#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_৯
জাওয়াদ জামী জামী
” নাজমা, মিনারা, তোমরা কোথায় গেলে? তাড়াতাড়ি এস, দেখে যাও আমাদের মেয়ের কীর্তি গড়েছে। ”
ইসহাক আজাদের হাঁকডাক শুনে যার যার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলেন দুই জা। ইসহাক আজাদ উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। তার দু-হাত ভর্তি মিষ্টির প্যাকেট। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিবেশি একজন। তার দু হাতেও মিষ্টির প্যাকেট।
” কি হয়েছে? কি করেছে আমাদের মেয়ে? ” নাজমা আক্তার উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন।
” অবনী আমাদের জেলার মধ্যে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে। জেলা ফার্স্ট হয়েছে আমার মেয়ে। ”
এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীরবে সব দেখছিল অবনী। বড় চাচার কথাটা শোনামাত্রই ওর দু-চোখ ঝরল প্রাপ্তির অশ্রুতে। নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে গেল একধাপ। ওর সামনে হাতছানি দিচ্ছে বিশাল পৃথিবী। যেই পৃথিবীতে ও লড়বে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য। লড়বে সম্মানের জন্য। লড়বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে।
নাজমা আক্তার দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন অবনীকে। চুমু দিলেন অবনীর পুরো মুখে৷ মিনারা খাতুনও ছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি কেঁদে উঠলেন হাউমাউ করে। তিনি ভাবতেও পারেননি অবনী এত ভালো রেজাল্ট করবে।
মেয়ের রেজাল্ট শুনে খুশিতে বাকহারা হয়ে গেলেন আব্দুল ওয়াহাব। বাজারে ছুটলেন মিষ্টি কিনতে। যদিও তার দরকার ছিলনা। কারন ইসহাক আজাদ ইতোমধ্যেই চল্লিশ কেজি মিষ্টি এনেছেন বাড়িতে।
” ইশু, বাপ, অবনীর রেজাল্ট দিয়েছে আজকে। ও পুরো জেলায় ফার্স্ট হয়েছে। বাড়ির সবাই ভিষণ খুশি হয়েছে। তোর বাবা চল্লিশ কেজি মিষ্টি এনেছে। দুই-একদিন পর পুরো গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করে খাওয়াবে। তুই বাড়িতে আসতে পারবিনা, বাপ? তোর বাবা ভিষণ খুশি হবে। ”
নাজমা আক্তার সোৎসাহে ছেলেকে জানালেন ৷ ইশরাক মায়ের গলা শুনেই বুঝতে পারছে, ওর মা কত খুশি হয়েছে। কিন্তু অবনীর রেজাল্ট শুনে ও কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়না। সেই ইচ্ছেও ওর নেই।
” আমি আগামী ছয়মাসের মধ্যে কোথাও যেতে পারবনা, মা৷ একটা প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত আছি। প্রজেক্টের জন্য হয়তো দেশের বাহিরেও যেতে হবে। ”
ছেলের কথায় মিইয়ে গেলেন নাজমা আক্তার। তার মুখের হাসিও মুছে গেল। ম্লান গলায় বললেন,
” একদিনের জন্যও আসতে পারবিনা! আমরা সবাই তোকে আশা করেছিলাম এই খুশির মুহূর্তে। একটা দিন গ্রামে এসে থাকলেই কি তোর বড় কোন ক্ষতি হবে? চেষ্টা করে দেখনা, বাপ। ”
