#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_২৫
জাওয়াদ জামী জামী
” ইশু, আজকেই যে ঢাকা যাবি, তোর ইন্টারভিউ কবে? ”
” ঠিক তিনদিন পর। কেন, মা? হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করছ যে? ”
” আজকে না গেলে হয়না? এই তিনদিন থাকবি কোথায়? নিশ্চয়ই হোটেলে? ইন্টারভিউ এর আগের রাতে চলে যাস। তুই কি নিশ্চিত এই চাকরিটা তোর হবে? আগের রাতে গেলে কোন অসুবিধা হবে? ”
” হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত। আচ্ছা, তুমি যখন বলছ তখন আগের রাতেই যাব। ”
” কোন পদে তোকে নিতে চাইছে? সেটাতে কি তুই কমফোর্ট ফিল করবি? ” ইসহাক আজাদ জিজ্ঞেস করলেন। ”
” রিসার্চ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার এর জন্য তারা অনুরোধ করেছে। আশা করছি কাজ করতে পারব। তবে বাবা, জার্মানের একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি থেকে আমাকে ডেকেছে। তারা খুব করে চাচ্ছে আমি তাদের সাথে কাজ করি। অফিস থেকেই বাড়ি, গাড়ি সব দেবে। স্যালারিও মন্দ নয়। কি করি বলতো? ”
” তুই কি চাচ্ছিস? তোর জীবন, সিদ্ধান্তও তোর। ”
” আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। একবার মনে হচ্ছে দেশেই থাকি, তো পরক্ষণেই আবার মনে হচ্ছে এই দেশে কোন কাজেরই যথাযথ সম্মান কিংবা মূল্য নেই। এখানে ক্যারিয়ার গড়তে গেলে পদে পদে বাঁধা আসবে। চারপাশে ধনী হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখে আমি হতাশ হই। ”
” তাহলে জার্মান চলে যা। আমরা চাই তুই সফল হ। ”
” আমি দেশের জন্য কিছু করতে চাই, বাবা। তাই অন্য কোথাও যেতে মন সায় দেয়না। ”
” আমি বলি কি, তুই কিছুদিন দেশেই চাকরি কর। ছয়মাস পর যদি ভালো না লাগে, ঠিকমত সুযোগসুবিধা পাচ্ছিসনা তখন বাহিরের দেশে যাস। ”
” তোর বাবা ঠিক কথাই বলেছে। এখানে কিছুদিন কাজ কর। তারপর সিদ্ধান্ত নিস। আর চাকরিতে জয়েন করেই একটা ফ্ল্যাট দেখবি। অবনীর মেডিকেলে যাতায়াতে সুবিধা হয় এমন জায়গায় নিবি। অবনী, তুই আর কয়দিন গ্রামে থাকবি? ”
” আরও পনেরদিন থাকব। ”
” তুমি এইডা কি কইলা? তোমার কি আক্কেল জ্ঞান কিছুই নাই? পোলাডার এখনো চাকরি হইলোইনা আর তুমি হেরে বাড়ি নিবার কইতাছ? আবার এই ছেমরিরেও রাখবার চাইতাছ সেইখানে? ইশু, কয় ট্যাকা বেতন পাইব সেইডা কি তুমি জানো? সেইসব না জাইনাই আগেই এই ছেমরির সংসার পাতনের চিন্তা করতাছ তুমি? ঐ ছেমরির নতুন বাড়িতে থাকন লাগব ক্যান? ” কুলসুম বেগম বরাবরের মতোই বাগড়া দিল।
