হলুদ বসন্ত পর্ব-১৬

0
62

#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_১৬
জাওয়াদ জামী জামী

ইষ্ট সাইড গ্যালারি, বার্লিন

কয়েকজন যুবক-যুবতী ইষ্ট সাইড গ্যালারির প্রতিটা কোন দেখে অভিভূত হল। বিশেষ করে গ্রাফিতিগুলো তাদের মুগ্ধ করেছে। স্লোভাক তরুনী লুসিয়া মালিনোভা নিজের উচ্ছাস চেপে রাখতে পারলনা। সে উচ্ছ্বসিত গলায় বারবার গ্রাফিতির প্রসংশা করছে।

” গাইজ, আই’ভ নেভার সিন সাচ বিউটিফুল গ্রাফিতি ইন মাই লাইফ! দিস উইল ইন্সট্যান্টলি লিফ্ট এনিওয়ান্স মুড! দিস ইজ ট্রলি বিউটিফুল। ”

” কাম ডাউন। ডন্ট লেট অল ইয়োর এক্সাইটমেন্ট ফেইড জাস্ট ইয়েট। দেয়ার আর স্টিল মোর সাইটস টু সি ইন বার্লিন। ” লুসিয়ার উচ্ছ্বাস দেখে বলল জার্মান তরুণী সোফি ক্রুগার।

” রিয়েলি? ”

” ইয়াহ্। ”

” হেই ইয়াংম্যান, হোয়াই আর ইউ সে কোয়াইট? সেই সামথিং? হাউ ডিড ইউ লাইক দ্য ইস্ট সাইড গ্যালারি? ” উলরিখ ফিসার নামক জার্মান তরুণ জিজ্ঞেস করল তার পাশে হেঁটে চলা আনমনা যুকটিকে৷

বন্ধুর প্রশ্নে মুখে হাসি ফুটল ইশরাক আজাদের। সপ্রসন্ন দৃষ্টিতে আরেকবার তাকাল গ্রাফিতির দিকে৷

” ট্রুলি অ্যামেইজিং! দেয়ার আর স্টিল সো ম্যানি ফেমাস থিংস লেফ্ট টু সি ইন লাইফ। ”

” ইউ আর জাস্ট এজ ক্যাপটিভিটিএজ দ্য গ্রাফিতি। এ্যান্ড ইউ অলওয়েজ খিপ ইয়োরসেল্ফ ওয়ার্পড ইন আ শেইল। হুইচ মেইখস ইউ ইভেন মোর ইনট্রিগুইং। ” লুসিয়া এসে দাঁড়িয়েছে ইশরাকের পাশে। নিজের ডানহাতে জড়িয়ে ধরেছে ইশরাকের বাহু।

হঠাৎই লুসিয়ার অযাচিত স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠল ইশরাক। একটা আলতো ঝাঁকি দিয়ে লুসিয়ার বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। ইশরাকের এমন কাজে লুসিয়ার চোখে বিষাদের ছায়া পরল।

” দ্যাটস জাস্ট হাউ আই অ্যাম। ওপেনিং আপ ইজ বিওন্ড মাই প্রেফারেন্স। আই ওয়ান্ট দ্য পিইপল এ্যারাউন্ড মি ঠু বি দ্য সেইম। ইট খিপস এভরিথিং ব্যালান্সড ইন এভরিওয়ে। ” সামনে তাকিয়েই বলল ইশরাক।

” আর অল দ্য পিইপল ইন ইওর কান্ট্রি লাইক দিস? ” লুসিয়া আহত স্বরে জিজ্ঞেস করল।

” আই ডোন্ট নো অল দ্য পিইপল ইন মাই কান্ট্রি। সো ইট’স নট পসিবল ফর মি ঠু আন্ডারস্ট্যান্ড দেয়ার মাইন্ডেসেট। বাট দোস আই নো ক্লোজলি আর জাষ্ট লাইক মি। ”

” ইজ দেয়ার সামওয়ান স্পেইশাল? ”

হাসিমুখে লুসিয়ার প্রশ্ন এড়িয়ে গেল ইশরাক। ও তাকিয়েছে উলরিখ ফিসারের দিকে।

” লেট’স সিট সামহোয়্যার। হাউ এ্যাবাউট হ্যাভিং আ কোল্ড কফি? হোয়াট আদার ফেইমাস ফুডস আর এ্যাভেইলেবল হেয়ার? ”

