#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_২৭
জাওয়াদ জামী জামী
” আসেন, আব্বা। আমাকে মনে রেখেছেন জেনে খুশি হলাম। আপনারাও ভেতরে আসেন। নাজমা আক্তার তার আব্বাসহ তার সাথে আগত সবাইকে ভেতরে ডাকলেন।
” কেমন আছিস তুই? তোর ছেলের বিয়ে দিয়েছিস শুনে অবাক হয়ে গেছিলাম। কোথায় তোর ছেলেরা? ” নাজমা আক্তারের আব্বা নাজিমউদ্দীন জিজ্ঞেস করলেন।
” ওরা বাহিরে কাজ করছে। এসেছেন যখন বসেন, ওরা আসবে। ”
” রাকিব, নাজমার হাতে মিষ্টির প্যাকেটগুলান দে। শহরের সবথেকে বড় দোকানের মিষ্টি কিনছে তোর আব্বা। তার একটাই কথা আমার মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে দামী মিষ্টি নিয়ে যাব। আমিও তার কথায় সায় দিলাম। আগেই শুনেছিলাম, তোর শ্বাশুড়ি খুব দজ্জাল। তোকে ঠিকমত খেতে দেয়না। তাই আমি ভাবলাম, এই সুযোগে তোকে তোর পছন্দের মিষ্টি কিনে খাওয়াব। সেকথা তোর আব্বাকে বললাম। সে ছয়শো টাকা কেজির পাঁচ কেজি মিষ্টি কিনল। ” নাজমা আক্তারের সৎমা রিজিয়া বেগম আহ্লাদী গলায় বলল। রিজিয়া বেগমের ছোট ছেলে রাকিব নাজমা আক্তারের হাতে মিষ্টির প্যাকেট দিল।
রিজিয়া বেগমের কথা শুনে মলিন হাসলেন নাজমা আক্তার। তিনি বুঝলেন, এত বছরেও এই মহিলা একটুও পাল্টায়নি। সবকিছুতেই নিজেকে প্রাধান্য দিতে পছন্দ করে সে।
” আমি কি পছন্দ করি সেটা আপনি জানেন! কি আশ্চর্য, জীবনে কোনদিন বাপের বাড়ির কাউকে আমার পছন্দের কথা বলিনি! আর বিয়ের আগে যেসব খাবার পছন্দের ছিল, এখন সেগুলোকে অপছন্দের তালিকায় রেখেছি। আর আপনি ভুল জানেন। আমার শ্বাশুড়ি যথেষ্ট ভালো মানুষ। সে আমাকে ভালোবাসে। শ্বাশুড়িরা একটু কড়া প্রকৃতির মানুষ হয়। তাই বলে তারা ছেলের বউকে না খাইয়ে রাখে এটা সত্যি নয়। তেতো হলেও একটা কথা সত্যি, পর কখনো আপন হয়না। আর নিজের মায়ের মত তো হয়ইনা। মায়ের মত আপন দুনিয়ায় কেউই নেই। তাইনা, রাকিব? মায়া, এগুলো রান্নাঘরে রেখে আয় তো, মা। আর অবনীকে ডেকে নিয়ে আয়। ”
নাজমা আক্তারের কথা শুনে তার আব্বাসহ সবার মুখ চুপসে গেল। নাজমা আক্তার তাদের বসতে দিলেন।
” মা, তাড়াতাড়ি পঞ্চাশ হাজার টাকা দাও। আরও দুইটা ছাগল কিনেছে বাবা। এই দুটো ছাগলের মাংসের রেজালা হবে। ” সাদাফ এসে তাড়াহুড়ো শুরু করে দিয়েছে।
” সাদাফ, এদিকে আয়। তোর নানা এসেছে। ”
মার কথা শুনে সাদাফ সোফায় বসা আটজনের দিকে মনযোগ দিল। সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরিহিত বৃদ্ধকে দেখে অবাক হল সে। বুঝতে পারল, এটাই তার নানা।
” আব্বা, এই যে আমার ছোট ছেলে সাদাফ। ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ”
সাদাফ নানাকে সালাম দিয়ে বাকি সবার সাথে পরিচিত হলো।
” তোর ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে! বাবাহ্! এ কি শুনছি আমি! তোর বড় ছেলে কি করে? ” রিজিয়া বেগম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
” ভাইয়া বুয়েটে পড়াকালীন সময়ে স্কলারশিপ নিয়ে জার্মান গেছিল। স্কলারশিপ শেষ করে দেশে এসেছে কিছুদিন আগে। দেশেই একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরির কথা হয়েছে। আবার চাকরির জন্য জার্মান থেকেও ডাকছে। ”
