হলুদ বসন্ত পর্ব-১৮

0
80

#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_১৮
জাওয়াদ জামী জামী

” তোর পরীক্ষা দরজার সামনে এসে কড়া নাড়ছে, আর তুই মুক্ত বিহঙ্গের মত সারাদিন ঘুরে বেড়াচ্ছিস? তোকে আগেও নিষেধ করেছি, বেশি ঘুরাঘুরি করবিনা। কিন্তু তুই কথা শোনার মত মেয়েই নয়। ”

সাদাফের ধমকে কেঁপে উঠল অর্নি। সত্যিই ও গত কয়েকদিন থেকে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। পড়াশোনাও লাটে উঠেছে। দুই মাস পর পরীক্ষা এটা জানার পরও মামার বাড়িতে গিয়ে সাতদিন থেকে এসেছে। সেখান থেকে বাড়িতে এসে আবার গেছে খালার বাড়ি। সাদাফ ওকে বেড়াতে যেতে বারণ করেনি ঠিকই কিন্তু ওকে যেতেও বলেনি। অবশ্য অর্নি বেড়াতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সাদাফকে জানায়নি। বেড়াতে যাওয়ার পরই ও সাদাফকে জানিয়েছে।

” অনেকদিন কোথাও বেড়াতে যাইনি, মন কেমন করছিল। তাই মামার বাড়ি, খালামনির বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তোমাকে বললে তুমি রাজি হতেনা, তাই না জানিয়েই গিয়েছিলাম। আর এমন হবেনা। ”

” আর এমন হবেনা, এটা একটা কমন ডায়লগ হযে গেছে। যার আবিষ্কারক তুই। প্রতিবারই ভুল করবি আর প্রতিবারই এই ডায়লগ দিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে তৎপর থাকিস। ভুল কিছু বললাম? ”

” ভুল নয় ঠিকই বলেছ। এটা বললেই তোমার ঝাড়ি থেকে বাঁচতে পারি। ”

” আর একটাও কথা বলবিনা তুই। ফাজিল মেয়ে। পড়াশোনা চাঙ্গে তুলে দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরীক্ষার আগে যদি শুনি বাড়ির বাহিরে পা রেখেছিস, তবে তোর পা কেটে দরজায় ঝুলিয়ে রাখব। ”

” আমি ভালো করেই জানি, কাজটা তুমি করতে পারবেনা। তবুও তোমার কথা শুনব আমি। আমি ভালো করেই জানি, তুমি মিছেই আমাকে ভয় দেখাও। অথচ সবকিছু জানা স্বত্বেও আমি তোমাকে সত্যিই ভয় পাই। কি বল, বিষয়টা আশ্চর্যজনক নয়? ” অর্নির আজ সাদাফকে রাগাতে ইচ্ছে করছে। তাই সাদাফের কথার পাল্টা উত্তর দিচ্ছে। ও ভালো করেই জানে সাদাফ মুখে মুখে কথা বলা পছন্দ করেনা। কিন্তু আজ অর্নি একটু বেশিই সাহস দেখাচ্ছে।

অর্নির চোখের দিকে তাকিয়ে সাদাফ বুঝল মেয়েটা ওকে রাগাতে চাচ্ছে। অর্নির চোখের তারায় দুষ্টুমির ঝিলিক। কিন্তু সাদাফতো রাগবার পাত্র নয়। ও যা করে ঠান্ডা মেজাজেই করে। রাগ ওর ধাতে নেই।

” কথা কম বলবি, আর বেশি বুঝা বন্ধ করবি। এটাই তোর জন্য মঙ্গল। নইলে দেখবি সত্যি সত্যিই তোর হাত-পা জায়গামত নেই। তখন চাইলেও আমাকে দোষ দিতে পারবিনা। যাহ ঘরে গিয়ে পড়তে বস। ”

” মায়ের সাথে কাজ করছিতো। তুমি জানোনা, ইশরাক ভাইয়া বাজার করেছে। আজকে আমাদের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া হবে। ”

