#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_৩১
জাওয়াদ জামী জামী
সেদিন আর ইশরাকের অবনীর হোস্টেলে যাওয়া হলোনা। অফিসেই ওর রাত দশটা পর্যন্ত থাকতে হয়। অবনীকে ম্যাসেজ দিয়ে জানিয়ে দেয় পরদিন সকালে ও হোস্টেলের বাহিরে অপেক্ষা করবে।
পরদিন বিকালে অবনী ইশরাকের ম্যাসেজ পেয়ে খাবারের বক্স নিয়ে বাহিরে আসে। আজ একটু আগেই অফিস থেকে বেরিয়েছে ইশরাক। ইশরাককে দেখে থমকে গেল অবনী। ফর্মাল ড্রেসে কি চমৎকার লাগছে তাকে! হালকা নীল শার্ট তার শ্যামলা চেহারায় বেশ মানিয়েছে। শার্টের হাতা কনুইয়ের নিচ পর্যন্ত গোটানো। বা হাতের কব্জিতে শোভা পাচ্ছে কালো রঙের রিষ্ট ওয়াচ। অবনী আগেই খেয়াল করেছে ঐটা… ব্রান্ডের। চোখে কালো রঙের রে ব্যানের রোদচশমাও রয়েছে। অবনীর বুঝে আসছেনা রোদচশমা আর রিষ্ট ওয়াচ কালো কিন্তু শার্ট পরেছে নীল, এটা কেন? নীল শার্টের সাথে মিলিয়ে তাকে নীল ঘড়ি আর নীল রোদচশমা পরতে হত। তবেই না তাকে স্মার্ট লাগত। মনে মনে কতকিছু চিন্তা করছে অবনী। নিজের চিন্তার বহর দেখে মুচকি মুচকি হাসল । তবে হাসিটা ইশরাককে দেখতে দিলনা। মুখে গম্ভীর ভাব এনে এগিয়ে গেল ইশরাকের দিকে। খাবারের প্যাকেট বাড়িয়ে দিল ইশরাকের দিকে।
” রুমে ফিরেই ফ্রিজে ঢোকাবেন। নয়তো নষ্ট হয়ে যাবে। আর এগুলো নষ্ট হয়ে গেলে শ্বাশুড়িমা আমার চৌদ্দটা বাজাবে। সে ধরেই নেবে, তার আদরের ধনের খাবার আমিই ইচ্ছে করে নষ্ট করেছি। ”
ইশরাক অবনীর কথা শুনে হতাশ হয়। কোন সৌজন্যতা না দেখিয়ে সরাসরি এ্যাটাকিং কথাবার্তা এই মেয়ের দ্বারাই সম্ভব।
” মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। এটা রাখ। ”
” কি আছে এতে? ”
” রুমে গিয়ে খুলে দেখলেই বুঝতে পারবি। ”
” বাসা দেখেছেন? নাকি না দেখেই মাকে শান্তনা দিচ্ছেন? এটা আমার কথা নয়, বাবার কথা। ”
অবনীর মুখভঙ্গি দেখে ইশরাক হাসল।
” দেখেছি। একটা পছন্দও হয়েছে। ফ্ল্যাটের মালিকের ফোন বন্ধ ছিল, তাই কথা হয়নি। দুই-এক দিনের মধ্যেই কথা হবে। বাবাকে বলে দিস, তার ছেলে কাউকে মিথ্যা শান্তনা দেয়না। ”
” আমি বলতে যাব কেন? আপনিই বলবেন। ”
” বাবা তো আমাকে জিজ্ঞেস করেনি। জিজ্ঞেস করলে আমিই বলতাম। এখন কি করবি? ”
” ছাত্রী পড়াতে যাব। ”
” কোথায়? ”
” সামনেই। পাঁচ মিনিট লাগবে। ”
” তৈরী হয়ে আয়। আমি পৌঁছে দেব। ”
” হুম। ”
অবনী রুমে গিয়ে তৈরী হয়ে বাহিরে আসল। ইতোমধ্যেই ইশরাক একটা রিক্সা ডেকেছে। অবনী আসলে ইশরাক ওকে রিক্সায় উঠতে বলল। অবনী রিক্সায় উঠে বসল।
পরদিন সকালে ক্লাসে গেল অবনী। প্রথম ক্লাস করে বের হতেই মুখোমুখি হল মাহির।
” হেই বিউটিফুল, কেমন আছো? আজকাল দেখছি বেশ ফূর্তিতেই দিন কাটাচ্ছ? গভীর কোন ঘটনা আছে নাকি? ”
” আমার ফূর্তিতে দিন কাটানো নিয়ে আপনার এত মাথাব্যথা কেন? আমি ফূর্তিতে থাকি আর না থাকি সেই কৈফিয়ত কি আপনাকে দেব? ”
