হলুদ বসন্ত পর্ব-২১

0
284

#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_২১
জাওয়াদ জামী জামী

” আমি যদি তোমাকে ওয়াহাবের প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে বলি, তবে কি তুমি রাগ করবে, ইসহাক? তুমি ভালো করেই জানো, কোন পরিস্থিতিতে আমি আমার সকল সম্পত্তি তোমাদের পাঁচ ভাইবোনকে ভাগ করে দিয়েছিলাম। আমি জানি, একদিক থেকে তোমাকেও ঠকিয়েছি। মেয়েদের হুমকিতে পরাজিত হয়ে, তাদের পছন্দমত জায়গাজমি তাদেরকে দিয়েছি আমি। এজন্য তোমাদের সকলের কাছে ক্ষমা চাইছি আমি। ” ড্রয়িংরুমে বসে বড় ছেলের পুরো পরিবারের কাছে আকুতি করলেন আব্দুর রহিম।

” আব্বা, আমি সব সময়ই চেয়েছি ওয়াহাব তার ন্যায্য হিস্যা ফিরে পাক। আপনার অনুমতির অপেক্ষা করেছি আমি। আজকে যখন আপনি অনুমতি দিয়েই দিলেন, আমিও ওয়াহাবকে ওর সম্পত্তি ফিরিয়ে দেব। এতদিন ওর সম্পত্তি অনিচ্ছাকৃতভাবেই ভোগ করেছি । এজন্য সর্বদাই অপরাধবোধে ভুগছি আমি। ইশু, সাদাফ তোমরা কি বল? ”

” তোমার বাবার সম্পত্তি তোমরা দুই ভাই সমান ভাগে পাবে, এটাই আইন। তাই তোমার উচিত চাচার প্রাপ্য সম্পত্তি তাকে ফিরিয়ে দেয়া। ” ইশরাক একবাক্যে উত্তর দিল।

” আমিও চাই তুমি চাচাকে তার সম্পত্তি ফিরিয়ে দাও। আগে যদি চাচকে তার সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে, তবে এত বছর চাচাকে কষ্ট করে দিনাতিপাত করতে হতোনা। সেই তোমাদের বোধদয় হলো, কিন্তু বড্ড দেরি করে ফেলেছ। ” সাদাফও সায় জানাল।

দুই ছেলের সম্মতি পেয়ে খুশি হলেন ইসহাক আজাদ। তবে তিনি সাদাফের কথার প্রত্যুত্তর করলেননা। তিনি জানেন, সাদাফ সত্যি কথাই বলেছে।

” তবে আর দেরি করোনা। একদিন সময় করে রেজিষ্ট্রি অফিসে চলে যাও। কিন্তু ভুলেও ওয়াহাবকে জানিওনা। ও জানলে কিছুতেই নিবেনা। ”

” ঠিক আছে, আব্বা। আমি আগামী সপ্তাহেই কাজটা করে ফেলব। নাজমা, তুমি মিনারার কাছ থেকে ওয়াহাবের ছবি আর আইডি কার্ড নিয়ে রেখ। জিজ্ঞেস করলে বলো, আমার প্রয়োজন আছে। ”

” আচ্ছা। ”

নিজের রুম থেকে সবকিছুই শুনল কুলসুম বেগম। তার ভেতরটা জ্বলে গেলেও কিছুই করতে পারছেনা। কারন সে জানে, এখন কিছু বললেই আব্দুর রহিম তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। গতকাল তার মেয়েদেরকে একরকম অপমান করেই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে আব্দুর রহিম। এমনকি এই বাড়িতে তাদের আসতেও নিষেধ করে দিয়েছেন। তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে, তার যাওয়ার মত জায়গা নেই। গতকাল সে স্বামীর ওপর রাগ করে, মেয়েদের সাথে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু কোন মেয়েই তাকে সাথে নেয়নি। এতে মন খারাপ হয়েছে কুলসুম বেগমের। কিন্তু সেটা কাউকে বুঝতে দেয়নি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছে কুলসুম বেগম। মেয়েরা তার মনে আশা জাগিয়ে মাঝপথে ছেড়ে যাবে, এটা সে কোনদিনও ভাবেনি।

