হয়তো তোমারি জন্য পর্ব-০৭

0
92

#হয়তো_তোমারি_জন্য ( সপ্তম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
কথাটা শুনে উজান হঠাৎ নিজের চোয়ালটা শক্ত করে বললো,
——-” মা চলে যাওয়ার কোন কষ্ট নেই আমার। কিন্তু বাবার জন্যই! ”
কথাটা বলতে বলতে উজানের চোখ দুটো জলে চিকচিক করে উঠলো যেন। এই মুহূর্তে শারদীয়া কিছু না বলে উজানের হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললো নিজে থেকে। তারপর আস্তে গলায় বললো,
——-” আমার বাবাও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। সব কথা শেয়ার করতাম। বাবাকে ছাড়া একটা দিনও কখনো ভাবতে পারতাম না! কিন্তু আজকে প্রায় ন বছর হতে চললো! একটা এক্সিডেন্ট পুরোপুরি বদলে দিল সব কিছু। আর মা বাবাকে এত ভালোবাসতো যে ওই এক্সিডেন্ট এ হঠাৎ বাবার চলে যাওয়াটা কিছুতেই একসেপ্ট করতে পারেনি। তার ছ মাসের মধ্যে এতটা অসুস্থ হয়ে পড়লো! কিছুতেই আর বাঁচাতে পারলাম না! ”
কথাগুলো খুব নিঃস্ব গলায় বললো শারদীয়া। উজান এই মুহূর্তে নিস্পলক ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। যেন এই প্রথম নিজের মতন কাউকে দেখলো, যে ভেতরে ভেতরে একটা ভাঙা পৃথিবী বুকে করে বাঁচে, রোজ। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ও থমকে থাকা স্বরে বললো,
——–” তোমার মা বাবার ছবি দেখতে পারি? ”
এটা শুনে শারদীয়া কেমন খুশি হয়ে গেল যেন। আসলে ওর মা বাবাকে তো আর সামনাসামনি কারোর সাথে আলাপ করাতে পারবে না! তাই যখন কেউ ছবি দেখে অন্তত মুখটুকু চেনে, তখন ভালো লাগে খুব। এটা ভেবেই ও বেশ হাসি মুখে বললো,
——-” আপনি দেখবেন! এক্ষুণি নিয়ে আসছি ফোনটা। ছবি আছে অনেকগুলো। ”
কথাটা বলেই তাড়াতাড়ি গিয়ে ফোনটা নিয়ে এসেছিল নিজের। তারপর উজানকে প্রথম চিনিয়েছিল ওর মা বাবার সঙ্গে। উজানেরও সেই মুহূর্তে ছবিগুলো দেখে বেশ ভালো লাগছিল।শারদীয়া আর ওর ছোট্ট পরিবার। বাবার মুখটা শান্ত, আর মায়ের সরল চেহারা। ছবিগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছিল খুব সাধারণ হাসি খুশি একটা পরিবার, যেখানে কোন জটিলতা নেই। কোন মুখোশ নেই। কোন খারাপ স্মৃতি নেই। এই এলোমেলো চিন্তার ভিড়েই সেদিন শারদীয়া হঠাৎ ওকে একটা অন্য কথা বলে উঠেছিল। একটু হিসাবের বাইরে বেরিয়েই ও জিজ্ঞেস করেছিল,
——–” আপনি আমার সাথে একটা জায়গায় যাবেন? ভালো লাগবে। ”
কথাটা শুনে উজান একটু অবাক হয়ে গেল যেন! তবে না বলতে পারলো না ঠিক শারদীয়াকে। আসলে এই মেয়েটাকে আলাদা লাগে ভীষণ। তাই মুখের ওপর না বলা সম্ভব না।
