হয়তো তোমারি জন্য পর্ব-০৫

0
85

#হয়তো_তোমারি_জন্য ( পঞ্চম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র

তবে এইসবের কিছুক্ষণ পরে উজান নিজে এসেছিল শারদীয়ার ঘরে। তারপর খুব আস্তে গলায় বলেছিল,
——” আই অ্যাম রিয়েলি সরি ফর অল দিজ.. আমি ভাবিনি ওদের মধ্যে এইসব কথা হয়েছে তোমাকে নিয়ে। আমি সত্যিই কিছু জানতাম না। আর অনীশ যেভাবে বিহেভ করলো তোমার সাথে, আই অ্যাম জেনুইনলি সরি ফর দ্যাট.. ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল উজান। তবে শারদীয়া এইসব শুনে কিছুটা শান্ত স্বরে উত্তর দিয়েছিল,
——-” আপনি কেন সরি বলছেন আমাকে! আপনি তো প্রথম থেকে আমাকে সাহায্য করেছেন যতটা সম্ভব। কাজ দিয়ে, থাকার জায়গা দিয়ে! এটাকে যদি লোকজন ভুল ভাবে, অন্য মানে ধরে, তাহলে তো আপনার কিছু করার নেই! আর আজ আমার মতন সাধারণ একটা রান্নার লোকের জন্য আপনি যেভাবে আপনার বন্ধুদের ওপর রিয়্যাক্ট করলেন তারপর প্লিজ আর এইভাবে সরি বলবেন না। আমি জানি আপনি কতটা ভালো মানুষ! ”
এই কথায় উজানের হঠাৎ একটু অন্য রকম লাগলো যেন নিজেকে! আসলে এত বছরের জীবনে কেউ ‘ভালো মানুষ’ কথাটা বলেনি ওকে আগে। মেয়েটা হয়তো একটু বেশি ভেবে ফেলছে ওকে নিয়ে। তাই শারদীয়াকে থামিয়ে উজান বলে উঠলো,
——-” না না! আমি খুব মহান ভালো মানুষ নই। সবার কাছে আমি ওমেনাইজার, ক্যাসানভা, স্পয়েল একটা ছেলে। যেটা ঠিকও। শুধু কেউ ভুল কথা বললে সহ্য করতে পারি না, ব্যাস। তখন রিয়্যাক্ট করে ফেলি। তবে তুমি যে আমাকে ভুল বোঝোনি, এটা জেনে ভালো লাগলো। ”
কথাগুলো বলে উজান চুপ করেছিল কিছুক্ষণ। তবে শারদীয়া কোন উত্তর না দিলেও মনে মনে ভাবছিল, যে মানুষটা একটা অচেনা মেয়েকে রাস্তা থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে আসে! কাজ দেয়। সবার সামনে তাকে কেউ খারাপ কিছু বললে এইভাবে রাগ দেখায়, সে আর যাই হোক, খারাপ মানুষ না। তবে উজান মনে হয় চেনে না নিজেকে ঠিক করে! বা হয়তো চিনতে চায় না ইচ্ছে করেই। নিজেকে ভালো ভাবতে পছন্দ করে না। নিজের ভালো মনটাকে শো কেস করে না সবার সামনে। এইভাবে নিজের আসল আমিটাকে আড়াল করে রাখে গোটা পৃথিবীর কাছে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই উজান হঠাৎ ওর খাটের পাশে রাখা ছোট্ট টেবিলে কিছু ঠাকুরের ছোট মূর্তির দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
——” বাবা! তুমি পুজো করো না কি রেগুলার? এত বিশ্বাস ঠাকুরে? ”
এই প্রশ্নে শারদীয়া একটু ইতঃস্তত হয়ে বলেছিল,
——-” হ্যাঁ, মানে করি পুজো রোজ ছোট থেকেই! কেন? ”
কথাটা শুনে উজান অল্প হেসে বলেছিল,
——–” না, আমার পুজোতে খুব একটা ইন্টারেস্ট না থাকলেও প্রসাদে ইন্টারেস্ট আছে, ছোট থেকেই! আসলে অনেক বছর আগে, যখন আমার ক্লাস ওয়ান কি টু, তখন ঠাম্মা রোজ পুজো করতো, আর কত রকমের ভোগ দিত ঠাকুরকে! আর বাবা সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে ফেরার পর সেই প্রসাদ আমাকে আর বাবাকে দিত। তারপর তো ঠাম্মা মারা গেল, বাবা মারা গেল! পুজোও এই বাড়ি থেকে উঠেই গেল। আসলে মায়ের দ্বারা তো এইসব কখনো সম্ভব ছিল না! ”
