#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_২০
জাওয়াদ জামী জামী
” বড়মা, আর কিছু রান্না করতে হবে? আমার রান্না কিন্তু শেষ। আর কি কি করতে হবে বল। ”
” ইশুর ফুপুরা আসবে, এই খাবারগুলো দিয়ে দুপুর আর রাতের খাওয়া হবেনা। এক কাজ করি, রাতের জন্য মাছের ঝোল আর ডিম ভুনা করলে কেমন হয়? ”
” সাথে একটা ভাজাও রাখা যেতে পারে। করলা ভাজলে কেমন হয় বল? খাবার কম পরলে তোমার ননদরা তোমার চুল ছিঁড়তে দুইবারও ভাববেনা। এক কাজ কর, কাতলামাছ বের করে দাও। দুপুরে রুই মাছ, মাংস খাবে, আর রাতের জন্য কাতলামাছ, ডিম ভুনা, করলা ভাজব। ”
” তুই যখন বলেছিস, তখন অবশ্যই হয়। তোরমত করে রান্না কর। আমি তোকে কেটে বেছে দিচ্ছি। আর একটা কথা, ওরা আসলে আগ বাড়িয়ে ওদের সাথে কথা বলতে যাবিনা। ওরা খোঁচা মেরে কথা বললেও চুপ থাকবি। মনে থাকবে? ”
” ওদের সাথে কথা বলতে এমনিতেও আমার ইচ্ছে করেনা। তবে আমাকে খোঁচা মারলে, আমিও প্রতিবাদ করব । আমাকে নিরব থাকতে দেখলে ওরা আরও আক্রমণ করবে। এটা তুমি আমার থেকেও ভালো জানো। এবার চুপটি করে চেয়ারে বসে বসে আমার সাথে গল্প কর। কোন কাজ করতে হবেনা তোমাকে। যা করার আমিই করব। ”
” আমাকে কে কি তোর এতটাই অবিবেচক মনে হয়? আমার ডাক্তার বউমাকে দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিব? দুই মা-মেয়ে কাজ করতে করতেই গল্প করব। তবে তার আগে ইশুকে লেবু পানি দিয়ে আয়। লেবু পানি খাওয়ার পরই ছেলেটা সুস্থবোধ করছে। ”
” এরমধ্যে আমাকে টানছ কেন? তোমার ছেলে তুমিই তাকে লেবু পানি হোক, আর হারপিক পানি হোক খাওয়াও। আমি এসবে নেই। ”
” বালাইষাট, হারপিক পানি খাওয়াব কেন? লেবু পানিই খাওয়াব আমার ছেলেকে। এবং সেটা তুইই নিয়ে যাবি। ছেলেকে বিয়ে করানোর আগ পর্যন্ত মা তার সকল দ্বায়িত্ব পালন করলেও, বিয়ের পর স্ত্রী’র ওপরই সব দ্বায়িত্ব ন্যাস্ত হয়। স্ত্রী’ ই হয়ে ওঠে স্বামীর আস্থাভাজন, অবলম্বন, বন্ধু, সাথী। সর্বোপরি একজন স্ত্রী হয়ে ওঠে স্বামীর অভিভাবক। বেশি কথা না বলে, ইশুকে লেবু পানি দিয়ে আয়। ” বড়মার ধমক খেয়ে অবনী মুখ কালো করে গ্লাস নিয়ে গেল ইশরাকের কাছে।
ইশরাক ড্রয়িংরুমে বসে দাদুর সাথে গল্প করছিল। অবনী ওর সামনে গিয়ে টেবিলে ঠক করে গ্লাস রাখল। অবনীর এমন কাজে চমকায় ইশরাক।
” কি আছে গ্লাসে? ”
অবনী জবাব না দিয়ে রান্নাঘরে গেল। ইশরাক মুচকি হেসে গ্লাস হাতে নিল।
” ও ইশু বাপ, কি হইছে তোমার? ঐ শয়তান ছেমরি তোমারে কি খাওয়াইছে? তুমি এখন কিমুন আছো? হায় হায় রে আমার বাপের অবস্থা কি হইছে। চোখে দেখা যাইতাছেনা। ” লেবু পানি শেষ করে ইশরাক গ্লাসটা টেবিলে রাখতেই সেখানে আসল ইশরাকের বড় ফুপু। বুক চাপড়ে আহাজারি করছে সে।
বড় ফুপুকে এমন করতে দেখে ভিষণ বিরক্ত হল ইশরাক। চোখমুখ কুঁচকে তাকাল দাদুর দিকে। দাদুও বিরক্ত নিয়ে তাকিয়ে আছেন তার মেয়ের দিকে।