সাদাফের মুখে বড় ভাইয়ের প্রসংশা শুনে মুখ ছোট হয়ে গেল রিজিয়া বেগমের। সে কখনোই আশা করেনি নাজমার ছেলেরা এত ভালো পজিশনে যাবে।
” তুই বসে কথা বল, আমি টাকা নিয়ে আসছি। ” নাজমা আক্তার ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি ফিরে এসে টাকাগুলো সাদাফের হাতে দিলেন।
” সাদাফ, ইশুকে পাঠিয়ে দে। তোর চাচাকেও পাঠিয়ে দিস। ”
” তোর ছেলেটা দেখছি খুব সুদর্শন হয়েছে রে, নাজমা! বিয়ে দিবিনা ছেলের? আমার রুখসানার ছোট মেয়ের বিয়ের জন্য ছেলে খুঁজছে। তোর ছেলের সাথে খুব মানাবে। আমার রুখসানার মেয়ে মিশু খুব লক্ষ্ণী একটা মেয়ে। ” নাজমা আক্তারের বাড়িঘর, আসবাব এবং তার ছেলেকে দেখে রিজিয়া বেগম বুঝে গেছে নাজমা আক্তার সুখেই আছে। এবং এই সংসারের কর্ত্রী সে। তাই নিজের নাতনীর জন্য একটা সুযোগ নিতে চাইল।
” কাকে, কার সাথে মানাবে? আর এই মিশুই বা কে? ” অবনী ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল।
নাজমা আক্তার হাত বাড়িয়ে অবনীকে নিজের কাছে নিলেন।
” অবনী, আমার আব্বা, এটা আমার আম্মা। আর এরা আমার ছোট ভাই, তাদের বউ-বাচ্চা। আব্বা, এ অবনী। আমার বড় ছেলের বউ। ”
অবনী সবাইকে সালাম দিয়ে নিজামুদ্দিনের পাশে গিয়ে বসল।
” আপনিই তাহলে গ্রেট নিজামুদ্দিন? আপনার দর্শন পেয়ে আমার দু-চোখ ধন্য হল। ”
” গ্রেট হলাম কিভাবে? আমি কিন্তু অতিসাধারণ একজন মানুষ। তোমার বাবার বাড়ি কোথায়? কয় ভাইবোন তোমরা? ”
” উঠানের অপরপ্রান্তে মাটির যে বাড়িটা দেখেছেন ঐটাই আমার বাবার বাড়ি। ওয়াহাব আহমেদ আমার বাবা। ”
” বল কি, তুমি ওয়াহাবের মেয়ে! ”
” জ্বি জনাব, আমি ওয়াহাব আহমেদেরই মেয়ে। এবার বলুন এত বছর পর মেয়েকে দেখে আপনার অনুভূতি কেমন? মেয়ের কথা মনে পরেনা? নাকি মৃত স্ত্রীর সাথে সাথে তার সন্তানকেও কবর দিয়েছেন? তাহলে আমি বলব, বাবা হিসেবে এটা আপনার ব্যর্থতা। স্ত্রী’র মৃত্যুর পর তার আমানতকে আগলে রাখার দ্বায়িত্ব কিন্তু আপনারই ছিল। ”
” এই মেয়ে, তুমি কার সাথে কথা বলছ সেই সম্পর্কে তোমার কোন ধারনা আছে? এত যে জ্ঞানের কথা বলছ, তা তোমার পড়াশোনা কতদূর? তোমার বাপের বাড়ি দেখে তো মনে হচ্ছেনা, লেখাপড়া কিছু জানো। নাজমা রে, এ কাকে ছেলের বউ করেছিস? তোর ভবিষ্যৎ ভেবে আমার চিন্তা হচ্ছে। ” অবনীর কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল রিজিয়া বেগম।
” আপনি বুঝি মানুষের চেহারা দেখে তার যোগ্যতা বিচার করে বসেন, নানি মা ? তাহলে তো বলতে হচ্ছে, আপনি মানুষ চেনার ব্যাপারে খুব একটা পোক্ত নন। আমার বাবার মাটির বাড়ি জন্যই যে আমি লেখাপড়া করবনা, এই ধারনা আপনি পেলেন কোথায় থেকে! আমি ঢাকা মেডিকেলে পড়ছি, শ্রদ্ধেয় নানি মা। এই যে গ্রেট নানা ভাই, কি দেখে এই ভদ্র মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন বলুনতো? আর আমার প্রিয় নানিমা, আমার শ্বাশুড়িকে নিয়ে আপনার চিন্তা দেখে আমার ভয় হচ্ছে। আপনিতো আবার মাকে নিজের কাছে নিয়ে যাবেননা? আমরা কিন্তু মাকে ছাড়া থাকতেই পারিনা। বাবা, দাদু, দাদি সবাই মাকে ছাড়া অসহায়। আপনি যদি মাকে নিয়েও যান, তবে এক মাসের বেশি রাখতে পারবেননা বলে দিচ্ছি। ঠিক বলেছিনা, নানা ভাই? ” হাসিমুখে বাঁশ দেয়া যাকে বলে অবনী সেটাই করল।