” আমার আক্কেল-জ্ঞান, বিবেক-বিবেচনা সবই আছে। আমার ছেলে বিদেশ থেকে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। ওর চাকরিও ভালো প্রতিষ্ঠানে হবে সেটা আমি জানি। আর ও কয় টাকা বেতন পাবে, সেটা ওর ব্যাক্তিগত বিষয়। কম টাকা বেতন পেলেও ওকে বউ নিয়ে থাকতে হবে, বেশি টাকা বেতন পেলেও বউ নিয়েই থাকতে হবে এতদিন পড়াশোনার জন্য বাহিরে ছিল তাই বউ নিতে পারেনি। এখন চাকরি করবে তাই বউ অন্য কোথাও থাকবে কেন? আবার অবনী ওর সাথে থাকলে ইশুর খাওয়ার সমস্যা হবেনা। অবনীরও তাই। মেয়েটা হোস্টেলে গেলেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। ইশু, আমি কি বলেছি বুঝতে পেরেছিস? ” শ্বাশুড়ির কথাকে মোটেও পাত্তা দিলেননা নাজমা আক্তার।
” ঠিক আছে, মা। আগে তাদের সাথে কথাবার্তা বলি। কাজে জয়েন করি। এরপর ফ্ল্যাট দেখব। দাদী, তুমি ঢাকা যাওয়ার জন্য তৈরী থাক। আমার নতুন বাসা গুছিয়ে দিতে হবে তোমাকে। কি পারবেনা? ”
” পারন তো লাগবই। ” কুলসুম বেগম মুখ কালো করে বলল।
***
” তুমিও কি ইশু ভাইয়ার সাথেই ঢাকা যাবে? ”
” কেন? আমি ঢাকা গেলেই বুঝি তোর সুবিধা হয়? পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিনরাত বন্ধুদের সাথে হৈচৈ করতে পারবি। আমি থাকলে সেটা করতে পারছিসনা। এজন্যই আমার যাওয়া নিয়ে এত উতলা হচ্ছিস? ”
সাদাফের কথা শুনে আকাশ থেকে পরল অর্নি। ও ভালোভাবে একটা কথা জিজ্ঞেস করল, কিন্তু সে অর্নির কথার উল্টো মানে বের করল! কিন্তু অর্নি সাদাফের ওপর একটুও রাগ করলনা। কেন যেন ও সাদাফের ওপর রাগ করতেই পারেনা।
” অপবাদ দেবেনা বলে দিলাম। আমি মোটেও বন্ধুদের সাথে হৈচৈ করিনা। এমনকি আমার ফোন নম্বরও কেউ জানেনা। তুমি আগেই আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলে। তাই কারও সাথেই আগ বাড়িয়ে বন্ধুত্ব করতে যাইনা। ”
” আমার কথা মনে রেখেছিস জন্য ধন্যবাদ। তোর পরীক্ষা শুরু হলে আমি ঢাকা যাব। প্রথমদিন পরীক্ষা কেন্দ্রে আমি তোকে নিয়ে যাব। ”
” আমিও এটাই চাচ্ছিলাম। তুমি আমার সাথে না গেলে আমার ভয় লাগত। ”
” কেন আমি কি তোর ভয় রোধকারী মেডিসিন? ”
” জানিনা। তবে তুমি আশেপাশে থাকলে সাহস পাই। ”
” বাব্বাহ্ মেয়ে দেখছি বড় হয়ে গেছে! আকারইঙ্গিতে এ্যাডাল্ট কথাবার্তা বলার চেষ্টা করছে! চাচী জানে, তার মেয়ে তলে তলে সিএনজি চালাচ্ছে? ” সাদাফ দুষ্টু হেসে তাকিয়ে আছে অর্নির দিকে।
এদিকে সাদাফের কথা শুনে অর্নি পারলে লজ্জায় মাটিতে মিশে যায়। লোকটা আজকাল অর্নিকে লজ্জা পাইয়ে দেয়।
” আপনি এই ধরনের কথা বললে, আমি আপনার সাথে আর কখনোই কথা বলবনা। ”
” আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবি? ”
” খুব পারব। ”
” ওকে। পরীক্ষা শুরু হোক তাহলে? তাহলে এখন থেকে কাল সারাদিন তোর সাথে কোন কথা নেই। দেখি কেমন থাকতে পারিস। ”
সাদাফের কথা শুনে অর্নি ওর দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল। কত সহজেই লোকটা বলে দিল কাল পর্যন্ত কথা বন্ধ থাকবে! সে কি জানেনা তার সাথে কথা না বললে অর্নির দম বন্ধ হয়ে যায়? তারপরও সে কেন এই কথা বলল? কষ্টের নোনাজল চোখের কোনে এসে জমা হল। অনেক কষ্টে তাদের ঝরে পরা থেকে আটকে রাখল অর্নি। ভাঙ্গা গলায় বলল,