” আমার কিছুই হয়নি, ফুপু। আর কেউ কিছু আমাকে খাওয়ায়নি। আমি নিজের ইচ্ছায় খাবার খেয়েছি। তোমার বয়স হয়েছে ঠিকই, কিন্তু চিৎকার চেঁচামেচি করার স্বভাব একটুও পাল্টায়নি দেখে অবাকই হচ্ছি আমি। কতদিন পর এ বাড়িতে এসেছ, কাছে এসে বসবে, হাসিমুখে কথা বলবে, কিন্তু সেটা না করে কান্নাকাটি শুরু করেছ। বুদ্ধি কি কোনদিনও হবেনা তোমার? ”
ভাতিজার ধমকে কান্না ভুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল আরজু। মনে মনে ভাতিজার ওপর যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে। কিন্তু সেটা বুঝতে দিলনা।
রান্নাঘর থেকে সবটাই শুনল অবনী আর নাজমা আক্তার। অবনী খুশি হয়েছে কিনা বোঝা গেলনা, তবে ছেলের উত্তর শুনে নাজমা আক্তার ভিষণ খুশি হয়েছেন বোঝাই যাচ্ছে।
” যাও বড়মা, সানাইয়ের পোঁ এসে গেছে। এবার বাকি সানাইগুলোর আসার অপেক্ষা কর। আগামী কয়েকদিন সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায় তোমার বাড়িতে ননস্টপ সানাই বাজবে। শুনে তোমার কান ধন্য হবে। ”
” চুপ থাক, পাজি মেয়ে। আমার কান ধন্য হবে, আর তোর কান কি বয়রা হবে? ” নাজমা আক্তার হেসে বললেন। তিনি অবনীর জবাবের অপেক্ষা না করেই ড্রয়িংরুমে গেলেন।
***
” ও ইশু বাপ, আম্গোর লাইগ্যা বিদেশ থাইকা কি আনছ? তোমার ফুপায় আমারে কইছে, দেইখো ইশু আম্গোর সক্কলের জইন্যই দামী দামী জিনিস আনব। ” মেজো ফুপু দিলারার কথা শুনে হাসল ইশরাক।
” আমি পড়তে বিদেশে গিয়েছিলাম, ফুপু। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে কাজ করেছি। নিজের খরচ নিজেকেই বহন করতে হয়েছে আমার। তাই ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও তেমন কোন গিফ্ট আনতে পারিনি। তবে যা এনেছি আশাকরি তোমাদের পছন্দ হবে। সাদাফ, চাচী, অর্নিকে ডেকে নিয়ে আয়। মা, তুমি লাগেজ বের কর৷ ”
ইশরাকের কথায় ওর ফুপুদের মুখ কালো হয়ে গেল। তারা আশা করেছিল ইশরাক তাদের জন্য ব্যাগ বোঝাই করে জিনিসপত্র আনবে। কিন্তু ইশরাক তাদের হতাশ করেছে।
নাজমা আক্তার লাগেজ নিয়ে আসলেন। ততক্ষণে মিনারা খাতুন, অর্নিও এসেছে। নাজমা আক্তার অবনীকে ডাকলে, অবনী কাজের অযুহাত দিয়ে দূরেই থাকল।
ইশরাক লাগেজ খুলে একে একে বিভিন্ন জিনিসপত্র বের করছে।
” তোমাদের চার বোনের জন্য কানের দুল এনেছি, ফুপু। দেখতো পছন্দ হয় নাকি। আর তোমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য, ফুপাদের জন্য, রিস্টওয়াচ, ইলেকট্রিক শেভার, ট্রিমার, পারফিউম, ফোন, সানগ্লাস, ওয়ালেট এনেছি৷ এই যে নাও। ” ইশরাক একে একে চার ফুপুর হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিল। ফুপুরা মুখ কালো করে সেগুলো নিল। কারো মুখে হাসি নেই।
” মা, চাচী, এগুলো তোমাদের জন্য। অর্ন, এই যে গোল্ডের জুয়েলারি সেট তোর জন্য। আর এই ব্যাগে আরও কিছু জিনিস আছে। সাদাফ, এই যে তোর ব্যাগ। দাদু, তোমারটা নাও। দাদী, এখানে তোমার জন্য কিছু আছে। ”
” এই-যে ইশু বাবা তোমারে কি দিছে দেখি? ” রওশন আরা মিনারা খাতুনকে বলল।