” ধানী লংকা আমার বরাবরই পছন্দের। ঝালেই লংকার আসল স্বাদ সেটা কি জানো? তুমিও আমার কাছে ধানী লংকা। দেখলেই ঝাল লাগে। ”
” মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ, রাসকেল। আর একটাও আজেবাজে কথা বললে থাপড়িয়ে আপনার গাল লাল করে দেব। আপনাকে দেখে মেডিকেল পড়ুয়া মনে হয়না। আপনার চালচলন দেখে মনে হয় বস্তির টোকাই। আপনার মত মানুষ ডক্টর হলে সমাজে কেমন বিরূপ প্রভাব পরবে সেটা ভেবেই ভয় হচ্ছে আমার। ”
” জ্ঞান দিওনা। ওগুলো নিজের কাছেই রাখ। আগে নিজের চরিত্র ঠিক কর, পরে অন্যকে জ্ঞান দিও। ”
” সাট আপ। আমার চরিত্র ঠিকই আছে। আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও চলবে। বেয়াদব একটা। ” অবনী আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু ওকে ডেকে পাঠিয়েছে ওদের স্যার। তাই বাধ্য হয়ে ওকে যেতে হল।
***
পরদিন ছুটি থাকায় সারাদিন রুমেই কাটাল অবনী। সাদাফ সকালেই ফোন দিয়ে জানিয়েছে, একটা তিন রুমের ফ্ল্যাট নিয়েছে ইশরাক। খুব তাড়াতাড়ি ওরা নতুন ফ্ল্যাটে উঠবে। এরপর আর ওর সাথে যোগাযোগ করেনি সাদাফ। অবনী অবশ্য ফোন বন্ধ করে লম্বা ঘুম দিয়েছিল। ঘুম ভেঙেছে সন্ধ্যার একটু আগে। ঘুম ভাঙ্গলে ফোনের সুইচড অন করল অবনী। একটু পরেই সাদাফের ফোন আসল।
” তোকে কতবার ফোন দিয়েছি জানিস? কি করছিলি এতক্ষণ? ” ধমকে উঠল সাদাফ।
” ঘুমাচ্ছিলাম। কেন ফোন দিয়েছিলে? ”
” ভাইয়া আর আমি মিলে বাসার জন্য কিছু ফার্নিচার কিনেছি। সেগুলো সেট করাও শেষ। তোর জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখ। কাল সকালে আমরা এসে তোকে নিয়ে নতুন বাসায় উঠব। পারবি তো? নাকি কোন কাজ আছে? ”
” কালকে সারাদিন কোন কাজ নেই। একদম ফ্রি আছি বলতে পার। ”
” তাহলে আমি আর ভাইয়া নয়টার দিকে যাব তোকে নিতে। ”
” আমাকে নিতে আবার দু’জনকে আসতে হবে! ”
” গাধী, ঐ দিকে ভাইয়ার একটা কাজ আছে। আমি যেহেতু যাবোই, তাই ভাইয়াকেও বলেছি যেতে। বুঝেছিস? ”
” বুঝবনা কেন? খুব বুঝেছি। ”
” বুঝলেই ভালো। ” দু’জন আরও কিছুক্ষণ ঝগড়া করার পর ফোন রাখল।
***
পরদিন সকালে কোন একটা কাজে হোস্টেলের বাহিরে আসল অবনী। ও রাতেই গোছগাছ করে, ওর ব্যবহার্য জিনিসপত্র সব গেটের ভেতরে এনে রেখেছে। নয়টা বাজার মিনিট দশেক আগে ওর রুমমেটের সাথে নিচে আসে। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত জানতনা, একটু পরই কি হতে চলেছে। অবনী জানতনা হোস্টেলের বাহিরে মাহি আছে। অবনীকে বাহিরে দেখেই ওর দিকে এগিয়ে আসল মাহী।
” কি সৌভাগ্য আমার সকাল সকাল মক্ষীরানির দর্শন পেলাম! হঠাৎ করেই যে বাহিরে আসলে? কেউ আসবে নাকি? না মানে তোমার কাস্টমারদের কথা বলছিলাম। ” মাহী সেদিনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে চায়। সেজন্যই সে অবনীকে আক্রমণ করল।