সাদাফ আর কিছু না বলে বাড়ির বাহিরে গেল। অর্নিও হেসে রান্নাঘরে গেল।

***

” অবনী, তুমি আজকে আমাদেরকে খাওয়াবে, ঠিক আছে? অনেক বছর পর আজকে আমি ছেলেদের, নাতি-নাতনীদের সাথে নিয়ে খেতে বসেছি। নাতবউ হিসেবে খাবার পরিবেশনের দ্বায়িত্ব তোমাকেই পালন করতে হবে। ”

দাদুর কথা শুনে হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বললনা অবনী। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে দিল নিরবে। এরপর একে একে খাবার এনে রাখল। দাদুর কথা ওর ভালো না লাগলেও অনিচ্ছাকৃতভাবেই ওর কাজটা করতে হবে। ইশরাক না থাকলে ওর খাবার পরিবেশনে কোনই আপত্তি ছিলনা। অবনী বুঝতে পারছে দাদু ইচ্ছাকৃতভাবেই ওকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিতে চায়। একে একে সবাই খাবার ঘরে আসলেন। শুধু ইশরাক অনুপস্থিত।

” বড় ভাবী, ইশরাক কোথায়? ও আসলোনা যে? ” মিনারা খাতুন জিজ্ঞেস করলেন।

” গোসল দিচ্ছে। খাবার বাড়তে বাড়তে ও চলে আসবে। আমাকে বল কি করতে হবে। তোদেরকে একটু সাহায্য করি। ”

” কিছুই করতে হবেনা। আপনি বসেন। ”

” বড় বউমা, ছোট বউমা, তোমরা দু’জনই আমাদের সাথে খেতে বসবে। অবনী সবাইকে খাওয়াবে। ”

” আচ্ছা, আব্বা। ”

” বড় ভাবী, আম্মা তো এখনও আসলনা? সে কি আসবেনা? আমি সকাল থেকে কয়েকবার তাকে ডেকে এসেছি। সে একবারও আমার সাথে কথা বলেনি। ” ম্লান গলায় বললেন মিনারা খাতুন।

” আমি আসার আগেও আম্মাকে ডেকে আসলাম৷ কিন্তু সে আমার কথার কোন প্রত্যুত্তর করলনা। মুখ গোমড়া করে বসে আছে। ” নাজমা আক্তার আঁড়চোখে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বললেন।

” যার যেটা কাজ, সে সেটাই করবে, বউমা ৷ তোমাদের কাজ তোমরা করেছ। অবনী বুবু, এক কাজ কর, তুমি গিয়ে কুলসুমকে ডেকে আন। বেশি জোড়াজুড়ি করবেনা। ”

” আমি কেন, দাদু? তুমি ভালো করেই জান, আমি ডাকতে গেলে বুড়ির সাথে ঝগড়া বাঁধবে নিশ্চিত। বুড়ির যেমন আমাকে দেখলে গায়ে ফোসকা পরে, তেমনি তার কথা শুনলেও আমার কলিজা জ্বলে উঠে। আমি বজ্জাত বুড়িতে ডাকতে পারবনা। ”

” আজকের আয়োজন করেছে তোমার জামাই। তাই কর্ত্রী হিসেবে তোমাকেই এসব করতে হবে। নিজের জায়গা চেনাতে হবে। ”

দাদুর কথা শুনে রাগে গজগজ করছে অবনী। দাদুকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে মন চাইছে। কিন্তু সামনে বড়মা থাকায় সেটা করা সম্ভব হলোনা। হাতের প্লেটগুলো দুমদাম করে মেঝেতে রেখে উঠে দাঁড়াল। খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বিরবির করে বলল,

” জামাই মাই ফুট। ”

***

” এই যে বুড়ি, তোমাকে খেতে ডাকছে। আমাদের বাড়িতে সবাই গেছে কিন্তু তুমি এখনও সং সেজে রুমে বসে আছ কেন? নাকি তোমার ক্ষুধা পায়না? সাধু-সন্ন্যাসীর পর্যায়ে চলে গেছ নাকি? ”

” শয়তান ছেমরি, তুই আমারে অপমান করতাছস? আমার খাওন লাগতনা। তোরাই বেশি কইরা গিল। আমার নাতী দুুই হাত ভইরা বাজার আনছে, তোরা গুষ্টির সক্কলে মিল্যা গাণ্ডেপিণ্ডে গিল। বছরে একদিনও তো এত ভালো খাওন তগোর মুখে জোটেনা। তাই তোরাই খা। আমার পোলা প্রতিদিনই ভালোমন্দ বাজার করে। আমরা তিনবেলাই ভালো খাওনই খাই। ফকিন্নির ঝি, মনে মনে যেডাই চাইছিল, সেইডাই পাইছে। ”

