#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_১২
জাওয়াদ জামী জামী
” এত অভাব-অনটনের মধ্যেও তুই এত ভালো রেজাল্ট করেছিস মা, অথচ তিনবেলা তোদের পেটপুরে খেতে দিতে পারিনি। তোদের কোন শখ পূরণ করতে পারিনি। একটা ভালো জামা কিনে দিতে পারিনি। আমরা তোদের কোন শখ মেটাতে পারিনি, কিন্তু তুই আমাদের স্বপ্ন ঠিকই পূরণ করেছিস। একজন বাবা-মা কাছে এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে? ” অবনীর হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পরলেন ওয়াহাব আহমেদ। তার পাশে বসে কাঁদছেন মিনারা খাতুনও।
” এভাবে বলছ কেন, বাবা? কে বলেছে তুমি আমাদের শখ পূরণ করোনি? তোমার সামর্থ অনুযায়ী আমাদের জন্য যা যা করবার তাই করেছ তুমি। এতে আমাদের কোনও অভিযোগ নেই আর ছিলওনা। তুমি আমাদের জন্য কত কষ্ট করেছ, সেটা আমরা নিজ চোখে দেখেছি। তোমার কষ্ট অনুভব করেছি আমরা। ”
” শোন মা, তুই ঢাকা যা, এডমিশনের প্রস্তুতি নে। তোকে ডক্টর হতেই হবে। আমার স্বপ্ন ছিল মেডিকেলে পড়ার। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থার জন্য হয়ে ওঠেনি। তাই আমি চাই আমার একটা মেয়ে অন্তত মেডিকেলে পড়ুক। আমি কিছু মানুষকে দেখিয়ে দিতে চাই আমার মেয়েরাও পারে। শত অনটনের মাঝেও আমার মেয়েরা নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেছে। ”
বাবার কথা শুনে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকল অবনী। আজ পর্যন্ত বাবা ওর কাছে এভাবে কিছুই চায়নি। আজকে প্রথমবার বাবা যখন নিজের স্বপ্নের কথা বলেছে, তখন সে না করে কিভাবে? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাবার দিকে তাকায় অবনী।
” ঠিক আছে, বাবা। আমি মেডিকেলের জন্য প্রস্তুতি নেব। তবে কোথাও এডমিশনের জন্য যাবোনা। আমি বিগত বছরগুলোর প্রশ্ন সংগ্রহ করব। মেডিকেল প্রশ্ন ব্যাংক সংগ্রহ করব। ”
” এডমিশনের জন্য কোচিং করতে সমস্যা কি? তুই কোন কোচিং-এ ভর্তি হয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা কর। টাকার চিন্তা করিসনা তুই। প্রয়োজনে রক্ত বিক্রি করে হলেও টাকা জোগাড় করব আমি। ”
” আমার কয়েকজন বান্ধবী মেডিকেল কোচিং-এ ভর্তি হবে। আমি ওদের কাছ থেকে সব ধরনের সাহায্য পাব। বাকিটা আমি নিজে পরিশ্রম করে করব। এখন কোথাও কোচিং-এ গেলে আমার টিউশনিগুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে। প্রতিমাসে পনের হাজার টাকা আসে, এই টাকাগুলোও পাবোনা। মেডিকেলে চান্স পেলে অনেক খরচ হবে। আগে থেকেই টাকার ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। তুমি জীবনে অনেক কষ্ট করেছ, আমি চাইনা আমার ভর্তির টাকা জোগাড় করতে গিয়ে, আরও কষ্ট তুমি কর। তোমরা শুধু আমার জন্য দোয়া কর, দেখবে আমরা দুই বোন সহজেই কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছি। ”