মিনারা খাতুন তার হাতে থাকা ব্যাগ খুলে একটা বক্স বের করলেন। বক্স খুলতেই সকলে দেখল একজোড়া কানের দুল আর হাতের বালা আছে সেখানে। এগুলো দেখেই বাকি সবার মত মিনারা খাতুনও চমকালেন। তিনি সত্যিই অবাক হয়েছেন।
” এ কি করেছিস, ইশু? এগুলো কেন আনতে গেছিস? আমার এসব লাগবেনা, বাপ। তুই এসেছিস তাতেই আমি খুশি হয়েছি। ” মিনারা খাতুন ইশরাকের দিকে ব্যাগটা এগিয়ে দিলেন।
” আমি তো ফেরত নেয়ার জন্য তোমাকে কিছু দেইনি, চাচী। কথা না বলে নিজের কাছেই রেকে দাও৷ ”
” রাইখ্যা দেও। জীবনে এইগুলান চোখে দেখবার পারতেনা। আমার ভাতিজার সুবাদে এইগুলান দিয়া ফুটানি কইরো। ফুটানি করনের লাইগাই তো মাইয়ারে ইশুর ঘাড়ে গোছায় দিছিলা। তার ফল ভোগ করতাছ এখন। ” খেঁকিয়ে উঠল দিলারা। তারা চারবোন রাগে গজগজ করছে। রেগেছে কুলসুম বেগমও।
” ফুপু, তুমি থামবে? আমি যেটা ভালো বুঝেছি, সেটাই করেছি। এমন নয় যে, তোমাদের রেখে আমি চাচীকে কিছু দিয়েছি। চাচী আমাকে ছোটবেলা থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। তার জন্য এতটুকু আমি করতেই পারি। ”
” হ সে-ই তোমাকে একা মানুষ করছে, আমরা কিছুই করি নাই। মূল কতা হইতাছে হেয় তোমার শাউড়ী। তাই তার জইন্য, তার মাইয়ার জইন্য এত কিছু আনছ। বউয়ের মন জয় করন লাগতোনা তোমার। সবই বুঝি আমরা। ”
” ভাইয়া, এগুলো আমাদের লাগবেনা। তুমি এগুলো ফুপুদের দিয়ে দাও। তুমি এসেছ, আমরা এতেই খুশি। ” অর্নি নিজের প্যাকেটটা ইশরাকের সামনে রেখে দিল।
এসব দেখে রাগে ইশরাকের শরীর কাঁপছে। ফুপুদের এত নাটক ওর সহ্য হয়না।
” এক থাপ্পড় মেরে দাঁত খুলে দেব। ফেরত নেয়ার জন্য তোকে এগুলো দিয়েছি আমি? নিতে ইচ্ছে না করলে পুকুরে ফেলে দে। আর একদিন যদি তোকে বড়দের ভেতর কথা বলতে দেখেছি, তবে সেদিন তোর কপালে খারাবি আছে। ”
ইশরাকের ধমকে কেঁপে উঠল অর্নি। আজ পর্যন্ত ইশরাক কখনোই ওর সাথে জোর গলায় কথা বলেনি। কিন্তু আজ রেগে গেছে। তবে অর্নি ভয় পেলেও মন খারাপ করলনা। ও জানে ফুপুদের ওপর রাগ করেই ইশরাক ওকে ধমক দিয়েছে।
” ভাই আম্গোর, ভাতিজা আম্গোর, কিন্তু এই লোভী মহিলা নিজের মাইয়ারে গোছায় দিয়া নিজের ফায়দা লুটতাছে। নিজে কথা না কইয়া, মাইয়ারে দিয়া কওয়াইতাছে। শ্বশুরের কাছ থাইকা কিছু পায় নাই, তাই ভালো বুদ্ধি আঁটছে। এখন থাইকা সুদেআসলে ইশু বাপের কাছ থাইকা সব আদায় করব। বোকাসোকা পাইয়া মা-মাইয়া মিল্যা পোলাডার সর্বনাশ করব। হায়রে লোভী রে। ” আরজুর থামার কোন নামই নেই। সে চিৎকার করেই চলেছে।