” বুঝতে চেষ্টা কর মা, এই মুহূর্তে আমি কোথাও যেতে পারবনা। তুমি মা হয়ে যদি না বোঝ, তবে অন্যরা বুঝবে কিভাবে? ”
” ওহ্। আচ্ছা আসতে হবেনা তোকে। শুধু একবার অবনীর সাথে কথা বল। মেয়েটা খুশি হবে। জানিসতো ও বদলে গেছে। ও আগের সেই অবনী আর নেই। ”
” সরি মা, কাউকে খুশি করতে আমি কোন কাজ করতে পারবনা। আমার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। কারও খুশি করে কথা বলার সময় আমার নেই। ”
” আচ্ছা, তোকে কথা বলতে হবেনা। তুই থাক নিজের মত। পড়াশোনা কর। জীবনে অনেক বড় হ। কিন্তু এখন তোর কোন আফসোস হচ্ছেনা, তাই বলে এটা কিন্তু নয় যে ভবিষ্যতেও আফসোস হবেনা। আফসোস তুই করবি, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তুই আজকে বুঝতে পারছিসনা কোন রত্ন তুই পায়ে ঠেলে দিচ্ছিস। কিন্তু একদিন হেলায় হারানো রত্নটিকেই তুই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইবি। ভালো থাকিস, বাপ। ”
নাজমা আক্তার ফোন কেটে দিয়ে হু হু করে কাঁদলেন। ছেলের এহেন আচরণ তিনি মানতে পারছেননা। কিভাবে ছেলেকে সঠিক পথে নিয়ে আসবেন সেটা ভেবে পাচ্ছেননা।
***
মা ফোন কেটে দিলে ইশরাক বুঝল মা ওর কথায় কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু ওর করার কিছুই নেই। ও যে আগুনে জ্বলছে, সেই আগুন শুধু পোড়াতেই পারে, পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে। সেই আগুনের লেলিহান শিখা থেকে নিস্তার পাওয়া হয়তো সম্ভব নয়। আজীবন ওকে পুড়তেই হবে।
” ইশরাক, কি এত এত ভাবছিস? একবারও চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখেছিস কি অবস্থা হয়েছে তোর? ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করিসনা। দিনরাত ক্লাস, বই আর প্রজেক্ট নিয়ে পরে আছিস। এসবের বাহিরেও তো একটা জীবন আছে, তাই না? ” ইশরাকের বন্ধু ইমন এসে দাঁড়িয়েছে ওর সামনে।
” আমার কাছে ক্লাস, বই আর প্রজেক্টই সব৷ এগুলোর বাহিরের জীবন আমি চাইনা। এই জীবনই আমাকে আমার সকল যন্ত্রণার উপশম করতে পারে। হয়তো কোনদিনও আমাকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবেনা এই জীবন কিন্তু উপশমতো হবে। এটাই বা কম কিসে। ”
” ইশরাক, জীবনে চড়াই-উৎরাই আসবেই। প্রতিটি মানুষের জীবনেই আসে। কিন্তু তাই বলে এভাবে ভেঙে পরলে চলেনা। ঐ মেয়ে যদি তোকে ছেড়ে ভালো থাকতে পারে, তবে তুই কেন পারবিনা? ও যদি নিজের ভালো থাকবার পথে চোখ বুঁজে হাঁটতে পারে, তবে তুই কেন তোর পথে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছিস? একবার বিরহের সেই কণ্টকাকীর্ণ পথ এড়িয়ে হেঁটে দেখ, দেখবি জীবনটা বড্ড সরল আর সুন্দর। ”
” পারছিনা রে। আমি কিছুতেই সেসব দিনগুলোর কথা ভুলতে পারছিনা। কৈশোরের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলা কি কখনো সম্ভব? ওর জন্য কত পাগলামি করেছি যদি জানতিস। সে-ও কম পাগলামি করেনি। আমি যদি চাইতাম, সে নির্দিধায় আমার হাত ধরে বাড়ি ছাড়তে দুইবার ভাবতনা। কিন্তু সেই মানুষটাই এক নিমেষে বদলে গেল। এক নিমেষে বলছি কেন! সে ধীরে ধীরে আমার অগোচরে বদলে গেছে। আমাকে জানতেও দেয়নি তার দুরভিসন্ধি। ”
