হলুদ বসন্ত পর্ব-১০

0
62

#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_১০
জাওয়াদ জামী জামী

” অবনী, আজ রাতে রাফিজ কাকার বাগানে যাবি নাকি? কলেজ থেকে আসবার সময় দেখলাম অনেকগুলো গাছে পাকা পেঁপে ঝুলছে৷ ” সাদাফ আগ্রহভরে তাকিয়ে আছে অবনীর দিকে।

অবনী রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল। ওকে রান্নাঘরে দেখে সাদাফ এসে প্রস্তাবটা দিল।

সাদাফের কথা শুনে ওর দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অবনী। ওর ভেতর কোন আগ্রহই দেখলনা সাদাফ। অবনীর এমন উদাসীনভাব সাদাফকে অবাক করে। হুট করেই যেন অবনী পরিনত নারী হয়ে উঠেছে। ওর আচার-আচরণ বদলে গেছে। সাদাফ বুঝতে পারে ভাইয়া আর অবনীর মধ্যে কিছু একটা ঠিক নেই। কিন্তু সমস্যাটা ঠিক কোথায় আজ-অব্দি সেটাই ধরতে পারেনি সাদাফ।

” তুমিই যেও, ভাইয়া। সকালে আমাকে কোচিং-এ যেতে হবে। ”

” আমরা যাব রাতে। সকালে তোর কোচিং-এ যেতে কোন সমস্যা হবেনা। ”

“এসব আর ভালো লাগেনা, ভাইয়া। রাতে অন্য কোথাও গেলে পড়ার ক্ষতি হবে। ”

” যখন তোকে বলেছি ‘ ভাইয়া ‘ ডাকতে, তখন তুই ডাকিসনি। কিন্তু এখন ‘ ভাইয়া ‘ ডাকার মোটেও দরকার নেই। এখন আমি তোর দেবর। এখন আমার নাম ধরে ডাকলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু তুই আমাকে ‘ ভাইয়া ‘ ডাকছিস! ”

” কিন্তু তুমি তো আমার ‘ ভাইয়া ‘ ই হও। আগে ভুল করেছি বলে, সব সময়ই একই ভুল করব এমনটাতো নয়। যাও ঘরে যাও। আমি তোমার চা নিয়ে আসছি। ”

” তোকে দেখলে মনেই হয়না ছয়মাস আগেও আমরা রাত-বিরেতে এর ওর বাগান থেকে কতকিছুই চুরি করেছি। তুই এখন অন্য মানুষে পরিণত হয়েছিস। আমরা হারিয়ে ফেলেছি, দুরন্ত অবনীকে। আফসোস হয়। ” মুখ কালো করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল সাদাফ।

গমনরত সাদাফের দিকে তাকিয়ে বিষাদের হাসি হাসল অবনী। সত্যিই ও আর আগের সেই অবনী নেই। ও পুরোদস্তুর বদলে গেছে। পরিস্থিতি ওকে বদলে দিয়েছে।

***

” বড় বউমা, ইশু দাদু কতদিন হল বাড়িতে আসেনা, তাকে একটিবার বাড়িতে আসতে বলনা। কতদিন দাদুভাইকে দেখিনা। ” বৃদ্ধ আব্দুর রহিম পুত্রবধূর হাত ধরে অনুনয় করলেন।

” ইশু পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আব্বা। বছরে দু’বার দেশের বাহিরে যেতে হচ্ছে ওকে। সেজন্য আসবার সময় পাচ্ছেনা। ” নাজমা আক্তার মুখে কথাগুলো বললেন ঠিকই কিন্তু তার মনও নিজের কথায় সায় দিচ্ছেনা। তিনিতো জানেন ভেতরের ঘটনা। এসব কথা কাউকে তিনি বলতে পারছেননা। আবার ভেতরে চেপে রাখতেও কষ্ট হচ্ছে।

” পড়াশোনা তো আমরাও করেছি, বউমা। আমাদের সময় এমন ছিলনা কিন্তু। অবনীর মুখের দিকে তাকাতে পারিনা। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য কত পরিশ্রম করছে মেয়েটা। এইসময় দাদুভাইয়ের উচিত ছিল ওর পাশে দাঁড়ানো। ”

