হলুদ বসন্ত পর্ব-২৮

0
298

#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_২৮
জাওয়াদ জামী জামী

” আহ আপু, একটু চুপচাপ বসে থাকবে? তুমি এমন তিড়িংতিড়িং করলে আমি তোমাকে সাজাব কিভাবে? এবার স্থির হয়ে বসে না থাকলে আমি বড়মাকে গিয়ে বলব তুমি সাজতে চাওনা। কথাটা শোনার পর বড়মা তোমাকে কি করবে এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ? ” অর্নির ধমক খেয়ে হকচকিয়ে গেল অবনী। শেষমেশ ছোট বোন ওকে ঝাড়ি দিচ্ছে এটা মানতে পারছেনা ও।

” আমি কি একবারও বলেছি , আমাকে সাজিয়ে দে? সাজতে চেয়েছি আমি তোর কাছে? শুধু শুধু তুই আর তোর বড়মা মিলে আমাকে সং সাজিয়ে দিচ্ছিস। ”

” একটাও কথা নয়। একদম চুপ। ”

” তাড়াতাড়ি কর। এভাবে বসে থাকতে ভালো লাগছেনা। ”

” কি রে তোদের হল? আর কতক্ষণ লাগবে সাজাতে? ”

” আরেকটু সময় দাও, বড়মা। তোমার ছেলের বউ সাজাতে দিচ্ছেনা ঠিকমত। মনে হচ্ছে, একটা বাচ্চাকে সাজিয়ে দিচ্ছি। ”

” মাশা-আল্লাহ পুরো সাজ না হতেই আমার অবনীকে কি সুন্দর লাগছে! ঠিক যেন নীল পরী। কারও নজর না লাগুক। অর্ন, তোর যত সময় লাগে নে। তবুও আমার মেয়েটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দে। লোকজন দেখে যেন বলে, ইশরাকের বউ লাখে এক। ”

” মা, আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকব বলতো? আমার কোমড় ব্যথা করছে। ”

” আজকের দিনটা সব কষ্ট সহ্য কর, মা। আমার অনেকদিনের ইচ্ছে পূরন করছিস তোরা। আজকে আমি কত খুশি সেটা যদি তুই জানতিস। ধীরে ধীরে তোদেরকে দিয়েই আমার সব শখ পূরণ করব। ”

এরপর আর কোন কথা থাকেনা। অবনী আর বাঁধা দিলনা। চুপচাপ সাজতে থাকে। নাজমা আক্তার দুচোখ ভরে দেখলেন অবনীকে। এরপর রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ পর ইশরাক রুমে ঢুকল। অবনীর দিকে চোখ পরতেই ও থ হয়ে গেল। এ কাকে দেখছে সে! ওর বউ এত রূপসী সেটা ইশরাকের ভাবনায়ও ছিলনা। আজকের আগে কখনোই অবনীকে সাজতে দেখেনি ইশরাক। তাই বধূ সাজে সজ্জিত অবনীকে দেখে ওর হার্টবিট বন্ধ হবার উপক্রম হল। কি উপমা দেবে খুঁজে পায়না ইশরাক। ওর সামনে যেন এক টুকরো চাঁদ বসে আছে। আচ্ছা, চাঁদের আলো কি এত মায়াবী হতে পারে? নাকি দ্বীপ্ত তারার মুকুট পরেছে সে? তার পরনের নীলরঙ্গা বেনারসী কি অসীম অন্তরীক্ষ তার গায়ে জড়িয়েছে? সে কারনেই বুঝি তার রং নীল? চোখের পলকে যেন থমকে গেছে সময়! হৃদয়ের গভীরে ঢেউ তুলেছে এক অজানা আবেশ। বুকের ভেতর কোথাও রূপকথার কোলাহল। তার স্বপ্নের রাজকন্যা কি তবে তার আদি রূপে ফিরেছে। নাকি এ শুধু তার ভ্রম? সে এক ভাষাহীন অনুভূতি নিয়ে মুগ্ধ নয়নে দেখছে তার নারীকে।

” এভাবে কি দেখছ, ভাইয়া? এমনভাবে তাকিয়ে আছ যেন আপুকে কোনদিন দেখনি! এবার আমার দিকে তাকাও এবং বল কেমন সাজিয়েছি ? আপুকে চেনাই যাচ্ছেনা, তাইনা? ”

” মন্দ নয়। তবে তোর বোন তো এমনিতেই সেরা দশজন সুন্দরীদের একজন। তাকে না সাজলেও মিস ইউনিভার্স লাগে। তাকে যদি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য ঘোষণা করা হয়, আমি একটুও অবাক হবনা। ”

