হয়তো তোমারি জন্য পর্ব-১০

0
94

#হয়তো_তোমারি_জন্য ( দশম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
কিন্তু অনেক সময় শেষ যেখানে মনে হয়, গল্পটা সেখানেই শেষ হয় না। অনেক না পড়া পাতা এসে জুড়ে যায় বইয়ের ভিতর। ঠিক সেটাই হয়েছিল উজানের সাথে। শারদীয়া চলে যাওয়ার কদিন বাদে সকাল সকাল অমিত এসেছিল সেই শুক্রবার উজানের কাছে। অমিত এই বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড। বেশ অনেকদিন ধরেই কাজ করে এখানে। তবে আজ ছেলেটা বেশ বেহিসেবী হয়ে এসেছিল উজানের কাছে। উজান সেই মুহূর্তে ফ্রেশ হয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল। তখনই দরজায় নক করে অমিত। ছেলেটাকে দেখে উজান কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অমিত নিজে থেকে বলেছিল,
——-” স্যার আমার কিছু দেখানোর আছে আপনাকে। জানতাম, আমার মুখের কথায় আপনি বিশ্বাস করবেন না। তাই ভিডিও করে এনেছি। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল অমিত। কিন্তু এইসব শুনে উজান কিছুটা অবাক হয়েই বলেছিল,
——-” কি ব্যাপারে ভিডিও? কি কথা বলতে চাও? ”
প্রশ্নগুলো শুনে অমিত একটু এলোমেলো হয়ে বলেছিল,
——–” স্যার আমি কালকে নিয়ে দুদিন হলো এই জিনিসটা দেখেছি। আপনি যখন থাকেন না, মানে অফিসে যান, তারপর তিস্তা ম্যাডাম আসে এই বাড়িতে। আর তিস্তা ম্যাডাম বিশু কাকাকে বেশ ভালো এমাউন্টের টাকা দেয়, ক্যাশ। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল অমিত। কিন্তু উজান এইসব শুনে আকাশ থেকে পড়ার মতন মুখ করে বলেছিল,
——–” কি! কি বলছো এইসব! কার ব্যাপারে কথা বলছো তোমার খেয়াল আছে? লোকটা বিশু কাকা। আমার বলতে গেলে বাড়ির লোকের মতন। ”
কথাগুলো খুব বিশ্বাস নিয়ে বলেছিল উজান। কিন্তু অমিত এবার বেশ জোর দিয়ে বলেছিল,
———” স্যার আমিও জানি বিশু কাকা এই বাড়িতে সব থেকে সিনিয়র। কিন্তু অনেকদিন ধরে ওনার সমস্ত কথা কাজ আমার অন্য রকম লাগছে। এই যেমন আমি যেদিন প্রথম তিস্তা ম্যাডামকে বিশু কাকাকে টাকা দিতে দেখেছিলাম, সেইদিনই ভেবেছিলাম আপনাকে এসে বলবো ড্রইং রুমের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখিয়ে। কিন্তু সেদিন চেক করে দেখলাম ওই সময় ক্যামেরাটা অফ ছিল ড্রইং রুমের। আর শুধু সেটাই না। বিশু কাকা সেদিন দরজা খুলে শারদীয়া ম্যাডামের ব্যাপারে যা যা বলেছে আপনাকে, সেগুলোও আমি শুনেছিলাম। আর সেগুলো সবটাই মিথ্যে ছিল। কোনদিন এই বাড়িতে কোন ছেলে নিয়ে আসতো না শারদীয়া ম্যাডাম। আরে উনি তো বাসে ট্রামে করে স্কুল থেকে ফিরতেন। এতদিন ধরে দেখছি! বিশু কাকা এত বড় মিথ্যে কথাটা কেন বললো বুঝলাম না। আর সেইদিনও বিশু কাকা সন্ধ্যের দিকে আমাকে জোর করে বাজার করতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তার মধ্যে নিশ্চয়ই এই ছেলেটা ঢুকেছে বাড়িতে। নইলে আমি তো কারোর আইডেন্টিটি কার্ড ছাড়া বাড়িতে এলাওই করি না। আমি সেদিনও গিয়ে সিসিটিভি ক্যামেরা চেক করেছিলাম। কিন্তু স্যার, সন্ধ্যে থেকে দু ঘন্টার জন্য বাড়ির সমস্ত সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ ছিল সেদিন। আর এটা কোন বাইরের লোকের কাজ হতে পারে না। কেউ ইচ্ছে করেই এইসব করেছে। ”