” থামবে তোমরা? তোমাদের সাথে কে কথা বলতে গেছে যে এভাবে হৈচৈ করছ? আমার বাবার হয়তো তোমাদের মত লাখ লাখ টাকা নেই, কিন্তু তার সম্মান তোমাদের থেকে হাজার গুণ বেশি। সে তোমাদের মত লোভী নয়। লোভ যদি তার থাকত, তবে অনায়াসেই বাপের সম্পত্তির মায়া ছাড়তে পারতনা। তোমরা তাকে ঠকানোর পরও সে চুপ থাকতনা। শুধুমাত্র তোমার বাবার সৎ ছেলে বলে তাকে তোমরা বঞ্চিত করতে পারতেনা। তাকে যেমন তোমরা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছ, তেমনি বঞ্চিত করেছ পিতার ভালোবাসা থেকে। নিজেদের মনে আকাশ সমান লোভ রেখে, তোমরা আমার নিরীহ বাবাকে লোভী বলছ? লজ্জা হওয়া উচিত তোমাদের। আমার দাদী নিজে থেকে দাদুর বউ হয়ে এসেছিলনা। তার শ্বাশুড়ি তাকে পছন্দ করে ছেলের বউ করে এনেছিল। কিন্তু তোমরা দিনের পর দিন সেই মানুষটাকেও নির্যাতন করেছ। তাকে বেঁচে থাকার মত অবস্থায় রেখেছিলেনা। হিংসা করে আমার বাবাকে চাকরি করতে দাওনি, দাদুকে পদে পদে ব্ল্যাকমেইল করেছ। এতকিছুর পরও তোমাদের মন ভরেনি ? আর কি চাই তোমাদের? আমার বাবা গরীব কিন্তু তাই বলে কোনদিনও তোমাদের কাছে হাত পাতেনি। তোমাদের দ্বারস্থ হয়নি কখনো। আবার বাবার হক মেরে তোমরা নিজেদের আখের ঠিকই গুছিয়েছ, কিন্তু নিজেদের সন্তানদের মানুষ করতে পারোনি। ওয়াহাব আহমেদের দুই মেয়ের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতা তোমাদের সন্তানদের হয়নি। আর হবেওনা। তোমরা আমার বাবাকে অসম্মান করলে কি হবে, এলাকার মানুষ কিন্তু আমার বাবাকে ঠিকই সম্মান করে। আর সে সম্মান আমার বাবা অর্জন করেছে। সেই সম্মান কিন্তু তোমাদের ঝুলিতে নেই। সারাজীবন মানুষের সম্মান পেতে তোমাদের হাহাকার করতে হবে। দিনশেষে আমার বাবাকে ঠকাতে গিয়ে তোমরাই ঠকে গেছ। আর রইল অর্থের অহংকার। আর কয়েক বছর পর ওয়াহাব আহমেদ চাইলেই তোমাদেরকে কিনে নিতে পারবে। ওয়াহাব আহমেদকে সবাই হুজুর হুজুর করবে, সেই ব্যবস্থা আমি করব। তোমরা দেখ এই অবনী তার বাবার সম্মানের জন্য কি কি করতে পারে। তাই আজ থেকে নিজের মুখ বন্ধ রাখলেই তোমাদের জন্য ভালো হবে। ” অবনী নিজের ইচ্ছেমত রাগ ঝাড়ল। রাগে ওর পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে।
অবনীর কথাগুলো শুনে পুরো বাড়ির মানুষ স্তব্ধ হয়ে গেছে। মিনারা খাতুন অবনীকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাইলেন। তিনি মেয়েকে ধমক দিলেন।
” অবনী, চুপ কর। চল বাড়িতে চল। এত কথা বলছিস কেন তুই? এই শিক্ষাই তোকে আমরা দিয়েছি? ”
” কেন চুপ করব, মা? কতগুলো নোংরা মানসিকতার মানুষ এসে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আমাদের অপমান করবে, আর আমরা মুখ বুজে সহ্য করব? সেই দিন পাল্টেছে। তোমার একটুও কষ্ট হয়না এদের কটুকথা শুনলে? তুমি কি লোভী? তুমি আরেকজনকে পটিয়ে এই গহনাগুলো নিয়েছ? আমাকে লেলিয়ে দিয়েছ তুমি আরেকজনের পেছনে? এদের বোধহয় জানা নেই, দুনিয়ার সেরা লোভী এরা। আমার বাবাকে ঠকিয়েছে এরা, নিজের বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করে তার সম্পত্তি ভোগদখল করছে, নিজের বড় ভাইয়ের সম্পত্তি জোর করে ভোগ করছে। এতকিছুর পরও এই নোংরা মানুষগুলো তোমাদেরকে লোভী বলে কিভাবে? এদের সামনে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছ কিভাবে? এদের দেখলেই তো আমার ঘৃণা হয়। ”
