হলুদ শহরের প্রেম পর্ব-০৮

0
74

#হলুদ_শহরের_প্রেম – [০৮]
লাবিবা ওয়াহিদ

জয়নালের এই অবস্থা দেখার পর সকাল থেকেই থানাতে কেউ না কেউ জয়নালের উদ্দেশে অভিযোগ কিংবা মামলা ঠুকে গেল। নতুন করে জানা গেল জয়নালের চরিত্র আগে থেকেই খারাপ৷ সে ছাত্রীদের উপর বেশি জুলুম করেছে। প্রেম নিবেদন, আজেবাজে প্রস্তাব, গায়ে হাত দেওয়া এগুলা তো ছিলোই। এমনকি সে তার একজন কলিগের সাথেও প্রেম করেছেন। সব তার বিয়ে থাকাকালীন। এজন্য ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে মোটেও ভালো চোখে দেখে না। এজন্যই নিশাতও এত ক্ষেপেছিল। জয়নালের নাকের ডগা দিয়ে যে এতকিছু ঘটে গেল সেটা সে মাতালের মাতলামিতে পড়ে বুঝতেই পারেনি।

অবশ্য, জয়নালের এক বুক অপেক্ষার অবসান ঘটালো তার স্ত্রী। বেশ বেলা করেই তিনি থানায় এসে উপস্থিত হলেন। জয়নালের নিভু নিভু আশাতে তখন তীক্ষ্ণ আলো পড়েছে। জয়নাল বেশ গদগদ। স্ত্রী তাকে ভীষণ ভালোবাসেন। নিশ্চয়ই সে এসব বিশ্বাস করবেন না।

জয়নাল যখন তার কারাগারের তালা খুলতে দেখল তখন মনে হলো জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য সেটা। জয়নালকে নিয়ে যাওয়া হলো তার স্ত্রীর সম্মুখে। জয়নালের স্ত্রী এক ফ্লোরাল প্রিন্টের বোরকা পরা। মাথায় সুন্দর করে হিজাব বাঁধা। জয়নাল আবেগপ্রবণ হয়ে স্ত্রীর নাম ধরে ডাকলো। তৎক্ষণাৎ স্ত্রী খাদিজা চোখ গরম করে তাকালেন স্বামীর দিকে। জয়নাল ভড়কে গেল তাতে। খাদিজার চোখ জোড়া কেমন লাল হয়ে আছে। যেন কোনো হিংস্র বাঘিনী। জয়নাল এতে প্রশ্ন করলো,
–“এ কী? তোমার চোখ এরকম দেখাচ্ছে কেন?”

পরপরই জয়নাল লক্ষ্য করলো খাদিজার উজ্জ্বল গালে লাল আভা। খাদিজা ভাঙা গলায় বলল,
–“গতকাল থেকে জ্বর ছিল, তাই আসতে দেরী হয়েছে।”

জয়নাল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। কিছুটা দূরে নজর ফেলতেই দেখল সুপ্ত থানার এক দরজার সাথে হেলান দিয়ে চুইঙ্গামের বাবল ফোটাচ্ছে। অধরে লেপ্টে আছে গা জ্বালানো হাসি। সুপ্ত গলায় হাত দিয়ে গলা কা/:টার ভঙ্গি দেখিয়ে হাসলো। অর্থাৎ সুপ্ত বোঝাতে চাইলো,
–“তুই শেষ আজ।”

জয়নাল এতে ভ্রু কুচকালো। সুপ্তকে এড়িয়ে জয়নাল স্ত্রীর উদ্দেশে বলল,
–“আমি কিছু করিনি খাদিজা। ওরা মিথ্যা রটিয়েছে আমার নামে। তুমি আমাকে নিয়ে যাও। তোমার ভাইকে এখুনি থানায় আসতে বলো।”

