হলুদ শহরের প্রেম পর্ব-০৭

0
78

#হলুদ_শহরের_প্রেম – [০৭]
লাবিবা ওয়াহিদ

নিপুণের ছোটো জীবনে অপ্রাপ্তিতে ভরতি, দমবন্ধকর ঘটনা কম ঘটেনি। সবচেয়ে বেশি জল ঘোলা হয়েছে তার তালাকের পরপর। বাবা-মায়ের থেকে দূরে থাকত সে এক এলাকায়। নিশাতকেও ততদিনে নিপুণ এক হোস্টেলে দিয়েছে। নিপুণ দুজন মেয়ের সাথে খুবই নিম্ন ভাড়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকত। পড়াশোনার পাশাপাশি টুকটাক কিছু না কিছু কাজ করত সে। এর মাঝে এলাকার এক সবজি ব্যবসায়ীর ভাইয়ের নজরে পড়ে সে। লোকটা এখানকার স্থানীয় ছিল। বিয়ে করেনি তবে মেয়েদের নানান ভাবে উক্ত্যক্ত করে বেড়াত এলাকাজুড়ে। লোকমুখে শোনা যায়, র‍্যাপের মতো নিকৃষ্ট কাজও সে করেছে। সেই লোক নিপুণের পিছে পড়ে যায়। নিপুণকে অশালীন প্রস্তাব দেয়, খারাপ ভাবে স্পর্শ করতেও ছাড়েনি। নিপুণ লোকটাকে চোখ রাঙাত, ধমকাত। কিন্তু কিছুতেই কিছু হতো না। মুখ বুজে বেশিদিন নিতে পারেনি। সে লোকটাকে তো একা কিছু করতে পারবে না, এজন্য সোজা থানায় চলে গেলো মামলা দিতে। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। উলটো নিপুণই ফেঁসে গিয়েছে। রাত-বিরেতে সেই লোক মাতাল হয়ে নিপুণের ফ্ল্যাটে পাগলের মতো দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে অশ্লীল ভাবে গালাগাল করত। এতে করে সেই বাড়ির ভাড়াটিয়া সহ বাড়ির মালিকও বিরক্ত হয়৷ পরপরই সবাই জানতে পারল নিপুণ একজন ডিভোর্সী মেয়ে। আর সেই লোকটা তো ছিলই রসিয়ে রসিয়ে বাজে কথা ছড়ানোর জন্য। সে চারপাশে ছড়িয়েছে নিপুণ নাকি তাকে অনেকভাবে প্রেমে ফেলতে চেয়েছিল৷ এরকম আরও কত বাজে কথা। এলাকা জুড়ে সেই কী হৈ-হুল্লোড়। বাড়িওয়ালা নিপুণকে বাসা ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। সেই বাড়িওয়ালার আগুনে আরও ঘি ঢেলে দেয় নিপুণের জন্মদাতা বাবা। একদিনের মধ্যে নিপুণ বাড়ি ছেড়ে দেয়। শুধু বাড়ি-ই নয়। সেই এলাকা ছেড়ে বহুদূরে চলে আসে। নিশাতকে হোস্টেল থেকে নিয়ে এসে দুজন মিলেই থাকতে শুরু করে দেয়। নিশাতের স্কুল বদলাতে হয়নি অবশ্য।

এই ঘটনা হঠাৎ-ই নিপুণের স্মৃতিতে বিচরণ করলো। একবার, দু’বার নয়.. অসংখ্যবার। পৃথিবীর কোনো পুরুষ মানুষের প্রতি তার বিশ্বাস জন্মায় না। সে প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে ঠকে গিয়েছে পুরুষদের দ্বারা। নিজের ঘরের একমাত্র পুরুষ, নিজের বাবাও ছাড় দেয়নি৷ মুখজুড়ে অন্ধকার নিয়েই সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো। চোখ জোড়া থমকে আছে আকাশের বুকে। খোলা, স্নিগ্ধ হাওয়া তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। খোলা হাওয়ার সঙ্গে নিপুণের খোলা চুলও একই তালে দুলছে। নিপুণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। গাল জোড়া যেন তার ঠান্ডা বাতাসে জমে আছে। নিপুণের তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।