মেয়ের জিদের কাছে হার মানলেন ওয়াহাব আহমেদ। মেয়ের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দিলেন তিনি।
শুরু হলো অবনীর লড়াই। মেডিকেল প্রশ্ন ব্যাংক সংগ্রহ করেছে। দিন-রাত এক করে পড়াশোনা করছে। নাজমা আক্তার ওকে কুটোটিও নাড়তে দিচ্ছেননা। মিনারা খাতুন মেয়ের পড়াশোনায় সর্বাত্নক সাহায্য করছেন। অবনী সকালে কোচিং-এ গিয়ে চার ঘন্টা পর বাড়িতে আসে। বিকেলে দুই ব্যাচ ছাত্র পড়ায়। বাকিটা সময় পড়াশোনার পেছনে ব্যায় করছে। ওর মনে জিদ চেপে গেছে যে করেই হোক মেডিকেল চান্স পেতেই হবে। ওর চারজন বান্ধবী মেডিকেল কোচিং-এ ভর্তি হয়েছে। তারাও যথেষ্ট সাহায্য করছে অবনীকে।
***
” অবনী, বাড়িতে আছ, বুবু? ” আব্দুর রহিম ঢুকলেন অবনীর ঘরে।
” এসো, দাদু। কি মনে করে গরীব ছেলের বাড়িতে আসলে? তোমার বউ এখানে আসতে দিল! ”
” ছেলের বাড়িতে বাবা আসবে, এখানে বউ বাঁধা দেয়ার কে? আমি হাজারবার আমার ছেলের বাড়িতে আসব। এবার দেখি তোমার হাতটা। কথা না বাড়িয়ে এদিকে এসে দাঁড়াও। ” কথার মাঝেই বৃদ্ধ পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা ছোট বক্স বের করলেন।
অবনী চোখ সরু করে দাদুর কাজ দেখছে। যখন দেখল বক্সটা গহনার, তখন সে বেশ অবাকই হলো।
” সর্বনাশ! করেছোটা কি! আবারও স্বর্নের কিছু এনেছ নাকি? তোমার বউ জানলে এবার তোমাকে গলা টিপে মারবে। দুই বছর আগের ঘটনা মনে আছে তোমার? আমাকে স্বর্নের চেইন দেয়ার অপরাধে তোমাকে কাঠগড়ায় তুলেছিল বুড়ি, ভুলে গেছ সে কথা? ”
” কে, কাকে কাঠগড়ায় তুলল এটা তোমার দেখবার বিষয় নয়। তুমি চুপচাপ হাত বাড়াও। দেখি মাপটা ঠিক আছে কিনা। ” দাদু একজোড়া বালা বের করে অবনীর হাতে পরিয়ে দিলেন। বালা দুটো অবনীর হাতে খাপ খেযে যায়।
” সত্যি করে বল তো , বুড়ি দেখেনি এগুলো? তুমি আমার জন্য এই শেষ বয়সে কেন সংসারে অশান্তি করছ, দাদু? আমার জন্য তুমি বুড়ির কাছে হেনস্তা হবে, এটা আমি মানতে পারিনা। এগুলোর আমার কোনই প্রয়োজন নেই। তুমি এগুলো নিয়ে যাও। আমাকে শুধু দোয়া কর। ”
” বেশি কথা বলোনা কেমন? তোমাকে দেখলে কেউ মনে করবে তুমি বিবাহিতা? আমার দাদী, মা তারা বলতেন বিবাহিতা নারীদের কখনোই হাত আর নাক খালি রাখতে হয়না। তারা স্বামীর মঙ্গলের কথা ভেবেই নাক ফুল আর চুড়ি পরত। কিন্তু এখন আর সেসব দেখাই যায়না। কে বিবাহিত আর কে অবিবাহিত সেটা বোঝা দায়। তোমাকে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে দেখে পাশের গ্রাম থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে কয়েকবার। অথচ তোমার হাতে একজোড়া চুড়ি থাকলে কিংবা নাকে নাকফুল থাকলে এমনটা ঘটতে পারত বলে তোমার মনে হয়? আজ থেকে এগুলো হাতেই রাখবে। খোলার কথা চিন্তাও করবেনা। ”
