হয়তো তোমারি জন্য পর্ব-১১

0
184

#হয়তো_তোমারি_জন্য ( একাদশ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
কলকাতার ভিড় রাস্তা পেরিয়ে এরপর যখন উজান ওই লেডিজ হোস্টেলটার সামনে পৌঁছেছিল তখন ঘড়িতে রাত নটা। উজান সেই সময় ভিতরে ঢুকতে চাইলে গেটের সিকিউরিটি গার্ড বলেছিল,
——-” এই সময়ে কোন ভিজিটর এলাওড না হোস্টেলে। আপনি পরে আসুন। ”
কথাটা শুনে উজান ভীষণ রিকুয়েস্ট করে বলেছিল,
——–” দেখুন প্লিজ আমাকে একবার শারদীয়ার সাথে দেখা করতে দিন। প্লিজ.. আমি আজ ওর সাথে কথা না বলে কোথাও যাবো না। একবার শুধু দেখা করতে দিন! ”
কথাগুলো এতটা ব্যাকুল স্বরে বললো উজান যে ওই গার্ড লোকটিও আর কঠিন হয়ে থাকতে পারলো না। উনি অল্প সময় নিয়ে বললেন,
——-” ঠিক আছে। আমি জানাচ্ছি। দরকার হলে উনি বাইরে এসে কথা বলে যাবেন। কিন্তু আপনার নামটা কি বলবো? ”
প্রশ্নটা শুনে উজান চোখ দুটো নামিয়ে বললো,
——” উজান। ”
তবে ও নিজেও জানে না এই নামটা শুনলে শারদীয়া নিচে আসবে কি না! মেয়েটা তো ওর ফোনটা অব্দি ধরছে না। দেখা করা তো দূরে থাক! কথাগুলো ভেবেই বেশ টেনশনের মধ্যে দাঁড়িয়েছিল বাইরে রাস্তায়। তবে কিছুক্ষণ বাদে গার্ড এসে বেশ অবাক সুরে বললো,
——” উনি তো বলছেন উনি এই নামের কাউকে চেনেনই না! তাই দেখাও করবেন না। আপনি শুধু শুধু এখানে এসেছেন কেন! অদ্ভুত! ”
কথাগুলো কেমন নিজের মনে চিন্তা করে বললো ওই সিকিউরিটি গার্ড। কিন্তু এটা শুনে উজান খুব স্পষ্টভাবে বুঝলো নিজের ভুলের কি দাম দিতে হচ্ছে ওকে! শারদীয়া আজ এতটাই অচেনা হয়ে থাকতে চায় যে ওর সাথে দেখা পর্যন্ত করছে না! কথাটা ভেবে মনের মধ্যে যেন একটা কাঁচ এসে বিঁধলো। কিন্তু উজান এইভাবে ফিরে যাবে না। শারদীয়ার সাথে যেভাবেই হোক দেখা করবে। তার জন্য যতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় করবে। কথাটা ভেবেই সেদিন সারা রাত হোস্টেলের সামনে উজান গাড়ির মধ্যে বসে ছিল; একটা ভোর হওয়ার অপেক্ষায়। এরপর ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে সকাল এগারোটার দিকে শারদীয়া যখন হোস্টেল থেকে বেরিয়েছিল, উজান সেই মুহূর্তে ওর কাছে গেছিল। তবে শারদীয়া আজ এতটাই কঠিন ছিল যে উজানকে দেখেও অদেখা করে চলে যাচ্ছিল। ওর ডাকে কোনভাবেই সাড়া দিচ্ছিল না। উজান সেই মুহূর্তে এগিয়ে এসে ওর হাতটা ধরে ফেলেছিল, তারপর ওর ভীষণ কাছে এসে বলেছিল,
——-” প্লিজ একবার আমার কথা শোনো। প্লিজ.. আমি জানি, আমি খুব বড় ভুল করে ফেলেছি। সেদিন আমার তোমার কথা শোনা উচিত ছিল। আমি আসলে এতটা রেগে ছিলাম! ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলছিল উজান। তবে ওর কথা শেষ হতে না দিয়েই শারদীয়া জোর করে এবার নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল উজানের কাছ থেকে। তারপর খুব শান্ত গলায় বললো,
