#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_২২
জাওয়াদ জামী জামী
” তুই দাদুর সাথে ঐভাবে কথাগুলো না বললেও পারতিস। দাদু যা করেছে, আমার কথায় করেছে। আজ আমার জন্য দাদুকে কষ্ট পেতে হচ্ছে। কেন করলি, অবনী? ”
অবনী নিজের ঘরে এসে চার বছর আগে থেকে বর্তমানের সব ঘটনা ভাবছে আর কাঁদছে। ওর কল্পনায়ও ছিলনা, দাদু ইশরাকের কথা ভাবতে গিয়ে, ওদের দু’জনকে মেলাতে গিয়ে ওর আত্নসম্মানে আঘাত করবে। কিন্তু ইশরাকের কথাগুলো ওর ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায়। দেশে আসবার পর এই প্রথম ইশরাক ওর সাথে সরাসরি কথা বলল। চোখ মুছে ঘুরে তাকাল অবনী। মুখোমুখি হল ইশরাকের। মুখে হাসি এনে বলল,
” আপনাদের সবারই চাওয়ার মূল্য আছে, বিবেক আছে, আত্নসম্মান আছে। কিন্তু এই অবনীর কিছুই থাকতে নেই, তাইনা? শুধুমাত্র একজন মেয়ে বলে আমাকে করুণা করেছেন আপনারা? নিজে সরাসরি কিছু করতে পারবেননা জেনে দাদুকে হাত করেছেন বুঝি? ভেবেছিলেন কথাগুলো কোনদিনও ফাঁস হবেনা, গোপনই থেকে যাবে! একটা কথা জানেনতো, সত্য কখনো চাপা থাকেনা। আপনি মহান হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য আপনার সহায় হলোনা। আশা করব, একই ভুল ভবিষ্যতে করবেননা। কারন অবনী আর পাঁচজন মেয়ের মত নয়, যারা টাকা আর খ্যাতিকেই জীবনে সবকিছু মনে করে। ”
কথার মাঝেই অবনী হাত থেকে বালাগুলো খুলল, এরপর খুলল কানের দুল। তারপর হুট করেই সেগুলো ইশরাকের হাতে ধরিয়ে দিল।
” সবকিছু জানার পর, আপনার দেয়া যেকোন কিছু নিতে আমার ঘৃণা করবে। এ পর্যন্ত যত টাকা আপনি আমাকে দিয়েছেন, সব টাকাই আমি ফিরিয়ে দেব। ভালো করে শুনে রাখুন, অবনী গরীবের মেয়ে হতে পারে, কিন্তু লোভী নয়। আমার বাবা-মা আমাকে অন্যের জিনিসের প্রতি নজর দিতে শেখায়নি। আর মিথ্যা বলতেও শেখায়নি। ”
অবনীর কথা শুনে ইশরাকের ভেতরটা শুকিয়ে গেল। ও বুঝতে পারেনি বিষয়টা নিয়ে অবনী এভাবে রিয়্যাক্ট করবে। সে তো ভালোবেসে স্ত্রীর দ্বায়িত্ব পালন করতে চেয়েছিল। নিজের ভুল শোধরাতে চেয়েছিল। ভেবেছিল, দেশে এসে অবনীর কাছে ক্ষমা চাইবে। যতক্ষণ পর্যন্ত অবনী ক্ষমা না করবে ততক্ষণ ও হাল ছাড়বেনা। যে করেই হোক তার রমনীকে জয় করেই ছাড়বে। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল!