” আমি ইশুকে বারবার আসতে বলছি। কিন্তু ওর সময় হচ্ছেনা। ”

” গ্রামের লোকজনও নানান কথা বলছে, বউমা। তারা আড়ালে আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করছে। অবনীর দিকেও আঙুল তুলছে। এসব বন্ধ করতে হবে। ”

” আমি ইশুকে আসতে বলব। ওকে আসতেই হবে। ” নাজমা আক্তারের চোখের কোনে পানি জমেছে। ছেলের ওপর মাঝেমধ্যেই তার রাগ হয়। ওর এমন আচরণ তিনি মানতে পারছেননা কিছুতেই।

সেদিন নাজমা আক্তার ছেলেকে কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দিলেন। জীবনে প্রথমবার তিনি ইশরাকের সাথে দুর্ব্যবহার করলেন। মায়ের কটুকথা শুনে ইশরাকও অবাক হয়ে গেল। সে বুঝল মা ওর ওপর ভিষণ রাগ করেছে। তাই দেরি না করে বাড়ির দিকে রওনা দিল।

মাঝরাতে বাড়িতে এসে পৌঁছাল ইশরাক। গেটে এসে সাদাফের কাছে ফোন দিল। অবনী তখনও পড়ার টেবিলে ছিল। ওর ঘর গেটের পাশে হওয়ায় ঘর থেকে ইশরাকের গলা শুনতে পেল। ভ্রুঁ কুঁচকে গেল ওর। একটু পরেই শুনতে পেল বড়মার গলা। বড়মা, বড় চাচা, সাদাফ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। ওদের শব্দ পেতেই ঘরের আলো নিভিয়ে দিল অবনী। দরজা-জানালা বন্ধ করে দিল৷

একটু পর নাজমা আক্তার অবনীর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। মৃদু গলায় ডাকলেন অবনীকে। কিন্তু অবনী সাড়া দিলনা। ঘুমের ভান ধরে পরে রইল। ওর বাটন ফোনটাও বন্ধ করে রাখল।

***

পরদিন সকালে অবনী যথারীতি বড় চাচার বাড়িতে গেল। ও বুঝতেই দিলনা রাতে বড়মার ডাক শুনেছে। বড়মার হাতেহাতে কাজ করে, রওনা দিল কোচিং-এ। নাজমা আক্তার ওকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসতে বললেন, অবনী তার কথার কোন জবাব দিলনা। ও বিকেলে বাড়িতে এসে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে শুরু করল। তবে অন্যদিনের মত বারান্দায় নয়। আজ নিজের ঘরে পড়াচ্ছে ও।

” অবনী, আর কতক্ষণ পড়াবি? তাড়াতাড়ি বাড়িতে চল। ” ফিসফিসিয়ে বললেন নাজমা আক্তার।

” কেন, বড়মা? ”

” পিঠা বানাচ্ছি। তুই ইশুর পছন্দের পিঠা বানাবি। নিজে বসে থেকে খাবার খাওয়াবি। ”

” আমার হাতে এসব আজাইরা কাজের সময় নেই। তোমার ছেলেকে তুমিই যতখুশি ইচ্ছে খাবার খাওয়াও। ”

অবনীর কথা শুনে ওর দিকে কপাল কুঁচকে তাকালেন নাজমা আক্তার। অবনীর কঠোর মুখ দেখে থমকালেন তিনি। ঐ মুখে কোন ছলচাতুরী দেখতে পেলেননা। দেখলেননা কোন অনুভূতি। সেখানে শুধুই দৃঢ় প্রত্যয় আর প্রতিজ্ঞা দেখলেন তিনি।

দুইদিন গ্রামে কাটালেও একবারের জন্যও অবনীকে দেখতে পেলনা ইশরাক। অবশ্য অবনীকে যে ওর ইচ্ছে করছে তেমনটাও নয়। কিন্তু মাঝেমধ্যেই অবনীর কথা মনে হচ্ছে ইশরাকের। ও দাদুর মুখে শুনেছে অবনী সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুল, কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে। নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালায়। এরইমধ্যে আবার বাড়ির সব কাজও সে-ই করে। সব শুনে ইশরাকের একটু খারাপই লাগল।