ইশরাকের কথা শুনে রাগে অবনীর পাগল হওয়ার দশা। ও চারপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে মেক-আপ বক্স তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল ইশরাককে। ওকে আক্রমণ করা হয়েছে দেখেই ইশরাক সতর্ক হয়ে গেল। আর ওর দিকে ছুটে আসা মেক-আপ বক্স সুনিপুণভাবে ক্যাচ ধরল। এবার সে অর্নির উদ্দেশ্যে মুখ খুলল,

” দেখলি অর্ন, তোর বোনের কাণ্ড? আমি বিদেশে গিয়ে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে কিছু পয়সা জমিয়েছিলাম। সেই জমানো পয়সা দিয়েই তোর বোনের জন্য শপিং করেছি। কিন্তু তোর বোন আমার পরিশ্রমের মূল্য দিলনা। দেখলি কেমন তুলোর মত ছুঁড়ে মারল! স্বামীর ওপর একটুও দরদ নেই। ”

” ভাইয়া, তুমি আর কথা বলোনা। বড়মা কিন্তু তোমাকেও তৈরী হতে বলেছে। এই প্যাকেটে তোমার শেরওয়ানী রাখা আছে। এটা নাও। দশ মিনিটের মধ্যে তৈরী হও। ” অবনীকে রাগতে দেখে পরিস্থিতি সামাল দিতে বলল অর্নি।

” আবার আমি কেন! আমি এভাবেই ঠিক আছি। শেরওয়ানী আমার জন্য নয়। এটা সাদাফকে দে। ”

” জামাই কি সাদাফ? তুমি জামাই তাই শেরওয়ানী তুমিই পরবে। সাদাফ ওর বিয়েতে শেরওয়ানী পরবে। তুমি এগুলো না পরলে বড়মা বাড়িভর্তি লোকজনের সামনে তোমার কান মলে দেবে। চাও নাকি কান মলা খেতে? ”

ইশরাক কিছু না বলে শেরওয়ানীর প্যাকেট নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

***

” রুমে ঢুকেই হতভম্ব হয়ে গেল অবনী। পুরো রুম ফুল দিয়ে সাজানো। অবনী জানতনা তার জন্য এমন এক নীরব আয়োজন অপেক্ষা করে আছে। ঘরে পা রেখেই মূহুর্তের জন্য থমকে গেল সে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা রঙিন ফুলের সৌরভ, মৃদু আলোর মায়াবী প্রতিফলন, পুষ্পসজ্জিত বিছানা সব যেন স্বপ্নের মত।

কিন্তু হৃদয়ের গহীনে যে শূন্যতার আকাশ, সেটি কি এত সহজেই পূরণ হবার ? ঘর যতই রঙিন হোক, অনুভূতিগুলো কি ততটাই উজ্জ্বল?

ধীর পায়ে অবনী এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিল ফুলগুলোকে। সৌরভে মুখরিত ঘরটা তাকে আরেকবার মনে করিয়ে দিল চার বছর আগের সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি।

অবনীর মত ইশরাকও ঘরে ঢুকেই চমকে গেল। ইশরাক দেখল পুষ্পরাজি সজ্জিত ঘরে মৃদু আলোয় দাঁড়িয়ে আছে এক উদাসীন অপ্সরা। হ্যাঁ, উদাসীন অপ্সরাই। যে উদাস চোখে তাকিয়ে দেখছে ঘরের সৌন্দর্য। অপ্সরার এই উদাসীনতা কাঁটার ন্যায় ইশরাকের বুকে বিঁধল।

ইশরাক মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখল সব আয়োজন যাকে ঘিরে, অথচ সে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। সে দূরত্ব যেন দূর নক্ষত্রের মত। যাকে দেখা যায়, কিন্তু ছোঁয়া যায়না কভু। এক ঘরে, এক বিছানায় থাকা স্বত্বেও তাদের দূরত্ব যোজন যোজন। বুক ভরে শ্বাস নিল ইশরাক। নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করল ফুলের সুবাস। সৌরভে শ্বাস আটকে আসে, আন্দোলিত করে তনু-মন, অথচ তার ভেতর জমে থাকা অভিমান গলতে চায়না।

এই সাজানো বাসর কি সত্যিই তার জন্য? নাকি এ কেবল নিঃশব্দ এক অভিনয়, যেখানে অনুভূতিগুলো লুকিয়ে থাকে হাসিমুখের আড়ালে?

অবনী ঘুরে তাকায়। এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তার চোখের কোনে জমে আছে এক বিন্দু অশ্রু – অব্যক্ত অথচ বিষাদে ভরা, হয়তো একটু অভিমান আর ক্লেশের সংমিশ্রণ ছিল সেখানে।

বিষাদ কন্যার বিষাদীনী রূপ দেখে ইশরাকের বুক ধুকপুক করছে। বিদ্রোহ করছে শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকা। সে কি জানে, তার চোখের পানি ইশরাককে ভেতর থেকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে?

