হলুদ বসন্ত পর্ব-৩৫

0
26

#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_৩৫
জাওয়াদ জামী জামী

অনেকদিন পর গ্রামে এসে খুশিতে পাগল হওয়ার দশা অবনীর। মা, বড়মাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদল। এরপর ছুটল দাদুর কাছে। দাদু বিছানা নিয়েছেন কয়েকদিন হয়েছে। খেতে পারছেননা ঠিকমত। তিনি প্রথমে অবনীকে চিনতে পারলেননা। পরে যখন চিনতে পারলেন তখন খুশিতে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। দাদুর অবস্থা দেখে ইশরাকের মন খারাপ হয়ে গেছে। ও বুঝতে পারল, দাদু আর বেশিদিন থাকবেনা। কথাটা মনে আসতেই ইশরাকের কান্না পেল। মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠল ছোটবেলার কতশত স্মৃতি। দাদুর কাঁধে উঠে হাটে যাওয়া, রাত জেগে দাদুর কাছ থেকে গল্প শোনা, দাদুর হাত ধরে নদীতে গিয়ে সাঁতার কাটা কতশত স্মৃতি জমে আছে হৃদয়ের মনিকোঠায়। সেই দাদুই আর ওদের মাঝে থাকবেনা এটা ভাবতেই কষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসছে ইশরাকের।

নাজমা আক্তার এবং মিনারা খাতুন দুই জা মিলে এটাসেটা রান্না করছেন, পিঠা বানাচ্ছেন। অর্নি মা, বড়মাকে কাজে সাহায্য করছে। মোটকথা, দুই পরিবারে যেন মিলন মেলা বসেছে।

***

” ইশু বাপ, এবার কি তোরা অর্নকে সাথে নিয়ে যাবি? মেয়েটার কিন্তু পড়াশোনা খুব একটা হচ্ছেনা। আজকাল ও পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছে। ” মিনারা খাতুন ইশরাকের কাছে জানতে চাইলেন।

” তার আগে তোমার মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বিয়ের পর ওকে নিয়ে ঢাকা যাব। তোমার মেয়েটা আর ছোট নেই বুঝলে? ”

” বিয়ে দেব? এখনই? অর্নি ছোট নেই জানি। কিন্তু হুট করে ছেলে পাব কোথায় যে ওর বিয়ে দেব? আবার বিয়ে দিলেই যে শ্বশুর বাড়ি থেকে ওকে ঢাকা যেতে দেবে এমনটাও কিন্তু নয়। ”

” দেশে পাত্রের অভাব পরেছে নাকি চাচি? তোমরা শুধু রাজি হও, দেখবে এক তুরিতে আমি পাত্র তোমার সামনে হাজির করব। ”

” শুধু আমি রাজি হলেই হবে? তোর চাচা আছে, আব্বা আছে, বড় ভাই আছে। সবাইকে রাজি থাকতে হবে। ”

সাদাফ সরু চোখে তাকিয়ে আছে ইশরাকের দিকে। ঘটনা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে সেটা বোঝার চেষ্টা করছে। ওর মাথায় ঢুকছেনা, হঠাৎ করে কেন ভাইয়া অর্নার বিয়ের কথা তুলল?

অর্নিও চোপসানো মুখে মাথা নিচু করে বসে থাকল। ওর বুক ধুকপুক করছে। মন কু ডাকছে। মা যদি বিয়েতে রাজি হয়, তবে কি হবে? কি বলবে সবাইকে?

” আমার বিশ্বাস যে পাত্রের কথা তোমাদের কাছে উপস্থাপন করব, সবাই একবাক্যে রাজি হবে। পাত্র লাখে এক। উচ্চ শিক্ষিত, উচ্চবংশীয় এবং পাত্রের বাবা-মাও এক কথায় সজ্জন ব্যাক্তি। এমনকি পাত্রের ভাই-ভাবীও সেইম। এবার বল রাজি কি-না? ”

ইশরাকের কথা শুনে অর্নির কান্না পাচ্ছে। এমনকি ফুঁপিয়েও উঠল। সাদাফ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ইশরাকের দিকে।

” কিসব বিয়ে বিয়ে করছ, ভাইয়া? কয়দিন পর অর্নির এডমিশন। আর তুমি কিনা ওর বিয়ের জন্য পাগল হচ্ছ? তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি। ” সাদাফ ইশরাককে থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল।

