#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_১৪
জাওয়াদ জামী জামী
” ফোনে ফেসবুক আর ম্যাসেঞ্জার ইন্সটল করে দিয়েছি। আমার দ্বিতীয় আইডি লগইন করা আছে এখানে। প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ফোন দিবিনা এমনকি ফেসবুকে কাউকে এড করবিনা। পড়াশোনা বাদ দিয়ে অনলাইনে আসবিনা। আমি প্রতিদিন রাতে ভিডিও কল দেব। আরেকটা কথা গার্লস কলেজে ভর্তি হবি। তামান্না ম্যামের কোচিং-এ যাবি, ম্যামের সাথে আমার কথা হয়েছে। সাইন্সের সব সাবজেক্ট ঐ কোচিং-এ পড়ায়। এমনকি ইংরেজিও পড়ায়। যে পড়াগুলো বুঝতে পারবিনা সেগুলো নোট করে রাখবি। আমি প্রতি রাতে ভিডিও কল দেব, তখন আমাকে জানাবি। আমি তোকে সেগুলো বুঝিয়ে দেব। আর ফোন নিয়ে কলেজে যাবি ঠিক আছে, কাউকে নম্বর দিবিনা। বন্ধুরা নম্বর চাইলে চাচারটা দিবি। রাস্তাঘাটে কোন ছেলের সাথে কথা বলবিনা। মনে থাকবে? ”
সাদাফের আদেশ-নিষেধের লিষ্ট শুনেও অবাক হলনা অর্নি। ও জানত, প্রতিবারের মত এবারেও কিছু সতর্কবার্তা ওর জন্য থাকবে। তাই আগে থেকে মানসিক প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিল। তাই সহাস্যে মাথা নাড়াল অর্নি।
” খুব মনে থাকবে। ভুলে গেলে আমার কি হবে সেটাতো আমি জানিই। ”
অর্নির কথায় ওর দিকে তাকায় সাদাফ৷ মেয়েটা ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগে বলা সাদাফের শর্তগুলো শুনে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সেটা সাদাফকে সত্যিই অভিভূত করেছে।
” গুড, মনে থাকা ভালো। এতে দু’জনেরই উপকার হবে। প্রতি সপ্তাহে তোর ফোনে জিবি পাঠিয়ে দেব। তবে মনে রাখিস, তুই ভুলেও আমাকে ফোন দিবিনা। আমি ফোন দিলে রিসিভ করবি। একবারের বেশি যেন ফোন দিতে না হয়। প্রথমবারেই রিসিভ করবি। ”
” ঠিক আছে। তুমি কবে ঢাকা যাবে? ”
” কাল সকালের গাড়িতে যাব। তোর যখন যেটা প্রয়োজন হবে আমাকে বলবি। চাচাকে প্যারা দিবিনা। আর ভুলেও পড়াশোনায় অমনোযোগী হবিনা। ”
” আচ্ছা। আবার কতদিন পর আসবে? ”
” তিনমাসের আগে নয়। ”
” ওহ্। ”
” রাত ঠিক এগারোটায় আম গাছের নিচে আসবি । আমি অপেক্ষা করব। ” অর্নিকে উঠানের উত্তর কোনের আম গাছের নিচে যাওয়ার কথা বলল সাদাফ। সাদাফের বাড়ি গাছটাকে একটু আড়া৷ করেছে, সেজন্য দিনের বেলায়ও কেউ গাছের নিচে গেলে সহজে দেখা যায়না।
” আপু জেগে থাকে তো। সে তিনটার আগে ঘুমায়না। ”
” জানি। ওকে আমি ব্যস্ত রাখব। আমি যাচ্ছি। সন্ধ্যার পর বাড়িতে আসব। কি খাবি বল? ”
” কিছুই খাবনা। ”
” ফুচকাও না? কিংবা বার্গার? ”
” কিছুইনা। ”
” ভদ্রতা নাকি কিপ্টামি কোনটা করছিস? ভদ্রতা দেখাতে চাইলে, সেটা তোর জন্য বরাদ্দ নয়। আর কিপ্টামি করলে, জিনিসটাকে আমি ঘৃণা করি। ”
” ঝালমুড়ি। ”
” আর কিছু? ”