” সে যদি ভুলে যেতে পারে, তবে তুই কেন তাকে ভুলতে পারছিসনা? সে তোকে ধোঁকা দিয়েছে। আর একজন ধোঁকাবাজকে মনে রেখে কেউ ধুঁকে ধুঁকে মরে, এটা তোকে না দেখলে জানতামনা। ”
” সেই ধোঁকাবাজকে ভুলে গেছি কবেই। কিন্তু ভুলতে পারছিনা কয়েক বছরের স্মৃতিগুলো। ভোলা সম্ভবও নয়। সেই ছয় বছরের স্মৃতি আমার মন মস্তিষ্কে মিশে আছে। সেগুলোকে ভুলতে গেলে , আমার নিজেকেই ভুলে যেতে হবে। যেটা এ জীবনেও সম্ভব নয়। ”
” মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর। আচ্ছা বাদ দে। চল একটু ঘুরে আসি। চায়ের তেষ্টা পেয়েছে ভিষণ। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কষ্টগুলো এক নিমিষেই উড়িয়ে দিবি চল। ” ইমন জোড় করে ইশরাককে নিয়ে বাহিরে গেল।
***
” অবনী, এদিকে শুনে যা দিদি ভাই। ” দাদুর ডাকে তার দিকে এগিয়ে গেল অবনী।
” ডাকছ কেন, দাদু? ”
” কাছে এস, আর এটা ধর। এখন থেকে সব সময় এটা গলায় পরবে। এটা তোমার উপহার। ” দাদু একটা স্বর্নের চেইন দিলেন অবনীর হাতে।
” এইডা কি করতাছ তুমি? এই অলক্ষ্মীরে তুমি স্বর্নের মালা দিতাছ কেন? মালা কিনার টাকা কই পাইলা তুমি? হায় হায় রে, আমার সর্বনাশ কইরা ফালাইছে। আমার পোলার সংসারডা ধ্বংস কইরা ছাইড়া দিল এই বুইড়া। মরনের আগে বুইড়ারে ভীমরতিতে ধরছে। ” চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু করল কুলসুম বেগম।
” চুপ কর তুমি, বেওকুফ মহিলা। আমি আমার নাতনিকে যা ইচ্ছে তাই দিব, তাতে তোমার কি? তোমার টাকায় আমি কি ওকে কিছু দিচ্ছি? নাকি তোমার বাপের টাকায় কেনা জিনিস ওকে দিচ্ছি? আমি আমার টাকায় কেনা জিনিস ওকে দিচ্ছি। আর একটা কথা বললে থাপড়ে তোমার গাল লাল করে দেব। বুড়ো বয়সে মার না খেতে চাইলে চুপ করে থাক। ” দাদুও দ্বিগুণ তেজে বললেন।
স্বামীর ধমক শুনেও একটুও ভয় পেলোনা কুলসুম বেগম। বরং সে-ও খেঁকিয়ে উঠল।
” তুমি এই অলক্ষ্মীডারে স্বর্নের মালা দিতাছ ঠিকই। কই আমার মাইয়ার ঘরের নাতনীগোরে কুনদিনই তো কিছুই দেওনি? তাগোরও তো ইচ্ছা হয় নানার কাছ থাইকা জিনিস পাইতে। ”
” তাদের পেছনেই আমার পেনশনের সমস্ত টাকা খরচ করেছি এতদিন। প্রতিমাসে তাদের চাহিদা পূরণ করতে যেয়ে আমি আমার দুই নাতনিকে ঠকিয়েছি, আমার ছোট ছেলেটাকে বঞ্চিত করেছি। এতকিছুর পরও তোমার মন ভরেনা? আর কি চাও তুমি? ”
” খোঁটা দিতাছ তুমি? নিজের মাইয়াগোরে জিনিসপত্র দিয়া খোঁটা দিতাছ? ধন্যি মানুষ তুমি? বুইড়া তুমি মরবার পারোনা? ”
” চিন্তা করনা, সময় হলেই মরব। তবে আমি মরলে তোমার কি হবে সেটা একবারও চিন্তা করে দেখেছ? ছেলে আর ছেলের বউ তোমাকে কি নজরে দেখে তা আমার থেকে ভালো কেউই জানেনা। অবশ্য সেটার কারনও তুমি। আমি বেঁচে আছি জন্যই এই বাড়িতে এখনো তোমার দাম আছে। আমি মরলে মেয়েদের কাছেও তোমার এক পয়সাও মূল্য থাকবেনা। ” ধরা গলায় বললেন আব্দুর রহিম।