” অবনী, প্লিজ এমনটা করিসনা। স্বীকার করছি আমি অন্যায় করেছিলাম। তোর ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিলাম। যেটা করা আমার উচিত হয়নি। বিশ্বাস কর, সেগুলো আমার মনের কথা ছিলনা। প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল আমার। প্রত্যাখ্যাত হয়ে নিজের বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলাম। কতটা যন্ত্রণায় ছটফট করেছি আমি, সেটা আর কেউ জানেনা। তুই তো সবকিছুই জানতিস? একবারও ভেবে দেখেছিস, কার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম আমি? যখন সদ্য জন্মানো ব্যথার দহনে প্রলেপ স্বরূপ মা তোকে দিতে চাইল। ভিষণ রাগ হলো আমার। ভাবলাম, তুই সবকিছু জানতিস কিন্তু আমাকে জানাসনি। দোষী করলাম তোকে। একবারও ভাবলামনা, শুরু থেকেই তুই আমার সাথ দিয়েছিলি, সেই তুই কখনো আমার সাথে বেইমানী করবিনা। একজন বেইমানের ভালোবাসা বুকে পুষে রেখে তোকে আঘাত করলাম। জীবনের সবথেকে বড় ভুলটা করলাম। যার খেসারত আজও দিতে হচ্ছে আমাকে। আমি হারিয়ে ফেললাম দুরন্ত সেই অবনীকে। তুই হারালি কৈশোর, হারালো তোর হাসি, বদলে গেল তোর জীবন। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি এসব চাইনি। যখন রাগ পরে গেল, তখন বুঝলাম কতবড় সর্বনাশ ঘটে গেছে। দিনের পর দিন দাদু আমার কাছ থেকে জানতে চাচ্ছিল, কেন আমি বাড়িতে আসিনা? একদিন দাদুকে সবকিছু খুলে বললাম। সবকিছু শুনে দাদু আমাকে ভিষণ বকলেন। বারবার আমাকে বোঝালেন, আমি অন্যায় করেছি। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য কি তার কাছ থেকেই শিখলাম। একটা সময় উপলব্ধি করলাম, তোকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। জীবন থেকে মুছে গেছে রিশা নামক বেইমান। নিজের কৃতকর্মের জন্য মরমে মরে যেতে ইচ্ছে করত। একটা সুযোগ আমাকে দিতে পারিসনা, অবনী? দেখবি, আদর্শ স্বামী হয়ে উঠব আমি। প্লিজ ফিরিয়ে দিসনা আমাকে। ”
” আমি কেন? কেন আমার দিকেই সবাই আঙ্গুল তোলে? ভালোবেসেছিলেন আপনি, ধোঁকা খেয়েছেন আপনি, কষ্ট পেয়েছেন আপনি, কিন্তু আঙ্গুল কেন আমার দিকেই উঠল? শুধুমাত্র কয়েকটা কথা জানতাম বলে? আপনার কষ্ট আমি ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। কিন্তু আপনি শুধু নিজেরটাই দেখেছেন। আমাকে বোঝেননি। রাগ শুধু আপনারই নেই, অন্যরাও রাগ করতে জানে, অন্যদেরও আত্নসম্মান আছে। কখনো কখনো দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সেই আত্নসম্মানই রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আপনি নিজের স্বার্থে আমার সেই আত্নসম্মানও ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেন। কেন করলেন এমনটা? আপনি স্বার্থপর, নিজেরটা ছাড়া আপনি কিছুই বোঝেননা। নিজের প্রতি যে বিশ্বাস আমার ছিল, সেটাও আপনি ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। আপনি আমাকে ধোঁকা দিয়েছেন। আমি আপনাকে কোনদিনও ক্ষমা করবনা। কোন সুযোগ আপনাকে দেবোনা। ” কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পরল অবনী।