তবে সেদিন গাড়িতে যেতে যেতে বেশ রহস্য লাগছিল ওর। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে শারদীয়া আজ! কোন রেস্টুরেন্টে! এই মেয়েটা তো এতদিন খুব বেশি কথাও বলতো না দরকার ছাড়া। তাই বেশ অন্য রকম লাগছিল যেন। তবে গাড়ির ড্রাইভার যখন শারদীয়ার কথা অনুযায়ী কলকাতার ভিড় রাস্তা পেরিয়ে একটা গলির মধ্যে এসে থামলো, তখন উজান সত্যি অবাক হয়ে গেল কেমন। ‘ আনন্দ আশ্রম বৃদ্ধাশ্রম ‘ । নামটা পড়ে উজান ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না! খুব আশ্চর্য চোখেই তাকালো শারদীয়ার দিকে। শারদীয়া এবার আলতো স্বরে বলে উঠলো,
——–” আমাদের দুজনের যেমন মা বাবা নেই, এই আশ্রমে যারা থাকে তাদের অনেকেরই সন্তান থেকেও নেই। খুব একা ওরা! আমি মাঝে মাঝে আসি এখানে। দাদু দিদাগুলো খুব ভালোবাসে আমাকে। আপনি চলুন একবার। আমার মনে হয় ভালো লাগবে। ”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো শারদীয়া। কিন্তু উজান নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল যেন। ও ভাবতে পারেনি শারদীয়া ওকে এরকম একটা জায়গায় নিয়ে আসবে আজ! তবে সেদিন এই আনন্দ আশ্রমে এসে ওর সত্যি অন্য রকম একটা এক্সপিরিয়েন্স হয়েছিল প্রথম। প্রায় বাইশ জন বয়স্ক মানুষ থাকেন এখানে। এক একজনের জীবনে এক এক রকম গল্প। কারোর ছেলে মেয়ে বিদেশে থাকে বলে তার এই আশ্রমে ঠিকানা, তো কেউ সারা জীবন বিয়ে করেনি বলে শেষ জীবনটা বৃদ্ধাশ্রমে কাটাচ্ছে। আর কারোর আবার ছেলে মেয়ে কেউই নিজের সংসারে জায়গা দিতে চায় না বলে এই আশ্রমে ঘর বুক করে দিয়েছে। ওদের প্রত্যেকের মনেই হয়তো অনেক জমা কষ্ট, অভিমান, একাকিত্ব। কিন্তু তাও ওরা জোর করে হাসে। একসাথে মিলে মিশে ভালো থাকার চেষ্টা করে। আর দেখে মনে হলো শারদীয়া এখানে মাঝে মাঝেই আসে। কাউকে দাদু, কাউকে ঠাম্মি বলে নিজের মতন সম্পর্কও পাতিয়ে নিয়েছে মেয়েটা। তবে উজানকেও একটা নতুন নাম দিয়েছে সবাই প্রথম দিনেই। দাদুভাই। যেন কত পুরনো সম্পর্ক ওদের সাথে! এতটা আন্তরিক ভাবে উজানের সাথে সবাই মিশেছে; কথা বলেছে।
সেদিন এরপর সত্যি উজানের মনটা ভালো হয়ে গেছিল। মনে হয়েছিল সম্পর্ক বিহীন পৃথিবীতে হঠাৎ করে অনেকগুলো নিজের লোক খুঁজে পেয়েছে আজ। সেদিন এরপর আনন্দ আশ্রম থেকে বেরিয়ে এসে ও শারদীয়াকে থ্যাঙ্ক ইউ বলেছিল, ভীষণ মন থেকে। শারদীয়া না থাকলে তো এখানে আসাই হতো না! তবে শারদীয়া এই কথাটা শুনে অন্য একটা কথা বলে উঠেছিল আজ। ও খুব সহজভাবেই বলেছিল,
——–” এই পৃথিবীতে মনে হয় না কেউ ভালো আছে! সবার নিজের নিজের এক একটা গল্প, যেখানে অনেক না পাওয়া, অনেক যন্ত্রণা! তবে এর মধ্যে আমরা একটা জিনিসই শুধু করতে পারি। ভালো থাকার চেষ্টা করতে পারি। আর প্লিজ নিজেকে কালকের মতন ওইভাবে হার্ট করবেন না! নিজের জন্য না হোক,নিজের বাবার জন্য। আপনার বাবা যেখানেই থাকুক, আপনাকে ওই অবস্থায় তো দেখতে চাইবেন না কখনোই! ”