মাহির মুখে এমন অশ্লীল কথা শুনে চমকে উঠল অবনী। সেই সাথে ঘৃণায় ওর চোখমুখ কুঁচকে গেল।
” হাউ ডেয়ার ইউ? আপনার সাহস হয় কি করে আমাকে অপমান জনক কথা বলার? আপনার কোন ধারনা আছে এইমাত্র আমাকে কি বললেন আপনি? ” রাগে-অপমানে অবনী কাঁপছে৷
” আমি যা বলার জেনে-বুঝেই বলেছি। অস্বীকার করতে চাও তোমার মনোরঞ্জনের জন্য কাস্টমার নেই? আজকাল তো দুই কাস্টমারকে বেশ এ্যাক্টিভ দেখা যাচ্ছে। তা তোমার রেট কত? কি ভেবেছিলে, মেধাবী ছাত্রী বলে পার পেয়ে যাবে? তোমার কুকর্ম কেউ দেখতে পাবেনা? আচ্ছা, দু’জন কাস্টমার যখন আছে, তখন আর একজনকে রাখলে ক্ষতি কি? তারা তোমাকে যা দেয়, তার থেকে বেশিকিছু আমি তোমাকে দেব। রাজি হয়ে যাও৷ আখেরে তোমারই লাভ হবে। ”
মাহির এমন মিথ্যা অপবাদে দিশেহারা অবনী অপমানে কেঁদে ফেলল। আশেপাশের লোকজন ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। কেউ কেউ ফিসফিস করে কিছু বলছে। আজ-অব্দি ওর চরিত্র নিয়ে কেউ কোন কথা বলতে পারেনি। কিন্তু আজ?
” আপনি থামবেন? আবারও বলছি না জেনে আজেবাজে কথা বলবেননা৷ আমি কোন রাস্তার মেয়ে নই যে আপনি আমাকে এভাবে কথা বলবেন। আমি থানায় যাব। আপনাকে শাস্তি পেতেই হবে। ”
” আরে থাম। তোমার মত মেয়েকে আমার চেনা আছে। মুখে মুখে আদর্শের বুলি আউড়ানো তোমাদের কাজের একটা অংশ৷ কিন্তু দিনদুপুরে খদ্দের নিয়ে ঘুরে বেড়াতে তোমাদের একটুও বাঁধেনা। ”
” স্টপ ইট। আই সে স্টপ ইট। আপনি কার দিকে আঙুল তুলেছেন সেটা যদি জানতেন তবে এভাবে সবার সামনে আমাকে অপমান করতে পারতেননা। অসভ্য লোক একটা। আমার দিকে আঙুল তোলার আগে নিজের দিকে একবার তাকান। মেডিকেলে ভর্তি হবার পর থেকেই আমি আমার পেছনে ঘুরেছেন। আমাকে নানান প্রলোভন দেখিয়েছেন। কিন্তু যেই দেখলেন, আমি আপনার প্রলোভনে পা দেইনি, ঠিক তখনই আমার নামে বদনাম করছেন। আপনি একটা কাপুরষ। ”
” বাহ্ বাহ্ তালিয়া। আজকাল রাস্তার মেয়েরাও জ্ঞানের বহর নিয়ে চলাফেরা করে দেখা যায়। তোমার রেট জানলেই আর কোন কথা বলতে হয়না। অন্যদের তো সুযোগ ঠিকই দিচ্ছ। আর সেই সুযোগ আমরা চাইলেই দোষ? ”
অবনী এবার জোরে কেঁদে ফেলল। আশেপাশে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়েছে। ছোটখাটো একটা ভীড় জমে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে অবনীর হেঁচকি উঠে গেছে। কয়েক মুহূর্ত পর ওর চোখ গেল সামনের দিকে। রিক্সা থেকে নামছে ইশরাক। সাদাফও আছে তার সাথে। ওদেরকে দেখে অবনী বোধশক্তি হারাল।
সামনে লোকজনের জটলা দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় ইশরাক, সাদাফ দু’জনেই। কৌতুহলী হয়ে সামনে এগোতেই ইশরাক ওর বুকে কাউকে আছড়ে পরতে দেখল। পরক্ষণেই বুঝতে পারল এটা অবনী।