খাদিজা এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেও সে সর্বসম্মুখে আচমকা জয়নালকে সজোরে চড় দিয়ে বসলো৷ জয়নাল সেই চড় খেয়ে হতভম্ভ, নির্বাক হয়ে পড়ল। তার সবচেয়ে সহজ, শান্ত স্ত্রী কিনা এভাবে তার গায়ে হাত ওঠালো? জয়নাল কী স্বপ্ন দেখছে? খাদিজা চেঁচিয়ে উঠে বলল,
–“কী মনে করেছিস আমি সব জেনে-বুঝেও এখানে তোকে ছাড়াতে আসছি? নাহ! তোকে আমি এই ভেবে দেখতে আসছি যে তুই আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে যা করেছিস তা নিয়ে কীভাবে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়াস? কিন্তু তুই চরম বেশরমের বেশরম। আমার ভাই তোকে একজন ভালো শিক্ষক ভেবে আমাকে তোর সাথে বিয়ে দিয়েছিল। আর তুই কী না এসব করে বেড়াস? ছি।”

জয়নাল তখনো ঘোরের মাঝে। সে ঘোরের মধ্যেই বলে ওঠে, “তুমি আমাকে চড় মারলে?”

–“হ্যাঁ, মারলাম। তো? তুই কী ভুলে গেছিস আমার ভাই কী জিনিস? ভাইয়ের রক্ত আমার গায়েও বইছে। তাই আমাকে সহজ ভেবে চরম বোকামি করলি। যা, মর গিয়ে গারদে। তোকে আমি এক আনারও মূল্য দেই না এখন। বাসায় গিয়ে সন্তানদের বলব তোদের বাপ মরে গেছে। এই লোক তোদের বাপ হতেই পারে না।

আর হ্যাঁ, আমার ভাই আজ আসেনি সেটা তোর ভাগ্য। এজন্য এই জেলই তোর বেঁচে থাকার জন্য বেস্ট অপশন। মর গিয়ে, শু*র।”

খাদিজা অত্যন্ত আক্রোশ নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে গেলো। একদম সুপ্তের পাশ কেটেই। জয়নাল স্ত্রীর যাওয়ার পানে তাকাতেই দেখলো সুপ্ত মোবাইলে এই পুরো ঘটনা নিজ হাতে ভিডিও করেছে। ঘটনা শেষ হতেই সে ফোন নামিয়ে নিয়েছে। এ দেখে জয়নালের ঠিক কোন অভিব্যক্তি দেখানো উচিত তার জানা নেই। তার যে একূল, ওকূল দুটোই গেল।

সুপ্ত ভিডিওটা নিয়ে জয়নালের সামনে আসলো। জয়নালের কাছাকাছি এসে গলা খাদে নামিয়ে বলল,
–“মনের শান্তির জন্য ভিডিওটা করেছি। এখন ইচ্ছে হচ্ছে সবাইকে দেখাতে। এত সুন্দর দৃশ্য, ড্যাম।”

জয়নাল চোখ রাঙাতে গেলেও পারল না। গায়ে তার সেই শক্তিও এখন নেই। সে শুধু নিরবে সুপ্তের গা জ্বালানো হাসি গিলে নিলো।

নিপুণ আজকের সব ঘটনাই একে একে রিপোর্টে লিখলো। তার বুক ভরা স্বস্তি তাকে এক ঘোরের মাঝে রেখেছে। সুপ্ত তাকে একটা ভিডিও পাঠিয়েছে, যেখানে জয়নালকে তার স্ত্রী অপদস্থ করছে। সুপ্ত এও বলেছে জয়নালের স্ত্রী বাচ্চাদের আপাতত দূরে পাঠানো হবে কয়েক মাসের জন্য। যাতে করে বাপের পাপ তার সন্তানদের না ছোঁয়। এতকিছুর পরে নিপুণের বোধহয় সামান্য হলেও মন গললো সুপ্তের প্রতি। সুপ্ত তার জন্য এত কিছু করেছে, অবশ্যই সে ধন্যবাদ প্রাপ্য। সাথে সেই মানুষটাও, যে কিনা জয়নালকে হাতেনাতে ধরেছে। তাদের দুজনের জন্যই সমাজের এক আবর্জনার দুর্গন্ধ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিলো। নিপুণ সিদ্ধান্ত নিলো, সুপ্তের সাথে দেখা হলে কোনো এক ফাঁকে তাকে ধন্যবাদটা জানিয়ে দিবে।