———” ভুল আপনার না। ভুল আমার হয়েছিল। আপনার মতন লোককে ভালোবেসেছিলাম। এটা ভেবেছিলাম যে আপনিও ফিল করতে জানেন! আসলে তখন বুঝিনি যে আপনার শুধু মেয়ের দরকার হয়। ব্যাস। আজ আমি, কাল তিস্তা, পরশু অন্য কেউ! যাইহোক, আমি বুঝতে পারছি না এখন কেন আপনি এসেছেন আমার মতন একটা রাস্তার মেয়ের জন্য নিজের টাইম ওয়েস্ট করতে! আপনি তো নতুন একজনকে পেয়েই গেছেন। যে আপনার সাথে একই বাড়িতে থাকছে! তাহলে কেন এখানে? ”
কথাগুলো ভীষণ কষ্ট আর রাগ থেকে বলেছিল শারদীয়া। কিন্তু উজান কিরকম দিশেহারার মতন ওকে জিজ্ঞেস করেছিল,
——–” তুমি আমাকে আপনি কেন বলছো! আর আই জাস্ট লাভ ইউ.. ট্রাস্ট মি.. আর তোমার সাথে যা কিছু হয়েছে সব তিস্তা বিশু কাকাকে দিয়ে! ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলছিল উজান। তবে এই মুহূর্তে শারদীয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে ভীষণ কঠিন গলায় বললো,
——–” আমার কিচ্ছু জানার নেই আর। আর আপনাকেও আমি চিনি না, চিনতে চাইও না। একটা কথা আমি বুঝে গেছি; আমাদের দুজনের পৃথিবী একদম আলাদা। আমি আপনাদের মতন নই। আমার ব্যাঙ্কে অঢেল টাকাও নেই, আর মদ খাওয়া, পার্টি করা, নাইট ক্লাবে গিয়ে সেই টাকা ওড়ানোর মতন রুচিও নেই। তাই প্লিজ, আর আমার সাথে কখনো দেখা করার চেষ্টা করবেন না। আর যদি আবার এই হোস্টেলে আসেন, তাহলে বাধ্য হয়ে এই ঠিকানাটাও আমাকে বদলাতে হবে।”

একসাথে কথাগুলো হিমশীতল গলায় বললো শারদীয়া। তারপর উজানের দিকে আর ফিরে না তাকিয়ে ভীষণ জোরে পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটার চোখের সীমানার বাইরে। কিন্তু উজান কেমন স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলো এক জায়গায়। ওর জীবনের একটা মাত্র সম্পর্ক, একজন মাত্র ভালোবাসার মানুষ আজ পুরোপুরি ভাবে মুখ ফিরিয়ে নিল ওর থেকে। ভীষণ একলা করে দিল উজানকে।

তবে আজ এই যন্ত্রণার মধ্যে উজান কিন্তু মদ খায়নি। নেশা করেনি। আসলে শারদীয়ার কথাগুলো যেন বাজছিল কানে। উজানকে শারদীয়া আজ কি চোখে দেখে সেটা খুব সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছে মেয়েটা। আর ঠিকই তো। দিনের পর দিন এই মদের নেশা, পার্টি এই সমস্ত কিছুতেই তো হারিয়ে থাকতো ও। সেদিনও অতটা ড্রিঙ্ক করেছিল বলেই শারদীয়ার কোন কথা শোনেনি। হাত ধরে টানতে টানতে বার করে দিয়েছিল মেয়েটাকে রাস্তায়! ওই নেশাই ওকে অন্ধ করে দিয়েছিল যেন। কিছু ভাবার, চিন্তা করার ক্ষমতাই ছিল না! কিন্তু উজান যদি আর ড্রিঙ্ক না করে, নিজের ভুলগুলোকে ঠিক করে, শারদীয়া যেরকম চায় সেরকম একটা নেশাহীন জীবন শুরু করে, তাহলে কি ফিরে আসবে মেয়েটা ওর কাছে! কথাগুলো যেন জোর করে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল উজান। একটা আশা খুঁজছিল রোজ, বেঁচে থাকার জন্য। তবে এই সময় হাজার ইচ্ছা করলেও শারদীয়াকে দেখার জন্য ও হোস্টেলে যেত না। যদি মেয়েটা রেগে অন্য কোথাও চলে যায় আবার; যেই ঠিকানা অমিতও জানবে না! তাহলে কি হবে! উজান নিজের দোষে আবার হারিয়ে ফেলবে শারদীয়াকে। কথাগুলো ভেবেই উজান নিজেকে আটকে রাখতো রোজ, প্রত্যেকটা মুহূর্তে।