ইশরাকের অবহেলায় কষ্ট পায় লুসিয়া। এখানে পড়তে আসার কিছুদিন পরই ইশরাকের সাথে ওর পরিচয় হয়। প্রথম দেখাতেই ইশরাকের প্রেমে পরে যায় লুসিয়া। নানানভাবে সেকথা ও ইশরাকে বলেছে। কিন্তু ইশরাক কখনোই ওর প্রতি তেমন আগ্রহ দেখায়নি। বরং হেসে এড়িয়ে গেছে ওর সকল প্রশ্ন।

স্প্রী নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে পাঁচজনের ছোট্ট দলটি। নদীর শান্ত জলধারা তৈরি করেছে এক মনোরম পরিবেশ। সবুজ প্রকৃতি মিশেছে নদীর সাথে। বড় বড় গাছপালা ডাল বিছিয়ে ছায়ায় ঢেকেছে ধরিত্রীর বুক। ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে প্রত্যেকের মন। নদীর স্বচ্ছ পানিতে ভাসছে ছোট ছোট নৌকা ও কায়াক। নানান দেশের মানুষের সমাহার সেই নৌকা ও কায়াকে। এই গোধূলি লগ্নে সূর্যের আলো নদীর পানিতে প্রতিফলিত হয়ে অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করেছে। পাখিদের কলকাকলীতে চারপাশ মুখরিত। ভাসমান কিছু ক্যাফেও চোখে পরল।

” লেইটস গো ওয়াটারগেট ক্যাফে। ইউ খ্যান খল ইট আ ফেইমাস ক্যাফে। ” উলরিখ ফিসার হাসিমুখে প্রস্তাব দিল।

” দেন হোয়াই ডিলেই? লেট’স গো। আ’ম হাংরি৷ আর’ন্ট ইউ অল? ” ডেনিস তরুণ ম্যাগনাস ফ্রেডরিকসেন হৈ হৈ করে উঠল।

” অফকোর্স, হোয়াই নট? ” হৈ হুল্লোড় করে সবাই ক্যাফেতে ঢুকল।

” হেই ইশরাক, ক্যান আই টেল ইউ সামথিং? ” ইশরাকের পাশে এসে বসল লুসিয়া।

” ইয়াহ্, অফকোর্স। ”

” এ্যাম আই নট অ্যান এ্যাট্রাকটিভ উইমেন? ওর এ্যাম আই নট সেক্সি? ”

” বিফোর কনসিডারিং আ উইমেন এ্যাট্রাকটিভ ওর সেক্সি, আই ট্রাই ঠু আন্ডারস্ট্যান্ড হার পারসোনালিটি। ই’টস পার্সোনালিটি দ্যাট মেইকস সামওয়ান রেসপেকটেইবল। পারসোনালিটি হ্যাজ দ্য পাওয়ার ঠু টার্ন এ্যান অর্ডিনারি পারসন ইনঠু এ্যান এক্সট্রাঅর্ডিনারি ওয়ান। ”

ইশরাকের কঠোর জবাব শুনে লুসিয়ার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ঠোঁট থেকে মুছে গেল হাসি। যেন তলপেটে প্রচন্ড ঘুষি খেয়েছে। তবুও হাল ছাড়লনা মেয়েটা।

” বি অনেষ্ট, ডু ইউ হ্যাভ সামওয়ান? ফর হুম ইউ হ্যাভ প্লেসড মি ইন দ্য ক্যাটাগড়ি অব দ্য ভেরি অর্ডিনারি? ”

” নট ফর এনিওয়ান, বাট ফর মাইসেল্ফ। জাস্ট আ স্মল এফোর্ট টু খিপ মাইসেল্ফ পিওর। ”

” হু ইজ দ্যাট লাকি ওয়ান ফর হুম ইউ ওয়ান্ট ঠু খিপ ইওরসেল্ফ পিওর? ”

” খল ইট মাই ডিজায়ার অর মাই ডিভোশন, সি ইজ এভরিথিং। আই খ্যান গৌ এগেইন্সট দ্য হোল ওয়ার্ল্ড ইন এ্যান ইন্সট্যান্ট ঠু উইন হার। সি ইজ মাই গার্ল । মাই ফেয়ারলেস গার্ল। সি ইজ মাই লেডি। ”