দীপক এবং সুপ্ত এসেছে নিপুণের বাড়ির নিচে। নিপুণের বাড়ির সামনের ল্যাম্পপোস্টের লাইটটা বন্ধ। নষ্ট হয়ে পড়ে আছে আজ কয়েকদিন যাবৎ। সেই ল্যাম্পপোস্টের সাথে হেলান দিয়েই সুপ্ত আবছা আলোয় নিপুণকে দেখছে। দীপক সেখান থেকে কিছুটা দূরের টঙে বসে চা খাচ্ছে৷ আর সুপ্ত সিগারেটে ফুঁক দিয়ে শূন্যে ধোঁয়া উড়িয়ে নিপুণকে এক নজরে দেখেই গেল। নিপুণ তার জন্যে এক সুখের নাম৷ এই সুখের সন্ধান সুপ্ত জীবনে প্রথম নিপুণের থেকেই পেয়েছে।

সুপ্ত নিপুণকে প্রথম দেখেছিল এক দুর্ঘটনায়। দুই বন্ধু মিলে বাইকে ছিল। দীপক অসাবধানবশত বাইক একদম রিকশার সাথে লাগিয়ে দেয়। এতে করে রিকশায় যে ছিল সে ধপ করে পড়ে যায়। এটা দেখে সুপ্ত দীপকের মাথায় এক চড় মেরে বাইক থেকে নেমে দাঁড়ায়। দীপককে বকতে বকতে যেই না মেয়েটির দিকে আসলো, তখনই দেখলো মেয়েটা ছিলে যাওয়া হাতের দিকে চেয়ে চাপা স্বরে আর্তনাদ করছে। সুপ্তের খারাপ লাগা কাজ করছিল। এজন্য সে মেয়েটাকে ডাকতেই মেয়েটা তার দিকে আগুন চোখে তাকায়। সেই মেয়েটাই ছিল নিপুণ। সুপ্ত সেই প্রথমদিনই নিপুণের আগুন চোখের গভীরে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।

অতীতের স্মৃতি মাথায় আসতেই সুপ্ত আপনমনে হাসলো। হাতের শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটের শেষ অংশ পায়ের নিচে পিষে আরেক পল চাইলো বারান্দার দিকে। কিন্তু বারান্দায় নিপুণ নেই। ভেতরে আলো জ্বলছে। এর মানে নিপুণ চলে গেছে। সুপ্তের চোখ-মুখে বিরক্ত ফুটে উঠলো। আশেপাশে তাকিয়ে দীপকের কাছে চলে গেলো।

দীপক তখন চায়ে ডুবে আছে। সবেই এক কাপ চা শেষ করে আরেক কাপ নিলো। যেই না দ্বিতীয় কাপে প্রথম চুমুক দিবে তখনই সুপ্ত এসে সেই চায়ের কাপ কেড়ে নিলো এবং দীপকের মুখোমুখি বসে চা খেতে লাগলো।

মুখের খাবার মুখ থেকে কেড়ে নেওয়া ক’জন সহ্য করতে পারে? দীপকও নিজেকে সামলাতে পারলো না। অত্যন্ত রেগে গিয়ে বলল,
–“এই বা*। মাত্রই চা-টা নিয়ে খেতে বসছি। তুই প্রেম করতে এসে আমার চা নিছিস কেন? ফেরত দে।”

সুপ্ত কয়েক চুমুকে গরম ধোঁয়া ওঠা চা শেষ করে খালি চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
–“নে খা।”

দীপক দাঁতে দাঁত চেপে ফুঁসে গেলো। সুপ্ত চায়ের কাপ এবার টঙে বসে থাকা জমিল চাচার কাছে দিয়ে বলল,
–“আরেক কাপ চা দেন চাচা। অবশ্যই আমার জন্য। কড়া লিকারের দিবেন। এই দীপকের টেস্ট ভালো না। এমন ম্যারা ম্যারা চা কী কেউ খায়? মুখটা কেমন বিষাদ লাগছে।”

দীপক ক্ষেপে গিয়ে আরেকটা বাজে বকা দিলো সুপ্তকে। সুপ্ত যেন শুনলোই না। ওদের কাণ্ড দেখে জমিল চাচা হাসতে লাগলো। এবার সুপ্ত দীপকের পাশে গিয়ে বসল। আপনমনে বলল,
–“মন ভালো নেই বন্ধু।”

