#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_১৭
জাওয়াদ জামী জামী
” ইশু, এসেছিস বাবা? কতদিন পর তোকে দেখছি। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিস একদম। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করিসনি বুঝি? ”
চার বছর পর ছেলেকে দেখে খুশিতে কেঁদে ফেললেন নাজমা আক্তার। সকালে তার ঘুম ভেঙেছে ইশরাকের ফোনে। প্রতিদিনের ন্যায় ফজরের নামাজ আদায় করে এক ঘন্টা ঘুমান তিনি। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়ে মাকে ফোন দেয় ইশরাক৷ দরজা খুলে ছেলেকে দেখে খুশিতে পাগল হওয়ার দশা নাজমা আক্তারের। তিনি ছেলেকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে আসলেন।
” আমি মোটেও শুকাইনি, মা। ওজন বেড়েছে আমার। তুমি অনেকদিন পর আমাকে দেখছ, তাই মনে হচ্ছে আমি শুকিয়েছি। কেউইতো ঘুম থেকে উঠেনি, মা। আজকের মত ডাকোনা সবাইকে। কতদিন দেখিনা তোমাদের। ”
” ডাকছি, বাবা। ” দরজার সামনে গিয়ে আবারও ফিরে আসলেন নাজমা আক্তার। ছেলের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
” অবনী এসেছে গতকাল সন্ধ্যায়। ওকে ও কি ডাকব? ”
ইশরাক মায়ের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকল।
” এখনই নয়, মা। ওকে না জানিয়েই চাচা-চাচীকে ডাক। যে ত্যাড়া মেয়ে ঐটা, আমার আসার কথা শুনলেই দেখবে নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে। ”
ছেলের কথা বুঝতে পেরে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন নাজমা আক্তার।
ইশরাক বিছানায় সটান হয়ে শুলো। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে। দুইদিন আগে বিকেলে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিল। সকালে কথা বলেছিল সাদাফের সাথে। কিন্তু সাদাফকে জানায়নি ও আসছে। স্টপওভারে দাদুকে ফোন দিয়েছিল। তখনই দাদুকে জানিয়েছে ও দেশে আসছে। ফ্লাইটের সমস্যার কারনে লেট হয় পুরো পাঁচ ঘন্টা। এরপর ঢাকা পৌঁছায় গতকাল রাতে।
” দাদু ভাই, তুমি সত্যিই এসেছ? ” আব্দুর রহিম লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে আসলেন। দাদুর গলা পেয়ে উঠে বসল ইশরাক।
” ওরে আমার আন্ধার ঘরের বাতি রে, তুমি আইছ? কতদিন তোমারে দেখিনা। কাছে আসতো, তোমারে দেইখা পরানডা জুড়াই। ” কুলসুম বেগম কাঁদতে কাঁদতে রুমে ঢুকে ইশরাককে জড়িয়ে ধরল।
” দাদি, একি! তুমি দেখছি আগের মতই ইয়াং আছ! তোমার তুলনায় দাদুকে বেশ বয়স্ক দেখাচ্ছে। লোকজন দেখলে ভাববে, তুমি দাদুর থেকে কম করে হলেও ত্রিশ-পয়ত্রিশ বছরের ছোট হবে। ”
” কি কইতাছে আমার ভাইয়ে। তোমার দাদু অসুখে পইরা ইমুন হইছে। তাছাড়া হেও জোয়ানই আছিল কয়দিন আগেও। ”
” দাদু ভাই, তুমি কেমন আছ বল? আমাকে তো বললেনা আজকেই আসবে? ”
” সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, দাদু। তোমার শরীর বোধহয় আজকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছেনা? ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করছ, ঔষধ খাচ্ছ? ”
” বয়স হয়েছে, দাদু ভাই। ওপরের ডাক পাওয়ার অপেক্ষা করি দিনরাত। এই সময় ঔষধপত্র যে খুব একটা কাজে দেবেনা, এটা কিন্তু আমরা সবাই জানি। ”