কথাগুলো খুব মন থেকে বললো শারদীয়া। উজান এই মুহূর্তে স্থির হয়ে রইলো যেন কয়েক সেকেন্ড। আসলে এই এতগুলো বছরে কেউ ওর জন্য এইভাবে ভেবেছে বলে মনে পড়ে না! তাই শারদীয়াকে ভীষণ আলাদা লাগলো আজ। এই মুহূর্তে ও খুব অল্প শব্দে বললো,
——–” আমি মনে রাখবো তোমার কথাগুলো। এন্ড থ্যাঙ্ক ইউ.. আজ তোমার জন্য নতুনভাবে লাইফটাকে দেখতে পেলাম। ”
কথাটা শুনে শারদীয়ার মুখে আলতো হাসি।
এই এলোমেলো ঘটনার মাঝেই এরপর পুজো এসে হাজির হয়েছিল শহরে। নীল আকাশ, কাশবনের ভিড়ে শরৎ এসেছিল নিশ্চুপে। আজ ষষ্ঠী। ঢাকের কাঠির শব্দেই ঘুম ভেঙেছিল শারদীয়ার। তবে আজ ও একটু নার্ভাস। একটা ব্যাপার নিয়ে একটু ইতঃস্তত, একটু চিন্তিত। সেদিন এই চিন্তার ভিড়েই ও উজানের কাছে গেছিল ব্রেকফাস্টের সময়। তারপর অল্প লজ্জা নিয়েই একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়েছিল উজানের দিকে। উজান এই মুহূর্তে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে একটু অবাক হয়ে তাকিয়েছিল শারদীয়ার দিকে। তখন শারদীয়া কিছুটা এলোমেলো হয়ে বলেছিল,
——” আপনার জন্য কিনেছিলাম। পুজোর গিফ্ট। একটা শার্ট আছে। আমি জানি আপনি অনেক দামি ডিজাইনার শার্ট পড়েন! জানি না আপনার ভালো লাগবে কি না এটা! কিন্তু চাকরি পাওয়ার পর তো এটা আমার প্রথম পুজো; তাই! ”
কথাটা কিভাবে শেষ করবে শারদীয়া ঠিক বুঝতে পারছিল না। তখনই পাশ থেকে বিশু কাকা বেশ হাসি মুখে বলে উঠলো,
——–” শারদীয়া দিদি তো আমাকেও নতুন জামা দিয়েছে পুজোতে। কি সুন্দর রংটা! আমার তো খুব পছন্দ হয়েছে। ”
কথাগুলো শুনে উজানের মুখে এক গাল হাসি। শারদীয়া নিজেও জানে না উজানের আজ ঠিক কতটা ভালো লাগছে! কেউ ওর জন্য পছন্দ করে পুজোর গিফ্ট কিনেছে! একা একা এতগুলো বছর থাকতে থাকতে তো এইসব মুহূর্তগুলো ভীষণ নতুন উজানের কাছে! কথাগুলো ভেবেই ও বেশ একসাইটেড হয়ে শারদীয়ার গিফ্টটা নিয়ে বলেছিল,
——–” এত বছরে এটা প্রথম হলো আমার সাথে। পুজোতে কেউ মনে করে আমার জন্য কিছু কিনেছে। আমি না দেখেই বলছি, তোমার শার্টটা খুব সুন্দর। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ”
কথাগুলো কিরকম সরল মুখে বললো উজান। শারদীয়ার আজ কিরকম মায়া হলো যেন ছেলেটাকে দেখে। আসলে ও বোঝে, উজান মনে মনে ঠিক কতটা একা! সবার ভিড়ে কতটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতন ছেলেটা!
যাইহোক, তবে সেদিন শারদীয়াকে অবাক করে উজান অফিসে যাওয়ার জন্য ওর সামনে ওই নীল রঙের শার্টটাই পড়ে এসেছিল আজ। শারদীয়া তো কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছিল না! তখন উজানই বলেছিল,
——–” ব্লু ইজ মাই ফেভারিট কলর.. তাই আর না পড়ে থাকতে পারলাম না! ”