***

” বড় ভাই, এটা তুমি কি করেছ? জমিজমা আমার প্রয়োজন নেই। তুমি আমাকে ছোটবেলা থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছ, এখন পর্যন্ত তুমি আমাকে আগলে রেখেছ, এটাই আমার জন্য অনেক কিছু। আমার এই সম্পত্তি চাইনা। ” ওয়াহাব আহমেদ মন খারাপ করে কথা বলছেন। তিনি যখন শুনেছেন তার বড় ভাই নিজের সম্পত্তি থেকে কয়েক বিঘা জমি তার নামে লিখে দিয়েছেন, তখনই তিনি ছুটে এসেছেন ভাইয়ের কাছে।

” তোর কথা শুনব বলে সম্পত্তি তোর নামে লিখে দেইনি। এতদিন আমার হাত-পা বাঁধা ছিল, তাই চাইলেও তোকে জমি দিতে পারিনি। চোখের সামনে তোর কষ্ট দেখার পরও আমি কিছুই করতে পারিনি, এটা আমার ব্যর্থতা। আজ যখন নিজের ব্যর্থতা ঘোচানোর সুযোগ এসেছে, তখন সেই সুযোগ আমি কিভাবে ছাড়ি বল? ”

” এত জমি দিয়ে আমি কি করব, ভাই? বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, ছোট মেয়েকেও বিয়ে দিতে হবে। তারা স্বাবলম্বী হবে, এটা আমার বিশ্বাস৷ আমরা দুইজন মানুষ শুধু বাড়িতে থাকব। এত জমিজমা দিয়ে আমার কোন কাজ নেই, ভাই। আমি বরং জমিগুলো আব্বাকে দেয়ার ব্যবস্থা করি। আব্বা চিরটাকাল এই সংসারে খেটে গেছে। একশো বিঘা জমি থাকার পরও আব্বার নামে কোন সম্পত্তি নেই। সব সম্পত্তি ছেলেমেয়ের নামে লিখে দিয়েছে। পেনশনের কয়টা টাকা দিয়ে আব্বা কিভাবে চলে তার খোঁজ তো কখনো নেইনি। জীবনে বাকি কয়টা দিন আব্বা একটু বিলাসিতা করে কাটাক, ভাই। ”

” আব্বার জন্য তোর কোন চিন্তা করতে হবেনা। প্রয়োজনে আব্বার এ্যাকাউন্টে টাকা রাখব আমি। তুই নিজেরটা ভাব। মেয়েদের বিয়ে দিলেই সব ঝামেলা মিটে যাবে? তোদের চলবে কি করে? কতদিন হাড়ভাঙা খাটুনি করবি? আর একটাও কথা নয়। আব্বার সম্পত্তির ছেলে অধিকার ছেলে হিসেবে তোর আছে। তোর প্রাপ্যটাই তোকে আমি দিয়েছি। ”

এতক্ষণ অবনী রান্নাঘর থেকে বাবা আর চাচার কথা শুনছিল। চাচার কথাগুলো ওর ভালো লেগেছে৷ কিন্তু বাবার একটা কথা শুনে থমকে গেল। উত্তরটা না জানা পর্যন্ত ও শান্তি পাবেনা। নাজমা আক্তার রান্নাঘরে আসলে অবনী প্রশ্নটা করেই বসল,

” বড়মা, বাবা যে বলল দাদুর নামে কোন সম্পত্তি নেই, এটা কি সত্যি? দাদু কি সব সম্পত্তি ফুপুদের লিখে দিয়েছে? ”

” ঠিকই বলেছে তোর বাবা। আব্বার নামে যত সম্পত্তি ছিল, দিনে দিনে সেসব তোর ফুপুরা আব্বাকে চাপ দিয়ে লিখে নিয়েছে। আর তোর চাচাকে কিছুটা দিয়েছেন। তা-ও ভাগে যতটুকু পায়, তার থেকেও কম পেয়েছে। ”

” এমনটা কেন করেছে দাদু? আর দক্ষিণ মাঠের যে জমি ছিল, সেই জমি তো দাদুর নামেই আছে তাইনা? ”