” তুই থাম। তুই কি বুঝবি, মেয়ে বড় হলে বাবা-মার চিন্তা সম্পর্কে ? একমাত্র বাবা-মাই জানে মেয়েকে একটা ভালো পরিবারে বিয়ে দিতে কতটা বাছবিচার করতে হয়। বাবা, চাচা, আমি কি ভুল কিছু বলেছি? ”

” ভুল বলিসনি। আমি কিছুদিন থেকেই অর্নির বিয়ের কথা ভাবছি। দুই-চার জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাবও আসছে। আমি সবাইকে না করে দিয়েছি। তবে কতদিন এভাবে চলবে সেটা বলতে পারিনা। ভালো পাত্র পেলে বিয়ে তো দিতেই হবে। ” ওয়াহাব আহমেদ চিন্তিত গলায় বললেন।

” বাবা, তুমি কি বল? ” ইশরাক ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করল।

” আমি আর কি বলব। যাদের মেয়ে তারা যদি বিয়ে দিতে চায়, আমি না করবনা। মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে বিয়ে দিতেই হবে এটাই নিয়ম। মেয়েকে সৎ একজন পাত্রের হাতে তুলে দিতে পারলে বাবা-মা শান্তি পায়। ”

” শুনলে চাচি, সবাই রাজি আছে? এবার বল তুমি রাজি কিনা? রাজি থাকলে আমি পাত্রের খোঁজ দেব তোমাকে। ”

সাদাফ বুঝল ইশরাক যে করেই হোক অর্নির বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। তাই ও সিদ্ধান্ত নিল, ইশরাক পাত্রের পরিচয় দেয়ার সাথে সাথেই ও অর্নকে বিয়ে করতে চাইবে। ও অর্নকে হারাতে চায়না। যেকোন কিছুর বিনিময়ে ওর অর্নকে চাই।

” সবাই যখন রাজি আমি আর কি বলব। ভালো একটা পাত্র দেখ। ”

” পাত্র আর দেখব কি! নগদে পাত্রকে হাজির করব তোমাদের সামনে। ”

” বলিস কি? কোথায় তোর সেই নগদের পাত্র? ” এবার কথা বললেন নাজমা আক্তার।

” কোথায় থাকে তোর সেই পাত্র? ” জিজ্ঞেস করলেন মিনারা খাতুন।

” বল কি চোখের সামনে দিনরাত পাত্র ঘুরঘুর করছে, কিন্তু তোমরা কেউই দেখতে পাওনা? সবারই কি একসাথে চোখের প্রবলেম দেখা দিয়েছে? ”

ইশরাকের হেয়ালি কথাবার্তায় সবাই বেশ অবাক হয়। ওয়াহাব আহমেদ তো বলেই ফেললেন,

” আমাদের চোখে সমস্যা হয়নি, মনে হচ্ছে তোর মাথায় সমস্যা হয়েছে। নইলে চোখের সামনে পাত্র কোথায় দেখলি? ”

” কেন চাচা, সাদাফকে কি তোমাদের পাত্র বলে মনে হয়না? ”

ইশরাকের একটা কথায় রুমের মধ্যে বোমা ফাটালো। মিনারা খাতুন আর ওয়াহাব আহমেদ একে-অপরের মুখপানে চাইলেন। নাজমা আক্তারও অবাক হয়েছেন। তিনিও তাকিয়েছেন স্বামীর দিকে। তার মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করছেন।

এদিকে সাদাফ ইশরাকের কথা শুনে হাঁফ ছাড়ল। বুকের ওপর থেকে মস্ত একটা পাথর নেমে গেল নিমেষেই। সে চাইল অর্নির দিকে।

অবনীই শুধু নিরুত্তাপ বসে থাকল। ও বোঝার চেষ্টা করছে ইশরাক কি চায়। এবং যেকোন পরিস্থিতিতেই অবনী ইশরাকের পাশে থাকবে।

” যা বলেছিস ভেবেচিন্তে বলেছিস তো, ইশু? আমি চাইনা কোন ভুল সিদ্ধান্তে আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মনোমালিন্য হোক। এত বছর ধরে আমরা মিলেমিশে আছি, তাই কোন ভুল সিদ্ধান্তে সেই বন্ধন হালকা হয়ে যাক সেটা আমি চাইনা। ” অবশেষে ওয়াহাব আহমেদ বললেন।

” মা, বাবা, তোমাদের কি মনে হচ্ছে আমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি? আমার জন্য তোমাদের দুই পরিবারের সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে? ”