” শয়তান ছেমরি, তর এত বড় সাহস আম্গোরে লোভী কস? আইজ তর একদিন কি আমার একদিন। আইজ তর মাথার চুল না ছিঁড়বার পারলে আমার নাম দিলারা না। ”
দিলারা এগিয়ে গেল অবনীর দিকে। সে তার হাত বাড়িয়েছে অবনীর চুলের মুঠি ধরতে। ঠিক তখনই ইশরাক এসে দাঁড়িয়েছে অবনী আর দিলারার মাঝখানে।
” খবরদার ফুপু , ভুলেও এটা করতে যেওনা। মনে রেখ তুমি যার চুল ছিঁড়তে চাইছ, সে আমার স্ত্রী। আর আমি বেঁচে থাকতে, আমার স্ত্রীকে কেউ অপমান করবে সেটা আমি হতে দেবোনা। অবনী ভুল কিছুই বলেনি। তোমরা একধারে যেমন চাচাকে ঠকিয়েছ, ঠিক তেমনই ঠকিয়েছ আমার বাবাকেও। দিনের পর দিন অন্যায় করার পরও তোমাদের বিবেক জাগ্রত হয়নি? চাচা তোমার নিজের মায়ের পেটের ছেলে নয় তো কি হয়েছে, সে তো দাদুরও ছেলে। তোমার জন্মদাতা পিতার সন্তান সে। তোমাদের রক্ত আলাদা নয়। তারপরও এত বিভেদ কর কেন? ”
” তুমি এইভাবে কইতে পারলা, বাপ? তোম্গো দুই ভাইরে আমরা কত ভালোবাসি হেইডা তুমি জানোনা? আইজ তুমি ওগোর পক্ষ নিয়া আম্গোরে অপমান করলা? ”
” পক্ষপাতীত্ব তোমরাই শুরু করেছ। আমি সব সময় চাচা-চাচীকে চাচা-চাচীই ভেবে এসেছি। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ভাবিনি। কিন্তু তোমরা নিজেদের সুবিধার জন্য তাদেরকে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বানিয়ে দিয়েছ। একটা পুরুষের জীবনে তার স্ত্রীর যেমন গুরুত্ব আছে, তেমনি শ্বশুর-শ্বাশুড়িরও গুরুত্ব আছে। কোন স্ত্রী যদি চায় তার বাবা-মাকে ফুপুদের চাইতেও বেশি সমাদর করতে হবে, তবে স্বামী সেটা করতে বাধ্য। অবনী চাইলে আমিও সেটাই করব। তাই বলছি কি, বছরে দুই-একবার ভাইয়ের বাড়িতে আসবে, ভাই-ভাবী আদর-আপ্যায়ন করবে। তোমরা হাসিমুখে সবার সাথে মিশবে। ব্যাস হয়ে গেল। নিজেদের ভালো চাইলে এরপর থেকে আমার বউ আর শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে বিবাদে জড়াতে যেওনা। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নিও। ”
” ইশু দাদু, এইডা কি কইলা তুমি? আমার মাইয়াগোরে এত কতা শুনাইলা তুমি? বাপের বাড়িতে আমার মাইয়াগোর আসার রাস্তা বন্ধ কইরা দিলা? ইসহাক ছাড়া আমার মাইয়াগোর আর কেউ নাই তুমি এইডা জাইনাও, এতগুলান কতা কইলা? ”
” ভুল কি বলেছে দাদু ভাই? তোমাদের জন্য আমি ওয়াহাবকে বঞ্চিত করতে বাধ্য হয়েছি। কোহিনূরকে আম্মা পছন্দ করে এই বাড়িতে এনেছিল। তার নাতির সাধ ছিল। কিন্তু তুমি পরপর ছয়টা মেয়ের জন্ম দিলে, আম্মা সেটা মানতে পারেনি। একদিন তোমার অনুমতি নিয়েই কোহিনূরকে বিয়ে করে আনলাম। কোহিনূর এ বাড়িতে আসার পর থেকেই তুমি আর তোমার মেয়েরা মিলে তাকে অত্যাচার করেছ। কোহিনূর কখনো মুখ ফুটে প্রতিবাদ করেনি। আম্মার মৃত্যুর পর কোহিনূরকে তোমরা এই বাড়ির কাজের মেয়ে করে রাখলে। আমি কিছু বলতে গেলেই তোমরা মা-মেয়ে মিলে বিষ খেয়ে মরার ভয় দেখাতে। একসময় ইসহাকের