অভিমান আর দূরত্বের যে কঠিন দেয়াল ইশরাক গড়ে তুলেছিল, সেই দেয়ালের ফাঁক গলে তার নীরব কান্না কি অবনীর কর্নকুহরে প্রবেশ করছে? ইশরাক মুখে কিছু বলতে পারলনা, কিন্তু তার মনের ভেতরে ঝড় উঠেছে।

সেই এক ফোঁটা অশ্রু এখনো অবনীর চোখের কোনে ঝলমল করছে। ইশরাক জানে, এই অশ্রু শুধু চোখ থেকে ঝরেনা, হৃদয়ের গভীর ক্ষত থেকেই এর জন্ম। সে কি পারবে, এই ক্ষতে ভালোবাসার প্রলেপ দিতে?

ইশরাকের ভেতরে এক অদ্ভুত টান অনুভূত হয়। সে কি এগিয়ে যাবে? দূরত্বের এই দেয়াল কি কভু ভাঙ্গার নয়? সে তো ভাঙতেই চায়। কিন্তু অবনী, সে তো নিজেকে গুটিয়ে নেয় বারবার? অথচ ইশরাক খুব করে চায় এ দূরত্ব চিরকালের জন্য ঘুচে যাক।

পুষ্পসজ্জিত, আলোর পসরা সাজানো ঘরের দুইপ্রান্তে দুই মানব-মানবী নীরব দাঁড়িয়ে আছে। যেন দু’জনের মধ্যে নীরব প্রতিযোগিতা চলছে। যার স্বাক্ষী কেবল নিঃশব্দ রাত। একজন কাঁদছে, আরেকজন অপরাধবোধে ভুগছে। কতদিন চলবে এই মান-অভিমান? নাকি দুজনেই নীরবে দূরে সরে যাবে, যতক্ষণ না নীরব ব্যথা দু’জনকে একই বিন্দুতে নিয়ে আসে?

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজা বন্ধ করল ইশরাক। এগিয়ে গেল অবনীর কাছে। কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধ নয়নে দেখল তার রাজ্যের রানীকে। বিষাদ রাজ্যের রানী! নিঃশব্দ রাতে যে হারিয়ে গেছে নিজস্ব শূন্যতার গভীরে। তার চোখের কোনে জমে থাকা অশ্রুগুলো হয়তো কখনো গোপনে ঝরে, আবার হয়তোবা কখনো বুকে চেপে থাকা অভিমানের মত আটকে থাকে। কিন্তু বিষাদ কি তার একমাত্র সঙ্গী? সে কি তার রানীর সঙ্গী হতে পারেনা? হলে ক্ষতি কি? সে-তো চায়, তার সকল বিষাদ ঘোচাতে।

” অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পর। ” নিজের সাথে আরও একবার বোঝাপড়া করে হেরে গেল ইশরাক। দূরত্ব ঘোচানোর সময় এখনো আসেনি। তার আগে প্রয়োজন অবনীর মনে ওর জন্য এক টুকরো জায়গা।

ইশরাকের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল অবনী। সাজানো গোছানো ঘর দেখে ওর ভয় হচ্ছিল। কিন্তু ইশরাক এই মুহূর্তে ওকে সেই ভয় থেকে মুক্ত করে দিল। আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে ছুটল ওয়াশরুমের দিকে।

কাপড় পাল্টে, ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখল ইশরাকও পোশাক পাল্টে শুয়ে পরেছে। বিছানা থেকে ফুলগুলোও সরিয়ে ফেলেছে। বালিশে মাথা রাখতেই একটা রঙিন কাগজে চোখ গেল অবনীর। একটা চিরকুট! আঁড়চোখে ইশরাকের দিকে তাকিয়ে, ধীরে ধীরে খুলল সেটা। কয়েক লাইনের লিখা পড়ে আরও একবার ইশরাকের দিকে তাকাল।

” আমাকে একবার ক্ষমা করা যায়না? একবার ক্ষমা করে দেখ, দেখবি তোকে কখনোই অভিযোগের কোন সুযোগ দেবোনা। ক্ষমা চাইছি, বউ। ক্ষমা চাইছি তোকে দেয়া আঘাতের জন্য। ক্ষমা চাইছি সবকিছুর জন্য। ”

‘ বউ ‘ শব্দটা অবনীর বুকে গভীর আবেশে আচড়ে পরল। অজান্তেই অবনীর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। আবারও তাকাল ইশরাকের দিকে। চিন্তা করছে, এবার কি তাকে ক্ষমা করা যায়? কিছুক্ষণ পর উত্তর পেয়ে গেল। এখনো সেই কাঙ্ক্ষিত সময় আসেনি। তাকে তার অন্যায়ের শাস্তি পেতেই হবে।

চলবে…