–“ক্যান, প্রেম খেদিয়ে দিলো নাকি? ভালোই হইছে, সর ভাগ।”

সুপ্ত সরে বসলো না। চিন্তিত সুরে বলল,
–“আজকে যা হয়েছে তা মোটেও ঠিক হয়নি। আগামীতে সাবধানে থাকতে হবে। ভাবছি লোক লাগিয়ে রাখব নিপুণের পিছে, যাতে করে এই ধরণের ঘটনা যেন আর না ঘটে।”

দীপক ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। এগুলা যে সুপ্তের ভাবনাতে সীমাবদ্ধ নেই তা দীপক জানে। সুপ্ত একদম সিদ্ধান্ত নিয়েই তাকে জানাচ্ছে। এবার সুপ্তের চাটা দীপক কেড়ে নিলো। খেতে খেতে বলল,
–“কালকে কিন্তু পার্টি অফিসে মিটিং আছে।”

সুপ্তের এতে কপালে ভাজ পড়লো। আগামীকালের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ দিনে কী না মিটিং! সুপ্ত দীপকের কাছ থেকে সময় জেনে নেওয়ার পর আবার বলল,
–“সার্কাস তবে আগে আগেই শেষ করতে হবে।”

————————–
জয়নাল এক বুক আশা নিয়ে স্ত্রীর অপেক্ষা করলো অনেকক্ষণ৷ তার আশায় জল ঢেলে জয়নালের স্ত্রী সারা রাতেও এলো না। জয়নাল ঘুমের চোটে চোখ খুলে রাখতে পারছিল না দেখে শেষ রাতে গিয়ে জেলের মধ্যে একদিকে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমাতে পারেনি অবশ্য বেশিক্ষণ। কারো চড় খেয়ে জয়নাল ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। জয়নাল চমকে সামনে তাকাতেই দেখল অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে আছে তার সাথের কয়েদি। সে তার লাল দাঁত কপাট বের করে বলল,
–“ভুল হইছে স্যার। চটকানাটা গালে না দিয়ে টাকে দেওয়া দরকার ছিল। আমার আবার টাক ওয়ালা স্যারগো টাকে মারার অনেক শখ।”

অদ্ভুত প্রকৃতির এই লোককে মুহূর্তেই কেমন ভয়ঙ্কর লাগলো। গতকাল রাতেই এই মাতাল লোকটাকে জেলে ভরেছে পুলিশ। মাতাল হয়ে মরার মতো পড়ে ছিল এক কোণায়। কিন্তু এই লোক যে সজ্ঞানে এসেও এমন উৎপাত করবে বুঝতে পারেনি জয়নাল। সুপ্তের লোক ভেবে জয়নাল সরে এলো লোকটার থেকে। কিন্তু এই লোক আরও এগিয়ে এলো জয়নালের দিকে। জয়নালের টাকের দিকে তাকিয়ে কিসব অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেই যাচ্ছিল। জয়নাল এবার ধমক দিয়ে ওঠে লোকটাকে। লোকটা এতে রেগে গিয়ে সত্যি সত্যি জয়নালের টাকে জোরে চড় দিয়ে বসলো। জয়নাল এতে আর্তনাদ করে ওঠে। পাগলা গরু আর মাতালদের সাথে লাগতে নেই। এটা জয়নাল হাড়ে হাড়ে বুঝে নিলো। এজন্য সে শান্তির জন্য আরেকটু সরে বসলো। কিন্তু ওই মাতাল লোক জয়নালকে হুমকি দিয়ে বলল,
–“আবার সরলে তোরে আবার চাটি মারমু।”

কঠিন যা-তাকলে পড়ে গেল জয়নাল। একে তো এই লোকের গা থেকে দুর্গন্ধ সাথে মুখ থেকে কেমন মদের বিশ্রী গন্ধ, তাতে জয়নালের বমি চলে আসছে। মনে মনে স্ত্রীকে ডাকলো। সে কেন আসছে না? এই মাতালটার হাত থেকে রেহাই পাবে কী করে? টাকের চড়টা ভীষণ জোরে ছিল। এর গায়ের এত শক্তি যে জয়নালের মাথা এখন টনটনে ব্যথা করছে।

চলবে—