ইশরাককে জড়িয়ে ধরে অবনী হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। অবনীকে কাঁদতে দেখে ইশরাক হতভম্ব হয়ে গেল। ওর কলিজায় কাঁপন ধরাচ্ছে অবনীর চোখের প্রতিটি অশ্রুকনা। বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন শতসহস্র ছোরা দিয়ে ওর ভেতরটা ক্ষত-বিক্ষত করছে।
” কি হয়েছে আমার, সোনা পাখী? কাঁদছিস কেন তুই? দেখি, একবার তাকা আমার দিকে। ” ইশরাক কাঁপা গলায় অবনীকে ডাকছে।
কিন্তু অবনী ইশরাকের ডাক শুনলনা, ও কেঁদেই চলেছে। ইশরাকের ন্যায় সাদাফও অবনীকে কাঁদতে দেখে অবাক হয়ে গেছে। যে মেয়ে হাজার দুঃখ-কষ্টেও ভেঙে পরেনা সেই মেয়ে আজ কাঁদছে! নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু ঘটেছে।
” অবনী, কথা বল। আমাদের বল তুই কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে? তোকে কাঁদতে দেখে ভাইয়া টেনশন করছে। ” সাদাফ ব্যাকুল গলায় বলল।
সাদাফের কথা অবনী শুনতে পেয়েছে সেটা বুঝতে পারল ইশরাক। সাদাফের কথা শোনামাত্রই অবনী দু হাত দিয়ে আরও জোরে আঁকড়ে ধরল ইশরাককে। এবার ইশরাক নিশ্চিত গুরুতর কিছুই ঘটেছে। ইশরাকও স্থান কাল ভুলে জড়িয়ে ধরল অবনীকে। আদুরে গলায় বলল,
” লক্ষ্মী বউ আমার আমাকে বল তোর কি হয়েছে? এভাবে আমাকে টেনশনে রাখিসনা। ” ইশরাকের ডাকে কিছু একটা ছিল যে অবনী ওর দিকে মুখ তুলে তাকাল। পেছনে হাত দিয়ে ইশারা করল। যেখানে মাহি দাঁড়িয়ে আছে। অবনীর হাতের দিকে লক্ষ্য করে সেদিকে তাকাল ইশরাক। এক নজর সেদিকে দেখে অবনীর চোখের পানি মুছে দিল।
” ঐ লোকটা আমাকে প্রস্টিটিউট বলেছে। সে আরও বলেছে, তুমি আর সাদাফ ভাইয়া তোমরা দু’জনেই আমার কাস্টমার। সে আমার রেট জানতে চেয়েছে। আরও অনেক আজেবাজে কথা বলেছে। আমি তাকে পাত্তা দেইনা জন্যই সে এটা করেছে। ”
অবনীর কথা শুনে রাগে ইশরাকের মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। সাদাফেরও একই অবস্থা। সাদাফ কোনকিছু না ভেবে এগিয়ে গেল মাহির দিকে। কোন কথা না বলে ওর কলার চেপে ধরল।
” তোর এতবড় সাহস, অবনীকে এমন জঘন্য কথা বলেছিস? তুই জানিস ও আমার কে? ও আমার বোন, আমার বড় ভাবী। ”
রাগে সাদাফের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। ও কথাগুলো বলেই একটা ঘুষি বসিয়ে দিল মাহির নাক বরাবর। ওর শরীরে যেন অসুরের শক্তি এসে গেছে। এক ঘুষি খেয়ে মাহি মাটিতে পরে গেলে ওকে মাটি থেকে তুলে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে সাদাফ৷ আশেপাশের লোকজন প্রথমে মাহিকে বাঁচাতে আসলেও সাদাফের কথাগুলো শুনে থেমে গেল। তারাও বুঝতে পারছে ছেলেটা ভুল করেছে।
ইশরাক রাগী চোখে তাকিয়ে আছে মাহির দিকে। সে মার খেতে খেতে কাহিল হয়ে গেছে। অবনী কাঁদছে জন্য ওকে রেখে মাহির কাছে যেতে না পারার আফসোস হচ্ছে ওর। এই আফসোস আজীবন থাকবে।