জন্ম হলো। আম্মার তার প্রথম নাতীর মুখ দেখতে পেলোনা। তুমি অসুস্থ হয়ে বিছানা নিলে। ইসহাককে কোলেপিঠে করে মানুষ করল কোহিনূর। ইসহাক ছোট মায়ের ন্যাওটা হল। কিন্তু তুমি সুস্থ হওয়ার পর ইসহাকে কোহিনূরের কাছ থেকে কেড়ে নিলে। একসময় জন্ম হলো ওয়াহাবের। একদিন তুমি মেয়েদের সাথে পরিকল্পনা করে, হাতে বিষের বোতল নিয়ে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলে আমার সম্পত্তির কোন অংশ পাবেনা ওয়াহাব। এমনকি আমার ইনকামের কোন টাকাই পাবেনা সে। তোমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিলাম। ওয়াহাব ধীরে ধীরে বড় হল, নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালাল। এক সময় আমার ছেলেটার সরকারি চাকরি হল। কিন্তু তোমার মেয়েরা হিংসায় জ্বলতে থাকে। নিজেরা পরিকল্পনা করে এবার ব্ল্যাকমেইল করলে ওয়াহাবকে। শর্ত দিলে, ও যদি চাকরি করে, তবে আমার মুখ কোনদিন দেখতে পাবেনা। কোহিনূরসহ ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। আমার নিরীহ ছেলেটা শুধুমাত্র আব্বার ভালোবাসার ছায়ায় থাকবে বলে, ওর মাকে স্বামীর ভিটেমাটি ছাড়া করবেনা বলে তোমাদের শর্ত মেনে নিল। কিন্তু বাঁধ সাধল ইসহাক। ও একরকম জোর করেই পুরোনো বাড়ির অংশটুকু ওয়াহাবকে দিয়ে দিল৷ আমার ছেলেটা অতটুকু নিয়েই চুপ থাকল। তোমরা এসব ভুলে যেতে পার, কিন্তু আমি ভুলিনি। আমি ভুলিনি কোহিনূর মৃত্যুশয্যায় বারবার আমাকে দেখতে চাইত কিন্তু তুমি আর তোমার মেয়েরা আমাকে যেতে দাওনি। এক সময় যখন তোমার হুমকি অগ্রায্য করেছি, তখন তোমার চারটা মেয়ের কোন একজন বিষের বোতল নিয়ে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে। সন্তান যতই খারাপ হোক তার অকালমৃত্যু কোন বাবাই দেখতে পারেনা। আমিও চাইনি আমার মেয়েদের কিছু হোক। ছয় মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেছিল সেই ছোটবেলায়। তাদের শোক আজও কাটাতে পারিনি আমি। তাই অন্য মেয়েদেরও হারাতে চাইনি। আমার সন্তানপ্রীতিকে তুমি দুর্বলতা ভেবেছ। তাই নির্দিধায় মেয়েদেরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে তোমার একটুও খারাপ লাগেনি। তাই একের পর এক অন্যায় করে গেছ। তবে আর নয়। অনেক হয়েছে। এরপর থেকে কোন বিষের বোতলের ভয় আমি করবনা। প্রয়োজনে তুমিসহ তোমার চার মেয়ে মরলেও আমি আমার ছেলের পাশে থাকব, আমার নাতনিদের পাশে থাকব। আর তুমি চাইলে তোমাদের মেয়েদের সাথে গিয়ে থাকতে পার। তোমার ভরণপোষণের দায়িত্ব আমি আর নেবোনা। আজকের পর থেকে তোসার মেয়েরা এই বাড়িতে আসতে পারবেনা। আমার ছেলেদের সংসারে ওরা অশান্তি করবে এটা আমি হতে দেবোনা। এই মুহূর্তে তোমাদের মেয়েদের সাথে তুমিও এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। ” আব্দুর রহিমের কথা শুনে তার মেয়েরা হতভম্ব হয়ে গেছে। তাদের আব্বা এই কথাগুলো বলবে সেটা তারা ভাবতেও পারেনি।
চলবে…