স্তব্ধ, হতভম্ব ইশরাকও অবনীর মুখোমুখি বসল। দু’হাতের আঁজলায় তুলে ধরল অবনীর মুখ। ওর দু’চোখ বেয়ে ঝরছে অশ্রুদল।
” এভাবে বলিসনা। মরে যাব আমি। কয়টা বছর তোকে না দেখে পাগল হয়ে গেছিলাম আমি৷ তোকে ছাড়া আর একটা দিন কাটানো আমার পক্ষে অসম্ভব। তোকে না দেখে এক মুহূর্ত কাটানোও অসম্ভব। আজকের পর থেকে তোর কোন বিষয়ে আমি মাথা ঘামাবনা। তুই তোর মত করে চলবি, বাঁচবি। শুধু আমার থাকিস তুই, এতেই খুশি আমি। ”
ইশরাকের কথার উত্তর দিলনা অবনী। ও কাঁদছে। কাঁদছে ইশরাকও। ওর চোখে ভালোবাসা হারানোর ভয় জেঁকে বসেছে। বুকের ভেতর হার্টবিটেরা ডামাডোল পেটাচ্ছে। ভয় হচ্ছে, যদি অবনী বেঁকে বসে? ইশরাকের দু’হাতের আঁজলায় বন্দী অবনীর কোনদিকে হুঁশ নেই। ও অঝোরে কাঁদছে। ইশরাক আবেগে, ভালোবাসায় ছুঁল অবনীর গাল। কান্নারত অবনী বুঝতে পারলনা শক্ত হয়ে গেছে ইশরাকের দু’হাতের আঁজলা। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল অবনীকে,
” একবার কথা দে আমার থাকবি? আমি কখনোই তোকে বিরক্ত করবনা। আমার কোন অধিকারবোধ তোকে আটতে রাখবেনা কোন কিছুতেই। ”
এবার যেন হুঁশ ফিরল অবনীর। ও এক ঝটকায় সরিয়ে দিল ইশরাকের দু’হাত। ধাক্কা দিয়ে ইশরাককে সরিয়ে দিল। ব্যালেন্স রাখতে না পারায় ইশরাক মেঝেতে পরে গেল। দু’হাতে চোখ মুছল অবনী। কড়া গলায় বলল,
” কোন প্রতিশ্রুতি আপনাকে দেবোনা আমি। আমার কাছে আপনি একজন ধোঁকাবাজ বৈই আর কিছুই নন। আর একজন ধোঁকাবাজকে নিজের জীবনের সাথে কিছুতেই আমি জড়াবনা। আমি চাইনা, আপনি আমার কিংবা আমার পরিবারের লোকজনের আশেপাশে থাকেন। আপনাকে দেখলেই নিজের প্রতি আমার ঘৃণা জন্মাবে বারবার। ”
ইশরাক ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে থাকল অবনীর দিকে। আজ ওর ভেতরে কোন রাগের জন্ম নিলনা। ব্যর্থতায় ছেয়ে গেল ভেতরটা। ভয় হচ্ছে হারানোর। তবুও হাল ছাড়লনা। গলায় আবেগ ঢেলে বলল,
” এই কথা বলিসনা। তোকে বোঝাতে পারবনা, তুই আমার জীবনে কি। চাচা-চাচীকে বাবা-মা থেকে কোন অংশেই কম ভাবিনা আমি। তোদের ছেড়ে থাকার কথা আমি ভাবতেও পারিনা। আচ্ছা, কোন প্রতিশ্রুতি তোকে দিতে হবেনা। আমাকে শুধু তোদের আশেপাশে থাকবার অনুমতি দিস, তাতেই হবে। ”
” আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যান। আর কোনদিনও এই ঘরে আপনি আসবেননা। ”
ইশরাক অসহায় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল অবনীর দিকে। অবনীর চোখে শুধু রাগ দেখল সে। চোখ মুছে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
***
” ইশু, তোকে কাল কতবার খেতে ডাকলাম কিন্তু তুই আসলিনা। তোর চাচা তোর সাথে খাবে বলে অপেক্ষা করছিল। আসলিনা কেন বলতো? আর ভরা সাঁঝে কোথায় যাচ্ছিস? দুইদিন থেকে দেখছি, তুই বাড়তেই থাকছিসনা। রাতে তোর চাচা তোকে সাথে নিয়ে খাবে। যেখানেই থাকিস, খাবার আগে বাড়িতে আসিস। ” ইশরাক বাড়ির বাহিরে যাচ্ছিল। তখনই ওকে জিজ্ঞেস করলেন মিনারা খাতুন।