” জান পাখি, এবার কান্না থামা। এখানে একটু দাঁড়াবি? ঐ জানোয়ারটাকে তোর পায়ের কাছে নিয়ে আসতে হবে যে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। আমি এক্ষুণি আসছি। তোকে অপমান করার শাস্তি তাকে না দিয়ে ছাড়বনা আমি। ” অবনীর কপালে কপাল ঠেকিয়ে কাঁপা গলায় বলল ইশরাক। এরপর অবনীকে সেখানে রেখেই গেল সাদাফের কাছে৷
” সাদাফ, অনেক হয়েছে। তুই অবনীর কাছে যা। একে আমি দেখছি। ” কথার মাঝেই ইশরাক শার্টের হাতা গুটিয়ে নেয়। এরপর মাহির কাঁধে হাত রাখল। রক্তাক্ত মাহি দাঁড়ানোর অবস্থায় নেই। কিন্তু ইশরাক ওকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
” ও আমার স্ত্রী, সেটা না জেনেই তুই ওকে অপবাদ দিয়েছিস? কি দোষ ওর? তোকে পাত্তা দেয়নি তাই, এমন জঘন্য অপবাদ দিয়েছিস! ভুল করেছিস। আমার কলিজায় হাত দিয়েছিস তুই। এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে। ” কথাটা শেষ করেই ইশরাক মাহির গালে সর্ব শক্তি দিয়ে থাপ্পড় মারল। এক থাপ্পড়েই মাহির মুখের ভেতরটা রক্তে ভরে গেল। মুখের ভেতর থেকে একটা দাঁত ছিটকে বাহিরে পরল। ইশরাকের সেদিকে নজর নেই। সে ব্যস্ত মাহিকে মারতে।
অবস্থা বেগতিক দেখে আশেপাশের লোকজনের ভেতর থেকে কেউ একজন থানায় ফোন করল।
***
” আপনি বলতে চাইছেন, এই ছেলেটা আপনার স্ত্রীকে অপমান করেছে? প্রমান আছে কোন? ” ডিউটি অফিসারের কথা শুনে ফোন থেকে মনযোগ সরাল ইশরাক।
” আপনার কি মনে হচ্ছে আমি মিথ্যা বলছি? ”
” প্রশ্ন করবেননা। আমি প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দিন। এটা থানা, এখানে আমরা প্রশ্ন করি। অন্যেরা শুধু উত্তর দেয়। ”
” আচ্ছা! তারমানে আপনি এটা বোঝাচ্ছেন যে, এখানে আপনারাই সর্বেসর্বা, জনগণকে আপনারা আঙুলে নাচাবেন? ”
” জাস্ট শাট আপ। এত বড় বড় কথা বলছেন, আপনার পরিচয় কি জানতে পারি? ”
” অফকোর্স, হোয়াই নট। তবে তার আগে ফোন রিসিভ করুন। ”
বিরস মুখে ডিউটি অফিসার ফোনের দিকে তাকায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
চলবে…
#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_৩২
জাওয়াদ জামী জামী
” স্যার, আপনি আগে বলবেননা আপনি এএসপি স্যারের বন্ধু? এইমাত্র ডিএমপি কমিশনার স্যার আমাকে ফোন দিয়েছেন। এএসপি স্যার কমিশনার স্যারকে ফোন দিয়েছেন আপনার কেস আমলে নেয়ার জন্য। কিন্তু স্যার, আমি বুঝতে পারছিনা, এএসপি মৃদুল স্যার থানায় ফোন না দিয়ে কমিশনার স্যারকে ফোন দিল কেন? ” ডিউটি অফিসার বিগলিত গলায় জিজ্ঞেস করল।
” কমিশনার স্যার মৃদুলের চাচা। আর কিছু জানার আছে আপনার? ” ইশরাক শান্ত স্বরে বলল।
” কিছু মনে করবেননা স্যার, লোকটাকে আপনি মারতে মারতে আধমরা করে ফেলেছেন। তার বাঁচার চান্স ফিফটি ফিফটি। তার পরিবার থেকে নিশ্চয়ই আপনার বিরুদ্ধে কেস করবে। তখন কি করবেন, স্যার? ”