” তুমি পারলে আমিও পারব। ” এরপর বেরিয়ে গেল সাদাফের রুম থেকে।
সাদাফের চোখে অর্নির চোখের পানি ঠিকই ধরা পরেছে। অর্নির ছেলেমানুষী দেখে হাসল সাদাফ। ও নিজেও অর্নির সাথে কথা না বলে থাকতে পারবেনা জেনেও অর্নিকে কথাটা বলেছে। এখন দেখার বিষয় কে আগে কথা বলে।
সাদাফের রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই ইশরাকের সাথে ধাক্কা খেল অর্নির।
” আউচ। আস্তে হাঁট। এভাবে ঘোড়ার মত দৌড়ে দৌড়ে হাঁটছিস কেন? ”
” তুমি আমার সামনে আসলে কেন? দেখতে পাওনি আমি আসছি? ”
” একে তো তুই আমাকে ধাক্কা দিয়েছিস, তারওপর আমাকেই কাঠগড়ায় তুলছিস? অর্ন, তুই তো দেখছি ভিষণ বেয়াদব হয়েছিস? বড় ভাই প্লাস দুলাভাইকে অসম্মান করছিস তুই! আমি বেঁকে বসলে তোর বিয়ে হবেনা এটা কি তুই জানিস? ”
” আগেতো নিজের বউকে সামলাও তারপর আমার বিয়ের কথা চিন্তা কর। তুমি কি ভেবেছ, তোমাকে দেখলেই যে তোমার বউয়ের মুখটা প্যাঁচার মত হয়ে যায়, সেটা আমি লক্ষ্য করিনি? আবার তুমিও তোমার বউকে দেখলে আশেপাশের সবার সাথে ভেজা বেড়ালের মত আচরণ কর সেটাও কিন্তু আমি জানি। ”
” তুই অনেক কিছুই জানিস, বইন। মাফ করে দে। আর জীবনেও তোর বিয়ের কথা মুখে আনবনা। যা ভাগ। কিন্তু আমিও যে অনেককিছুই জেনে গেছি, এটা কাকে বলি বলতো? তাই বাঁচতে চাইলে আমাকে হুজুর হুজুর করবি। দিনে তিনবার সালাম দিবি। এসবেই তোর মঙ্গল। ”
ইশরাকের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলনা অর্নি। চোখে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকল ইশরাকের দিকে। কিন্তু ইশরাক ওর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের রুমে গেল।
***
রুমে এসে অবনীকে আলমারি গোছাতে দেখল ইশরাক। ওকে দেখতে পেয়ে অবনী নিজের কাজে আরও গভীরভাবে মনযোগী হল। ইশরাকও কম যায়না। অবনীকে আরও কাছ থেকে দেখার জন্য সে-ও গেল আলমারির কাছে। যেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু খুঁজছে এমন ভান করে এলোমেলো করতে থাকে অবনীর গোছানো কাপড়চোপড়। ইশরাকের এমন কাজে বিরক্ত হল অবনী।
” ধ্যাত্তেরি, এমন ঝামেলা করে কেন? আমি সব কাপড়চোপড় এভাবেই রেখে দেব বলে দিচ্ছি। কাজের মধ্যে এসে অকাজ করছে। যতসব বিরক্তিকর লোকজন। ”
” আমি আবার কি করলাম! একটা জরুরি কাগজ খুঁজছিলাম। ঠিক আছে তোর যদি আমার কাজ পছন্দ না-ই হয়, তবে থাক। লাগবেনা আমার কোন জরুরি কাগজ। আমি বেকারই থেকে যাব। ডক্টর বউয়ের পয়সায় হেসেখেলে জীবনটা কাটিয়ে দেব। লোকে মন্দ বলবে, উপহাস করবে করুক। তাতে আমার কি? আমিতো বউয়ের সুবিধার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ কাগজটা হেলায় হারিয়েছি। ”
ইশরাকের কথা শুনে রাগে জ্বলে উঠল অবনীর শরীর। ওর চোখমুখ গরম হয়ে গেছে। ঝট করে উঠে দাঁড়াল।