কথাটা বলেই উজান থমকে গেল যেন শারদীয়ার সামনে। মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল কিরকম। শারদীয়ার মনে হলো, যেটা উজানের বলার কথা না, সেটাই যেন বলে ফেলেছে ও। তবে এই ভাবনার ভিড়েই উজান কথা থামিয়ে বললো,
——-” এনিওয়েজ.. গুড নাইট.. ”
তারপরই ঘরটা খালি করে দিয়ে চলে গেল সেই মুহূর্তে। তবে শারদীয়ার আজ আবার মনে হলো অনেকদিনের মতন, এই ছেলেটার কি ফ্যামিলি বলে কেউ নেই! কোন রিলেটিভকেও আজ পর্যন্ত আসতে দেখেনি এই বাড়িতে! আর বাবা ঠাম্মা এরা নয় মারা গেছে। কিন্তু উজান স্যার মায়ের ব্যাপারে তো কিছু বললো না! বা বলা যায় বলতে চাইলো না। কথাগুলো কেমন মনের মধ্যে এসে ভিড় করলো শারদীয়ার; আর রাতটা নিরুত্তর হয়েই থেকে গেল ওর সামনে।
তবে এরপরের দিন শারদীয়া বিশু কাকার কাছে জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিল উজানের মা বাবা, বাড়ির লোকের ব্যাপারে। একটু ভেবেই বলেছিল রান্নাঘরে কাজ করতে করতে,
——-” আচ্ছা বিশু কাকা, অনেকদিন হলো এই বাড়িতে আছি। কিন্তু উজান স্যারের বাড়ির কোন লোককে তো দেখেনি এই বাড়িতে আজ অব্দি? আমি জানি উজান স্যারের বাবা মারা গেছেন। কিন্তু ওনার মা কোথায়? এই বাড়িতে স্যারের বাবা, ঠাকুমার অনেক ছবি দেয়ালে দেখলেও মায়ের ছবি দেখিনি কখনো! ”
কথাগুলো কিছুটা সহজভাবেই বললো শারদীয়া। তবে এই প্রশ্ন শুনে বিশু কাকার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল যেন। তারপর একটু সময় নিয়ে আস্তে গলায় বললো,
——-” আসলে আমি তো বহু বছর এই বাড়িতে আছি! উজান তখন ছোট। তাই সবটাই জানি। তোমাকে এতদিন দেখে খুব অন্যরকম লাগে বলেই কথাগুলো বলছি। জানি, তুমি পাঁচকান করবে না এইসব! উজানের মা মানুষটা ভালো ছিল না! রোজ তার নতুন নতুন ছেলে দরকার হতো। আর স্যার মারা যাওয়ার পর তো পুরোই বেলাগাম হয়ে যায় রেবতী ম্যাম। দিনরাত বাইরে ঘুরতো, মদ খেত, পার্টি করতো। উজান সেই সময় বাড়িতে একা একা পড়ে থাকতো । যাইহোক, এরকম একদিন বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে গিয়ে রেবতী ম্যামের একটা গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়। সেইদিনই মারা যান উনি। তবে ব্যাপারটা নিয়ে পেপারে অনেক লেখালেখি বেরিয়েছিল। আত্মীয়দের মধ্যে এই নিয়ে অনেক কথা হয়। তারপর থেকেই কেউই আর এই বাড়ির সাথে কোন যোগাযোগ রাখে না! উজান তো পনেরো বছর বয়স থেকেই একা। ছেলেটা এই কারণে হোস্টেলে থেকে বড় হয়েছে। বাড়ির আদর বিশেষ পায়নি কখনো। ”
কথাগুলো বলতে বলতে গলাটা ধরে এলো যেন বিশু কাকার। শারদীয়ার চোখেও জলের কুচি এসে জমা হল এই মুহূর্তে। মনে হলো যাকে এতদিন ধরে চেনে, যে কোন শর্ত ছাড়াই ওর এত উপকার করছে, তার জীবনে এত কষ্ট! এত একাকিত্ব! এই বাড়িতে এতগুলো দিন থাকার পর আজ বুঝলো কথাটা।