” তোমাকে ছাড়া ঐ খাবারগুলো কারো পেটে সহ্য হবেনা। শেষে দেখা যাবে, সবারই ডায়রিয়া হয়েছে। চাপার জোড়ের সাথে সাথে তোমার বাদ নজরটাও বেশ শক্তিশালী। অলরেডি খাবারগুলোয় তোমার বদ নজর পরেই গেছে। তাই সেগুলো এখন তোমাকে খেতেই হবে। নইরে বাড়িসুদ্ধ মানুষকে হসপিটালে যেতে হবে। সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তাই ভংচং না করে তাড়াতাড়ি চল। ”

” এই ছেমরি, কইলামনা তুই গিয়া গিল? বাপের জন্মে ইমনু খাওন খাস নাই। আমার নাতীর বদৌলতে খাওন জুটতাছে কপালে, কি কপাল তর। ”

” এতই যখন জানো, তখন বেশি কথা বল কেন? তোমার নাতী জগৎ জয় করে এসেছে। দুনিয়ার একমাত্র স্কলারশিপ পাওয়া ব্যক্তি সে। এবং তোমার দোয়ায় এটা সম্ভব হয়েছে। তাই তার খরচে কেনা খারাবগুলো তুমি না খেলে আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর মানুষের পাপ হবে। আর তাছাড়া নিজের চোখেই না হয় দেখবে হাভাতে ওয়াহাব আহমেদ আর তার পরিবার তোমার নাতীর পয়সা কেমন করে সাবার করে। এতে তুমি আগামী কয়েক বছর আমাদেরকে গালি দেয়ার ইস্যু পাবে। এমন সুযোগ মিস করতে নেই। চল তাড়াতাড়ি। ” অবনী হাত ধরে দাদীকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।

” এই ছেমরি, ছাড় কইতাছি। খুব রং লাগছে মনডায়? আমার নাতীর ট্যাকা-পয়সা ধ্বংস করনের পরিকল্পনা করছস এইডা আমি বুঝি। এইডা হবার দিমুনা আমি। প্রয়োজনে ইসহাকরে কইয়া ইশুর জীবন থাইকা তরে তাড়ানোর ব্যবস্থা করমু। ”

” তাই নাকি? পারবে? জানো তো আমারও ইচ্ছে নেই তোমার নাতীর সংসার করার? এমনিতেই তোমার খ্যাঁচখেচিতে আমার কানের পোকারা শহীদ হয়ে যায়। তার ওপর তোমার নাতীর মত ফালতু ছেলের বউ হয়ে এই বাড়িতে থাকলে সকাল-বিকাল তোমার অলক্ষুণে চেহারা আমার দেখতে হবে। যেটা আমি চাইনা। এমনিতেই তুমি আমার জীবন ভাজাভাজা করে দিয়েছ। আমি চাইনা বাকি জীবনটাও তুমি তেজপাতা করে দাও। ”

” বজ্জাত ছেমরি, তুমই আমার নাতীরে ফালতু কইবিনা কইতাছি। আমার ইশুর মত খাঁটি পোলা আশেপাশের দশ গেরামে একটাও নাই। তুই নিজেই অলক্ষ্মী সেইডা কসনা ক্যা? তরে বিয়া কইরাই আমার ইশু দেশান্তরী হইছে। ওর জীবনডা তুই শ্যাষ করছস। ”

” ওরে আমার খাঁটি নাতীর দাদীরে। তোমার নাতীরে কি তুমি খাঁটি ঘি মনে কর? আমার থেকেও বেশি চেনো তাকে? আমি জানি…

অবনীর গলার আওয়াজ পেয়েই ইশরাক এসে দরজায় দাঁড়িয়েছিল। এতক্ষণ ও দুজনের ঝগড়া শুনছিল। কিন্তু যেই ঝগড়া লাইন ছেড়ে বেলাইনে চলে যাচ্ছিল, তখনই ইশরাক ভেতরে ঢুকল।