” নিন খুঁজুন আপনার সো কোল্ড গুরুত্বপূর্ণ কাগজ। যদিও আমি এখানে কোন কাগজ দেখিনি কিংবা রাখিনি। আপনি আপনার গায়েবি কাগজ খুঁজে বের করে নিজের কলিজায় শান্তি দিন। ”
অবনীকে রাগতে দেখে দু পা পিছিয়ে গেল ইশরাক। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলল,
” গায়েবি কাগজ, ভালো বলেছিস। তুই একটু দোয়া পড়ে আমার মাথায় ফুঁ দিলেই গায়েবি কাগজটা খুঁজে পাব আমি। দে ফুঁ দিয়ে দে। ” ইশরাক মাথা এগিয়ে দিল অবনীর দিকে
” অসহ্য। ” অবনী মেঝেতে সব কাপড়চোপড় রেখেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
অবনী বেরিয়ে যেতেই ইশরাক মৃদু হেসে আলমারি গোছাতে শুরু করল।
চলবে…
#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_২৬
জাওয়াদ জামী জামী
” মা, এত বছর পর আবার কিসের অনুষ্ঠান বলতো? মানুষজন কি বলবে? ”
” তুই চুপ থাক। মানুষজন যা বলে বলুক। তোদের বিয়ে হুট করেই হয়েছিল। আমার ইচ্ছে ছিল তোদের বিয়েতে বিশাল আয়োজন করব। গ্রামের প্রতিটা মানুষকে দাওয়াত করব। কিন্তু পরিস্থিতির কারনে সেটা হয়ে ওঠেনি। এবার যখন সুযোগ এসেছে, তখন আমি অনুষ্ঠান করবই। এবং সেটা ইশু ঢাকা যাওয়ার আগেই। তুই লিষ্ট কর কাকে কাকে দাওয়াত করবি। আর আজ বিকেলেই তোরা চারজন মিলে শহরে যাবি। বিয়ের কেনাকাটা করবি। ”
নাজমা আক্তারের ধমক খেয়ে অবনী চুপ করে গেল। ও বুঝতে পারছে বড়মা যখন বলেছে অনুষ্ঠান করবে, তখন তাকে আর থামানো যাবেনা।
” অবনী, তুই এখানে কি করছিস, মা? বাহিরে গিয়ে দেখ লিষ্ট অনুযায়ী সব বাজারগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা। তবে তার আগে আমাকে এক গ্লাস পানি দিয়ে যা। যা গরম পরেছে। সেদ্ধ হয়ে গেলাম গরমে। ” ইসহাক আজাদ গরমে হাঁপিয়ে উঠেছেন। তিনি সোফায় বসলেন।
” আরও যাও বাজারে। তোমাদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, টাকা রাখার জায়গা পাচ্ছনা। শখ কম নয় তোমাদের। টাকাগুলো এভাবে খরচ না করে মাকে গহনা বানিয়ে দিতে পারতে। কিংবা জমি কিনতে পারতে। কিন্তু না তোমরা ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান করবে, তা-ও আবার বিয়ের চার বছর পর। ”
” তোকে চুপ থাকতে বলেছিনা? চুপচাপ যা যা করতে বলেছি কর। যা তোর চাচাকে পানি এনে দে। ফাজিল মেয়ে, খালি অনুষ্ঠান বন্ধের বাহানা খোঁজে। ” আবারও ধমকে উঠলেন নাজমা আক্তার। বড়মার ধমকে সুড়সুড় করে পানি আনতে গেল অবনী।
” নাজমা, তোমার বাবার বাড়ির লোকজনকে দাওয়াত দেবেনা? এদিকে প্রায় সবাইকেই দাওয়াত দেয়া হয়েছে। শুধু আমার শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত দেয়া বাকি আছে। ”
” দিতে হবেনা। ওদের বদলে তুমি অন্য কাউকে দাওয়াত দাও। ”
” এটা কি বললে তুমি? তোমার আব্বা এখনও বেঁচে আছে। তোমার ভাইবোন আছে। তাদের রেখে নিজের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান করবে তুমি? এটা কিন্তু ঠিক নয়। তারা শুনলে কি ভাববে? ”