দাদুর ধমক খেয়ে চুপসে গেল অবনী। দাদুর কাজকর্ম ওর বোধগম্য হচ্ছেনা।
” নিজেকে বিবাহিতা বলে পরিচয় দিলে কি কি সুবিধা পাব, দাদু? আমি বিবাহিতা জানলে লোকজন কি আমাকে আগের থেকে বেশি সম্মান করবে? নাকি সামাজিক কোন সুবিধা পাব? অযথা তোমার নাতীর সাথে আমাকে জড়াতে চাও কেন? সে আছে তার মত, আর আমাকেও আমার মত থাকতে দাওনা। ”
” আমার নাতীর সাথে তোমাকে নতুনভাবে জড়ানোর কি হল? তুমি তিন বছর আগেই তার সাথে জড়িয়ে গেছ। তার সাথে একটা পবিত্র বাঁধনে আবদ্ধ হয়েছ তুমি। যে বাঁধন চাইলেই কেউ ছুটাতে পারবেনা। এই সাময়িক দুরত্বটুকু দেখে কি ভেবেই নিয়েছ, এটা চিরতরেই ঘটবে? তবে তুমি ভুল। দূরত্ব কিছু কিছু সম্পর্কের ভীত মজবুত করে। ধরে নাও তোমার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটছে। তোমাদের দুরত্ব দূরে যাবার নয়, কাছে আসার। ”
” তুমি কি কোনভাবে তোমার নাতীর পক্ষ নিচ্ছ? আমাকে বোঝাতে চাইছ সে-ই সঠিক ব্যক্তি? ”
” নাতীও যেমন আমার, আবার নাতনীও আমার। আমি যেমন তোমার সামনে আমার নাতীর সাফাই গাইব, ঠিক তেমনি আমার নাতীর সামনে তোমার সাফাই গাইব। তোমরা দু’জন আমার বুকের দুই পাঁজর। তোমাদের এই দূরত্ব, মান-অভিমান আমাকে পোড়ায়। একজন নারীর জীবনে যেমন তার পিতার পরে স্বামীর গুরুত্ব বেশি, ঠিক তেমনি একজন পুরুষের জীবনে তার জন্মদাত্রী জননীর পর তার স্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ। একজন পিতা যেমন তার আদরের কন্যাকে রাজকন্যার ন্যায় আদরে লালনপালন করে, ঠিক তেমনিভাবে বিয়ের পর সেই সেই কন্যাটির সমস্ত দায়-দায়িত্ব তার স্বামীকেই পালন করতে হয়। তার নিরাপত্তা, ভরনপোষণ এমনকি চিন্তাধারার ওপরও স্বামীর সর্বাধিক অধিকার থাকে। একসময়ের বাবার আদরের কন্যাটিও বিয়ের পর সর্বাঙ্গীনভাবে তার স্বামীর হয়ে যায়। তেমনি পুরুষের ক্ষেত্রেও তাই। আদরযত্ন দিয়ে গড়ে তোলা আদরের ধনটিকে সঁপে দিতে হয় একজন স্ত্রী’র হাতে। যে স্ত্রী’র ভালোবাসার ছোঁয়ায় পুরুষটির জীবন হয়ে ওঠে সুখের বাগান। একজন দ্বায়িত্বশীলা স্ত্রী’র কারনেই একজন পুরুষ হয়ে ওঠে আদর্শ সন্তান, আদর্শ বাবা কিংবা ভাই। এবং সর্বোপরি সে হয়ে ওঠে একজন আর্দশ স্বামী। স্বামী-স্ত্রী একে-অপরের পরিপূরক। একজনের বিপদে আরেকজন ভরসাস্থল হবে, এটাই নিয়ম। এতেই ভালোবাসার গভীরতা বাড়ে। আমি তোমাকে বোঝাতে পেরেছি? তুমি যতই অস্বীকার করতে চাওনা কেন, দিনশেষে তুমিই কিন্তু ইশরাক আজাদের স্ত্রী। সে দেশে না থেকেও তোমার ওপর যতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, আমরা কেউই সেটা করতে পারবনা। তেমনি ইশরাকও যদি তোমাকে অস্বীকার করতে চায়, ওর বিবেক ওকে বাঁধা দেবে। একজন বিবেকবান পুরুষ কখনোই স্ত্রী’র জায়গায় অন্য কাউকে স্থান দিতে পারবেনা। আর আমি ইশরাককে কখনোই অবিবেচক মনে করিনা। ”