কথাগুলো কিরকম এক নাগাড়ে বলেছিল অমিত। তারপর নিজের ফোন থেকে করা ভিডিওটা দেখিয়েছিল উজানকে। উজান সত্যিই এইসব দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেছিল! বিশু কাকা হঠাৎ তিস্তার কাছ থেকে এতগুলো টাকা নিচ্ছে কেন! কী হচ্ছে এইসব বাড়িতে! তাহলে কি সেদিন শারদীয়াকে বুঝতে কোন ভুল হয়ে গেছিল উজানের! কথাগুলো ভেবেই আর ও স্থির থাকলো না। ভীষণ চিৎকার করে বিশু কাকাকে ডাকলো ঘরে। তারপর কোনরকম আড়াল না করেই জিজ্ঞাসা করলো,
——–” আমাকে একটা কথা সত্যি করে বলো। কিসের জন্য তুমি তিস্তার কাছ থেকে টাকা নিয়েছ দুবার? অমিত ভিডিও করেছে। আমি সব দেখেছি। তাই কিছু লুকোনোর চেষ্টা করবে না! ”
কথাগুলো বেশ রেগে বলেছিল উজান। সেই মুহূর্তে অমিতও ভীষণ রেগেই বলে উঠেছিল,
——-” কেন করছো বিশু কাকা তুমি এইসব? তুমি সেদিন শারদীয়া ম্যাডামের নামেও কত উল্টো পাল্টা কথা বানিয়ে বললে! আমি বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে শুনেছি সব। কিন্তু তুমিও জানো, শারদীয়া ম্যাডাম এরকম মেয়েই নয়। কোনদিন একটা কোন ছেলের সাথে কথা অব্দি বলতে দেখিনি ওনাকে। আর সত্যি করে বলো, ওই ছেলেটাকে সেদিন বাড়িতে তুমিই ঢুকিয়েছিলে তাই না? সেই জন্য আমাকে বাজারে পাঠিয়ে দিয়েছিল ইচ্ছে করে ওই সন্ধ্যেবেলা। কারণ আমি থাকলে তোমার কাজটা করতে অসুবিধা হতো! ছিঃ তুমি সত্যি শারদীয়া ম্যাডামের মতন মানুষকে এইভাবে মিথ্যে ফাঁসিয়ে দিতে পারলে! যে তোমায় এতটা সম্মান করতো। এত ভালোবাসতো। ”
কথাগুলো কিরকম রাগ কষ্ট নিয়ে বলেছিল অমিত। আসলে শারদীয়া ওকে প্রথম থেকে দাদা দাদা বলতো। এমনকি বহুদিন শারদীয়া ওর মেয়ের জন্য সমস্ত স্কুলের বই খাতা কিনে দিত নিজে থেকে। তাই এই মানুষটার জন্য অমিতের মনে আলাদাই জায়গা। কিন্তু এই মুহূর্তে বিশু কাকাও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো হঠাৎ। আসলে বিবেকের দংশন হয়তো। আর পারছে না এই অপরাধবোধটাকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে। তাই আজ উজানের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো হঠাৎ। তারপর চোখে জল নিয়ে হাতজোড় করেই বললো,
——-” আমাকে ক্ষমা করে দাও তুমি। আমি যা করেছি শুধু আমার ছেলের জন্য করেছি। ছেলেটা জুয়া খেলে কিছু গুন্ডা মস্তানের কাছে প্রচুর টাকা হেরে গেছে। তারা দিনরাত হুমকি দিচ্ছে বাড়িতে এসে! তাই যখন তিস্তা ম্যাডাম এইসব করলে আমাকে টাকা দেবে বললো, আমি আর না করিনি! সেদিন আমি বাড়িতে ওই ছেলেটাকে ঢুকিয়েছিলাম। তার আগে তিস্তা ম্যাডামের কথা মতন আমি শারদীয়ার কফিতে একটা নেশার ড্রাগ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। ওই ওষুধটাও আমাকে তিস্তা ম্যাডামই দিয়েছিল। আর ওই ছেলেটাকেও তিস্তা ম্যাডাম ঠিক করেছিল। সেদিন ছেলেটা আমার সামনে শারদীয়ার শাড়ির আঁচল টেনে খুলেছিল। ব্লাউজ খুলেছিল। আমার সামনেই ওর সাথে শোয়ার অভিনয় করেছিল। ওকে নোংরা ভাবে ছুঁয়েছিল। আর আমি পাথরের মূর্তির মতন এক জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম। কিছু করিনি আমি। কিচ্ছু না। ”

