হলুদ শহরের প্রেম পর্ব-০১

0
127

#হলুদ_শহরের_প্রেম’ – [০১]
লাবিবা ওয়াহিদ

–“ডিভোর্সি আপুরে ভেজা কাপড়ে করড়া লাগতেছে। এত সুন্দর মা*লরে ছাড়ল ক্যান আপনের জামাই? আমাদের জন্য নাকি?”

কথাটা বলার পরপরই দলবদ্ধ হাসির সুর কানে এলো নিপুণের। এরকম বাজে কথা শুনে তার গা গুলিয়ে বমি আসার মতো অবস্থা, ছি! কত জঘন্য মানসিকতার এরা।

নিপুণ এতক্ষণ বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় বাস স্টপেজের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। যেই বৃষ্টিটা কমে গেল হাঁপ ছেড়ে দ্রুত পায়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা দিয়েছিল। কিন্তু নিপুণ বেশিদূর যেতে না যেতেই আবারও ঝুম বৃষ্টি নামলো। রাতের আকাশ দেখে নিপুণ বুঝতে পারেনি যে আবারও আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। এজন্য বৃষ্টিতে অনেকটা ভিজে গিয়েছে সে। দাঁড়ানোর জায়গাও নেই এদিকটায়। ভিজে যেহেতু গেছেই দাঁড়িয়ে কাজ নেই ভেবে সে দ্রুত পায়ে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। রিকশা, সিএনজিরও যেন এই মুহূর্তে অকাল পড়েছে।

হেঁটে যাওয়ার সময়ে দুটো বাইকে করে চারজন বখাটে ছেলে নিপুণের পাশে পাশেই এগিয়ে আসছে এবং চরম জঘন্য কথা বলে তাকে উত্ত্যক্ত করছে। নিপুণের কান গরম হয়ে গেছে এদের কথা শুনে। আবার মুখ খুলে তর্ক করাও চরম বোকামি বই কিছু না। এজন্য নিজেকে কোনোরকমে শাড়ির আঁচল দ্বারা আবৃত করে দ্রুত পায়ে বাসায় পৌঁছানোর দোয়া করছে।

–“কী আপু, শীত করে? শীত করলে আমাদের মধ্যে একজনকে কম্বল বানিয়ে ফেলেন!”

আবারও দলবদ্ধ অট্টহাসি। নিপুণের রাগে-দুঃখে চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। উপচে আসা অশ্রু চোখ জুড়ে টলমল করছে। এদিকে বৃষ্টিও থামার নাম-গন্ধ নেই। এই প্রথমবারের মতো বৃষ্টির প্রতি নিপুণের চরম রাগ হলো।

–“আব্বে, ওই? এদিকে কী তোদের?”

ভরাট, পুরুষালি চেনা কণ্ঠস্বর কানে ধাক্কা খেতেই নিপুণ থমকে দাঁড়ায়। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পিছে ফিরে তাকাতেই দেখল রিকশা করে কেউ একজন এদিকে আসছে। এই কণ্ঠস্বর ছেলেগুলোর বেশ পরিচিত। এজন্য তারা কোনো দিক না তাকিয়েই বাইক টান দিলো। ওদের পালাতে দেখে আবারও একই গলায় চিৎকার শোনা গেল,
–“ওই কাপুরুষের দল, পালাচ্ছিস কোথায়? যা বলার ছিল আমার সামনে এসে বল, দেখতাম তোদের বুকে কত পাঠা!”

রিকশা এসে থামলো নিপুণের সামনে। রিকশায় থাকা যুবক ছাতা হাতে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াল। নিপুণ চোখে পানি নিয়েই শক্ত নজরে তাকিয়ে আছে তার সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে। সুপ্ত নিপুণের মাথার উপর ছাতা ধরে বলল,
–“ওরা বাজে কথা বলছিল তাই না?”

নিপুণ এতক্ষণে মুখ খুলল। গলা খাদে নামিয়ে বলল,
–“বললে বলুক, আপনার কী?”

নিপুণের কথার তোয়াক্কা করলো না সুপ্ত। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। চোখ জোড়া এতক্ষণে প্রায় লাল হয়ে গিয়েছে। রাগ চেপে কয়েক শব্দে উচ্চারণ করে বলল,
–“চেহারা দেখলে চিনতে পারবে?”