তবে একটা জায়গায় ও এরপর থেকে যাওয়া শুরু করেছিল নিয়ম করে। সেটা হলো আনন্দ আশ্রম। যেখানে প্রত্যেক শনি রবিবার শারদীয়া আসে। উজান একমাত্র এখানে এলেই মেয়েটাকে কাছ থেকে দেখতে পায়। যদিও শারদীয়া ওর সাথে একটা শব্দও বলে না। চোখাচোখি হলেও ভীষণ কঠিন একটা মুখ করে অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। তবে অন্তত দেখা তো হয়! এই ভেবেই উজান প্রত্যেক সপ্তাহে এখানে আসে। তবে এই বয়স্ক মানুষ গুলোর কাছে এলে এমনিতেও শান্তি পায় যেন। ওদের সবার সাথে উজান দিন দিন ভীষণ ভাবে জড়িয়ে পড়ছে। ওদের খারাপ লাগা ভালো লাগা গুলোকে নিজের করে নিচ্ছে। তাই তো সেইবার পুজোর আগে একটা পিকনিকের এড়েঞ্জমেন্ট করেছিল নিজে। বিমল দাদু, সবিতা পিসি, মিষ্টি জেঠিমা, সবাইকে নিয়ে গেছিল এই ছোট্ট আউটিংটায়। তবে এই পিকনিকে শারদীয়াও ছিল। আসলে ওই বয়স্ক মানুষগুলোর মুখের ওপর কখনো না বলতে পারে না শারদীয়া। তাই যখন ওরা বলেছিল পিকনিকের কথা, শারদীয়াকে যেতেই হয়েছিল। তবে এখানে এসেও ও উজানের সাথে কথা বলেনি দরকার ছাড়া। শুধু ওই খাবার সার্ভ করার সময় বাধ্য হয়ে দু চারটে শব্দ বলতে হয়েছিল। তবে সেদিন পিকনিকে, পার্কে ঘুরতে ঘুরতে শারদীয়ার জুতোর স্ট্র্যাবটা হঠাৎ খুলে গেছিল, আর হোঁচট খেয়েছিল হঠাৎ, তখন উজানই ওকে সবার মাঝে এসে ধরেছিল শক্ত করে। সেই মুহূর্তে ছেলেটা কেমন নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। এই সময় শারদীয়াও কিছুক্ষণের জন্য একটা কথাই ভাবছিল। কেন করছে ছেলেটা এইসব! নিজের পার্টি, নাইট ক্লাব, মদ, তিস্তা, আরো হাজারটা মেয়েকে ছেড়ে কেন পড়ে আছে এখানে! এই বয়স্ক মানুষগুলোর সাথে! উজান কি সত্যিই এইসব ওর জন্য করছে! ওকে একবার দেখবে বলেই প্রত্যেক সপ্তাহে এখানে আসে! আর এখানে আসতে আসতে কি সত্যিই ছেলেটা এই মানুষগুলোর সাথে জড়িয়ে পড়েছে মন থেকে! কথাগুলো কেমন নিজের অজান্তেই মনে হয়েছিল শারদীয়ার। তারপর অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে শাসন করে উজানের ব্যাপারে ভাবনাগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল ও এক রকম জোর করেই।

তবে এর মধ্যে অনেকগুলো মাস কেটে গেছে। আর উজানও ধীরে ধীরে নিজের মনের আশা গুলোকে শেষ করে ফেলছে যেন। এই দিনগুলোতে শারদীয়া কখনো ওর সাথে কথা বলেনি, সামনে দেখেও এমন ভাব করেছে যেন উজান এগজিস্টই করে না আর ওর কাছে! এতটা কঠিন হয়ে গেছে মেয়েটা উজানের প্রতি যে উজান ভিতরে ভিতরে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে রোজ। বুঝতে পারছে ওর আর শারদীয়ার মাঝে অদৃশ্য, কিন্তু এতটা শক্ত কাঁচের দেয়াল আছে যে সেটা ভেদ করে মেয়েটার কাছে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। ওই ভালোবাসাটা ফিরে পাওয়া অসম্ভব। তাই প্রত্যেকটা দিন একটা অদ্ভুত কাঁচ বিঁধে থাকে মনে; আর উজান রোজ ক্ষত বিক্ষত হয়।