————-
জোবেদা মূলত ঘটকালি করে। এলাকায় তার “জোবেদা ঘটক” নামে বেশ পরিচিতি। এলাকায় বেশ কিছু বিয়েও তিনি নিজ উদ্যোগে দিয়েছেন। তবে সেসব বিয়ে কতটা টিকেছে সেটা নিয়ে সবার মাঝেই আবছা সন্দেহ রয়েছে। তবে জোবেদা কখনোই তার পেশার ক্ষেত্রে হার মানেনি। কারো বাড়িতে মেয়ে আঠারো, উনিশ পেরিয়েছে? জোবেদা সেই বাড়িতে চট করে হাজির হয়ে যায়। ছেলেদের বেলাতেও তাই করে। তবে সে কখনোই সোজা ভাষায় কাউকে বিয়ের কথা বলে না। তার বিশেষ ধাপ আছে। প্রথমে বাড়ির কর্ত্রীর সাথে খুব ভাব করবেন। লম্বা আড্ডা দিবেন। দু’তিনদিন সময় নিয়ে কোনো এক ছুঁতোয় বেশ ছলের সাথে তার আসল উদ্দেশ্য প্রকাশ করবেন। অভিভাবকও বেশ সহজেই তার কথার ভ্রমে আটকে যায়। জোবেদা সেই সুযোগেই বলবে,
–“আমার হাতে বেশ কিছু ছেলে আছে। আপনের আপত্তি না থাকলে আমি তাদের পরিবারের সন্ধান আর ছেলের ছবিও দেখাতে পারি। ভালো লাগলে বলবেন, না লাগলে মামলা ডিসমিস। আর এমনিতেও, আপনেরে আমি কী কখনো খারাপ ছেলের সন্ধান দিতে পারি? আপনেরে আমি সেরাটাই দিব।”

এভাবেই মূলত তার কথা শুরু হয়। একই কার্যক্রম জোবেদা সাবিনার উপরেও মাড়িয়েছে। তবে সাবিনাকে মানানো সহজ ছিল না। বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়েভহে জোবেদার। এইযে, এখন টানা কয়েকটা মেয়ের সন্ধান দিলো সাবিনাকে। কিন্তু সাবিনার আবার ছেলেকে নিয়ে অনেক অহংকার। ছেলের সাথে কোনো মেয়েকেই মানাচ্ছে না। এজন্য সে অকপটে সব সম্বন্ধ ফিরিয়ে দিলেন। জোবেদাকে আরও জোর দিয়ে বললেন আরও ভালো মেয়েদের সন্ধান দিতে।

জোবেদা মুখ ঘুচে ফেলল সহজেই। মনের মধ্যে সাবিনাকে কয়েক পাট গালমন্দ করতেও পিছপা হলো না। তেতো ভাব নিয়ে জোবেদা বলল, “ভালো করে দেখছেন তো ওদের?”

সাবিনার অকপট জবাব, “দেখেছি। তুমি আরও মেয়ে দেখো। একটামাত্র সোনার টুকরো ছেলে আমার। বিয়ে জীবনে একবারই করবে। তাই বউমাও মন মতো হওয়াটা প্রয়োজন।”

জোবেদার মুখ বেজার, অন্তরজুড়ে গালমন্দ। সাবিনা থেমে আবার বললেন, “তুমি চিন্তা করো না, তোমার সম্মানী আরও বাড়িয়ে দিবো। তুমি শুধু ভালো মেয়ে দেখো। যদি না পারো বলে দিও, আমি অন্য কাউকে এই কাজ দিব।”

একে তো সম্মানী বাড়ার কথা, তার উপর কাজ হাতছাড়া হওয়ার হুমকি। দুটোয় মিলিয়ে ঠিক কী অভিব্যক্তি প্রকাশ করবে তা তালগোল পাকিয়ে গেল জোবেদার। তবে খুশিতে মুখ রাঙিয়ে বলল, “একদম চিন্তা নিবেন না। আমি মেয়ে দেখিয়ে চমকায় দিব, জোবেদার ওয়াদা।”