” যা ভাবার ভাবুক। যাদেরকে তুমি আমার ভাইবোন বলছ, তারা আমার সৎ ভাইবোন। আর আব্বা সে তো অনেক বছর আগে থেকেই আমার কাছে মৃত। যে পিতা তার মাতৃহীনা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দ্বায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে পারে, তাকে আর যাইহোক পিতা বলা যায়না। বিয়ের পর সে কখনো আমার খোঁজ নিয়েছে? তার সম্পত্তি কিংবা টাকাপয়সার প্রয়োজন ছিলনা আমার। আমাকে নায়র নিতেও বলিনি কখনো। আমি শুধু চেয়েছিলাম, আব্বা নিয়মিত আমার খোঁজ নিক। কিন্তু সে তার দ্বিতীয় স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে, নাজমা নামের তার একটা মেয়ে ছিল, সেটা ভুলে গেছে। সেই মানুষকে আমি অযথা কেন দাওয়াত করতে যাব? আবার তার ছেলেমেয়েরাও আমার সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি। প্রথমদিকে আমিই দরদ দেখিয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে গেছি। কিন্তু তারাও তাদের পিতার মত আমাকে ছুঁড়ে ফেলেছে। তাই তাদেরও দাওয়াত করার প্রয়োজনিয়তা দেখছিনা। ”
” আমার বাড়িতে এসে কিন্তু তুমি কম কষ্ট সহ্য করোনি। আমার মা-বোনেরা কম অপমান-অসম্মান করেনি তোমাকে। কিন্তু তারপরও তুমি তাদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করোনি। আমার মায়ের সেবাযত্ন করছ, আমার বোনদের বছরে দুই-চারবার নায়র নিয়ে আসছ। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে সর্বপ্রথম তাদেরকে দাওয়াত দিয়েছ। আমার বোনদের প্রতি যদি এত দ্বায়িত্ব পালন করতে পার, তবে নিজের আব্বা আর ভাইবোনদের প্রতি কেন এই অবিচার? ”
” কারন জানতে চাইছ? তোমার মা, তোমার বোন ওরা তোমার আপনজন। আমিতো তাদের কাছে বাহিরের মেয়ে। অন্য বাড়ির মেয়ে। তাই তারা আমাকে হাজার অপমান, অসম্মান করতেই পারে। তারা অপমান, অসম্মান করলে ততটাও আঘাত লাগেনা, যতটা নিজের মানুষ করলে লাগে। আমার আব্বা? সে-তো আমার জন্মদাতা? সে কিভাবে পারল, তারই ঔরসজাত সন্তানকে পর করে দিতে? তার দ্বিতীয় স্ত্রী’র সন্তানরাই তার কাছে আপন। আমি কেউ নই। বিয়ের দিন সেই যে এই বাড়িতে আসলাম, তারপর এক দিনের জন্যও আমার খোঁজ নিলনা, আমাকে দেখতে আসলনা। আমিই কতদিন একে-তাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছি। কিন্তু সে আসেনি। সে যদি বাবা হয়ে আমাকে ত্যাগ করতে পারে, তবে মেয়ে হয়ে আমি কেন পারবনা? যে বা যারা আমার দুঃখের দিনে আমার পাশে ছিলনা, তাদেরকে আমার সুখের দিনে আমার পাশে চাইনা। তোমার মা-বোনেরা আমাকে হাজার অপমান করলেও আমি খবর দেয়ার সাথে সাথে ওরা ছুটে এসেছে। ওদেরকে আমি কি়ভাবে ফেলি বল? এসব নিয়ে আর কোন কথা হবেনা। ”
