#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_১৯
জাওয়াদ জামী জামী
” শুধু তোমার জন্য আজকে আমার এই দুর্দশা, দাদু ভাই। তুমি আগ বাড়িয়ে খাবার দিতে না বললে ঐ লাল মরিচ আমাকে অতগুলো মাংস দিতনা। তুমি বলার পরই, ও সাহস পেয়েছে। ও জানত, সবার সামনে আমি কিছুই বলতে পারবনা। ওরে বাবা রে, কি ব্যথা। আবারও যেতে হবে ওয়াশরুমে। ” পেট চেপে ধরে ইশরাক ছুটল ওয়াশরুমের দিকে।
নাতির কষ্ট দেখে আব্দুর রহিমের খারাপ লাগলেও মাঝেমধ্যে হাসিও পাচ্ছে। তিনি জানেন, অবনী প্লেটে মাংসগুলো দিয়েছিল জন্যই ইশরাক সেগুলো খেয়েছে। নয়তো ও সেগুলো ছুঁয়েও দেখতনা। কিন্তু বেচারা বুঝতে পারেনি, স্ত্রীকে জব্দ করতে গিয়ে সে নিজেই ফেঁসে যাবে।
কিছুক্ষণ পর ইশরাক ভেজা শরীরে রুমে ঢুকল। গোসল সেড়ে বেরিয়ে এসেছে। আজকে এ নিয়ে সাতবার গোসল করল। ভেজা শরীরেই শুয়ে পরল। নাজমা আক্তার স্যালাইন বানিয়ে খাইয়েছেন ছেলেকে। ইসহাক আজাদ ডক্টরের কাছে ফোন করে ঔষধও এনে দিয়েছেন। কিন্তু কোনটাই কাজ করছেনা। বেচারার রুম আর ওয়াশরুম করতে করতেই অবস্থা কাহিল।
” ও ভাই, এই যে ধর লবন পানি, এক নিঃশ্বাসে খাও দেখি। শরীলডায় একটু বল পাইবা। আমার কথা তো তোমরা কেউই শুনবানা। ঐ বজ্জাত ছেমরি ইচ্ছা কইরাই তোমারে বেশি খাওন দিছিল। হেয় জানতোনা, তুমি চার বছর বিদ্যাশে আছিলা? চার বছর ধইরা ইমুন মশলাদার খাওন তুমি খাও নাই? ঐ চালাক ছেমরি তোমারে বিপদে ফেলনের লাইগা বুদ্ধি আঁটছিল। আর তুমিও হের ফাঁন্দে পা দিছ। ”
” বউ ফাঁদ পাততে যদি এমন রান্না করে, তবে প্রতিবেলায় আমি তার ফাঁদে পা দিতে রাজি আছি। আমাকে নিয়ে চিন্তা করোনা, দাদি। শরীরটা খারাপ লাগলেও মনটা আমার ফুরফুরে আছে। ” দাদির আনা লবন পানি নিমেষেই শেষ করল ইশরাক।
নাতির উত্তর কুলসুম বেগমের পছন্দ হলোনা। সে অবনীকে কথা শোনানোর উপায় হাতড়াতে লাগল।
” ইশু, খুব খারাপ লাগছে, বাপ? ডক্টরের কাছে যাবি? ” নাজমা আক্তার ছেলের পাশে এসে উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
” ডক্টরের কাছে যাওয়ার মত অতটাও অসুস্থ হইনি, মা। সময়মত স্যালাইন বানিয়ে দিও, তাতেই হবে। ”
” একটু ঘুমাতে চেষ্টা কর। দেশে আসতে না আসতেই অসুস্থ হয়ে গেলি। না জানি পরে আরও কি হয়। ”
” চিন্তা করোনা, মা। আমি ছোট বাচ্চা নই। অনেকদিন পর দেশের খাবার খেয়ে পেট চমকে গেছে। তাই একটু প্রতিবাদ করেছে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। ”
” ইশু, জেগে আছিস, বাবা? আমি ভেবেছিলাম তুই ঘুমিয়ে গেছিস। এই লেবু পানিটুকু খেয়ে নে তো। দেখবি ভালো লাগবে। আমার লজ্জাই লাগছে। অবনী তোকে অতগুলো মাংস দিল, আর তুই কিছু না বলেই খেয়ে নিলি! জীবনে কখনো অতগুলো মাংস একসাথে খেয়েছিস? ” মিনারা খাতুন লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বললেন। তিনি ইশরাকের জন্য লেবু পানি নিয়ে এসেছেন।