কথাগুলো বলতে বলতে বিশু কাকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। উজান এই মুহূর্তে সমস্ত সত্যিটা জেনে কেমন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিল যেন! এত কিছু হয়েছিল সেদিন শারদীয়ার সাথে! তারপর উজান ওকে হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির বাইরে বার করে দিল! একটা কথা শুনলো না মেয়েটার। একবার বিশ্বাস করার চেষ্টা অব্দি করলো না! আর বিশু কাকা শেষে এতকিছু করলো! তাও তিস্তার কথায়! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ও প্রায় দিকবিদিক শুন্য হয়ে বিশু কাকার সামনে বসে পড়লো। তারপর কেমন নিঃস্ব গলায় জিজ্ঞেস করলো,
———” তুমি এইসব করলে শেষে! এত বড় মিথ্যে বললে! আর তিস্তা? ও এইসব কেন করালো তোমাকে দিয়ে? আমার আর শারদীয়ার রিলেশনটা ভাঙলে ওর কি লাভ! ”
কথাগুলো শুনে বিশু কাকা সেদিন সোজাসুজিই বলে উঠলো,
——–” ও পছন্দ করে তোমাকে। তাই করেছে এইসব। শারদীয়া থাকলে তো ও তোমার কাছে আসতে পারতো না! তাই। আর বিশ্বাস করো, আমার টাকাগুলোর খুব দরকার ছিল। তিস্তা ম্যাডাম আমাকে ক্যাশ দিচ্ছিল। আসলে ব্যাঙ্কে টাকা পাঠালে তো প্রমাণ থেকে যাবে, সেই জন্য। ”

এইসব শুনে সেদিন উজান কিরকম স্থির হয়ে গেছিল যেন কয়েক সেকেন্ড। তবে অমিত চুপ থাকতে পারেনি আর। ও বিশু কাকার ওপর নিজের সমস্ত রাগ বার করে বলেছিল,
——” তুমি টাকার জন্য একটা মেয়ের সাথে এতটা নোংরামো করতে পারলে! শারদীয়া ম্যাডাম তো তোমাকেও কত ভালোবাসতো! এই কমাস আগে পুজোতে তোমার জন্য জামা কিনেছিল নতুন। কতটা সম্মান করতো তোমাকে। আর তার সাথেই তুমি! ”
না, কথাগুলো আর শেষ করতে পারলো না অমিত। গলাটা ধরে এলো যেন; এতটা খারাপ লাগছিল। কিন্তু উজান এই মুহূর্তে ভীষণ কঠিন হয়ে বলে উঠলো,
——-” অন্য কেউ হলে আমি পুলিশে দিতাম। কিন্তু তুমি বলে সেটা করতে পারছি না! ছোটবেলা থেকে দেখছি তো! যাইহোক, আর এক সেকেন্ড তুমি এই বাড়িতে থাকবে না। ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে বেরিয়ে যাও এক্ষুণি। তোমার যা টাকা পয়সা আছে আমি সব মিটিয়ে দেব। শুধু আর আমার সামনে কখনো এসো না। ”
কথাগুলো বলেই উজান সেদিন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর সোজা অফিসে গিয়ে তিস্তার মুখোমুখি হয়েছিল। তার আগেই স্টাফকে বলে তিস্তার সাথে ওদের কোম্পানির যে এড ফিল্ম এর জন্য কনট্র্যাক্ট ছিল, তার ক্যানসেলেশন পেপারটা রেডি করিয়েছিল। সেদিন তিস্তা আসার পর ওর মুখে পেপারটা ছুঁড়ে মেরেছিল উজান। তারপর প্রচণ্ড রাগ নিয়ে বলেছিল,
——–” তুমি শারদীয়ার সাথে কি কি করেছ, সব আমি জেনে গেছি। নেহাৎ বিশু কাকা ইনভলব আছে বলে আমি তোমাকে পুলিশে দিইনি। নইলে আজ তোমার কেরিয়ার রেপুটেশন শেষ করতে আমার দু সেকেন্ড লাগতো না! এতটা চিপ তুমি! নিজে একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সাথে এরকম করলে! শারদীয়া তো তোমাকে চিনতো পর্যন্ত না। আর তুমি বাইরে থেকে একটা ছেলে ঢুকিয়ে ওর সাথে! ”