কথাটা শুনে শারদীয়ার ঠোঁটেও আলতো হাসি। সত্যি ছেলেটাকে ওর অন্য রকম লাগে আজকাল। খুব খাঁটি মানুষ। যে দাম দিয়ে কিছুর বিচার করে না। যে শুধু আন্তরিকতাকে মূল্য দেয়।

তবে এইভাবে ধীরে ধীরে শারদীয়াও উজানের মনে কিরকম আলাদা জায়গা তৈরি করে নিচ্ছে নিজের। এই মেয়েটাকে খুব সহজ আর নিজের লাগে আজকাল, যার সাথে কোন আড়াল রাখা যায় না! সারাদিন বাদে বাড়িতে এসে শারদীয়ার মুখোমুখি একবার না হলে দিনটা কিরকম ইনকমপ্লিট লাগে ওর। সকালবেলা উঠে ব্রেকফাস্ট টেবিলে একবার মেয়েটাকে দেখলে সকালটা এমনি মিষ্টি হয়ে যায় কেমন! এমন কি এখন আর কোন মেয়ের সাথেই টাইম স্পেন্ড করতে ইচ্ছে করে না উজানের। এই কথাটা সেইবার অষ্টমীর দিন আরো বেশি করে বুঝেছিল উজান। সেদিন ওদের কোম্পানির নতুন মডেল তিস্তার সাথে ডিনারে গেছিল ও। তিস্তা এখন কলকাতার খুব নাম করা মডেল। অনেক এড এজেন্সি লাইন দিয়ে থাকে ওর একটা এপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার জন্য। সেদিন এই তিস্তার সাথেই দু বছরের কনট্র্যাক্ট সাইন করেছিল উজানের কোম্পানি, ওদের নতুন তৈরি কমপ্লেক্সের এড, প্রমোশনের জন্য। তবে তিস্তার প্রথম দেখাতেই উজানকে বেশ পছন্দ হয়েছিল। এরকম হ্যান্ডসম একটা ছেলে! তিস্তা তো প্রথম দেখেই কেমন স্থির হয়ে গেছিল যেন। তারপর নিজেই বলেছিল একসাথে ডিনার করার কথা। তবে আগে এইসব হলে উজান বেশ এনজয় করতো ব্যাপারটা। তবে এই প্রথম উজান ঠিক কোন ইন্টারেস্ট পাচ্ছিল না যেন এই মেয়েটার প্রতি। তাও কিছুটা জোর করেই গেছিল ডিনারে। কিন্তু এখানে এসেও উজান কিরকম আনমনা ছিল যেন পুরোটা সময়। যদিও তিস্তা যেরকম সুন্দরী, সেরকম স্মার্ট। ওর মাখনের মতন শরীর, এপ্রচিং কথাবার্তা সবই ভীষণ নজর কাড়ার মতন। কিন্তু তাও যেন কিছু একটা মিস করছিল উজান। তিস্তার ইউরোপ ট্রিপের কথা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝেই শারদীয়ার মুখটা ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। তিস্তার সৌন্দর্য গ্ল্যামার কিছুই আর চোখে লাগছিল না উজানের। মনে হচ্ছিল কতক্ষণে উঠবে এখান থেকে! কতক্ষনে বাড়ি ফিরবে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে হলো আজ তো অষ্টমী। আজ শারদীয়া বাড়িতে একা একা কি করছে এখন! ওর তো কোন বন্ধুর সার্কেল, কিছুই নেই কলকাতায়। তাহলে একা বাড়িতে এখন কি করছে মেয়েটা! কথাটা ভেবেই ও আর বসে থাকতে পারলো না স্থির হয়ে। আসলে অদ্ভুত একটা টান তৈরি হয়েছে যেন শারদীয়ার ওপর! যার আকর্ষণে উজান কিছুতেই আর দূরে থাকতে পারছে না মেয়েটার থেকে। তাই তিস্তার কথার মাঝেই ও বলে উঠেছিল,
——” আমার একটা আর্জেন্ট কাজ মনে পড়ে গেছে। আই হ্যাভ টু লিভ রাইট নাও.. সি ইউ ল্যাটার..”