” ঠিকই বলেছ, বুবু। তোমার কথার সাথে আমি একমত। বিয়ের আগে আমি বুঝতে পারিনি আমার গিন্নী মানুষ চেনায় এতটা অপটু। জানলে কি আর তাকে বিয়ে করি। তুমি কি সত্যিই ঢাকা মেডিকেলে পড়ছ? ”
” সত্যিই ঢাকা মেডিকেলে পড়ি। আপনার কতক্ষণ ধরে এখানে বসে আছেন ? মা তোমাদের চা-নাস্তা দিয়েছে? ”
” এত ব্যস্ত হয়োনা। আমরা এসেছি পনের মিনিটও হয়নি। খাওয়ার অনেক সময় পাব। তোমার সাথে গল্প করতে ভালো লাগছে। ”
” উঁহু তা বললে কি হবে? আপনারা বসেন, আমি আসছি। মা, তুমি বস। আমি রান্নাঘর থেকে আসছি। ”
অবনী রান্নাঘরে গেলে নাজমা আক্তার নিজামুদ্দিনের সামনের সোফায় বসলেন। চাইলেও তিনি আব্বার মুখের দিকে তাকাতে পারছেননা। আব্বাকে দেখে তার ভেতরে কোন আবেগ কাজ করছেনা। অথচ তার আবেগে ভেসে যাওয়ার কথা ছিল। আজ প্রায় আটাশ বছর পর আব্বাকে দেখলেন তিনি। কিন্তু একবারও আব্বাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছেনা, এতদিন কেন আসেননি, আব্বা? কেন আমার খোঁজ নেননি?
” ডাকছিলে কেন, মা? ” পাঞ্জাবীর হাতা ঠিক করতে করতে জিজ্ঞেস করল ইশরাক। ঠিক তখনই ওর নজর গেল সোফায় বসা কয়েকজনের দিকে। এদেরকে সে চেনেনা। তাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় মায়ের দিকে। কিন্তু মায়ের মলিন চেহারা দেখে ওর খটকা লাগে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় মায়ের দিকে। মায়ের পাশে গিয়ে বসে তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল,
” তোমার শরীর খারাপ লাগছে, মা? সকালে খাবার খেয়েছিলে? কতবার করে বলেছি, না খেয়ে থাকবেনা কিন্তু তুমি আমার কোন কথা শোনোনা। ”
” আমার কিছুই হয়নি, বাপ। তুই অস্থির হোস না। সকালে খেয়েছি। তোর নানা-নানী, মামা-মামী এসেছে। আব্বা, আমার বড় ছেলে ইশরাক। ”
ইশরাক এবার বুঝতে পারল মায়ের মলিন মুখের পেছনের কারণ। সামনে বসা মানুষগুলোকে দেখে ওর ভেতরে ভেতরে রাগ হলেও মুখটা হাসিহাসিই রাখল। সবার সাথে হেসে কথা বলতে শুরু করল।
” তুমিও দেখছি কম সুদর্শন নও! তা এখনই বিয়ে করলে কেন? বিয়ের বয়স তো আর পেরিয়ে যাচ্ছিলনা। বিদেশ থেকে পড়াশোনা করেছ, দেখতে ভালো, তুমি চাইলেই কোটিপতির মেয়েকে বিয়ে করতে পারতে। আমার হাতেই অনেক পাত্রী ছিল। ” রিজিয়া বেগম ব্যঙ্গ করে বলল।
” কোন কোটিপতির বখে যাওয়া মেয়ের প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। অবশ্য আমার শ্বশুরও কিন্তু গরীব নয়। আবার আমার স্ত্রীও সবদিক থেকেই যোগ্য এবং আমার কাছে দুনিয়ার সেরা সুন্দরীদের একজন। যে কোন কোটিপতির মেয়েদের সাথে টেক্কা দেয়ার যোগ্যতা আছে আমার স্ত্রী’র। তাই এই বিষয়ে আমার কোন আফসোস নেই। এছাড়া আপনার হাতে হাজারটা পাত্রী থাকলেও কোন লাভ ছিলনা। আপনি আজ প্রথমবার আমাকে দেখছেন। প্রথমবার আমাকে দেখেই আমার বিয়ের ঘটকালী করতে চাইলেই কিন্তু আমি রাজি হতামনা। আমি আবার মনের মত মানুষ না পেলে কারও সাথে মিশিনা। তাই আমার বিয়ে দেয়া কোনভাবেই সম্ভব ছিলনা আপনার পক্ষে। ” ইশরাকের চাঁছাছোলা কথা শুনে রিজিয়া বেগমের মুখ কালো হয়ে গেল।
বাহির থেকে কেউ একজন ইশরাককে ডাকলে ও রুম থেকে বেরিয়ে যায়। অবনী চা, নাস্তা নিয়ে আসল। ওরা নাস্তা খেতে খেতে গল্পে মাতল।
চলবে…