অর্নি জবাব না দিয়ে মাথা নাড়ায়। সাদাফ বুঝল মেয়েটা ছোট থেকেই ওকে একটু ভয় পায়, খানিকটা সমীহ করে। ইশরাকের সাথে নানান বায়না করলেও ওর সাথে কখনোই সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। অবশ্য সেই সুযোগ সাদাফই ওকে দেয়নি। ক্লাস টেনে উঠার পরে সাদাফ বুঝতে পেরেছে, ও অর্নিকে চাচাতো বোনের চোখে দেখেনা। অর্নির জন্য ওর মনে অন্য অনুভূতির জন্ম নিয়েছে। সেই থেকেই ও অর্নিকে শাসন করেছে, চোখে চোখে রেখেছে। অর্নিও কোনদিন সাদাফের কথার বাহিরে যায়নি। ছোট থেকেই মেয়েটা বড্ড শান্ত আর স্বল্পভাষী। সেজন্য কখনো কোন প্রশ্নও করেনি। সাদাফ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে অর্নি একটু হেসে বড়মার কাছে গেল। প্রতিদিন এই সময় বড়মার চুলে তেল দিয়ে দেয় ও। এই দায়িত্ব বড়মা ওকে দিয়েছে।
***
” অবনী কি করছে? ”
” তোমার দেয়া নোটসগুলো পড়ছে। ” আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দু’জন ফিসফিসিয়ে কথা বলছে।
” মিছেই ভয় পাচ্ছিলি। ”
অর্নি নিরুত্তর থাকল। ওকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে সাদাফ পকেট থেকে একটা বকুল ফুলের মালা বের করে অর্নির গলায় পড়িয়ে দিল৷ হঠাৎই সাদাফের অযাচিত স্পর্শ পেয়ে চমকায় অর্নি। ইতোমধ্যেই বকুল ফুলের মিষ্টি ঘ্রান ওর নাসারন্ধ্রে পৌঁছে গেছে।
” বকুলের মালা! কোথায় পেলে? ”
” আরও আছে। ” সাদাফ একটা বেলি ফুলের মালা বের করে অর্নির খোঁপায় জড়িয়ে দিল।
সাদাফের কাজে অর্নি অবাক হয়ে গেছে। ও একবার খোঁপায় হাত ছোঁয়াচ্ছে, তো পরক্ষণেই গলায় হাত দিচ্ছে। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল, কয়েকটা বেলি আর বকুলের মালা কিনে বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখবে। কিন্তু টাকার অভাবে কেনা হয়ে উঠেনি। আজকে সাদাফ ওর গোপন ইচ্ছে পূরন করেই দিল। কিন্তু কে কিভাবে জানল অর্নির মনের গোপন কথা? জানার কৌতুহল জাগলেও অর্নি সাদাফকে দ্বিতীয়বার কোন প্রশ্ন করলনা। থাকুকনা কিছু বিষয় অজানা।
” ভেতরে যা। নয়টার দিকেই আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব। যাওয়ার আগে যেন তোকে দেখতে পাই। ”
” হুঁ। ” অর্নি পা বাড়াল। ওর হাত ছুঁয়ে থাকল বকুলের মালা। ঠোঁটে হাসি। সাদাফ নামক পুরুষের প্রতি ভালোবাসা ছলকে উঠল আরও একবার।
***
” কাঁদছ কেন, বউমা? ” নাজমা আক্তারকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন তার শ্বশুর।
” ইশরাক নাকি আরও দুই বছর দেশে আসবেনা। এতদিন ওকে না দেখে আমি কিভাবে থাকব, আব্বা? ”
” কাঁন্দো আরও বেশি কইরা কাঁন্দো। আমার কথা তোমরা কেউই মান নাই। তুমি না কাঁন্দলে, তোমার পাপ মুছব ক্যাম্নে? আগেই কইছিলাম, ঐ ফকিন্নিগো ঘরে ইশু দাদু ভাইয়ের বিয়া দিওনা। কিন্তু তুমি সেই কথা শুনার মানুষ? পোলারে তুমি জন্ম দিছ তাই তুমি যা কইবা সেইডাই হইব। কত জোর তোমার। এখন বুঝতাছ, কত বড় ভুল তুমি করছ? তোমার পোলায় দ্যাশে আসতাছেনা শুধু ঐ অপয়া ছেমরির লাইগা। ঐ অপয়ারে বাড়ির বউ না করলে আইজ আমার ইশু দাদু ভাই আম্গো কাছে থাকত। তোমার মত মা নিজের প্যাটের পোলার ভালো চায়না। তুমি মা নামের কলংক। ” নাজমা আক্তারকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বলল কুলসুম বেগম।
স্ত্রী’র এহেন আক্রমনাত্নক কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে গেলেন আব্দুর রহিম। তিনিও খেঁকিয়ে উঠলেন।