” ইশু, গ্রামে কয়দিন থাকবি? ” ইশরাকের ভাবনার মাঝেই মিনারা খাতুন এসে জিজ্ঞেস করলেন।

” কালকেই চলে যাব, চাচী। ”

” আজ রাতে তোর চাচার সাথে খাবি কিন্তু। গ্রামে আসার পর থেকেই তোর দেখা পাওয়া যাচ্ছেনা। আমাদের বাড়িতে খেতে বললেও খাচ্ছিসনা। তোর চাচা ভিষণ রাগ করেছে। ”

” এত ঝামেলা করার দরকার কি, চাচী? তুমি তো তরকারি পাঠিয়েছ। ”

” তরকারি পাঠানো আর চাচার পাশে বসে খাওয়া এক কথা নয়। ”

” বুঝেছি। কিন্তু বেশি কিছু করতে যেওনা। অযথা খরচ করার কোন মানেই হয়না। ”

” সেই চিন্তা তোর করতে হবেনা। ”

মিনারা খাতুন ইশরাকের বাড়ির সকলকেই দাওয়াত করলেন। বিকেলে ইশরাক বন্ধুদের সাথে বেড়িয়ে গেল। রাত দশটার দিকেও যখন বাড়িতে আসলনা, তখন বাধ্য হয়েই সবাই ওকে রেখেই খেয়ে নিল। ওয়াহেদ আহমেদ শুধু না খেয়ে ভাতিজার প্রতিক্ষায় রইলেন। এগারোটার দিকে বাড়িতে আসল ইশরাক।

” অর্না, আছিস? নাকি মরে গেলি? ” অবনীদের বারান্দায় এসে অর্নিকে ডাক দিল ইশরাক।

” বেঁচে আছি। তুমি ভেতরে এস। ”

ইশরাক কয়েকটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল অর্নির হাতে। অর্নি অবাক হয়ে জানতে চাইল,

” কি আছে এতে? ”

” শুনলাম তুই নাকি সারাক্ষণ খাই খাই করিস। তাই তোর জন্য খাবার এনেছি। ”

” বুঝেছি। চাপা না মেরে বল, শ্বশুর বাড়িতে আসবার সময় জামাইরা যেমন ফলমূল, মিষ্টি নিয়ে আসে, তুমিও এনেছ। কি এনেছ, ভাইয়া? ” অর্নি হাসিমুখে জানতে চাইল।

অর্নির কথা শুনে চকিতে ওর দিকে তাকায় ইশরাক ৷ সত্যিইতো ও এই বাড়ির জামাই। অথচ এই কথা দিব্যি ভুলে বসেছিল! ও অর্নির জন্যই খাবারগুলো এনেছে। ছোটবেলায় অর্নি ওর কাছে এটা-সেটা খাবার জন্য বায়না ধরত। সেই কথা মনে করেই ও এগুলো এনেছে।

” সন্দেশ, আপেল, পেয়ারা আর দই আছে। চলবে? ”

” খুউব। ভেতরে এস। বাবা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে সেই সন্ধ্যা থেকে। সবাই খেয়েছে। শুধু তুমি বাবা আর মা বাকি আছ। ”

” চল। আমারও ক্ষুধা লেগেছে। কি রান্না করেছে চাচী? ”

” মাছ , মাংস, ডিম, সবজি সবই আছে। সবগুলোই তোমার পছন্দের। ”

” এতকিছু করতে গেছে কেন? ”

” বিয়ের পর প্রথমবার জামাই শ্বশুর বাড়িতে আসছে, আর এতটুকু আয়োজন করবেনা শ্বাশুড়ি! বাঙালী শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বলে কথা। ”

অর্নির কথা শুনে আবারও চমকাল ইশরাক। এর আগে এই বাড়িতে এসেছে ভাইয়ের ছেলে হয়ে। আজ সে এ বাড়ির জামাই! কথাটা বারবার ভুলে যায় ইশরাক

” ইশু, এত দেরি করলি কেন? কোথায় ছিলি এতক্ষণ? বড় ভাই, আব্বা তোর অপেক্ষায় কতক্ষণ বসে ছিলেন জানিস? আব্বার ইচ্ছে ছিল, দুই ছেলে, নাতীদের সাথে নিয়ে খাবেন। ”

” বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম, চাচী। অনেকদিন পর সবার সাথে দেখা হল, সময় কোনদিন দিক দিয়ে চলে গেছে বুঝতেই পারিনি। ”

” আয় এখানে বস। তোর চাচা আসুক। ”

” চাচা কোথায়? ”

” আব্বার কাছে গেছে। ”

ওয়াহেদ আহমেদ আসলে মিনারা খাতুন দু’জনকে খাবার দিলেন।

” এতকিছু কেন করতে গেছ? এত ঝামেলার কি দরকার ছিল? এগুলো রান্না করতে তোমার কষ্ট হয়নি? ”

” সবকিছুই আপু রান্না করেছে। মা শুধু বলে দিয়েছে কি রান্না হবে। ”

অর্নির কথা শুনে ইশরাক আঁড়চোখে চারপাশে দেখল। কিন্তু অবনীর ছায়াও দেখতে পেলনা। অনেকদিন পর তৃপ্তি করে খাবার খেল। মা, চাচী সব সময়ই ভালো রাঁধে কিন্তু অবনীর রান্নার হাত যে এত ভালো সেটা জানতনা ইশরাক।

” তোর পড়াশোনা কেমন হচ্ছে? মন দিয়ে পড়ছিস তো? নাকি ফাঁকিবাজি করেই দিন যাচ্ছে? ” খাবার পর অর্নির ঘরে এসে বসেছে ইশরাক। অর্নিই ওকে কয়েকটা অংক দেখানোর জন্য ডেকেছে।

” আমি ফাঁকিবাজ মোটেও নই। জেনে রাখ, আমি ক্লাসের সবচেয়ে মনযোগী ছাত্রী। ”

” কোন অংক সমস্যা হচ্ছে, দেখা? ”

অর্নি অংক বই বের করে ইশরাকের কাছে দেয়। কোন কোন অংক সমস্যা হচ্ছে সেটা দেখিয়ে দেয়। ইশরাক ধীরেসুস্থে অর্নিকে অংকগুলো বুঝিয়ে দেয়।

” উফ্ বাঁচলাম। অংকগুলো খুব জ্বালাচ্ছিল। ”

” সাদাফকে বলতে পারতিস তো? ও কি করে? তোকে অংক করায়না? ”

” ভাইয়ার সামনে পরীক্ষা। আগের মত সময় পায়না। মাঝেমধ্যে অংক করায়। আপুও প্রতিদিন দুই একটা করে অংক করায়। কিন্তু গত কয়েকদিন আপুও সময় পায়নি। ”

অবনীর কথা শুনে নড়েচড়ে বসল ইশরাক। ও মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল,

” অবনী কোথায় রে? ”

” ঘরেই আছে। মাথা ব্যথা করছিল জন্য শুয়ে গেছে। ”

চাচার বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় অবনীর ঘরের দিকে তাকায় ইশরাক। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজার ফাঁকা দিয়ে আলোর সরো রেখা এসে পড়েছে বারান্দায়। ইশরাক বুঝল অবনী জেগেই আছে। জোরে শ্বাস ছেড়ে উঠানে গিয়ে দাঁড়ায়। সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। উঠানের এক কোনে আমড়া গাছের নিচে গিয়ে সিগারেট ধরালো। চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখল দুই বাড়ি থেকে কেউ ওকে দেখছে কিনা। কাউকে না দেখে পরপর কয়েকটা টান দিল সিগারেটে। হঠাৎই ওর চোখ গেল অবনীর ঘরের জানালায়। জানালা খোলা থাকায় ঘর থেকে আলো এসে পরেছে উঠানে। সেই আলোতেই জানালায় কারও ছায়া দেখতে পেল ইশরাক৷ মেয়েটা হাঁটছে। ইশরাকের কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। ওর সামনে না আসতেই অবনী মাথা ব্যথার অযুহাত দিয়েছে। রাগে ইশরাকের শরীর কাঁপতে লাগল। গায়ের জোরে সিগারেট ফেলে দিল মাটিতে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সিগারেটের টুকরা পিষতে থাকে।

চলবে…