” চাচী, মিছেই লজ্জা পাচ্ছ তুমি। ক্ষুধা লেগেছিল তাই কোনকিছু না বুঝেই খেয়েছিলাম। দাও লেবু পানি খেয়ে নেই। ”
মিনারা খাতুন ইশরাকের হাতে দিলেন গ্লাসটা। ইশরাক বাধ্য ছেলের মত পুরোটাই খেয়ে নিল।
***
” দাদু, ও দাদু, তোমার নাতনি বোধহয় খোশমেজাজে আছে তাইনা? আমাকে জব্দ করতে পেরে বোধহয় ও ভিষণ খুশি? ”
” খুশি হওয়াটা কি অস্বাভাবিক, দাদু ভাই? কম তো সহ্য করেনি মেয়েটা। বিয়ের রাতেই স্বামী অপমান করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে দিয়েছে, পাড়া-প্রতিবেশিরা সবাই ওর দিকে আঙুল তুলেছে। তোমার ফুপুরা বাড়ি বয়ে এসে অপমান করেছে। সবাই তোমার চলে যাওয়ার জন্য ওকেই দায়ী করেছে। পনের বছর বয়সেই মেয়েটার ওপর দিয়ে কি ঝড় গেছে সেটা একবারও ভেবে দেখেছ? বিয়েতে যেমন তোমারও অমত ছিল, তেমনি অবনীও রাজি ছিলনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওকেই সবাই কাঠগড়ায় তুলল। তোমার অপরাধের তুলনায় শাস্তি কিন্তু কমই হয়ে গেছে। আমি তো ভেবেছিলাম, তোমার জন্য আলাদা কিছু রান্না করেছে সে। আর সেই খাবারেই কেরামতি ঘটিয়েছে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তোমাকে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাইয়েই কপোকাত করেছে আমার নাতনী। ”
” তারমানে ভবিষ্যতে আরও কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে আমার জন্য? আমি প্রস্তুত তার যে কোন শাস্তির জন্য। শুরু যখন আমিই করেছি, শেষও আমিই করব। ”
” শোন দাদু ভাই, সংসার নামক জিনিসটা সহজলভ্য নয়। চাইলেই অনেকেই সংসারী হতে পারেনা। নারী-পুরুষ উভয়কেই সংযমী হতে হয় সংসার জীবনে। কঠোরতা কখনো কখনো যেমন সংসারের ভীত মজবুত রাখে, তেমনি সরলতাও কখনো কখনো সংসারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়। একজন পুরুষকে প্রয়োজনে যেমন কঠোর হতে হবে, তেমনি আবার সেই প্রয়োজনেই তাকে মোমের মত গলতে শিখতে হবে। সৃষ্টিকর্তা নারীদের সৃষ্টি করেছেন কোমল আর নমনীয়ভাবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের বুদ্ধিমত্তাও তাদের থেকে বেশি হয়। নারীরা হলো নরম কাদামাটির মত। তাদেরকে ইচ্ছেমত গড়তে আমাদের কোন বাঁধা নেই। কিন্তু সেই অধিকার বলেই যদি তুমি কোন নারীকে ভেঙে চুরমার করে দিতে চাও, দেখবে দিনশেষে তুমিই ভেঙে খানখান হয়ে গেছ। কঠোরতা দিয়ে নারীকে জয় করতে পারেনা কোন পুরুষই। নারীকে জয় করতে হলে লাগে ভালোবাসা। নারীকে একবার মন থেকে ভালোবেসে দেখ, দেখবে তার শরীর, মনের অধিকার তুমি জয় করেছ অতি সহজেই। শরীর জয় করলেই শুধু সেখানে ভালোবাসা থাকেনা। একবার নারীর মন করে দেখ। দেখবে তার শরীরও তুমি পেয়ে গেছ অনায়াসেই। নারী চিরটাকালই ভালোবাসার কাঙাল। কিন্তু আমরা পুরুষরা দিনের পর দিন তাদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছি। তারা পুড়েছে ভালোবাসাহীনতায়। আশা করছি, আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছ? ”