এর মধ্যেই একদিন একটা ঘটনা ঘটলো। প্রত্যেক সপ্তাহের মতন সেই শনিবারও উজান আর শারদীয়া গেছিল আনন্দ আশ্রমে। কিন্তু সেদিন হঠাৎ বৃদ্ধাশ্রমের অধীর জেঠুর হার্ট এ্যাটাক! প্রচণ্ড বুকের যন্ত্রণা নিয়ে লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সবার সামনে। সেই সময় ওল্ডেজ হোম থেকে অনেকবার ওনার ছেলেকে ফোনে ট্রাই করা হয়েছিল। কিন্তু কেউই ফোনটা ধরেনি একবারও। আসলে অধীর জেঠুর ছেলে ছেলের বউ কেউই দেখে না ওনাকে। নিজের পেনশনের টাকায় মানুষটা এই ওল্ডেজ হোমে থাকেন। তাই ওনার কোন ব্যাপারেই ছেলের কোন মাথা ব্যাথা নেই। যাইহোক, সেদিন উজান সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে এম্বুলেন্স কল করেছিল। তারপর আনন্দ আশ্রমের কেয়ার টেকারের সাথে উজান আর শারদীয়া দুজনে মিলে গেছিল নার্সিং হোমে। কিন্তু সমস্যাটা টাকার ছিল। প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা ভর্তির সময় নার্সিং হোমে ডিপোজিট দিতে হতো। কিন্তু সেই টাকা দেয়ার লোকই কেউ ছিল না অধীর জেঠুর হয়ে। ছেলে তো তখনও বেপাত্তা। আর এই আনন্দ আশ্রমের মালিক আউট অফ টাউন। এই সময় শারদীয়া খেয়াল করলো উজান একটুও সময় নষ্ট না করে নিজে থেকে এগিয়ে এসেছিল। ছেলেটা সমস্ত টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল নিজের একাউন্ট থেকে। শুধু তাই না, একজন খুব ভালো কলকাতার হার্ট স্পেশালিস্ট এর সাথে যোগাযোগ করে অধীর জেঠুর ট্রিটমেন্ট শুরু করিয়েছিল এখানে। এই সময় শারদীয়া কেমন স্থির চোখে দেখছিল উজানকে। ছেলেটা কি সত্যি পুরোপুরি বদলে গেল! ওই রাতের পর রাত পার্টি করা, ড্রিঙ্ক করে পরে থাকা উজানের জায়গায় এ যেন এক নতুন মানুষ! যে নিজের সব টুকু দিয়ে একজনের পাশে দাঁড়াচ্ছে। মন থেকে সাহায্য করছে। তাহলে কি উজান ভীষণ ভাবে জড়িয়ে গেছে এই আনন্দ আশ্রমের সাথে! এখানকার বয়স্ক মানুষ গুলোর সাথে! কথাটা কেমন না চাইতেই মনে হলো শারদীয়ার। তবে এরপর উজান সারা রাত ছিল নার্সিং হোমে। অধীর জেঠুর একটা স্ট্রেইন বসেছে আজ। তার জন্য ব্লাড এরেঞ্জ করা, ওষুধ কিনে আনা সব ব্যাপারে ছোটাছুটি করেছে উজান আনন্দ আশ্রমের কেয়ার টেকার জয়ের সাথে। আসলে আজ বার বার অধীর জেঠুর হাসি খুশি মুখটা মনে পরছে উজানের। কি ভালো গান গাইতো মানুষটা! আর উজান আনন্দ আশ্রমে গেলে কি খুশি হতো! এই কদিন আগে পুজোতে একটা জামা গিফ্ট করেছিল অধীর জেঠু ওকে নিজের পেনশনের টাকা থেকে। সেই মানুষটাকে এইভাবে হঠাৎ করে চলে যেতে দেবে না উজান কিছুতেই। তাই সব রকম ভাবে চেষ্টা করছে মানুষটাকে সুস্থ করে তোলার! সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়ে প্রায় সারা রাত উজান ছিল হসপিটালে। জয় যদিও কাল রাতেই চলে গেছে। আনন্দ আশ্রমে আরো অনেকেই তো আছে। তাদের দেখাশোনা করার দ্বায়িত্ব তো ওরই! কিন্তু উজান কিছুতেই যেতে পারেনি যেন আজ নার্সিং হোম থেকে। আসলে অধীর জেঠুর অবস্থা খুব ক্রিটিকাল ছিল। তাই উজানের খালি মনে হচ্ছিল যদি কোন ওষুধের দরকার হয় রাত্রে! তখন কেউ না থাকলে খুব সমস্যা হবে। এই ভেবেই ছেলেটা সারা রাত নার্সিং হোমের করিডোরে বসে ছিল।