” তোর ফুপুদের যখন প্রয়োজন হয়েছে, তখনই আব্বাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে। আব্বা বাধ্য হয়ে মেয়েদেরকে জমি দিয়েছেন। আর দক্ষিণ মাঠের জমি আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগেই রওশনকে দিয়েছেন আব্বা। ঐ জমিটা না দিলে রওশনকে শ্বশুর বাড়ি থেকে বের দিত। বুঝিসই তো, মেয়ের সংসার বাঁচাতে আব্বা তার হাতে থাকা শেষ জমিটাও হাতছাড়া করেছেন। ”

বড়মার কথা শুনে অবনী বাকহারা হয়ে গেছে। মেডিকেলে ভর্তির আগে দাদু ওকে বলেছিলেন, দক্ষিণ মাঠের জমির টাকাই তিনি অবনীকে দিয়েছেন। কিন্তু আজ এ কি শুনছে ও। তবে সেদিন দাদু অতগুলো টাকা কোথায় পেয়েছিলেন?

” দাদুর কি জমানো টাকা ছিল, বড়মা? কিংবা এখনো আছে? পেনশনের টাকা ছাড়া? ”

” নাহ্। পেনশনের কয়টা টাকা ছাড়া আব্বার কাছে কোন জমানো টাকা নেই। অবশ্য সব সময় আব্বা এমন কর্পদশূন্য ছিলেননা। তার এ্যাকাউন্টেও অনেক টাকা ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে সব টাকা তিনি মেয়েদেরকে দিয়ে দিয়েছেন। ”

” তুমি নিশ্চিত, বড়মা? দাদুর কোন জমানো টাকা নেই? ”

” আমি একশোভাগ নিশ্চিত। আব্বার ব্যাংকের লেনদেন সব আমিই করতাম। তার প্রয়োজনে টাকা-পয়সা আমিই তুলে আব্বার হাতে দিতাম। প্রায় পাঁচ বছর আগে ব্যাংক থেকে শেষ টাকা তুলে আব্বা তার চার মেয়েকে দিয়েছেন। সেটাও আমার হাত দিয়েই। এরপর থেকে আর কোন টাকা তিনি এ্যাকাউন্টে রাখতে পারেননি। অবশ্য ইশু জার্মান যাওয়ার পর আব্বাকে একদিন তার এ্যাকাউন্টের বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিল। ইশু চেয়েছিল, আব্বা যেন এ্যাকাউন্ট চালু করে। ”

অবনী আর কিছু ভাবতে পারছেনা। বড়মার কথায় ও যা বোঝার বুঝে গেছে। ও ভাবতেও পারেনি দাদু ওর সাথে এভাবে ছলচাতুরী করতে পারে। ওর কাছে দাদু এক আদর্শের নাম ছিল। কিন্তু সেই দাদুই ওর সাথে মিথ্যা বলেছে? অবনী কিছু না বলে সরাসরি দাদুর গেল। দাদু বিছানায় বসে তসবিহ পাঠ করছেন। অবনীকে দেখে হেসে ওকে নিজের কাছে ডাকলেন।

” এসো, বুবু। এই অসময়ে আমার কাছে আসলে যে? ”

” আমার সাথে মিথ্যা কেন বলেছ, দাদু? আমার বাবা গরীব ছিল বলে, তুমিও আমাকে করুণা করেছ! সত্যিই কি তুমি আমাদের ভালোবাস? নাকি সবটাই লোক দেখানো? ”

আব্দুর রহিম নাতনির কথা শুনে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকলেন। অবনী কি বলছে সেটা তার বোধগম্য হচ্ছেনা। তার আদরের নাতনী তাকে এভাবে কথা শোনাচ্ছে, এটা তিনি বিশ্বাস করতে পারছেননা৷ কিন্তু এটা সত্য।

” এসব তুমি কি বলছ, বুবু? তুমি আমার কতটা আদরের সেটা পুরো গ্রামের মানুষ জানে। তোমাদেরকে আমি কতটা ভালোবাসি সেটা আর কেউ না জানুক আমার আল্লাহ জানেন। ”

” ভালোই যদি বাসো তবে কেন মিথ্যা বলেছ? কেন আমাকে করুণা করেছ? ”

” কি মিথ্যা বলেছি তোমাকে? আর করুনার কথাই বা কেন আসছে? তুমি ভালো করেই জানো আমি মিথ্যাকে ঘৃণা করি। ”