এরপর কটা দিন কেটে গেছে শহরে। শারদীয়া অবশেষে নিজের জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে পেরেছে। একটা স্কুলে পার্টটাইম ফিলজ্যোফি টিচার। মাইনে পনেরো হাজার টাকা। ওর একজনের জন্য যথেষ্টই। এরপর শুধু একটা লেডিজ হোস্টেল খুঁজতে হবে। তাহলে কলকাতায় থাকার ব্যবস্থাটাও হয়ে যাবে। এইসব ভাবনার ভিড়েই সেদিন বাড়ি ফিরে কথাটা সবার প্রথমে এসে বিশু কাকাকেই বলেছিল শারদীয়া। কিন্তু কথাটা শুনে বিশু কাকা মুখটা অন্ধকার করে বলেছিল,
——” মানে তুমি চলে যাবে দিদি! যাঃ। ছেলেটা যাওবা তোমার জন্য এতদিন বাদে বাড়ির রান্না খেতে শুরু করেছিল রোজ, সেটা আর হবে না! ”

কথাটা শুনে শারদীয়া ঠিক কি বলবে বুঝতে পারেনি। হ্যাঁ, এটা ঠিক, ওর রান্না করা খাবার উজান স্যারের খুব পছন্দ। কিন্তু তার মানে তো এটা না যে উজান স্যারের ও চলে গেলে খারাপ লাগবে! আর উজান স্যার এখানে নিজের বাড়িতে ওকে থাকতে দিয়েছিল হেল্প করার জন্য। কিন্তু সেই সাহায্য তো সারা জীবনের নয়! একটা ঘর দখল করে বসে আছে শারদীয়া। সেটা খালি হলে উজান স্যার খুশিই হবে নিশ্চয়ই। কথাগুলো ভেবে শারদীয়া নিজের মনটাকে স্থির করেছিল। ভেবেছিল কাল সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে যখন উজানের সাথে দেখা হবে, তখন কথাটা বলবে। কিন্তু এতক্ষণ শারদীয়াকে অপেক্ষা করতে হলো না। তার আগেই উজান এসে হাজির।
সেদিন রাতে হঠাৎ ওর দরজায় আওয়াজ হয়েছিল আসলে। ওই রাত বারোটার পর। শারদীয়া সেই সময় ঘুম চোখে দরজা খুলতেই অবাক! উজান সামনে দাঁড়িয়ে। একটু শুকনো মুখে। শারদীয়া এই সময় এখানে উজানকে দেখে বেশ অবাক হয়েই বললো,
——–” কি হয়েছে স্যার? কোন দরকার ছিল? ”
কথাটা শুনে উজান একটু ইতঃস্তত হয়ে বললো,
——–” একচুয়ালি ক্যান ইউ কুক সামথিং ফর মি নাও? আসলে আমি একটা পার্টিতে গেছিলাম। কিন্তু সেখানকার খাবার আমার ঠিক ভালো লাগছিল না, তাই খাইনি। রোজ তোমার হাতের রান্না খেয়ে একটা অভ্যাস হয়ে গেছে মনে হয়! ”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো উজান। তবে শারদীয়া এইসব শুনে আলতো হেসে ফেললো কেমন। কে বলবে এই লোকটা ওকে মাস গেলে মাইনে দেয়! যেখানে অর্ডার করার কথা, সেখানে রিকুয়েস্ট করছে কেমন। কথাটা ভেবেই ও সঙ্গে সঙ্গে বললো,
——–” হ্যাঁ স্যার, নিশ্চয়ই। আমি এক্ষুনি কিছু বানিয়ে দিচ্ছি আপনাকে। ”
কথাটা বলে ও আর দাঁড়ালো না। সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। তারপর আধ ঘণ্টার মধ্যে রুটি আর চিকেন স্টু বানিয়ে উজানের কাছে নিয়ে এলো। সেদিন উজান খাবারটা খেতে খেতে এত তৃপ্তি পাচ্ছিল! ও কেমন নিজের মনেই বলে উঠলো,
——–” তুমি ফিলজ্যোফি নিয়ে না পড়ে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়তে পারতে। এত ভালো রান্না তোমার হাতের! ফাইভ স্টারের কোন শেফকে টক্কর দিতে পারবে! ”
কথাগুলো শুনে শারদীয়া একটু মলীন হেসে উত্তর দিয়েছিল,
——-” হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ার টাকা কোথায় পেতাম স্যার! গ্র্যাজুয়েশন করেছি নিজে টিউশন পড়িয়ে। আর রান্না ভালো হওয়ার পিছনে আমার মামা মামীর খুব অবদান আছে। মা বাবা মারা যাওয়ার পর ওই ক্লাস টেন থেকে ওদের বাড়িতে থাকতাম। তখন থেকেই সমস্ত বাড়ির রান্না আমাকে দিয়ে করাতো। আর এদিক থেকে ওদিক হলেই মারধোরও জুটতো। তাই ওই মারের ভয়েই মনে হয় ভালো রান্না করার গুণটা তৈরি হয়ে গেছে! ”
কথাগুলো সেই মুহূর্তে বলার সময় শারদীয়ার ঠোঁটে হাসি থাকলেও চোখে কিরকম একটা দুঃখ ছিল! যেন অনেকদিনের জমানো ক্ষত আঘাতগুলো মনের মধ্যে চেপে রাখার দুঃখ। উজান নিজের মনেই খেয়াল করেছিল সেটা। যদিও এতদিন কাজ করার পর শারদীয়া এই প্রথম নিজে থেকে এতগুলো কথা বললো! কথাটা আনমনে মনে হয়েছিল উজানের। তবে ওর কথাগুলো শুনে খারাপ লেগেছিল খুব। কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছিল না। তাই একটু আলতো স্বরে বলেছিল,
——-” আই অ্যাম সরি.. আমি জানতাম না তুমি লাইফে এতকিছু ফেস করেছো! ”
কথাগুলো শুনে শারদীয়া তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে বলেছিল,
——–” না স্যার.. আপনি কেন সরি বলছেন! যাইহোক, আপনাকে আমার একটা কথা বলার আছে। আমি একটা চাকরি পেয়েছি। একটা স্কুলে। পার্টটাইম ফিলজ্যোফি টিচার। মাইনে যা দিচ্ছে তাতে আমার একার ভালো ভাবেই চলে যাবে। ”

চলবে।