” ঘুমিয়ে ছিলাম, চাচী। এরপর থেকে চাচাকে আমার জন্য অপেক্ষা করতে নিষেধ কর। আমি কখন কোথায় থাকব তার ঠিক নেই। আজকেও আমার আসতে রাত হবে। ”
” এটা কি বললি তুই? তোর জন্য হাঁসের মাংস রান্না করেছি। তোর চাচা সকাল থেকেই বলছে রাতে তোর সাথে খাবে। আর তুই বলছিস আসতে দেরি হবে? ”
” আমি নিরুপায়, চাচি। রাগ করোনা। ঢাকা থেকে ফিরলে চাচার সাথে খাব। ”
” ঢাকা যাচ্ছিস তুই? কবে? ”
” সকাল দশটার গাড়িতে। ”
” হঠাৎ করেই কেন যাচ্ছিস? আগে বলিসনিতো? ”
” চাকরির ব্যাপারে কথা বলতে যেতে হবে। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি থেকে ডেকেছে। ”
” খুব ভালো কথা। কবে আসবি? ”
” বলতে পারছিনা। ”
” তোর কি মন খারাপ, ইশু? কেমন মনমরা লাগছে তোকে। ”
” না চাচী, আমি ঠিক আছি। এখন আসছি। যাওয়ার আগে তোমার সাথে কথা বলব। ” ইশরাক চাচীর উত্তরের অপেক্ষা না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দায় বসে সবটাই শুনল অবনী।
***
” অবনী, এই পিঠাগুলো একটু বানিয়ে দে, মা। একা হাতে আমি আর কত কাজ করব বল? তোর মাকে রান্না করতে লাগিয়ে দিয়েছি। তুই পিঠাগুলো বানিয়ে দে। আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা। ”
” তুমি সরে বস। আমি পিঠা বানাচ্ছি। শরীর খারাপ, তাহলে রান্নাঘরে আসার দরকার কি, বড়মা? ”
” দরকার আছে জন্যই এসেছি। মানুষের ছেলের বউ শ্বাশুড়িকে আম্মা, মা আম্মু ডেকে মুখে ফেনা তোলে। আর আমার পোড়া কপালে মা ডাক জুটলনা। তুই শ্বাশুড়িকে একবারও ‘ মা ‘ ডাকলিনা। তোর মুখে শ্বাশুড়িকে ‘ মা ‘ ডাকলে কেমন শোনায় সেটা আজও জানা হলোনা। ” আক্ষেপ করে বললেন নাজমা আক্তার।
” এক কাজ কর, আমাকে দেখেশুনে একটা বিয়ে দাও। তখন শুনতে পাবে, শ্বাশুড়িকে কিভাবে ‘ মা ‘ ডাকি। আমিও শ্বাশুড়িকে ‘ মা ‘ ডাকতে পারব আবার তোমার শোনাও হয়ে যাবে। ”
কথাটা মজার ছলেই বলল অবনী। এদিকে বাড়িতে ঢুকেই অবনীর কথাগুলো ইশরাকের কানে গেল। ইশরাক কপাল কুঁচকে তাকাল অবনীর দিকে। হঠাৎ কি মনে করে অবনী তাকাল ড্রয়িংরুমের দিকে। সেখানে ইশরাককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ সরিয়ে নিল। ইশরাক নিজের রুমে গিয়ে পায়চারী করছে। অবনীর কথা শুনে ওর রাগ হচ্ছে। ওর মুখে বিয়ের কথা শুনে ইশরাকের কপালের একপাশের শিরা দপদপ করছে। সবকিছু ভেঙে চুরমার করতে ইচ্ছে করছে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে হাতের কাছে থাকা ফুলদানী তুলে মেঝেতে আছাড় মারল।
এদিকে নাজমা আক্তারও অবনীর কথা শুনে থতমত খেয়ে গেছেন। এই মেয়েটা হাসতে হাসতে এত কঠিন কথা সহজেই বলে দিল দেখে তিনি অবাক হয়েছেন। তিনি অবনীর দিকে তাকালেন। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করলেন।
চলবে…