” ঘৃণা কর? তবে কেন বলেছিলে, দক্ষিণ মাঠের জমির টাকা তুমি আমাকে দিয়েছ? টাকাগুলো নাকি তোমার এ্যাকাউন্টে জমা ছিল? তুমি আমাকে একজোড়া বালা কিনে দিয়েছিলে। বলেছিলে, জমানো টাকা থেকেই দিয়েছ। কানের দুল কিনে দিয়েছিলে । বলেছিলে জমানো টাকা থেকেই দিয়েছ। কিন্তু তোমার এ্যাকাউন্টে কোন টাকা নেই গত কয়েক বছর যাবৎ। এমনকি দক্ষিণ মাঠের জমিও তোমার নেই। তাহলে অতগুলো টাকা কোথায় থাকে আসল, দাদু? ”

নাতনীর প্রশ্নে মাথা নিচু করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন বৃদ্ধ। কিন্তু কোন কথা জোগালনা তার মুখে। দাদুকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আবারও কথা বলল অবনী,

” জবাব দাও, দাদু। কেন মিথ্যা বলেছিলে? জানি তোমার কাছে আমার প্রশ্নের কোন জবাব নেই। তুমি তোমার নাতীকে সমাজের চোখে মহান দেখাতে গিয়ে আমার সাথে মিথ্যা বলেছ। তুমি একবারও ভাবোনি, এতে সম্মানহানি ঘটবে। এই তুমি আমাকে ভালোবাস? ”

” তুমি কি একবার আমার কাছে এসে বসবে? আমার পাশে বসে যত খুশি অপমান তুমি করতে পার। আমি বাঁধা দেবনা। শুধু একটাই অনুরোধ করব, আমার কাছে এসে বস। ”

দাদুর অনুরোধ শুনে অবনী তার কাছে গিয়ে বসল। কিন্তু ও আর কিছুই বলতে পারলনা। রাগে ওর শরীর কাঁপছে। আবার কান্নাও পাচ্ছে। অবনীকে নিরব থাকতে দেখে দাদু আবার কথা বললেন,

