বেশি পেমেন্ট দেব ফর ওয়ান নাইট.. ”
কথাটা শুনে উজান আর ঠিক রাখতে পারলো না নিজেকে। ও অনিশের কলার ধরে চেঁচিয়ে উঠলো হঠাৎ ভীষণ রেগে,
——–” জাস্ট শাট আপ.. মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ.. কি বলছিস কি এইসব? ”
কথাটা উজান চিৎকার করে বলেছিল সেইদিন। আর এই দৃশ্যটা দেখে পার্টিতে সবাই যেন থমকে গেছিল কেমন। তবে অনীশ বেশ হকচকিয়েই বলে উঠেছিল,
———” হোয়াই আর ইউ রিয়্যাকটিং লাইক দিজ ব্রো? এই মেয়েটা তো তোর বাড়িতেই থাকে। রুবি বলেছে। তুই ওকে নিশ্চয়ই এমনি এমনি ফ্রি তে এই বাড়িতে রাখিসনি। আমাদের ফ্রেন্ডস গ্রুপে সবাই জানে এই মেয়েটার ব্যাপারে। ”
কথাটায় উজান আর নিজের ধৈর্য্যটাকে ধরে রাখতে না পেরে প্রচণ্ড রেগে বলেছিল,
——-” ও আমার বাড়িতে কাজ করে অনীশ। সি কুকস ফর মি.. শারদীয়ার ব্যাপারে এইসব কথা ভাবলি কি করে তোরা? সি ইজ নট আ দ্যাট কাইন্ড অফ গার্ল.. কেউ কারোর বাড়িতে থাকলেই তার সাথে শোয় না! এনিওয়েজ, অনেক হয়েছে। নাও গেট আউট অফ মাই হাউজ.. রাইট নাও.. আই কান্ট টলারেট দিজ ননসেন্স এনিমোর..”
কথাটা শুনে অনীশ কি বলবে বুঝতে পারছিল না। তবে ভিড়ের মধ্যে থেকে রুবি এসে বলেছিল,
——-” কম অন উজান, একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছে জাস্ট.. তার জন্য পার্টিটা স্পয়েল করার কি আছে! ”
এই কথায় উজান ভীষণ তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠেছিল,
——–” শাট আপ.. তুমি রটিয়েছ এইসব ননসেন্স সবার মধ্যে? নাও ইউ অলসো লিভ.. এন্ড ইন ফিউচার তোমার সাথে কাজের কথা ছাড়া আমার কোন কথা থাকবে না। নাও লিভ মাই প্লেস.. ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল উজান। এসব শুনে রুবি বেশ ঘাবড়ে গেছিল সেই মুহূর্তে। তবে এতকিছু শুনে কেউই আর থাকেনি সেদিন পার্টিতে। আসলে উজানকে এতটা রেগে থাকতে প্রথম দেখেছিল সবাই। তাই কেউ কোন কথা না বাড়িয়ে চলে গেছিল সেই মুহূর্তে পার্টি ছেড়ে।

চলবে।