এতক্ষণ অবনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু’জনের ঝগড়া শুনছিল। দাদীর এমন ব্যবহারে ও বিরক্তই হল।
” দাদু, আমার কিছুই লাগবেনা। তুমি বরং তোমার মেয়ের ঘরের নাতনীদের মধ্যে কাউকে এটা দিও। আমাকে তুমি দোয়া করো। তোমার দোয়াই হবে আমার জন্য সবচেয়ে দামী উপহার। ”
” এটা তোমাকে নিতেই হবে, দিদি ভাই। তুমি এটা না নিলে আমি ভাবব তুমি আমাকে আজও ক্ষমা করতে পারোনি। একজন অভদ্র, অশিক্ষিত মহিলার জন্য তোমাদের সাথে আমার দূরত্ব বেড়ো গেছে। আমার ছেলেটা তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আগে যা ভুল করবার করেছি। এখন থেকে কারও কথা শুনে তোমাদের ঠকাবনা আমি। ” দাদু জোর করে অবনীর গলায় চেইনটা পরিয়ে দিলেন।
কুলসুম বেগম কিছু করতে না পেরে রাগে গজগজ করতে থাকল।
***
তিনদিন পর সত্যিই বাড়িতে বিরাট আয়োজন করলেন ইসহাক আজাদ। তিনি গ্রামসুদ্ধ মানুষকে দাওয়াত করে খাওয়ালেন। তার বোনদেরও দাওয়াত করেছিলেন। কিন্তু তারা কেউই আসেনি। অবশ্য এতে আফসোস করেননি তিনি। গ্রামের মানুষও অবনীর রেজাল্ট শুনে ভিষণ খুশি হয়েছে। তারা মন থেকে দোয়া করল অবনীকে।
অবনী জেলা শহরেরই একটা কলেজে ভর্তি হলো। নিয়মিত ক্লাস করছে। দুইমাস ক্লাস করার পরেই একটা কোচিং-এ ক্লাস নেয়ার সুযোগ পেল। অবনীর রেজাল্ট শুনে তারা ওকে কোচিং-এ নেয়ার কথা ভেবেছে। প্রতিমাসে ছয় হাজার টাকা বেতন দেবে। অবনী বাড়িতে এসে বাবা-মা’ র সাথে আলোচনা করে রাজি হয়ে যায়। অবশ্য নাজমা আক্তারকেও জানায়। নাজমা আক্তার কোনও আপত্তি করেননি। এরইমধ্যে বাড়িতেও কয়েকজন স্টুডেন্ট পেয়ে যায় অবনী। বাড়িতে আটজন ছেলেমেয়েকে পড়ানো শুরু করল। সব মিলিয়ে মাস শেষে বেশকিছু টাকা আসবে ওর হাতে। এতেই নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ছাড়াও অর্নির পড়াশোনার খরচও চালাতে পারবে।
প্রতিদিন সকাল সাতটা নয়টা পর্যন্ত কোচিং-এ ক্লাস নিয়ে, ও যায় কলেজে। সেখানে ক্লাস করে আবারও যায় কোচিং-এ। ক্লাস নিয়ে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায়। বাড়িতে এসেই আবারও ছাত্রছাত্রী পড়ানো শুরু করে। পড়ানো শেষ করে চলে যায় বড়মার কাছে। বড়মাকে রান্না করতে দেয়না। নিজেই রান্না করে। প্রতিদিন ঘুমাতে ঘুমাতে রাত দুইটা বেজে যায়। আবার ঘুম থেকে উঠে সেই ফজরের আজানের সময়। আজকাল অবনী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। ফজরের নামাজের পরই চলে যায় বড়মার কাছে। সেখানে রান্নাবান্না করে, এরপর বাড়িতে এসে নাস্তা না করেই রওনা দেয় কোচিং-এ। মিনারা খাতুন প্রতিদিনই মেয়েকে খাবার সাজিয়ে দেন। এভাবেই চলছে অবনীর জীবন। হাজার কষ্ট হলেও সেটাকে পাত্তা না দিয়ে লড়াই করছে অবিরত। লক্ষ্য একটাই, জীবনে বড় কিছু হওয়া।
চলবে…