–“চিনলেই বা কী? আপনি আমার ব্যাপারে নাক গলানো ছাড়ুন।”

এবারও নিপুণের বাঁকা উত্তর। মেয়েটা যেন জন্মই নিয়েছে বাঁকা জবাব দেওয়ার জন্য। এমন অবস্থাতেও সুপ্ত তার ধৈর্যের কঠিন পরীক্ষা দিলো। রাগ চেপে অত্যন্ত শান্ত গলায় সুপ্ত বলল,

–“থাক, বলতে হবে না৷ ওদের গন্ধ শুঁকে ঠিকই ওদের কাছে পৌঁছে যাব, তুমি রিকশায় উঠো।”

নিপুণ এতে ঘাবড়ে যায়। গলা খাদে নামিয়ে বলল,
–“খবরদার আমাকে জড়িয়ে কোনো ঝামেলা করবেন না। আমি ঝামেলাহীন, শান্তিপ্রিয় মানুষ। আমাকে শান্তিতে থাকতে দিন, প্লিজ!”

সুপ্ত দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“তুমি রিকশায় উঠবে?”
–“আগে আমার কথার জবাব দিন।”
–“তুমি আমার কোন কথাটা শুনো যে আমি তোমার কথা শুনব?”

রাগে নিপুণের অধর জোড়া তরতর করে কাঁপছে। কিছু বলতে পারল না সে। কিছু না বললেও সেখান থেকে নড়লও না। সুপ্ত ভ্রু কুচকে নিপুণের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। মিনমিন করে বলল,
–“ভেজা কাপড়ে তোমাকে ভালো লাগছে না নিপুণ। আমার কথা শোনো, রিকশায় উঠো। একদম বাসায় পৌঁছে দিবে। এই অবস্থায় আমাকে ঝামেলা করতে বাধ্য করিও না।”

বৃষ্টির বেগ অনেকটা কমে এসেছে। নিপুণ নিজের দিকে তাকাতেই তার গলা শুকিয়ে এলো। জেদ করে কাজ নেই, এর চাইতে ভালো রিকশায় উঠে পড়বে। তাই করলো সে। বৃষ্টির থেকে বাঁচার জন্য নীল পলিথিনটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিল সে। সুপ্তর দিকে একপলক তাকাল। সুপ্ত ছাতা বন্ধ করে তার পানেই চেয়ে। নিপুণ নজর ঘুরিয়ে রিকশা চালককে যেতে বলল।

সুপ্ত এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে নিপুণের চলে যাওয়া দেখল। বৃষ্টি এখন একদমই নেই। চারপাশে এশারের আযান শোনা যাচ্ছে। আযান শেষ হওয়া অবধি সুপ্ত সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। এর মাঝে বাইক চালিয়ে সুপ্ত’র সামনে এসে থামে দীপক। সুপ্ত’র দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে দীপক বলল,
–“কীরে, এখানে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

সুপ্ত চোখ ফিরিয়ে দীপকের দিকে তাকাল। চোখ জোড়া মুহূর্তেই লাল হয়ে গেল। বিশ্রী এক গালি দিয়ে বলল,
–“আমার এলাকায় দাঁড়িয়ে আমার নিপুণকে কিছু কুকুর উত্ত্যক্ত করে গেছে। এখন দাঁড়িয়ে ভাবছি এদের আগে হাত ভাঙব নাকি পা! পারলে জিভটাই আগে টেনে ছিঁড়ব।”

দীপক ব্যাপারটা বুঝলো। কিন্তু এই ব্যাপারে কথা না বাড়িয়ে বলল,
–“সে ব্যবস্থা পরে করা যাবে। এখন আমার সাথে চল মসজিদে। আঙ্কেলের সাথে রাস্তায় দেখা হয়েছিল। বলেছে তোকে ধরে-বেঁধে যেন মসজিদ নিয়ে যাই। চল আমার সাথে।”

মিনহাজ সাহেবের কথা শুনে সুপ্ত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। জীবনে সুপ্তের উপর গলাবাজি একমাত্র তার বাবাই করতে পেরেছে। এছাড়া দ্বিতীয় কারো সাহস হয়নি এই কাজ করার। সুপ্ত নিঃশব্দে দীপকের পিছে উঠে বসল। মিনমিন করে বলল,
–“চল।”
দীপক আনমনে প্রশ্ন করল,
–“কোথায়?”