ইশরাকের এই কয়েকটি বাক্য যেন ওদের টেবিলো বিস্ফোরিত হল। ওর বন্ধুরা প্রত্যেকেই ওর দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকাল। গত দুই বছর ওরা একসাথে আছে, কিন্তু আজ প্রথমবারের মত ইশরাকের মুখে অন্য কোন মেয়ের কথা শুনছে। এটা ওদের জন্য অবাক করা কান্ডই বটে।

লুসিয়া ঠোঁট কামড়ে খবরটা হজম করার চেষ্টা করল। ওর চোখে পানি জমেছে। কিন্তু যখন ইশরাকের দিকে তাকাল, ওর চোখে ধরা পরল ইশরাকের প্রশান্ত মুখখানা। যে রমনীর কথা বলতে গিয়ে ইশরাকের মুখে হাসি ফুটেছে। ইশরাকের চোখের তারায় সেই অদেখা রমনীর জন্য ভালোবাসা দেখল লুসিয়া। সব সময় বইয়ে মুখ গুঁজে রাখা ছেলেটির কোন এক নারীর প্রতি গভীর ভালোবাসা দেখে চমকায় লুসিয়া। ওর মন অশান্ত হযে উঠল। এই গম্ভীর সুপুরুষটির ভালোবাসা না পাওয়ার আক্ষেপে মন কেঁদে উঠল।

***

” হেই আমি মাহি, সেকেন্ড ইয়ারে আছি। তোমার পরিচয় জানতে পারি? ” ক্লাস থেকে বের হতেই অবনীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একজন। নিজেকে মাহি বলে পরিচয় দিল।

” অবনী, অবনী আহমেদ। ফার্স্ট ইয়ার। ”

” বন্ধু হতে পারি আমরা? ” ছেলেটা হাত বাড়িয়ে দিল।

” ধন্যবাদ। আমি পড়াশোনা নিয়েই থাকতে চাই। বইয়ের সাথে আমার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়েছে অনেক আগে থেকেই। ”

অবনীর রসকষহীন কথাবার্তা শুনে ছেলেটি মুখ কালো করল। সে বুঝতে পারছে, এই মেয়েকে পাটতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে তার।

” ইন্টারেস্টিং! বইয়ের বাহিরেও তো বন্ধুর প্রয়োজন আছে, তাইনা? আমি সেই বন্ধুর কথাই বলছিলাম। কি হতে পারি? ”

” আপনি সিনিয়র। সেই হিসেবে আমার বড় ভাইয়া হতে পারেন, বন্ধু নয়। আপনি চাইলে আপনাকে ভাইয়া ডাকতে পারি। কি ডাকব? ”

অবনীর ত্যাড়া উত্তর শুনে ছেলেটি ভ্যাবাচ্যাকা খায়। নেহাৎ তার প্রথমদর্শনেই মেয়েটিকে ভালো লেগেছে নয়তো মেয়েটিকে জব্দ করা তার পক্ষে অসম্ভব কিছুই ছিলনা৷ লম্বা, একহারা গড়নের মেয়েটির চোখে দ্যুতি ছড়াচ্ছে সর্বদা। কোন প্রেমিকপুরুষ তার চোখের গহীনে ডুবতে বাধ্য। মাহিও ডুবেছে মেয়েটির চোখের মায়ায়।

” ঠিক আছে, ঠিক আছে। কোনকিছুই ডাকতে হবেনা। তবে যেকোন প্রয়োজনে আমাকে ডাকতে পার। দেখবে এই বান্দা তোমার ডাক শোনার সাথে সাথেই হাজির হয়ে গেছে। আমার ফোন নম্বর রেখে দাও নিজের কাছে। ”

” ধন্যবাদ। আমার মনে হয় ফোন ছাড়াও আপনাকে পেয়ে যাব। কারন গত একমাস যাবৎ আপনাকে এখানেই দেখা যায় বেশিরভাগ সময়। আমি ভেবে পাইনা একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট এতটা অমনোযোগী হয় কিভাবে? আচ্ছা আপনি এখানে বসে বসে গুনতে থাকুন মেডিকেলে কতজন ছাত্র-ছাত্রী আছে। আমি যাই। ” অবনী মাহির উত্তরের আশায় না থেকে হাঁটতে শুরু করল।