” মোটেওনা। আমার ইশু কখনোই কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। অন্তত সাদাফ, অর্নির ক্ষেত্রে তো নয়ই। আমরা সবাই কমবেশি জানি তুই অর্নিকে কতটা ভালোবাসিস। কিন্তু আমাকে একটা কথা বল, হঠাৎ করেই তোর কেন মনে হল অর্নির বিয়ের কথা? ” নাজমা আক্তার ছেলের পক্ষ নিয়ে বললেন।

” সাধেই কি বলেছি, তোমাদের সবারই চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে। নইলে ওরা দু’জন যে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে সেটা তোমাদের চোখে আগেই পরত। যেহেতু ওরা কাউকেই কিছু জানায়নি, তাই ওদের দু’জনকে এক করার দ্বায়িত্ব আমাকেই নিতে হল ৷ ”

এবার বাড়ির সকলেই ইশরাকের কথা শুনে বিস্মিত না হয়ে পারলেননা। সবাই একযোগে তাকালেন অর্নি সাদাফের দিকে৷ সবাইকে তাকাতে দেখে লজ্জা পেল অর্নি। ও দ্রুতই জায়গা ত্যাগ করতে চাইল। কিন্তু রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই ইশরাক ওর হাত ধরে আটকাল। আর সাদাফ, সে তো মাথা চুলকে হাসছে।

” কিহ্! কবে থেকে এসব চলছে? ভেতরে ভেতরে এসব চলছে কিন্তু আমরা কেউই জানতে পারলামনা, দেখতে পেলামনা ! ” অবাক হয়ে বললেন নাজমা আক্তার।

” দেখার চোখ থাকলে তো দেখবে। ”

” তুমি জানলে কিভাবে? কয়দিনই বা গ্রামে এসে থেকেছ? নাকি আজকাল চোখে বেশি দেখছ? ” অবনী ইশরাককে খোঁচা মারতে ভুললনা।

” দিনের পর দিন গ্রামে এসে থাকলেই কি সব জানা যায়? কোন কিছু জানতে হলে কয়েক বছর কিংবা কয়েক মাস লাগেনা। দেখার চোখ থাকলেই সহজেই অনেক কিছুই দেখা যায়। তোর তো আবার সেই চোখ নেই। তোর চোখে শুধু মেডিকেলে ঝোলানো কংকালই পরবে এটাই স্বাভাবিক। ”

” আসছে দার্শনিক। এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন সে-ই দেশের একমাত্র চোখওয়ালা ব্যাক্তি। ”

” চুপ থাক। আমাকে আমার কাজ করতে দে। আসছে কাজের মধ্যে বাগড়া দিতে। বাবা-মা, চাচা-চাচী, তোমাদের মতামত জানতে চাচ্ছি আমি। ”

ইশরাকের কথা শুনে কুলসুম বেগম কিছু বলতেও পারছেনা আবার সইতেও পারছেনা। তার ইচ্ছে ছিল তার ছোট মেয়ের কন্যাটিকে সাদাফের বউ করবে। কিন্তু ইশরাকের কথায় তার আশার মুখে মাটি পরতে চলেছে।

” আমার আবার মতামত কি হবে! যেহেতু আমার ছেলেই অর্নকে পছন্দ করে, সেখানে ভেটো দেয়ার আমি বা আমরা কে? তুই কি বলিস, ওয়াহাব? ” ইসহাক আজাদ নির্ভেজাল গলায় বললেন।

” তোমার কথার সাথে আমিও একমত। জীবনটা যেহেতু ওদের, তাই ওদের পছন্দের গুরুত্ব আমাদেরকে দিতে হবে। ”

” আমিও এটাই বলব। অর্নকে ছোট ছেলের বউ করতে আমার কোন আপত্তি নেই। বরং খুশিই লাগছে আমার। ” নাজমা আক্তার অর্নির কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর কপালে চুমু দিয়ে বললেন। বড়মার এমন কাজে লজ্জা পেল অর্নি।

” তাহলে আর দেরি কেন? বিয়ের ব্যবস্থা কর। আগামী তিনদিনের মধ্যেই বিয়ে দাও ওদের। এরপর অর্নকে নিয়ে ঢাকা যাব। দুই বোন চুটিয়ে সংসার করবে। বনিবনা না হলে চুলোচুলি করবে। অবশ্য এক্ষেত্রে অবনীকে হারানো অর্নর জন্য কঠিনই হবে। তারপরও অর্নর জন্য আমার শুভকামনা থাকবে। ”

ইশরাকের কথায় সকলে হেসে উঠলেন। কিন্তু অবনীর মুখে হাসি নেই। ও কটমটিয়ে তাকিয়ে আছে ইশরাকের দিকে।

চলবে…