সুপ্ত দীপকের পিঠে এক ঘুষি দিয়ে বলল,
–“গর্ধব, মসজিদ চল।”

——————
বাড়ির সামনে রিকশা এসে থামতেই নিপুণ রিকশা থেকে নামল। ভাড়া দিতে গেলেই রিকশা চালক জানায় ভাড়া দেওয়া লাগবে না। নিপুণ ভ্রু কুচকে বলল,
–“কেন?”
–“ভাই ভাড়া দিয়ে দিছে।”

নিপুণ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। ওই লোকটা আস্ত পাগল, অসভ্য। রিকশা চালকের সাথে তর্ক করার শক্তিও অবশিষ্ট নেই তার। নীরবে কেচিগেটের তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। ক্লান্ত পায়ে যখন উঁচু নিচু সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছিল তখন বারংবার তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছিল। তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো অকল্পনীয় ঝড় হচ্ছে বিয়ে, তার পরপরই ডিভোর্সের তকমা গায়ে লেগে যাওয়া। ডিভোর্সি তকমার জন্য আশেপাশে মানুষের মুখে কটাক্ষ, বাজে কথা শুনতে শুনতে নিপুণ ক্লান্ত। এই পা, শরীর যেন চলতেই চায় না। তারা যেন মুক্তি চায় বেঁচে থাকার এই কঠিন লড়াইয়ে।

দোতলার বাম পাশের পুরানো নীল দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নিপুণ। খটখট শব্দে দরজায় কড়া নাড়ল। কলিংবেল নষ্ট পড়ে আছে অনেকদিন। নতুন করে কলিংবেল লাগানোর সময় হয়ে উঠছে না যেন। প্রতিদিন বাসায় ফিরে দরজার সামনে দাঁড়ালেই কলিংবেলের কথা মনে পড়ে। লাগাবে লাগাবে করেও আবার ভুলে বসে।

নিপুণের ভাবনার মাঝেই দুই পাটের নীল দরজাটা খুলে দাঁড়ায় নিপুণের ছোটো ভাই নিশাত। নিপুণের ছোট্ট জীবনটা নিশাতকে ঘিরেই। নিশাত ছাড়া এই জগতে তার আপন কেউ নেই। থাকলেও তারা আপনের কাতারে পড়ে না। নিপুণ জুতা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে নিশাতকে শাসিয়ে বলল,
–“কতবার বলেছি, দরজা খোলার আগে জিজ্ঞেস করে নিবি কে এসেছে।”

নিশাত এতে মুচকি হেসে বলল,
–“এই সময়ে তুমি ছাড়া আর কেউ আসবে না, তা আমি ভালো করেই জানি আপা। আর বারান্দা দিয়েই তোমাকে দেখেছিলাম রিকশা থেকে নামতে।”

নিপুণ আর কিছু বলল না। সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। ভেজা শাড়ি পালটে ঘরের জামা পড়ে আগেই চলে গেল রান্না বসাতে। আজকে বৃষ্টির জন্য আসতে দেরী হয়ে গেছে। অন্যান্য দিন সন্ধ্যার মধ্যেই সে চলে আসে। না জানি নিশাত কতক্ষণ খালি পেটে রয়েছে। নিপুণ রান্না বসাতে বসাতে নিশাতকে হাঁক ছেড়ে ডেকে বলল,
–“কিছু খেয়েছিস নিশাত?”

ভেতর থেকে নিশাতের গলা শোনা গেল,
–“হ্যাঁ আপা, বিস্কুট খেয়েছি। বাইরে থেকেও চা খেয়ে এসেছিলাম।”

নিপুণ আর কিছু বলল না, দ্রুত হাতে রান্নাটা সেরে নেয়। আজকে ভাই-বোন বেশ তাড়াতাড়িই রাতের খাবার সেরে ফেলল। খাওয়া শেষ করে নিপুণ বসল ল্যাপটপ নিয়ে। আর নিশাত বসল বই-খাতা নিয়ে। নিশাত এবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে। এক মাস বাদেই নিশাতের পরীক্ষা। এজন্য নিপুণ যতটা সময় পায়, নিশাতকে নিজে পড়ানোর চেষ্টা করে। নিপুণ প্রায় প্রতিদিন রাতেই রিপোর্ট লিখতে বসে৷ নিপুণ সাংবাদিকতার রিপোর্টিং বিভাগে চাকরি করছে। এটাকে প্রায় ‘অনলাইন মিডিয়া’-ই বলা হয়। মাস দুয়েক হলো এই চাকরিতে ঢুকেছে সে। রিপোর্ট লেখার ফাঁকে ফাঁকে নিশাতের পড়ার ব্যাপারটাও সে দেখে।