” দাদু, একদম চুপ। এসব কথা আর বলবেনা বলে দিচ্ছি। আমি এবার তোমাকে ঢাকা নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাব। দেখবে তুমি আগের মত ফিট হয়ে যাবে। ”
” ইশু, অবশেষে তুই এসেছিস! সকাল সকাল কোন স্বপ্ন দেখছিনাতো আমি? ” মিনারা খাতুন রুমে এসে জিজ্ঞেস করলেন।
” সত্যিই এসেছি, চাচী। স্বপ্ন দেখছনা তুমি। এস চাচা। কেমন আছ তোমরা? অর্ন কই? ”
” এই যে আমি। আগে বল তোমাকে কি বলে ডাকব? ভাইয়া নাকি দুলাভাই? ”
” তুই যেটাতে কমফোর্ট ফিল করবি সেটাই ডাকবি। ”
” ও বউ, পোলাডা সাত সমুদ্দুর পার হইয়া দ্যাশে আইছে, তুমি শরবত আনো। পোলাডারে কতক্ষণ না খাওয়াইয়া রাখবা? আমার মানিকডার মুখখান কিমুন শুকায় গেছে। যাও খাওন বানাও গিয়া। ” ওয়াহাব আহমেদের পরিবারকে রুমে আসতে দেখে খেঁকিয়ে উঠল কুলসুম বেগম।
” আমার ক্ষুধা লাগেনি, দাদি। তুমি অযথাই চিন্তা করছ। সবার সাথে খাবার খাব আমি। মা, তুমি আমার পাশে বসতো। চাচা-চাচী, তোমরাও বস। ”
” শুন ভাই, ম্যালা বছর পর বিদ্যেশ থাইকা আইছ, ম্যালা জিনিস আনছ, এখন তোমার চাইরপাশে মৌমাছির ভিড় জমবো। তোমার মন নরম এইডা আমরা জানি। সেই সুযোগ লোভী মানুষাজন নিবার পারে। তুমি আবার যারে তারে দামী জিনিসগুলান দিয়া দিওনা। ” কুলসুম বেগম ইনিয়েবিনিয়ে বলল৷
দাদির এমন কথা শুনে রাগ হল ইশরাকের৷ ও বুঝতে পারছে দাদি চাচাদের উদ্দেশ্য করে এমন নিচ কথা বলল।
” আমি বিদেশে পড়তে গিয়েছিলাম, দাদী। সেখানে গিয়ে নিজের খরচ চালাতে আমাকে কাজ করতে হয়েছে। এমন দামী কোন চাকরি করতামনা আমি। নিজের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হত। তাই আমি তেমন কোন দামী জিনিসপত্র আনতে পারিনি ৷ যতটুকুই এনেছি সবার জন্যই এনেছি। এসব নিয়ে তোমাকে চিন্তা না করলেও চলবে। আমারটা আমাকেই বুঝতে দাও। ”
সকলের সামনে যেন থাপ্পড় পরল কুলসুম বেগমের গালে। মুখ কাঁচুমাচু করে বসে থাকল সে। মিনারা খাতুন আর ওয়াহাব আহমেদ মলিন হাসলেন। তারা উঠে যেতে চাইলেও ইশরাক তাদের যেতে দিলনা।
***
সকাল দশটায় ঘুম ভাঙ্গলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসল অবনী। রাতে মাথা ব্যথা হওয়ায় স্লিপিং পিল খেয়ে শুয়েছিল, তাই ঘুম ভাঙ্গতে দেরি হয়েছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকাল অবনী। মিনারা খাতুন ব্যস্ত হয়ে কাজ করছেন। মায়ের পাশে বসে আছে অর্নি। ও মাকে কাজে সাহায্য করছে।
” মা, কি এত কাজ করছ? উঠে এস, আমি একটু পরে তোমার সব কাজ করে দেব। ” ঘুম জড়ানো গলায় বলল অবনী।
ইশরাক উঠানে পা রেখেছে। এমন সময় ওর কানে আসল কথাগুলো। থমকে দাঁড়াল ইশরাক। এ কার গলা শুনছে! কত বছর পর শুনল গলাটা? কতদিন হয়ে গেছে সেই পরিচিত মুখটা দেখেনি ইশরাক। না জানি সে দেখতে কেমন হয়েছে। শুকনো ঢোক গিলে অবনীর মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হল ইশরাক।