অবনী চাচার হাতে পানির গ্লাস দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। বড়মার চোখে পানি দেখে ওর কান্না পাচ্ছে। ও ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত কখনোই বড়মার বাবার বাড়ির কাউকে দেখেনি কিংবা কখনো বড়মাকে বাবার বাড়িতে যেতে দেখেনি। ও যখনই বড়মাকে জিজ্ঞেস করত তখনই বড়মা বলত, আমার কেউ নেই। তখন বড়মার কষ্ট না বুঝলেও আজ অবনী ঠিকই বড়মার কষ্ট বুঝতে পারে। এই মানুষটা হাসির আড়ালে কতশত কষ্ট গোপন করে রেখেছে, তা কেবল সে-ই জানে। গুটিগুটি পায়ে অবনী গেল বড়মার কাছে। হাত দিয়ে মুছে দিল বড়মার চোখের পানি। ভাঙ্গা গলায় বলল,
” তুমি কাঁদবেনা বলে দিচ্ছি। তুমি জানোনা, তোমার চোখে পানি দেখলে আমারও কান্না পায়? কাদের জন্য কাঁদছ তুমি? যারা ভয়ে তোমার দ্বায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করেছে? যারা ভেবেছিল, তোমার সাথে সম্পর্ক রাখলে অনেক টাকা খরচ করতে হবে। তাদের জন্য কিসের এত কান্না তোমার? ওরা তোমাকে যতটা আঘাত দিয়েছ, তুমিও এবার সেই আঘাতের শোধ নাও। এবার সেই সময় এসেছে। তুমি তাদের দেখিয়ে দাও, তারা তোমাকে ত্যাগ করলেও বড় চাচা তোমাকে ত্যাগ করেনি। তোমার ছেলেরা তোমাকে ত্যাগ করেনি। তাদের থেকে তুমি বেশি সুখী। তোমার ছেলেরাও অযোগ্য নয়। তোমার সুখ তাদেরকে দেখিয়ে দিয়ে, তোমার এত বছরের আঘাতের শোধ নাও তুমি। তাদেরকে বুঝতে হবে, তারা তোমার সাথে অন্যায় করেছে। তারা একরকম তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু সেই তুমিই এখন তাদের থেকে শতগুনে ভালো আছ। তোমাকে রিকুয়েষ্ট করছি, মা। তুমি তাদের ইনভাইট কর। এই সুযোগে আমরাও দেখতে পাব তোমার আব্বা আর তোমার ভাইবোনদের। তোমার সৎমাকেও দেখার ইচ্ছে হয়। একটা মানুষের কতটা ঝাঁঝ থাকলে বাবা আর মেয়েকে আলাদা করতে পারে, সেই মানুষকে দেখতে ইচ্ছে করে। প্লিজ, মা, আমার রিকুয়েষ্ট রাখ। ”
” তুই আবারও কথা বলছিস? কতবার তোকে বলেছি, বড়দের ভেতর কথা বলবিনা। কথাটা কি তোর মনে থাকেনা? ”
” চার বছর আগে থেকেই আমি বিবাহিতা, মেডিকেলে পড়ছি। এখনো যদি আমাকে তোমার ছোট মনে হয়, তবে এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি। শোন, সংসার জীবনের পুরোটা না বুঝলেও কিছু কিছু বিষয় আমি খুব ভালো বুঝি। তাই এখন থেকে মাঝেমধ্যে আমার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবে। তুমি ঠকবেনা এই গ্যারান্টি না দিলেও ঝকমারি একটা সিন ক্রিয়েট হবে এটার নিশ্চয়তা দিতে পারি। আর মাঝেমধ্যে কিছু কিছু সিন ক্রিয়েট হওয়া দরকার। এটা শরীরের জন্য উপকারী, তাইনা বড় চাচা? একমত হলে, ‘ হ্যাঁ ‘ বল, দ্বিমত থাকলেও, ‘ হ্যাঁ ‘ বল। এই ‘ হ্যাঁ ‘ আবার তোমার শরীরের জন্য উপকারী। ”