” তুমি থামবে? আমাদের মা-ছেলের মাঝে তুমি কথা বলছ কেন? তোমাকে কি আমরা মাতব্বরি করার জন্য নিমন্ত্রণ দিয়েছি? ফালতু মেয়ে মানুষ। মানুষকে আঘাত দেয়া ছাড়া কথা বলতেই জানেনা। একে বিয়ে করে জীবনের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় ভুল করেছি আমি। সব সময়ই মুখ নাড়াতেই থাকে। অশিক্ষিত মহিলা তুমি লেখাপড়ার কি বুঝবে? দাদু ভাই চার বছরের প্ল্যান করেই জার্মান গেছে। ওর স্কলারশিপ শেষ করতে চার বছর লাগবে। ওর পড়া শেষ না করে বাড়িতে এসে কি তোমার মত গণ্ড মূর্খের সাথে এক খাতায় নাম লিখাবে? এক পা কবরে গেছে তাও কটুকথা বলা ছাড়তে পারলেনা? তুমি না কয়েকজন সন্তানের মা? তবে একজন মা হয়ে আরেকজন মায়ের কষ্ট বুঝতে পারলেনা? মা নামের কলংক তুমি, বউমা নয়। একজন মা তার ছেলেকে না দেখে কষ্ট পাচ্ছে, আর তুমি আরেকজন মা হয়ে এই দুঃখিনী মাকে কথা শোনাচ্ছ? তোমার ভাগ্য ভালো বউমা এখনো তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এই বাড়ি থেকে বের করে দেয়নি। আর কাকে তুমি ফকিন্নির মেয়ে বললে? অবনীকে? আমার ছেলেকে কথায় কথায় ফকির বলার সাহস কোথায় পাও তুমি? ওর এই অবস্থার তুমি দায়ী। তোমার জন্যই আমার ছেলেটা উচ্চ শিক্ষিত হয়েও কোন চাকরি পায়নি। পরের জমি বর্গা চাষ করে কোনরকম বেঁচে আছে। তুমিই ওকে ঠকিয়েছ। আমার, ইসহাকের হাত-পা বেঁধে দিয়েছিলে তুমি। তোমার জন্যই আমার এত অর্থ-সম্পদ থাকা স্বত্বেও আমার ওয়াহাব খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছে। হাশরের ময়দানে সবকিছুর জবাব দিতে পারবে তো? দুনিয়ায় না-হয় তুমি স্বাধীন। কিন্তু মনে রেখ একজন সব দেখছেন। সব হিসাব টুকে রাখছেন। ”
কথা বলতে বলতেই শ্বাসকষ্ট শুরু হল আব্দুর রহিমের। তিনি হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছেন। শ্বশুরকে হাঁসফাঁস করতে দেখে তাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন নাজমা আক্তার। দৌড়ে এক গ্লাস পানি এনে ধরলেন শ্বশুরের মুখের সামনে। কুলসুম বেগম ভাবলেশহীন চোখে সবকিছু দেখল । একবারও এগিয়ে গেলনা স্বামীর দিকে। তাকে এতগুলো কথা শোনানোয় সে বৃদ্ধর প্রতি ভিষন বিরক্ত হয়েছে।
” কিছু কইলেই দোষ আমার। আমিই একলা খারাপ, আর বাকিগুলান ফেরেশতা। আমি আমার পোলা-মাইয়াগোর স্বার্থ দেখছি। আর যতদিন বাঁইচা রইছি তাগোর স্বার্থই দেখমু। তোমরা যা খুশি কও। তোমগোর কথা আমি এক কান দিয়া শুইনা আরেক কান দিয়া বাইর কইরা দেই। পাইছে এক বড় বউমা। আরেক ফকিন্নির বেডি এইডা। খালি চোপা নাড়াইতে পারে। কাঁইন্দা কাঁইন্দা আমার পোলারে হাত করছে, আবার এই বুইড়ারেও হাত করছে চোখের পানি দেখাইয়াই। ছিঁচকান্দইন্না বেডি। ”
” আপনি থামবেন, আম্মা? দেখছেননা আব্বা অসুস্থ হয়ে গেছে? আপনি না তার স্ত্রী? একজন স্ত্রী তার স্বামীকে অসুস্থ হতে দেখেও এভাবে পাগলের প্রলাপ বকতে পারে, সেটা আপনাকে না দেখলে জানতামনা। ঘ্যানঘ্যান না করে, যান এখান থেকে। অবনী, অর্না, তোরা কোথায় গেলি? মিনারা, তাড়াতাড়ি এদিকে আয়। আব্বা অসুস্থ হয়ে গেছে। ”
নাজমা আক্তারের ডাক শুনতে পেয়ে মিনারা খাতুন দৌড়ে আসলেন। অবনী অর্নিকে নিয়ে বাড়ির পেছনে শাক তুলতে গেছে। তাই ওরা বড়মার ডাক শুনতে পেলনা।
চলবে…