অবনী হাই তুলতে তুলতে লম্বা চুলগুলো খোঁপা করছিল। কাঁধের একপাশে ঝুলছে ওড়না। ঘুম থেকে উঠে কোনরকম ওড়নাটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিল৷ খোঁপা বাঁধা হয়েছে কি হয়নি, থমকে গেল অবনী। এ কাকে দেখছে? গতকাল সন্ধ্যায়ই শুনল সে আসবে। কিন্তু সে আজকে এসেই হাজির? অবনী দেখল ইশরাক দুই হাতে ভরা ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘরে দিকে যাচ্ছে। তবে তার আগেই এক পলক তাকিয়েছে অবনীর দিকে। ঐ চোখে কি ছিল অবনী সেটা জানেনা, কিন্তু মনে হল যেন ঝলসে উঠলো তার চোখের তারা । কয়েক সেকেন্ডের চোখাচোখিতেই শিরশিরিয়ে উঠল অবনীর সর্বাঙ্গ। ঐ প্রখর দৃষ্টির সামনে একটু যেন কুঁকড়ে গেল মেয়েটা।
” চাচী, এই নাও বাজার। কত বছর তোমার হাতের রান্না খাইনা। আজকে জমিয়ে রান্না করতো। কব্জি ডুবিয়ে খাব। ”
এতটুকুই বলতে পারল ইশরাক। ওর বুক ধুকপুক করছে। গলা কাঁপছে। মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ডে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ওর কল্পনায়ও ছিলনা সেই দুরন্ত অবনীর এত পরিবর্তন হয়েছে। সেই চঞ্চলা মেয়েটা চার বছরেই পুর্ণাঙ্গ রমনীতে পরিনত হয়েছে। যার ডাগর আঁখি, মধুরঙ্গা অধর, ভরাট শরীর যে কারও অন্তরে কাঁপন ধরাতে যথেষ্ট। তার ফোলা চোখে ঘুমের আবেশ এখনো রয়েছে। সে কি জানে, ঘুম জড়ানো তার আঁখিদ্বয় ইশরাককে প্রবলভাবে আকর্ষন করেছে? তার রিনরিনে কণ্ঠস্বর শুনে ইশরাকের হৃদ পিঞ্জরে বাঁধ ভাঙ্গা ঢেউ আছড়ে পরছে।
” এতকিছু কিনতে গেলি কেন? তোর চাচা কোথায়? সে বাজার করেনি? ”
” চাচা তার ভাইয়ের জন্য বাজার করেছে আর আমি আমার চাচার জন্য করেছি। আর কোন কথা নয়। অর্ন, এগুলো গুছিয়ে রাখ। ”
” অবনী, এদিকে আয় তো, মা। ” ওয়াহাব আহমেদ বাড়িতে ঢুকেই মেয়েকে ডাকলেন।
বাবার ডাক শুনে অবনী গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়ায় রান্নাঘরের সামনে। ইশরাক মিষ্টি একটা গন্ধ পেল। তার চুলের? হুট করেই আরেকটিবার তাকে দেখবার তেষ্টা পেল ইশরাকের। নিজের হিয়াকে কষ্ট দিতে রাজি নয় ইশরাক। সে ঘুরে তাকাল। অবনী ঝুঁকে বাজারের ব্যাগ দেখছে। তার শ্যামল মেঘের অভিসার চন্দনাভিষিক্ত পৃষ্ঠভাগ বেয়ে হাঁটু অব্দি নেমে এসেছে। তাদের ছুঁয়ে দিচ্ছে সুগন্ধি মলয়, যেন রাতের আকাশ ছুঁয়ে থাকা কোন রহস্যময় কবিতা। ইশরাক মুগ্ধ নয়নে দেখছে তার নারীকে।
” অবনী, এগুলো তোর বড়মাকে দিয়ে আয়। তবে এখন যেন রান্না করতে না বসে। আজ দুপুরে সবাইকে আমাদের বাড়িতে খেতে বলবি। ”
” আমি বলব? কেন বাবা, তুমি বলতে পারোনা? ”
” আমি বলেছি। তুই আরেকবার মনে করিয়ে দে। ”
” ইশু, তুই সকালে খেয়েছিস? এক কাজ কর, আমার কাছে বস। তোর পছন্দের পিঠা বানাচ্ছি। খেয়ে বল কেমন হয়েছে। ” মিনারা খাতুন ইশরাককে একটা পিঁড়ি দিলেন বসার জন্য।
” বসতে হবেনা। একটা পিঠা দাও। খেয়ে বলি কেমন হয়েছে। আমি একটু বাহিরে যাব।”
” কোথায় যাবি আবার? সকালে একটা রুটি খেয়েছিস। না খেলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে। অবনী, তুই গিয়ে টেবিলে খাবার দে। তোর চাচা বসে আছে ছেলের সাথে খাবে বলে। আব্বাও অপেক্ষা করছে। ওয়াহাব তুমি চল। একসাথে সবাই খাবে। ”
নাজমা আক্তার এসে দাঁড়িয়েছেন উঠানে। তিনি অবনীকে ঠেলে পাঠিয়ে দিলেন বাড়িতে। অবনী বাবার সামনে কিছু বলতে পারলনা। তবে ওর আপত্তি ঠিকই ইশরাকের চোখে ধরা পরেছে। ইশরাক মুখ টিপে হাসল। একবার যখন ওর সাথে দেখা হয়েছে, এরপর কথাও হবে। আরও অনেক কিছুই হবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
চলবে…