দাদুর কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনল অবনী। দাদুর কথার পিঠে বলার মত কোন কথা পেলোনা। তিন বছর আগের সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেল। ওর সমস্ত সত্তায় ‘ স্বামী ‘ নামক এক পুরুষের আবির্ভাব হল। ও না চাইলেও যে পুরুষের সাথে ‘ বিয়ে ‘ নামক বাঁধনে জড়িয়ে থাকতে হবে আজীবন। তিন বছর আগে যেমন ওর পরিচয় ছিল ওয়াহাব আহমেদের মেয়ে। ঠিক তেমনি গত তিন বছর যাবৎ ওর পরিচয় ইশরাক আজাদের স্ত্রী হিসেবে। গ্রামের অনেক মানুষই ওকে ইশরাকের স্ত্রী বলেই সম্মোধন করে। অধিকাংশ মানুষের কাছেই ও ইসহাক আজাদের পুত্রবধূ। এখন আর গ্রামসুদ্ধ মানুষ ওকে বলেনা, তুমি ওয়াহাব আহমেদেে মেয়ে। বরং সবাই ওকে বলে, তুমি ইশরাকের স্ত্রী। ওর কাছেই অনেকেই ইশরাকের খবর জানতে চায়। সকলের নানান প্রশ্নকে এতদিন পাশ কাটিয়ে গেছে অবনী। জানিনা কতদিন পাশ কাটিয়ে যেতে পারবে। দাদুর কথাগুলো আজ ওর মনে নতুন করে চিন্তার খোরাক এনে দিল।
***
” অর্না, কোথায় যচ্ছিস? ” অর্নিকে বাহিরে যেতে দেখেই প্রশ্ন ছুঁড়ল সাদাফ।
” পশ্চিম পাড়ার সাদেক চাচার বাড়িতে যাচ্ছি। ” অর্নি মিনমিন করে উত্তর দিল।
” আমি ঢাকা থেকে আসার পর থেকেই দেখছি, তুই সারাদিনই এই পাড়া ঐ পাড়ায় যাচ্ছিস। তোর পা দুটো কি বড় হয়ে গেছে আজকাল? কেটে দিতে হবে? ”
সাদাফের গলার স্বর শুনে ভয় পায় অর্নি। ও ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে সাদাফ ভাইয়া ওকে সব সময়ই শাসন করে। অবনী আপু হাজার দুষ্টুমি করলেও সে কিছুই বলতনা। কথাটা মনে আসতেই কষ্ট এসে হানা দিল। মুখ কালো করে বলল,
” সাদেক চাচার মেয়ে আমার সাথে পড়ে। ওর কাছ থেকে একটা খাতা আনার দরকার ছিল। সেজন্যই চাচার বাড়িতে যাচ্ছিলাম। ”
” কি খাতা? ”
” অংক। ”
” ভেতরে যা, আমি খাতা এনে দেব। আর তোর কোন কোন অংক সমস্যা আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে রাখ। এছাড়াও অন্য কোন সাবজেক্টে সমস্যা থাকলে সেগুলোও চিহ্নিত করে রাখ। আমি যে কয়দিন বাড়িতে আছি, তোকে পড়াব। সব সাবজেক্টের নোট করে দেব। এরপরও যদি শুনি, তুই সারাদিন এ পাড়া ও পাড়া করে বেড়াচ্ছিস, তখন কোন প্রশ্ন না করে স্রেফ তোর পা কাটব আমি। ”
সাদাফের গলার স্বরে কি ছিল সেটা জানা নেই অর্নির। ও বুঝতে পারল, সাদাফের কথা শুনে ভয় পেয়েছে। আর সাদাফ রাগ করে এমন কাজ ভবিষ্যতে করা যাবেনা। নয়তো দেখা যাবে, সত্যি সত্যিই সে ওর পা কেটে দিল। ভয়ে অর্নি সুড়সুড় করে ঘরের ভেতর গেল। ওকে ভেতরে যেতে দেখে সাদাফ রওনা দিল পশ্চিম পাড়ার সাদেক চাচার বাড়িতে।
চলবে..