” ভালোমতই বুঝেছি, দাদু। তোমাকে আবারও ধন্যবাদ, আমাকে সত্যটা উপলব্ধি করানোর জন্য। তুমি না থাকলে অনেককিছুই বোধগম্য হতোনা আমার। বুঝতামনা সংসার জীবনের কঠিন মারপ্যাঁচ। নিজের দুঃখেই কাতর থাকতাম আজীবন। জানতেও পারতামনা, আমার একার দুঃখে কষ্ট পাচ্ছে কতগুলো মানুষ। বুঝতামনা, একজন দুরন্ত কিশোরীর মন ভেঙেছি আমি। কেড়ে নিয়েছি তার দুরন্তপনা। কেড়ে নিয়েছি তার কৈশোর। নিজেকে নিয়েই থাকতাম। বুঝিনি, দিনের পর দিন এক বেইমানের ভালোবাসায় নিজেকে স্বার্থপর করে তুলেছি৷ এসব ভাবতে গেলে নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মায়। নিজেকে মানুষ বলে মনে হয়না। ”
গলা ভারি হয়ে গেল ইশরাকের। চোখের সামনে ভেসে উঠেছে চার বছর আগের রেই রাতের দৃশ্য। চঞ্চলা কিশোরীর অনুনয় ওর মন গলাতে পারেনি। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে কবে যে এত কঠোর হয়েছিল সেটা বুঝতেই পারেনি ইশরাক।
” শেষ পর্যন্ত সঠিকটা উপলব্ধি করতে পেরেছ এজন্য তোমাকে সাধুবাদ জানাই। নিজের ভুল ধরতে পারে ক’জন? সবাই সর্বদা নিজেকে শুদ্ধ রাখতে তৎপর থাকে। কিন্তু তুমি যে সেটা করোনি এজন্য তোমার ধন্যবাদ প্রাপ্য। কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ? বউ ছাড়া আর কতদিন কাটাবে? ”
” আগে বউয়ের মন জয় করি। তারপর সংসার করার চিন্তা করব। তার মন জয় করা সহজ হবেনা এটা বুঝতে পারছি। আমার বউ সেই ছোট্ট, দুরন্ত অবনী আর নেই৷ সে এখন পুরোটাই বোম্ব। যেকোনো মুহূর্তে ফাটতে দ্বিধা করবেনা৷ আর আমি হচ্ছি এক হতভাগা ডিজপোজাল টিম। সময় ফুরিয়ে আসছে, আমাকে সাবধানে নিস্ক্রিয় করতেই হবে, নইলে বড়সড় বিস্ফোরন অর্নিবার্য। ”
” কিন্তু তার আগে তোমাকে সুস্থ হতে হবে। সুস্থ হয়ে মিশনে নেমে পর। আমি তোমার সাথে আছি। ”
***
” অবনী, ইশরাক এত অসুস্থ কিন্তু তুই ওকে একবারও দেখতে গেলিনা, এটা কি ঠিক করলি? তুই ইশরাকের স্ত্রী। ওর বিপদে সবার আগে তোকে ছুটে যেতে হবে। কিন্তু তোর সেদিকে কোন নজরই নেই। তুই কি ভেবেছিস, তোর বড়মা তোর এমন স্বার্থপর আচরণে কষ্ট পাচ্ছেনা? সে তোকে একটু বেশিই ভালোবাসে তাই তোর সব হেয়ালি নির্দিধায় মেনে নেয়। তার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে, তুই বুঝতে পারতিস সংসার জীবন কাকে বলে। ” মিনারা খাতুন একটু রেগেই গেছেন। ইশরাকের বিষয়ে অবনীর নির্লিপ্ততা তিনি মানতে পারছেননা।