নিপুণ বিরতিহীন টপাটপ ল্যাপটপের কী চাপতে চাপতে নিশাতকে বলল,
–“কতখানি পড়া আগিয়েছ?”
নিশাত তাকে আপডেট করল। নিপুণের নজর তখনো ল্যাপটপের স্ক্রিনে স্থির।

রাত সাড়ে বারোটা অবধি কাজ চলল। নিপুণ নিশাতকে তার রুমে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেও লাইট নিভিয়ে বিছানায় ক্লান্ত গা এলিয়ে দেয়। তবে তার আগে একবার বারান্দার দরজা চেক করে নিয়েছে সে। পুরান আমলের জীর্ণশীর্ণ তিন তলা বাড়ি এটা। সেই আমলের হওয়ায় বারান্দাগুলো একদম খোলা, কোনোরকম গ্রিলের ব্যবস্থা নেই। তাই নিজের সুরক্ষার দিকে একটু বেশি-ই সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।

নিপুণ অন্ধকারে শূন্য নজরে চেয়ে জীবনের খাতা খুলে নিল। একে একে জীবনের হিসাব-নিকাশ করতে লাগল, যা নিপুণের প্রতিদিনকার স্বভাব। জীবনের হিসাব মেলাতে গিয়ে অপ্রাপ্তির হিসেবটাই বেশি হলো। শেষ কী নিয়ে তার জীবন প্রাপ্তির রঙে রঙিন ছিল তার জানা নেই। নিপুণ মাঝেমধ্যেই ভাবে, এত অপ্রাপ্তি ঘিরে কী করে সে বেঁচে আছে? নিশাতের জন্য? হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে নিপুণের ক্লান্ত চোখে একসময় ঘুম নেমে এলো।

সকালের আকাশে মেঘেদের বিচরণ। রাস্তা-ঘাট তখনো ভেজা, জায়গায় জায়গায় অল্প বিস্তর পানি জমেছে। সেগুলোও আবার শুকিয়ে যাবার পথে। খুব করে বোঝা যাচ্ছে ভোরের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টির রেশ এখনো আকাশের বুক থেকে কাটেনি। নিপুণ চুলের খোপা করতে করতে বারান্দার দু পাটের দরজাটা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে শীতল হাওয়া প্রবেশ করল। তা নিপুণকেও ছুঁয়ে দিল। মুক্ত বাতাসে নিপুণ চোখ বুজে নিঃশ্বাস নিলো। পরমুহূর্তেই দেয়াল ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে তৈরি হতে চলে যায়।

এখন সে বাজারে যাবে। ঘরে বাজার-সদাই প্রায় শেষের দিকে। একবার নিশাতের ঘরে উঁকি দিয়েই সদর দরজার দিকে চলে গেল। হাতে জুতো নিয়ে দরজা খুলতেই দেখল দরজার সাথে ঝুলানো তাজা গোলাপ এবং রজনীগন্ধা ফুল। ফুলের সাথে একটা ছোটো চিরকুট।

ফুলের শখ কিংবা ফুলের প্রতি দুর্বলতা নেই এমন মেয়ে খুঁজলে খুব কমই পাওয়া যাবে। নিপুণ আনমনেই ফুলগুলো ছুঁয়ে হাতে নিয়ে নিলো। চিরকুটটা হাতে লাগতেই সেটার ভাজ খুলে নিপুণ গোটা গোটা অক্ষরে নজর বুলালো। প্রথমত, লেখা মোটেও গুছানো নয়। হাতের লেখার প্রতি যে একরাশ অযত্ন সেটা লেখাতে নজর বুলিয়েই বোঝা গেল।

চিরকুটে লেখা,
“শুনেছি, ভালোবাসা প্রকাশ করতে চাইলে ফুল দিয়ে প্রেমিকার মন জিতে নিতে হয়। তাই সাত-সকালে শাহবাগ চলে গিয়েছিলাম বৃষ্টিভেজা তাজা ফুল আনতে। খুব যত্নের সাথে এনেছি, একটা আঁচড়ও কাটতে দেইনি ফুলে। এই যত্নের বদলে কী একমুঠো ভালোবাসা পেতে পারি, গরম মেজাজী নিপুণ?”

চলবে—