” দাদি, তুমি এখনও বাড়িতে কেন? মা তোমাকে চাচার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইল কিন্তু তুমি গেলেনা। কিসের এত অহংকার তোমার? অথচ গুরুজন হিসেবে তোমার উচিত ছিল দুই পরিবারকে একসাথে করা। চল, খেতে চল। চাচী আশা করে আছে তোমাকে নিজ হাতে খাওয়াবে৷ তুমিও কি এইটার মত ঝগড়ুটে মহিলা? আমরা সবাই জানি, এইটার জন্মই হয়েছে ঝগড়া লগ্নে। তাই হাজার চেষ্টা করেও এরসাথে ঝগড়ায় তুমি জিততে পারবেনা। ঝগড়ার ওপর স্পেশাল ট্রেনিংপ্রাপ্ত কিছু মানুষ থাকে দুনিয়ায়। তারমধ্যে এই ডাক্তারনি একটা। দুনিয়ার প্রথম এবং একমাত্র ঝগড়ায় ট্রেনিংপ্রাপ্ত ডাক্তারনি৷ ”

অবনী বুঝল ইশরাক ওকে ঝগড়ুটে বলল। রাগে দাঁত কিড়মিড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মনে মনে হাজারটা গালি দিল ইশরাককে।

***

কুলসুম বেগমকে নিজের বাড়িতে দেখে খুশি হলেন ওয়াহাব আহমেদ এবং মিনারা খাতুন। মিনারা খাতুন যত্ন করে শ্বাশুড়িকে চেয়ারে বসালেন। কারন কুলসুম বেগম কোমড়ের ব্যথার কারনে নিচে বসতে পারেননা। পুরোটা সময় মুখ কালো করে থাকল কুলসুম বেগম।

মাদুরে পাশাপাশি বসেছেন দুই ভাই। আব্দুর রহিম বসেছেন ছোট ছেলের পাশে। আব্দুর রহিমের পাশে বসেছে ইশরাক। ইশরাকের পাশে সাদাফ। আরেকটা মাদুরে বসেছেন মিনারা খাতুন ও নাজমা আক্তার। নাজমা আক্তারের পাশে বসেছে অর্নি।

অবনী মাঝখানে বসে সবার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে। তিন রকমের মাংস, চার রকমের মাছ, ডিম, সবজি সবই রান্না হয়েছে। অবনীই রান্না করেছে সব খাবার। ওকে সাহায্য করেছেন মিনারা খাতুন আর অর্নি।

নিচে সবাইকে খাবার দিয়ে অবনী গেল দাদির কাছে।

” তোমার কিছু লাগবে, দাআআদি? নাকি সবার খাওয়া দেখেই পেট ভরাবে? এতে কিন্তু তোমার বিরাট লস হবে। ”

” তুই-ই খা বেশি কইরা। আমার আর লাগতনা। ”

” অবনী, আমাকে একটু মাছের ছোল দে, মা। প্রতিটা তরকারিই খুব সুস্বাদু হয়েছে। দিনকে দিন তুই পাকা রাঁধুনি হয়ে উঠছিস। কোনটা ছেড়ে কোনটা খাই বলতো? ” ইসহাক আজাদ সহাস্যে জিজ্ঞেস করলেন।

” তোমার যেটা ইচ্ছে সেটা দিয়েই খাও। দাদু, তোমাকে কিছু দেব? ” বড় চাচার প্লেটে রুই মাছের তরকারি দিয়ে, দাদুকে জিজ্ঞেস করল অবনী।

” আমাকে নয়, ইশু দাদুকে দে। দেখনা দাদু ভাই আমার খেতেই পারছেনা। ”

দাদুর কথা শুনে অবনী দাঁতে দাঁত পিষে আট-দশ চামচ মাংস দিল ইশরাকের প্লেটে। তরকারিতে মাখামাখি হয়ে গেল ওর প্লেট। অসহায় চোখে ইশরাক তাকায় দাদুর দিকে। কিন্তু দাদু দেখেও না দেখার ভান করলেন। বাধ্য হয়ে ইশরাক মাংসই খেতে শুরু করল।

চলবে…