” যাব্বাবা চলে গেল? স্বীকার করতে হবে মেয়েটার ঝাঁঝ আছে। তবে আমিও যে-কোন উপায়েই হোক একেই পেতে চাই। ঝাঁঝেই শান্তি, ঝাঁঝেই স্বস্তি। ”

***

” অবনী, একবার বাড়ি আসতে পারবি, মা? মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিস এক বছরের বেশি। কিন্তু এরমধ্যে শুধু দুই ঈদে বাড়িতে এসেছিস। তোর দাদু সব সময় তোর কথা বলে, তোকে দেখতে চায়। ”

” আর কয়েকটা দিন, মা। পরীক্ষা শেষ হলেই বাড়িতে যাব। এবার বাড়িতে গিয়ে বেশ কিছুদিন থাকব। আমিও হাঁপিয়ে গেছি এই দমবন্ধকর জীবনে। ”

” তোর পরীক্ষা শেষ হবে কবে? ”

” সামনে মাসের শেষ সপ্তাহে। পরীক্ষা শেষ হলে পরদিনই বাড়িতে যাব। ”

” এক কাজ করিস, সাদাফের সাথে আসিস। সাদাফও নাকি সামনের মাসেই আসবে। ”

” ভাইয়া এত ঘন ঘন বাড়িতে যায় কেন? ওর বন্ধুরা কেউই ছয়মাসের আগে বাড়িতে যায়না। কিন্তু ভাইয়া দুইমাস পর পরই বাড়িতে যায়। কাহিনি কি, মা? ”

” হোস্টেলের খাবার খেতে পারেনা। তাই ঘনঘন বাড়িতে আসে। আর তাছাড়া নিজের বাড়িতেই তো আসছে। তুই হিংসা করছিস কেন? তুই আমাদের ছাড়া থাকতে পারিস বলে সবাই কি পারবে নাকি? ”

” মাফ চাই, মা। আর বলবনা কিছু। আচ্ছা শোন, এখন রাখছি। ছাত্রী পড়াতে যাব। রাতে হোস্টেলে ফিরে তোমাকে ফোন দেব৷ তখন বাড়ির সবার সাথে কথা বলব। ”

” সাবধানে যাস। নিজের খেয়াল রাখিস। ”

***

পেরিয়ে গেছে আরও আট মাস। অর্নি এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। অবনী সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। সাদাফ পড়ছে থার্ড ইয়ারে। ওদের পরীক্ষা চলছে। অবনী সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরীক্ষার পর অন্তত একমাস বাড়িতে থাকবে।

পনেরদিন পর পরীক্ষা শেষ হলে অবনী বেড়িয়ে পরল গ্রামের উদ্দেশ্যে। সাথে সাদাফও আছে।

নাতি-নাতনিকে একসাথে বাড়িতে দেখে ভিষণ খুশি হলেন আব্দুর রহিম।

” তোমরা এসেছ? কতদিন পর তোমাদের দেখছি। ভেবেছিলাম মৃত্যুর আগে বোধহয় আমার চার নাতি-নাতনিকে একসাথে দেখতে পাবোনা। কিন্তু আল্লাহ চাইছেন আমি সবাইকে দেখেই মরি। ”

দাদুর কথা শুনে তাকে জড়িয়ে ধরল অবনী।

” এমন কথা বলতে নেই, দাদু। তুমি জানোনা তুমি আমাদের কাছে কি। আর কখনোই আমাদের সামনে এমন কথা বলবেনা। ”

” আচ্ছা দাদু, তুমি চারজনের কথা বললে কেন? আমরা তিনজন বাড়িতে আছি। ভাইয়াতো নেই। নাকি তোমার মেয়ের ঘরের নাতি-নাতনি আসবে? ” সাদাফ জিজ্ঞেস করল।

” ইশু দাদু ভাই আসছে। ”

” বল কি? ভাইয়ার সাথে কালকেই কথা হয়েছে, সে আমাকে কিছু বললনাতো। কবে আসছে ভাইয়া? ”

” খুব তাড়াতাড়ি আসবে। আমাকে গতকালই জানিয়েছে। হয়তো তোমাকে জানাতে ভুলে গেছে। ”

দাদুর কথা শুনে অবনীর মুখের হাসি মুছে গেল। আবারও লুকোচুরি করতে হবে ভেবে তিক্ততায় ছেয়ে গেল ভেতরটা।

চলবে…