না, কথাটাকে আর শেষ করতে পারলো না উজান। তার আগেই তিস্তা কেমন নিজের মনে বলে উঠলো,
——-” বিকজ আই লাভ ইউ.. যা করেছি ঠিক করেছি। আর ঐরকম একটা লোয়ার ক্লাস মেয়ে। যার কোন ফ্যাশন সেন্স নেই, ড্রেসিং সেন্স নেই। কোথা থেকে চলে এসেছে! তার জন্য তুমি আমার দিকে তাকাতে না? আমাকে এটেনশন দিতে না! আই কুড নট একসেপ্ট দ্যাট.. সেই জন্যই আমি এইসব করতে বাধ্য হয়েছি। ”
কথাগুলো বেশ তেজ দেখিয়ে বলে গেল তিস্তা। কিন্তু উজান এর উত্তরে ভীষণ কঠিন স্বরে বললো,
——–” ইউ নো হোয়াট, ইউ আর সিক.. বেটার, নিজের গিয়ে ট্রিটমেন্ট করাও। আসলে তুমি এতটাই সেলফ অবসেস্ট যে কারোর রিজেকশন সহ্যই করতে পারো না। আর তুমি প্লিজ শারদীয়ার নামটা নিজের মুখে উচ্চারণ করতে যেও না, বিকজ ওর নাম বলারও যোগ্যতা তোমার নেই। তুমি এতটাই চিপ.. এন্ড নাও, গো টু হেল.. ”
কথাগুলো কেমন এক নাগাড়ে বলেছিল উজান প্রচণ্ড মাথা গরম করে। কিন্তু তারপর তিস্তা আর দাঁড়ায়নি। এত কিছু শোনার পর উজানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মুখও নেই ওর। তাই বেরিয়ে গেছিল অফিস থেকে। কিন্তু উজান এবার ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছিল চেয়ারে। মাথাটা ঘুরছিল যেন। আসলে নিজের ওপরই নিজের রাগ হচ্ছিল কেমন। এটা কি করলো ও! যেই মেয়েটা ওর জীবনে স্থিরতা এনেছিল, ভালোবেসেছিল, তাকে এইভাবে হারিয়ে ফেললো! এতটা অপমান করলো! এরপর কোন মুখে যাবে শারদীয়ার কাছে! কি বলে ফিরিয়ে আনবে ওকে! সব কিছু তো শেষ করে ফেলেছে নিজের ভুলে।

এরপর উজান কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে কোনভাবে সামলে শারদীয়ার নাম্বারটা ডায়েল করেছিল আজ ফোনে। তবে সেদিন আর কেউ ওর ফোন ধরেনি। বরং কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোনটা নিজে থেকেই কেটে গেছিল দু তিন বার। আর অবশেষে সুইচ অফ হয়ে গেছিল। উজান সেই মুহূর্তে বুঝেছিল, শারদীয়া কথা বলতে চায় না আর ওর সাথে। তাই আজ ফোন ধরলো না। আসলে কথা বলার মতন কোন কাজ করেনি তো উজান। এতটা অপমান করেছে মেয়েটাকে যে আর কোন কথা বলার জায়গাই রাখেনি। কিন্তু উজান এইভাবে তো চুপ করে বসে থাকতে পারবে না! যেভাবেই হোক ওকে শারদীয়ার কাছে যেতেই হবে। ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের ভুলটা স্বীকার করতে হবে। কথাটা ভেবেই সেদিন উজান এরপর শারদীয়ার স্কুলে গেছিল। এখানে এলে নিশ্চয়ই মেয়েটার খোঁজ পাওয়া যাবে। তবে আজ স্কুলের গেট বন্ধ ছিল। উজান এই দৃশ্য দেখে কেমন থমকে গেছিল। তারপর দারোয়ানের কাছে গিয়ে জানতে পেরেছিল যে স্কুলে গরমের ছুটি পড়েছে। তাই এখন এক মাস বন্ধ। কথাটা শুনেই কেমন দিশেহারা হয়ে গেছিল উজান। এবার কি করবে ও! কিভাবে শারদীয়াকে খুঁজবে! কথাটা ভেবে উজান দারোয়ানটাকেই জিজ্ঞেস করেছিল শারদীয়ার ব্যাপারে। কিন্তু লোকটা কিছু বলতে পারেনি। সে বাকি টিচারদের মতন শারদীয়াকে চিনলেও তার ঠিকানা জানে না! কথাটা শুনে উজান চুপ হয়ে গেছিল যেন। কি করবে