তবে পরেরদিন সকাল সকাল শারদীয়া নার্সিং হোমে এসে কেমন থমকে গেছিল যেন উজানকে দেখে! উস্কো খুস্কো চুল, ক্লান্ত চেহারা! শারদীয়া ওকে দেখে বুঝেছিল যে ছেলেটা সারা রাত ধরে জেগে বসে আছে। তবে সেদিন আর ও দূরে থাকতে পারেনি। কথা না বলে অদেখা করতে পারেনি উজানকে। বরং আজ নিজে থেকেই উজানের কাছে এসে বলেছিল,
——–” তুমি ঠিক আছো? খেয়েছ তুমি কিছু? ”
প্রশ্নটা শুনে উজান ক্লান্ত দৃষ্টিতে কিছুটা অবাক হয়েই শারদীয়ার দিকে তাকিয়েছিল। তারপর খুব আস্তে গলায় বলেছিল,
——–” এতদিন বাদে আপনি থেকে তুমি হলো তাহলে? ”
কথাটা শুনে শারদীয়া কি বলবে ঠিক বুঝতে পারেনি। হঠাৎ যেন মনে হয়েছিল এতদিন কি একটু বেশিই কঠিন হয়ে থেকেছে ছেলেটার ওপর! যাইহোক, এইসব ভাবনার মাঝেই শারদীয়া আবার বলে উঠেছিল,
——–” কিছু খাবে চলো। এখানে ক্যান্টিন আছে একটা। ”
উজান এটা শুনে একটু সময় নিয়ে বলেছিল,
———” আমার খেতে ইচ্ছে করছে না; খিদে নেই। ঠিক আছি আমি। ”
শারদীয়া এটা শুনে কেন জানে না হঠাৎ বেশ রেগেই বলেছিল,
——-” আমি তো বলছি খেতে চলো। এইভাবে এতক্ষণ না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ হবে এরপর। চলো আমার সাথে। ”
কথাগুলো বেশ অর্ডার করার মতন করে বলেছিল শারদীয়া। আর এরপর উজানও আর না বলতে পারেনি। চুপচাপ উঠে গিয়েছিল ক্যান্টিনে। তারপর শারদীয়া ওর জন্য একটা বাটার ছাড়া টোস্ট আর অমলেট নিয়ে এসেছিল ক্যান্টিন থেকে, যেটা দেখে উজান সত্যি অবাক হয়েছিল! তার মানে শারদীয়ার এখনও মনে আছে উজান কি খায়, আর কি খায় না! কথাটা আনমনে ভেবে ফেলেছিল যেন উজান। তবে সেই মুহূর্তেও কিছু ঠিক বলতে পারেনি। আসলে এই মেয়েটার সামনে এতগুলো দিন ধরে কথাহীন হয়ে থাকার, চুপ করে থাকার একটা অভ্যাস হয়ে গেছে যেন। তাই উজান চুপচাপ খাবারটা খাচ্ছিল শুধু। তবে শারদীয়া এই মুহূর্তে খেয়াল করেছিল খুব কাছ থেকে ছেলেটাকে। কিরকম নিঃস্তব্ধ হয়ে গেছে যেন উজান! সেই আগের চঞ্চল হাসি খুশি ভাবটা যেন আর কোথাও নেই! তার বদলে অন্ধকার ফ্যাকাসে ক্লান্ত একটা মুখ। কথাগুলো আজ ভীষণ ভাবে মনে হচ্ছিল শারদীয়ার। তবে কিছুতেই যেন কোন কথা আসছিল না ওর। আসলে যেই শক্ত মোটা কাঁচের দেয়ালটা আছে ওদের মাঝে, সেটা আর কখনোই ভাঙতে পারবে না শারদীয়া। আর সেই পুরোনো অবিশ্বাস, অপমান গুলোকেও ভোলা ওর পক্ষে সম্ভব না।
সেদিন এর মাঝেই সময়টা পেরিয়ে গেছিল। এরপর যখন অধীর জেঠুর কেবিনের সামনে ওরা গেছিল, তখন ডাক্তার এসে বলেছিল মানুষটা ঠিক আছে। আর কোন বিপদ নেই। ক্রিটিকাল অবস্থাটা কেটে গেছে। কথাটা শুনে উজানের মুখে সেই মুহূর্তে একটা চওড়া হাসি। শারদীয়া খেয়াল করেছিল এতক্ষণের চিন্তাটা যেন শেষ হয়েছে ছেলেটার। তবে আজ ওর সত্যি মনে হচ্ছে, অধীর জেঠু সুস্থ হয়েছে শুধুমাত্র উজানের জন্য। ওর নিঃস্বার্থ ভালোবাসার জন্য।

চলবে।