” আমরা প্রমান দেখিয়ে দেব, মাহি অবনীকে মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই বিরক্ত করত। আজও সে আগেই অবনীকে এ্যাটাক করেছিল। এবং ওকে হ্যারাজ করেছে। আমি নিজে স্বাক্ষী দেব এবং হোস্টেলের কয়েকজনও অবশ্যই অবনীর পক্ষেই কথা বলবে। আপনাকে অভিযোগ লিখতে বলা হয়েছে, আপনি অভিযোগ লিখুন। আর হ্যাঁ, ভবিষ্যতে অবশ্যই নিজেকে একজন দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে প্রমান করতে সত্যের পক্ষে লড়ার চেষ্টা করবেন। ” অবনীর সাথে থানায় ওর বন্ধু মিশমি এসেছে। সে তীক্ষ্ণ গলায় ডিউটি অফিসারকে উপহাস করল।
ডিউটি অফিসার মুখ কালো করে মিশমির ভাষন শুনল।
” আপনার পরিচয়? ভিক্টিমের সাথে আপনার সম্পর্ক কি? ” ডিউটি অফিসার চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
” আমি মিশমি রেজা। অবনীর বন্ধু আমি। একসাথেই হোস্টেলে থাকি আমরা। আমার বাবা ব্যারিষ্টার শহীদ রেজা, মা প্রফেসর সালমা রেজা। ও হ্যাঁ, আমার মামা সাদিক আমীন যিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রনালয়ে সচিব হিসেবে কাজ করছেন। আর কিছু জানতে চান? ”
” ন…না ম্যাম, যা বলেছেন এটাই যথেষ্ট। আমি অভিযোগ নিচ্ছি। শুরু থেকে বর্ননা করুন সকালে কি ঘটেছিল। ”
মিশমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবকিছু বর্ননা করল।
” মাহি জানতনা ম্যাম বিবাহিতা? ”
” অবনী তাকে ভর্তি হওয়ার পরপরই বলেছিল, ও ম্যারিড। কিন্তু মাহি ওর কথা বিশ্বাস করেনি। যেহেতু অবনী কারও সাথেই তেমন একটা কথা বলতনা, মিশতনা তাই ও মাহিকে বিশ্বাস করাতে যায়নি। ইভেন আমরাও বিশ্বাস করিনি ও বিবাহিতা। আমরা ভেবেছিলাম, অবনী আমাদের সাথে মজা করেছে। ”
” কেন বিশ্বাস করেননি? স্পেসিফিক কোন কারন? ”
” আমরা ভেবেছিলাম, ও ছেলেদের থেকে দূরে থাকতে নিজেকে বিবাহিতা পরিচয় দিয়েছে। মাহিও সেটাই ভেবেছিল। এটা সে নিজে বলেছে। আচ্ছা, আপনি এত প্রশ্ন করছেন কেন? আপনি কি কোনভাবে মাহির পক্ষ নিতে চাচ্ছেন? ”
” তদন্তের স্বার্থে জানতে চাচ্ছি, ম্যাম। ” এরপর আর কোন কথা হলোনা। ডিউটি অফিসার অভিযোগ নিলে ইশরাক সবাইকে নিয়ে থানা থেকে বেড়োনোর উদ্যোগ নিল।
” চলুন আপনাকে পৌঁছে দেই। আপনাকে হোস্টেলে নামিয়ে দিয়ে আমরা বাসায় যাব। ” সাদাফ মিশমিকে বলল।
” নো থ্যাংকস। আপনারা চলে যান। অবনীর শরীরটা বোধহয় ঠিক নেই। আমি রিক্সা নিয়ে চলে যাব। ”
” না করবেননা। আমরা হোস্টেলের পাশ দিয়েই যাব। সাদাফ, গাড়ি দেখ। ”
” ভাইয়া, আমার কথা শুনুন, আপনি অবনীকে নিয়ে বাসায় যান। আমার জন্য চিন্তা করবেননা। আমার একটু কাজ আছে। আমি কাজ সেড়ে হোস্টেলে যাব। ”
” ওকে। সময় করে একদিন বাসায় আসবেন। ভালো লাগবে আপনি আসলে। ”
” শিওর। ”
ইশরাক সাদাফ দুই ভাইকেই পছন্দ হল মিশমির। স্বল্পভাষী দু’জনের মধ্যে ব্যাক্তিত্বের ছটা দেখে অবাক হয় মিশমি। সেই সাথে বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। বাবা-মার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে হবে। যাকে মিশমির পছন্দ নয়। যার অবস্থান কিনা মিশমির বিপরীত মেরুতে।
চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়েই অবনীর মাথা ঘুরে গেল। তাল হারিয়ে পরে যেতে লাগলে ইশরাক ওকে ধরে ফেলল।
” অবনী, ঠিক আছিস তুই? কোথায় খারাপ লাগছে আমাকে বল? ” ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল ইশরাক।
অবনী কিছু না বলে ইশরাকের দিকে তাকাল। ওর চেহারা দেখে ইশরাক বুঝে গেল মেয়েটা ঠিক নেই। প্রায় সাথে সাথেই ইশরাক অবনীকে কোলে তুলে নিল। ইশরাকের এমন কাজে অবনী প্রথমে ভয় পেলেও পরক্ষণেই দু হাত দিয়ে ইশরাকের গলা পেঁচিয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখল। মিশে রইল ইশরাকের বুকের সাথে।
মিশমির মন নিমেষেই ভালো হয়ে গেল দৃশ্যটা দেখে। সায়েমও এমন। সে-ও মিশমির সামান্য মন খারাপেই উদগ্রীব হয়ে পরে। ওর মন ভালো করতে তৎপর হয়ে যায়। মনে মনে মিশমি ভাবল, চাইলেও মানুষ সবকিছু পায়না। কোন মানুষই পরিপূর্ণ নয়। মাঝেমধ্যে কিছু অপরিপূর্ণতাকেও সাথী করে মানুষকে সুখী হতে হয়।
সাদাফ গাড়ি নিয়ে আসলে ওরা রওনা দেয়। ইশরাকের কোলে মাথা রেখে গাড়ির সিটেই শুয়েছে অবনী। অবশ্য ইশরাকই ওকে শুইয়ে দিয়েছে।
বিল্ডিংয়ের সামনে এসে গাড়ি থেকে নামল সাদাফ। গাড়ি থেকে নেমে আবারও অবনীকে কোলে নেয় ইশরাক। আশেপাশের সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ইশরাক কোনদিকে না তাকিয়ে অবনীকে নিয়ে লিফ্টে উঠল।
***
” ওয়েলকাম ঠু ইওর রেলম। ” অবনীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হাসিমুখে বলল ইশরাক।
অবনী রুমের ভেতরে চোখ বুলাল। মোটামুটি গোছানো হয়েছে রুমটাকে।
” পছন্দ হয়েছে? ” আবারও জিজ্ঞেস করল ইশরাক।
মাথা নাড়ল অবনী। কথা বলার শক্তি পাচ্ছেনা।
” কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা? ” অবনীকে নিরব থাকতে দেখে ইশরাক ওর গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল।
” ক্ষুধা লেগেছে। গতকাল সকালের পর কিছু খাওয়া হয়নি। ” দুর্বল গলায় বলল অবনী।
” কেন? খাওয়া হয়নি কেন? ” অবাক হয়েছে ইশরাক।
” সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। রাতে মাথা ব্যথা করছিল। খেতে ইচ্ছে করেনি। ”
ইশরাক দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সাদাফকে পাঠাল খাবার আনতে। এরপর রান্নাঘরে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে রুমে গেল।
” তুই এমন কেন বলতো? চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে তুই না খেয়ে আছিস। শরীর তো এমনিতেই খারাপ হবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর সাদাফকে পাঠিয়েছি খাবার আনতে। ”