” হ্যাঁ, তোমার ভর্তির টাকা, তোমার বালা, কানের দুল কেনার টাকা ইশুই দিয়েছিল। আমি এর আগেও অনেকবার তোমাকে বলেছিলাম, তুমি আর ইশু তোমরা দু’জনই আমার কাছে সমান। তোমাদের দু’জনকে আলাদা চোখে কখনোই দেখিনি আমি। আর কোনদিন দেখবওনা। আজকে তোমাকে একটা গল্প বলি শোন। মন দিয়ে শুনবে। এরপর বিচার করবে, আমি ভুল না সঠিক। চার বছর আগে হুট যখন তোমাদের বিয়ে হল, সেদিন আমি ভিষণ খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু বিয়ের পর থেকে ইশরাকের আচরণ আমাকে হতাশ করে। বিয়ের দুইদিন পর যখন হুট করেই ঢাকা ফিরে গেল, তখন আমি যারপরনাই অবাক হয়েছিলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি সে পড়াশোনার অযুহাত দিল। পরবর্তীতে এক বছর যখন বাড়িতে আসলনা, তখন বিষয়টা আমাকে ভাবিয়েছে। তাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু প্রতিবারই সে আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে। কিছু সন্দেহ সৃষ্টি হল আমার মনে। এরপর একদিন সে বাড়িতে আসল। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম, তুমি ওর থেকে লুকিয়ে থাকছ। দু’জন একবারের জন্যও মুখোমুখি হলেনা। তখন সন্দেহটা আর প্রাগাঢ় হল। আমি ইশুকে চেপে ধরলাম। সেদিন আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেই হল তাকে। সেদিনই আমি জানলাম, একটা বছর কতটা কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেছে সে। প্রতিনিয়ত নিজের সাথে নিজে লড়াই করেছে। ভুলতে চেষ্টা করেছে তার অতীত। এক সময় যে অতীতই ছিল তার সব। একজনের ছলনায় তার গোছানো জীবন অগোছালো হয়ে গেছে। সব শোনার পর ইশু দাদু ভাইয়ের জন্য ভিষণই কষ্ট হয়েছে আমার। আবার পরক্ষনেই যখন শুনলাম, বাসর রাতে সে তোমাকে চরমভাবে আঘাত করেছে, তখন তার ওপর ভিষণ রাগ হয়েছিল। কিন্তু কথাটা ওকে বলিনি। কথায় কথায় সে যখন বলল, সেই রাতে রাগে তার হিতাহিত জ্ঞান ছিলনা, সবকিছুর জন্য তোমাকে দায়ী মনে হচ্ছিল তার কাছে। তাই সে তোমাকে অপমান করেছিল। কিন্তু সেদিন সে তার বাসর রাতের করা কর্মকাণ্ডের জন্য লজ্জিত ছিল। হ্যাঁ, এটা ঠিক সেদিনও তার মনে তোমার জন্য কোন ভালোবাসা ছিলনা। কিন্তু অনুশোচনা ছিল। আমি সেদিন সব চুপচাপ শুনে গেলাম। তাকে কয়েকটা উপদেশও দিলাম। এরপর সে ঢাকা ফিরে গেল। একদিন জার্মান চলে গেল। সে প্রতিদিন আমাকে ফোন দিত। সুযোগ বুঝে আমি তাকে বোঝাতে লাগলাম স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে। নানানভাবে তাকে বোঝালাম। একদিন বুঝতে পারলাম, তোমার সম্পর্কে তার মনোভাব সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। তোমার প্রতি তার রাগ অনেক আগেই বিলীন হয়েছিল। ধীরে ধীরে সেই রাগের জায়গা দখল করল ভালোবাসা। হ্যাঁ, এটাই সত্যি একটা সময় সে তোমাকে ভালোবেসে ফেলল। তোমার সব খবরাখবর আমার কাছ থেকেই নিত। তোমার মেডিকেলে চান্স পাওয়ার কথা শুনে, সে কি খুশি। আমাকে বলল, তোমার পড়াশোনার সব খরচ সে-ই দিতে চায়। স্বামীর দ্বায়িত্ব পালন করতে চায়। তোমাকে যেন যেভাবেই হোক ম্যানেজ করি। আমিও সেদিন এক মিথ্যা গল্প ফাঁদলাম। একদিন যখন গল্পে গল্পে তাকে জানালাম, তোমার বিয়ের প্রস্তাব আসছে। তখন তার কি রাগ। আমাকে দিয়ে একজোড়া বালা কেনালো। এরপর কানের দুল, রিং। প্রতিমাসে আমার এ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে শুরু করল। যে ছেলেটা নিজের খরচ চালানোর জন্য টুকটাক কাজ করত, সেই ছেলেটাই একদিন স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হাড়ভাঙা খাটুনি শুরু করল। নিজের ঘুমের জন্য চার ঘন্টা সময় বরাদ্দ রেখে বাকিটা সময় পড়াশোনা আর কাজের জন্য রাখল। স্ত্রীর আশেপাশে তৈরী করল অদৃশ্য বলয়। কোন কুদৃষ্টি কিংবা কুচক্রী সেই বলয় ভেদ করতে পারলনা। নিজের বন্ধুদের সাহায্যে তোমার জন্য চারজন ছাত্র খুঁজে দিল। তুমি ভেবে নিলে সাদাফ দাদু ভাই তোমার জন্য টিউশনির ব্যবস্থা করেছে। তুমি জানতেও পারলেনা, ইশু দাদু ভাই জার্মান থেকেও তোমার জন্য সবরকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা করল। তোমার মনে আছে, একদিন তোমাকে বলেছিলাম, দাদু ভাই দূরে থেকেও তোমার ওপর যে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, আমরা তোমার কাছে থেকেও তার কিছুই করতে পারবনা? দাদু ভাই সেটাই করেছে। সে সূদুর জার্মান বসে, তোমার ভালোর জন্য যা যা প্রয়োজন সবটাই করেছে। শুধু তোমাকে ভালোবাসে বলে করেছে। আর আমি শুধুমাত্র আমার নাতীর ভালোবাসার স্ত্রীকে ভালো রাখতে তার কথামত কাজ করেছি। যে একবার ভুল করে পরবর্তীতে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়, ভবিষ্যতে কোন ভুল না করার প্রতিশ্রুতি করে, তাকে ক্ষমা করাই যায়। একটা সুযোগ তাকে দেয়াই যায় বলে আমার মনে হয়েছিল। তাই তার কথামত কাজ করেছি আমি। এর জন্য তোমার কাছে আমাকে মিথ্যা বলতে হয়েছে। আমি নিরুপায় বলেই সেটা করেছি। এবার বল, আমি ভুল কিছু করেছি? আমি তোমাকে ভালোবাসিনা? ”

দাদুর সব কথা শুনে অবনীর মাথা ঘুরতে লাগলো। এত বছর পর এসব কি শুনছে ও? ইশরাক নাকি ওকে ভালোবাসে! এ-ও সত্যি?