ঠিক মাথা কাজ করছিল না! কোথায় খুঁজবে এবার শারদীয়াকে! ওর কোন বন্ধু আত্মীয় কেউই তো নেই কলকাতায়। আসলে উজান ছাড়া নিজের লোক আর কে ই বা ছিল মেয়েটার এই শহরে! তাহলে এখন কার কাছে যাবে! কথাটা ভেবেই সেদিন ওর বৃদ্ধাশ্রমের কথাটা মনে পড়লো। শারদীয়া তো ওখানে যেত মাঝে মাঝেই। ওরা নিশ্চয়ই জানবে শারদীয়ার ব্যাপারে। কথাটা ভেবেই সেদিন উজান বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়েও কোন উত্তর পায়নি ছেলেটা। বৃদ্ধাশ্রমের অরুণ দাদু বলে উঠেছিল,
——-” শারদীয়া মা প্রত্যেক শনি রবিবার করে এখানে আসে ঠিকই। কিন্তু কোথায় থাকে, সেই এড্রেস জানা নেই। হ্যাঁ, এটুকু আমরা শুনেছি যে ও একটা লেডিজ হোস্টেলে থাকে। তবে তার বেশি কিছু জানি না! ”
কথাগুলো শুনে উজানের চোখে জল চলে এসেছিল। মনে হচ্ছিল ও হারিয়ে ফেলেছে শারদীয়াকে, পুরোপুরিভাবে। শুধুমাত্র নিজের দোষে।
এরপর ছেলেটা সারাদিন কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছিল, যদি কোনভাবে এই এত লোকের ভিড়ে শারদীয়ার মুখটা খুঁজে পায় আজ! কিন্তু দিন থেকে রাত হয়ে গেলেও উজান দেখা পায়নি মেয়েটার। তারপর ভীষণ ক্লান্ত শরীরে ফিরে এসেছিল বাড়ি। তবে বাড়ির ভিতর ঢোকার আর শক্তি ছিল না যেন। কেমন নিঃস্ব হয়ে বাড়ির বাইরের সিঁড়িটাতেই বসে পড়েছিল উজান। কিন্তু এই মুহূর্তে গেটে দাঁড়ানো অমিত আর চুপ থাকতে পারেনি। ও নিজে এসেছিল উজানের কাছে। তারপর আস্তে গলায় জিজ্ঞেস করেছিল,
——–” স্যার আপনি ঠিক আছেন তো? ”
কথাটা শুনে উজান কেমন এলোমেলো হয়ে বলেছিল,
——–” সারাদিন ধরে খুঁজলাম শারদীয়াকে। কিন্তু কোথাও পাইনি! ফোনটাও ও আমার ধরছে না! স্কুলও বন্ধ। আর ওর কোন বন্ধু আত্মীয় কেউ তো নেই কলকাতায়! কোথায় গিয়ে খুঁজবো এখন আমি মেয়েটাকে! আই ফিল আই জাস্ট লস্ট হার..”
কথাগুলো বলতে বলতে উজান কেঁদে ফেলেছিল কেমন। অমিত এটা দেখে আর লুকিয়ে রাখতে পারেনি কথাটা। নিজেই বলে উঠেছিল,
——-” স্যার আমি জানি শারদীয়া ম্যাডাম কোথায় আছে। আপনি যেদিন ম্যাডামকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিলেন, সেদিন আমি ওনাকে বাড়ি নিয়ে গেছিলাম। এতটা খারাপ অবস্থা ছিল সেদিন ম্যাডামের! বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছিল রাস্তায়। যাইহোক, তারপর কদিন আমাদের বাড়িতে থেকে শেষে ম্যাডাম নিজে হাতিবাগানের কাছে একটা লেডিজ হোস্টেল খুঁজে চলে যায়। হোস্টেলটার নাম ‘শান্তি নীড়’। যদিও আমি জানি আমি এই এড্রেসটা আপনাকে দিয়েছি শুনলে ম্যাডাম খুব রাগ করবেন আমার ওপর; কিন্তু তাও না দিয়ে থাকতে পারলাম না। ”
কথাগুলো ধীর গলায় বলেছিল অমিত। কিন্তু এটা শুনে উজান জড়িয়ে ধরেছিল ছেলেটাকে এই মুহূর্তে। তারপর ওর হাত দুটো ধরে বলেছিল,
——–” থ্যাঙ্ক ইউ.. থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ.. আমি তোমার হেল্পটা সারা জীবন ভুলবো না! ”
কথাগুলো চোখে জল নিয়ে বলেছিল উজান। তারপর আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়েছিল শারদীয়ার নতুন ঠিকানার খোঁজে, শান্তি নীড়ে।

চলবে।