অবনী মাথা নেড়ে সায় জানায়। চোখ বন্ধ করে পরে রইল বিছানায়। ইশরাক ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ইশরাকের ছোঁয়া একটুও খারাপ লাগছেনা অবনীর। ওর প্রতিটা ছোঁয়ায় শিউরে উঠছে মেয়েটা।
পনের মিনিট পরই সাদাফ বাসায় আসল। ও খাবারের প্যাকেট পানি অবনীর রুমে দিয়ে বেরিয়ে গেল অবনীর হোস্টেলের উদ্দেশ্যে। অবনীর জিনিসপত্রগুলো এখনো হোস্টেলেই রয়ে গেছে। সেগুলো আনতে হবে।
ইশরাক অবনীকে খাইয়ে দিল। খাওয়ার পরপরই ঘুমিয়ে গেল সে। মাথা ব্যথার কারনে রাতে ঘুমাতে পারেনি। ক্ষুধায়, মাথা ব্যথায় শরীরটা দুর্বল ছিল। খাওয়ার পরই শরীরটা নেতিয়ে পরল। আর ঘুমিয়ে পরল সাথে সাথেই।
ঘুম ভাঙ্গলে রুমে ইশরাককে মেঝেতে ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকতে দেখল অবনী। সে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছে। শরীরটা ঝরঝরে লাগছে। হাই তুলে দরজার দিকে তাকাতেই দেখল ওর ব্যাগগুলো রাখা আছে।
” এসে গেছে আমার জিনিসপত্র? ”
” উঠে গেছিস? শরীর ভালো লাগছে এখন? ”
” হুঁ। ” অবনী আর কিছু না বলে সোজা বেলকনিতে গেল।
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। সামনের একটা বিল্ডিংয়ের ছাদে চোখ গেল। নানান রঙের ফুলের মেলা বসেছে সেখানে। মুগ্ধ নয়নে সেদিকে তাকিয়ে থাকে অবনী। হঠাৎই উপলব্ধি করল ওর পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। অবনী গ্রীলে কপাল ঠেকিয়ে তাকিয়ে ছিল সামনের ছাদের দিকে। ওর দু হাত দু’দিকের গ্রীল আঁকড়ে ধরেছে। সে অবস্থাতেই ওর হাত দু’টোকে আঁকড়ে ধরল কেউ। থুঁতনি রাখল অবনীর খোলা কাঁধে। অবনীর বুঝতে বাকি রইলনা সে কে। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল মেয়েটার। শরীরের ভার ছেড়ে দিল ইশরাকের ওপর। ইশরাক বুঝতে পারল ওর রমনীর মনোভাব।
” কিছুক্ষণের জন্য বাহিরে যেতে হবে আমাকে। সাদাফ বাসায় নেই। একা থাকতে পারবি? ”
” পারব। ”
” ভয় করবেনা তো? ”
” উঁহু। ”
” কিছু লাগবে তোর? ”
” হুঁ। ” একটু ভেবে উত্তর দিল অবনী।
” কি? ”
” একটা লাল শাড়ী। ”
” আর? ”
” একমুঠো কাঁচের চুরি। ”
” তারপর? ”
” বেলি ফুলের মালা। ”
” আর কিছু? ”
” আলতা। ”
” এখনো আলতা পরিস? ”
” চার বছর ধরে আলতায় পা রাঙাইনা। ”
” সরি। ”
” কেন? ”
” সবকিছুর জন্য। ”
অবনী নিরব থাকল।
” আর কিছু লাগবে? ”
মাথা নাড়ল অবনী।
” কি? ”
” একটা লাল পাঞ্জাবি। ”
হাসি ফুটল ইশরাকের ঠোঁটের কোনে।
” তোর জন্য আর কি আনব সেটা বল? ”
” বলেছি তো। ”
” ভয় লাগলে আমাকে ফোন দিস। আমি যাচ্ছি। ”
হঠাৎই অবনী ওর কাঁধে ভেজা অথচ নরম ছোঁয়া অনুভব করল। কয়েক সেকেন্ড ছিল সেই ছোঁয়ার স্থায়িত্ব। অবনী ঠোঁট কামড়ে হাসল। পেছন ফিরে তাকালনা।
ইশরাক হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অনুমতি পেয়ে গেছে। আজকের পর থেকে অবনীর সুখের কারন হবে সে। সুখের জোয়ারে ভাসাবে তার নারীকে।
চলবে…