কথাটা শেষ করেই ও উঠে দাঁড়িয়েছিল। যদিও তিস্তা বেশ অবাক হয়ে গেছিল এই মুহূর্তে। তবে ওর কিছু বলার আগেই উজান বেরিয়ে এসেছিল রেস্টুরেন্টটা থেকে। তারপর সোজা পার্কিং এরিয়াতে গিয়ে গাড়ি বার করে বাড়ির রাস্তা ধরেছিল। তবে এই মুহূর্তে ও নিজেই বেশ অবাক হয়ে যাচ্ছিল নিজের ওপর! হঠাৎ কি হলো ওর! এইভাবে কথায় কথায় শারদীয়ার কথা মনে পড়ছে কেন! কেন এইভাবে ছুটে যাচ্ছে ও মেয়েটার কাছে! এইভাবে তো এর আগে কারোর জন্য ভাবেনি উজান। তাহলে কি শারদীয়া আলাদা সবার থেকে! প্রশ্নগুলো মনে নিয়েই ও ফিরেছিল সেদিন বাড়ি। তারপর এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে শেষে ছাদে গিয়ে দেখা পেয়েছিল শারদীয়ার। একটা লাল রঙের খুবই সাদামাটা চুড়িদার পড়ে ও দাঁড়িয়েছিল একা, আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে। এই মুহূর্তে ও উজানকেও ঠিক খেয়ালও করেনি। কিন্তু উজান কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে দেখছিল শারদীয়াকে। আর অদ্ভুত একটা শান্তি পাচ্ছিল মনে। এই শান্তি, এই ভালো লাগাটা আর অন্য কোথাও গেলে উজান খুঁজে পায় না। কথাটা ভেবেই ও ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল শারদীয়ার কাছে। তারপর আস্তে করে ওকে ডেকে উঠেছিল। এই সময় হঠাৎ উজানের গলার আওয়াজ শুনে যেন ঘোরটা কেটেছিল শারদীয়ার। ও চমকে উজানের দিকে তাকিয়েছিল। তারপর চোখটাকে একটু বড় করেই বলেছিল,
——-” আপনি! এখানে? ”
এই প্রশ্নে উজান ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠেছিল,
——-” সেই প্রশ্ন তো আমারও। তুমি এখানে ছাদে একা একা কি করছো? ”
এটা শুনে শারদীয়া একটু এলোমেলো হয়ে বললো,
——” না, এমনি। আসলে এই সময়ে ওই দূরে ঢাকের আওয়াজ, মাইকে গান, এইসবের মধ্যে একটা একলা ছাদ আর খোলা আকাশ ভালো লাগে খুব আমার। তাই দাঁড়িয়েছিলাম। যাইহোক, আসছি। ”
কথাটা বলেই শারদীয়া চলে যাচ্ছিল। কিন্তু উজান আজ একটু বেহিসেবী ভাবেই ওর হাতটা ধরে বললো,
——–” কেন চলে যাচ্ছো? আমি কি এতটাই খারাপ যে কিছুক্ষণ অকারণে দাঁড়িয়ে কথা বলা যায় না আমার সাথে! ”
এই প্রশ্নে শারদীয়া কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছিল না। তাই কিছুটা অবাক হয়েই বললো,
——–” এ বাবা! না না। সেসব কিছুই না। ”
কথাটা শুনে উজান এবার ওর হাতটা ছেড়ে বলে উঠলো,
———” বুঝলাম। যাইহোক, তুমি ঠাকুর দেখেছো এবার কলকাতার? এটা তো তোমার প্রথম পুজো এই শহরে। ”
এই কথায় শারদীয়া একটু সময় নিয়ে বললো,
———” না। দেখা হয়নি। আসলে আমার ভিড় ঠিক পছন্দ না। তবে এই গলির মুখের ঠাকুরটা দেখে এসেছি। ওতেই হবে। ”
এটা শুনে উজান বেশ কৌতূহল নিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
——-” তাহলে তোমার কি ভালো লাগে? মানে কিরকম জায়গা পছন্দ? জানতে পারি? ”
এতগুলো প্রশ্ন শুনে শারদীয়ার হঠাৎ কেমন অন্য রকম লাগলো যেন ছেলেটাকে। এইভাবে তো আগে কখনো কথা বলতো না উজান! কথাটা ভেবেই ও কিছুটা সহজ ভাবে বললো,
——–” ভিড় ছাড়া যেকোন জায়গাই আমার ভালো লাগে। যেখানে প্রাণ খুলে অক্সিজেন নিতে পারবো। ”
এটা শুনে উজান কিছু একটা যেন চিন্তা করে বলে উঠলো একটু সময় নিয়ে,
———-” কাল ভোরবেলা সাড়ে চারটে কি পাঁচটার দিকে রেডি থেকো তুমি। একটা জায়গায় যাবো আমরা। ”
কথাটা শুনে শারদীয়া বেশ অবাক হয়ে বললো,
———-” কোথায় যাবো আমরা? অতো ভোরে!”
এটা শুনে উজান বেশ জোর দেখিয়ে বললো,
——–” যাবো একটা জায়গায়। কাল জানতে পারবে। আর আমি সিওর, সেদিন যেমন আমার ভালো লেগেছিল আনন্দ আশ্রম গিয়ে, কাল তোমার ভালো লাগবে আমার পছন্দের জায়গায় গিয়ে। এনিওয়েজ, রেডি থেকো তুমি। ”
কথাগুলো কিরকম যেন অধিকারের সুরে বললো উজান। এরপর শারদীয়া আর না করতে পারলো না! শুধু মনে মনে প্রশ্নটা রয়েই গেল যেন। কাল কোথায় যাবে ওরা অতো ভোরে!

চলবে।