” আমার যাওয়ার দরকার কি, মা! তার পাশে তোমরা সবাই আছো। আমি গিয়ে কি করব? ”
” তোর বাবার অসুখ হলে, আমিই কিন্তু সর্বদা তার পাশে থাকি। কেন থাকি এটা নিশ্চয়ই জানিস? ”
” তোমাদের সাথে আমাদের গুলিয়ে ফেলোনা, মা। কিংবা তোমার সাথে আমাকে৷ এটা সামঞ্জস্য নয় মোটেও। ”
” আমাকে বোঝাতে আসিসনা। তোর থেকে কম বুঝিনা আমি। এতগুলো বছর তুই এই বাড়িতে থেকেছিস, নিজের খরচে পড়াশোনা করেছিস, আরও অনেককিছুই করেছিস। কিন্তু কখনো তোকে প্রশ্ন করিনি। তোর ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দিয়েছি সবসময়। কিন্তু তারমানে এই নয় যে, আমাদের জানতে ইচ্ছে করেনি। তোর মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা তোর সকল সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। একটুআধটু ধারনা করতে পারি, তোদের মধ্যে কি ঘটেছে। হুট করেই তোদের বিয়ে হয়। ইশরাকের অমত থাকতেই পারে৷ বিয়ে নিয়ে সবারই কমবেশি পরিকল্পনা থাকে৷ ওর ও হয়তো ছিল। রাগ হতেই পারে। তোর বাবা কি আমার ওপর রাগ করেনা? আমাদের কি ঝগড়া হয়না? কখনো দেখেছিস, ঝগড়াকে আঁকড়ে ধরে আমরা বিছানা আলাদা করেছি? রাগ, ঝগড়া সবকিছুর সমাধান নয়। সংসার করতে গেলে দু পক্ষকেই নতি স্বীকার করতে হয়। জিদ কখনো ভালো কিছু বয়ে আনেনা৷ কখনো কখনো নিজে নির্দোষ জেনেও গরলকে অমৃত ভেবে পান করতে হয়। ইশরাক ভালো ছেলে। ছোট থেকেই ওকে আমরা চিনি। তাই তোর বড়মার প্রস্তাব সেদিন আমরা মেনে নিয়েছিলাম। জানতাম, আমাদের মেয়ে ঐ বাড়িতে গেলে সুখে থাকবে। বাবা-মা হিসেবে মেয়ের সুখ আমরা চাইতেই পারি। হয়তো ইশরাকের কোন ব্যবহারে তুই কষ্ট পেয়েছিস। তারপরও বলব, ভুলে যা। ওর সাথে কথা বল। দেখ ও কি চায়। তোর চাওয়াটাও ওকে জানিয়ে দে৷ মিলেমিশে সিদ্ধান্ত নে। মনে রাখিস, একটা ঘর গড়তে যতটা পরিশ্রম, সময় লাগে, ভাঙতে তার অর্ধেক সময়ও লাগেনা। গড়ার মধ্যে যতটা যত্ন, ভালোবাসা থাকে। ঠিক তেমনই ভাঙ্গনের মধ্যে থাকে রাগ, কষ্ট, ঘৃণা। ঘৃণা দিয়ে যে জিনিসটা শুরু হয়, সেখানে সুখ থাকেনা কভু৷ তাই ভাঙ্গনেও কখনো সুখ মেলেনা। তোর আর ইশরাকের জীবন ঘৃণা দিয়ে শুরু হয়নি। হয়তো বোঝার ভুল ছিল কিংবা ছিল সিদ্ধান্তের ভুল৷ একে ঘৃণা বলা যায়না মোটেও। তাই তোদের উচিত ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে কথা বলা। সেটাকে মিটিয়ে নেয়া। জানিনা তোকে বোঝাতে পেরেছি কিনা। আমারটা আমি বললাম। বাকিটা তোর ইচ্ছা। ”
মায়ের কথাগুলো শুনে তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল অবনী। গত চার বছরে মা কখনোই ওকে এভাবে বলেনি। হয়তো মায়ের যুক্তিতে মা ঠিক। কিন্তু ওর ভেতরটা দেখবে কে?
চলবে…