” যে মানুষ ছয় বছরের ভালোবাসা অতি সহজেই ভুলে যায়, আর যাইহোক সে অন্য কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসতে পারেনা। এটা আমি বিশ্বাস করিনা। ”

” ছয় বছরের ভালোবাসা! যে মেয়েটা ওর সাথে ছলনা করেছে, ওকে ধোঁকা দিয়েছে, সেই মেয়েটাকে ভালোবাসা যায়? তাকে শুধুমাত্র ঘৃণা করা যায়। হ্যাঁ দাদু ভাই প্রথম প্রথম কষ্ট পেত। হাজার হোক কিশোর বয়সের প্রেম, সহজেই ভোলা যায়না। সেও পারেনি। কিন্তু তাই বলে, একজন ছলনাময়ীকে আজীবন হৃদয়ের মনিকোঠায় রেখে দেবে সেটাও কি সম্ভব? যেখানে অবনীর মত তার একজন স্ত্রী আছে। তুমি একবারও ভেবে দেখেছ, একটা ছেলে তার ছয় বছরের ভালোবাসা হারিয়েছে, সে কি অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে? সে কোন পরিস্থিতিতে তোমার সাথে দূর্ব্যবহার করেছে? তার মানসিক অবস্থা তখন কেমন ছিল? ঐ দুঃসময়ে তার পাশে কি কেউ ছিল? কেউ তাকে শান্তনা দিয়েছে? তুমি সবাইকে পাশে পেয়েছ। এমনকি বড় বউমাও তোমাকে আগলে রেখেছে। কিন্তু ইশু দাদু ভাইয়ের পাশে কে ছিল? সে কাউকে জানাতেও পারেনি। একা একাই দগ্ধ হয়েছে। কিভাবে সে পরিস্থিতিটা সামলে উঠেছে এটা একবারও ভেবেছ? এখানে কি তুমি স্বার্থপরের পরিচয় দাওনি? তোমার উচিত ছিলনা স্বামীর খোঁজ নেয়া? ”

দাদুর কথা শুনে নির্বাক অবনী ছলছল নয়নে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে। সত্যিই তো ও একবারও ইশরাকের কথা ভাবেনি। সেই কঠিন দিনগুলো সে কিভাবে কাটিয়েছে সেটা একবারও ভাবেনি। সব সময়ই নিজের অপমান নিয়ে ভেবেছে। সত্যিই কি ও স্বার্থপর? হঠাৎই অবনী উপলব্ধি করল ওর চোখে পানি এসেছে। কিন্তু কেন? চোখ মুছে দাদুর দিকে তাকাল অবনী।

” বেশ করেছি। সবকিছুর জন্য সে আমাকে কেন দায়ী করল? তার তো অনেক বুদ্ধি। সে কেন ভাবলনা, অবনী আর যাই করুক, তার সাথে কখনো মিথ্যা বলেনা? বাকি সবার চেয়ে তাকেই অবনী বেশি ভরসা করত। তার সব কথাই অবনী মেনে চলত। কেন ভাবলনা সে? একতরফা আমাকেই দোষী করল কেন? আমি তাকে কতবার বলেছিলাম, আমি কিছুই জানতামনা। কিন্তু সে আমার কথা বিশ্বাস করলনা। সে কি আমাকে জানতনা? ” চোখ মুছে অবনী রুম থেকে বেরিয়ে আসল। রুম থেকে বেড়োতেই দেখল ইশরাক দাদুর রুমে ঢুকছে। চোখাচোখি হল দু’জনের। অবনী নিজের দুঃখ বিলাস করতে গিয়ে বুঝতেও পারলনা এতক্ষণ ইশরাক দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল।

চলবে…