——————-
জয়নালের সর্বশেষ আপডেট নিয়ে রিপোর্ট লেখার ভার নিপুণের ওপরই পড়ল। সে আঙুল চালিয়ে ধপাধপ টাইপ করে গেলো শুধু। যত লিখছে ততই যেন মনের ভার হালকা হচ্ছে। লোকটা তবে তার অকাজগুলোর শাস্তি পেতে চলেছে। রিপোর্ট মেইল করে দিতেই রিয়া এসে দাঁড়াল নিপুণের ডেস্কের পাশে। এক কাপ কফি এগিয়ে দিলো নিপুণকে। নিপুণ মুচকি হেসে ধন্যবাদ জানালো রিয়াকে। রিয়া নিজের কফিতে চুমুক দিয়ে নিপুণকে পরখ করলো। সন্দিহান গলায় বলল,
–“কী ব্যাপার নিপুণ? আজ এত খুশি খুশি লাগছে কেন তোমায়?”
নিপুণ থতমত খেয়ে যায়৷ হাসিও দমে গেলো মুহূর্তেই। আসলেই কী আজ নিপুণকে বেশি খুশি লাগছে?

মানুষের খুশি সবসময় মনে চেপে রাখা যায় না। সেটা কোনো না কোনো ভাবে প্রকাশ পাবেই। হয় চোখের হাসিতে, অধরের হাসিতে নয়তোবা বান্দার মুখজুড়ে সেই খুশি বিস্তার করবে। নিপুণও তার খুশি চেপে রাখতে ব্যর্থ হয়। নিপুণ হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “কোথায়?”

রিয়া ভীষণ সূক্ষ্ম নজরে চেয়ে আছে নিপুণের দিকে। এতে নিপুণ অপ্রস্তুত হলো। রিয়া আচমকা বলল,
–“প্রেমে-টেমে পড়েছ নাকি?”

–“ছি, প্রেম? কী বলছ?” নিপুণ মুখ ফসকে বলে ফেলল। তা শুনে রিয়া মুখ বেজার করে ফেলল। বলল,

–“প্রেমের মতো এত সুন্দর অনুভূতিকে তুমি কী করে ছি বলছ নিপুণ?”

নিপুণ এতে দমে গেল। রিয়া আবার বলল,
–“প্রেমে পড়ে আবার প্রেমকেই ছি বলছ? সত্যি নিপুণ, তুমিও না!”

–“কীসব বলছ রিয়া? আমি প্রেমে পড়তে যাব কেন?”

–“পড়বে নাই বা কেন? এখনই তো প্রেমে পড়ার, বিয়ে করার, সংসার সাজানোর বয়স। তবে?”

রিয়ার এসব কথায় নিপুণের ফুরফুরে মন ভঙ্গুর হয়ে যায় নিমিষেই। সংসার, বিয়ে কথাটা মাথায় নাড়া দিতেই নিপুণ অনেকটা ঘুচে গেলো। নীরবে কফির কাপে চুমুক দিলো সে। রিয়া সেসব খেয়াল না করে ভীষণ উচ্ছ্বাস মাখা গলায় বলল,
–“আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব আসছে ইদানীং। এতদিন বিয়ের কথা না ভাবলেও এখন ভাবছি শুভ কাজটা করেই ফেলব। তুমি কী বলো?”

শুকনো হাসলো নিপুণ। বলল,
–“বিয়ে করবে ঠিক আছে, তবে আগে থেকে পাত্রের সম্পর্কে সবকিছু জেনে নিবে। এক চুল পরিমাণও ছাড় দিও না। নয়তো জীবনের ছোটো একটা ভুলও তোমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে৷ তাই জীবনের প্রতিটা ধাপ খুব সাবধানে, পরখ করে ফেলতে হয়।”

চলবে—