” আমি তোর সাথে একমত। অবনী ভুল কিছু বলেনি, নাজমা। তুমি রাজি হয়ে যাও। আমি তোমার বাপের বাড়ির লোকজনদের দেখিয়ে দিতে চাই, আমার পুত্রবধূটি একটা রত্ন। তোমার বাপের গোষ্ঠীতে কয়টা ডক্টর আছে সেটাও দেখতে চাই। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি , শালা-শালীকে দেখাতে চাই আমার ছেলেরা একেকটা খাঁটি রত্ন। ঠিক বলেছি তো, মা? ”
” একটা বিষয় বাদ গেছে চাচা, তাদেরকে আরও দেখাতে হবে তোমার পুত্রবধূ এই এলাকার সেরা সুন্দরী। সে মেডিকেলে না পড়লেও, তার রূপে আশেপাশের দশ গ্রাম আলোকিত হয়ে থাকত। পুরো জেলার ছেলেদের হার্টথ্রব তোমার পুত্রবধূ। তাকে না দেখলে তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের দুনিয়ার সেরা সুন্দরীদের একজনকে দেখতে পাওয়া হবেনা। তারা এই বিরল সৌন্দর্য মিস করবে। ঠিক বলেছিনা, বাবা? ”
” একশোবার ঠিক বলেছিস, হাজারবার ঠিক বলেছিস। রাজি হয়ে যাও, নাজমা। ”
” একটু সংশোধন করতে হবে, বাবা। তোমার মনে রাখতে হবে, তোমার ছেলের বউ আর পাঁচজন বউদের মত নয়। সে একজন ভবিষ্যৎ ডক্টর এবং সেই সাথে সেরা সুন্দরীদের একজন। তাই তার ক্ষেত্রে একশোবার, হাজারবার কথাটা বলা ভুল। বলতে হবে মিলিয়ন, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন। এবার সঠিকভাবে বল। ”
” বলছি, বলছি। তুই মিলিয়নবার ঠিক বলেছিস, বিলিয়নবার ঠিক বলেছিস, ট্রিলিয়নবার ঠিক বলেছিস, মা। রাজি হয়ে যাও নাজমা। ”
নাজমা আক্তার দু’জনের অভিনয় দেখে হেসে ফেললেন।
” ওরে ঢংগী মেয়ে, এবার থাম। এত ঢং তুই জানিস? ”
” আমি কি ভুল কিছু বলেছি, শ্বাশুড়িমা? মনে কর তোমার বজ্জাত বাপ অসুস্থ হয়ে গেল, তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে গেল। আমি তখন ডিউটিতে আছি। বেডে কাতরানো নানা শ্বশুরকে দেখামাত্র চিনে ফেললাম। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিলাম। এর ফলেই তোমার বাপ সুস্থ হয়ে গেল। সুস্থ হয়েই তোমার বাপ মনে কর ফল মিষ্টি নিয়ে তোমার বাড়িতে আসল। ইচ্ছে হলে সম্পত্তিও লিখে দিল। বিষয়টা ভালো হবেনা বলো? সেই সাথে আমারও সুনাম হল। ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজি হও, মা জননী। ”
হাসতে হাসতে শ্বাস বন্ধ হওয়ার দশা নাজমা আক্তারের। তিনি অনেক কষ্টে হাসি থামালেন।
” অনেক হয়েছে, এবার থাম। তোর চাচাকে বল তার শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত করতে। পারলে যেন তার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে দাওয়াত করে। ”
” চৌদ্দ গোষ্ঠী নয় মা, বল আঠারো গোষ্ঠীকে দাওয়াত করতে। বড় চাচা, রেডি হয়ে যাও। তোমার শ্বশুরকে ফোন লাগাও। ”
ইশরাক এতক্ষণ ড্রয়িংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল। সেই পুরোনো অবনীকে যেন দেখতে পেল সে। একটু দুষ্টু, পুরোটাই মিষ্টি সেই অবনী। যে অবনী দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রাখত সবাইকে। আনমনেই হেসে উঠল ইশরাক।
চলবে…