হলুদ শহরের প্রেম পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
104

#হলুদ_শহরের_প্রেম – [অন্তিম]
লাবিবা ওয়াহিদ

নিপুণ এবং সুপ্তের বিয়ের প্রায় বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গিয়েছে। সাবিনা এখনো নিপুণের সাথে সহজ হননি। বেশ দূরত্ব বজায় রাখেন নিপুণের থেকে। নিপুণ এতে কষ্ট পায়, কিন্তু বর্ণা তাকে সামলে নেয়। সুপ্তও নিপুণকে ভরসা দেয়, সাবিনার একটু সময় লাগলেও নিপুণকে মেনে নিবেন। তার মা উপরে উপরে শক্ত দেখালেও তিনি ভেতর থেকে বেশ নরম। নিপুণ ভরসা পায়, চেষ্টা করে শাশুড়ীর মন যুগিয়ে চলতে।

মাসুদাকে বের করে দেওয়ার পর অন্য এক মধ্যবয়সী মহিলা এনে দিয়েছে সুপ্ত, কাজের জন্য। এই মহিলা শুধু এই বাড়িতেই কাজ করবেন। এর বদলে মাস শেষে বেতন আর থাকা খাওয়া সব এ বাড়িতেই। মহিলাকে সবাই সজলের মা বলে ডাকে। সজলের মা বেশ ভালো এবং নরম মানুষ। কথা-বার্তাতেও তার নম্রতা আছে। সাবিনার মন জয় করতে মহিলা বেশি সময় নেয়নি।

মাসুদাকে বের করে দেওয়ার বেশ কিছু কারণ ছিল। সাবিনা শুনেছেন মাসুদা এ বাড়ি সে বাড়ি গিয়ে তাদের ঘরের কথা বলে বেড়ায়। তবে আরও দু’চার লাইন নিজের মতো মিশিয়ে বলে। সেখানে নিপুণকে সুপ্ত পছন্দ করেছে; বাজে পরিস্থিতি। যখন সাবিনা হাড়ে হাড়ে বুঝে গেল ছেলের পছন্দেই ছেলেকে বিয়ে দিতে হবে তখনই কৌশলে মাসুদাকে কাজ ছাড়া করলেন। মাসুদার এতে কিছুই আসবে যাবে না, সে এমনিতেও কাজ পেয়ে যাবে। তবে সাবিনা নিপুণকে নিয়ে তিনি কোনো রিস্ক নিতে চাচ্ছিলেন না। যতই অপছন্দ করুক না কেন নিপুণকে, সবশেষে সুপ্তের বউ হবে সে।

এই চিন্তাগুলো সাবিনা কাউকে মুখ ফুটে বলেনি। কিন্তু বাড়ির সবাই নীরবে সব বুঝে নিয়েছে। সুপ্ত নিজেও নিপুণকে এই ব্যাপারে বিস্তারিত বলেছে। সাবিনার প্রথম দিকে এরকম ধাক্কা নিতে কষ্ট হবে তা ঠিক, কিন্তু সে কখনোই নিপুণের কোনো সমস্যা হতে দিবে না, এটা সুপ্ত বেশ ভালো করেই জানে।

সুপ্তের বিয়ের কথা আপাতত আত্নীয় স্বজনদের মধ্যেই জানাজানি হয়েছে। মিনহাজ সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সুপ্তের এই ইলেকশনের ঝামেলা মিটে গেলেই ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করবেন। এতে সবাই সহমত জানায়। সুপ্ত নিজেও।

ইলেকশনের বেশি দেরী নেই। সুপ্ত দিন-রাত এই খেটে যাচ্ছে ইলেকশনের পেছনে। এবার তার সংসদ সদস্য হওয়ার লক্ষ্য সে পূরণ করেই দম নেবে। তাতে যত বাঁধাই আসুক না কেন। সুপ্ত ক্লান্তমুখে যখন বাড়ি ফিরে নিপুণকে দেখে তখন তার অর্ধেক ক্লান্তি নিমিষেই গায়েব হয়ে যায়। নিপুণ যখন সংসারী মেয়েদের মতো করে নিজের আঁচল দিয়ে সুপ্তের গাল, কপালের ঘাম মুছে দেয় তখন সুপ্তের বাকি ক্লান্তিও ফুরিয়ে যায়। ফুরফুরে মেজাজে তখন চট করে গোসল সেরেই নিপুণকে জড়িয়ে ধরবে। প্রতিবারের মতো বলবে,
–“থ্যাঙ্ক ইয়্যু নিপুণ, আমাকে ভালোবাসার জন্য।”

নিপুণ তখন সুপ্তের সদ্য ভেজা বুকে লেপ্টে মিনমিন করে বলে,
–“আপনাকেও ধন্যবাদ, সবকিছুর জন্য।”

নিপুণ এখন অফিস যায় না। অফলাইনের কাজ অনলাইনে নিয়ে এসেছে সে। এতে অবশ্য বেতন কমে গিয়েছে। তাতেও সমস্যা নেই। নিপুণ ভেবেছিল চাকরিটা ছেড়ে দিবে। কিন্তু সাবিনা এই বিষয়ে নিজে বলেছেন, “খুব বেশি সমস্যা না থাকলে তুমি কাজ করতে পারব। বাঁধা দিব না।”

শাশুড়ীর থেকে এই প্রথম এই ধরণের অনুমতি পেয়ে নিপুণের ভেতরটা অনেকখানি ভারমুক্ত হয়। সাবিনা নিপুণের রেজাল্ট সম্পর্কে জানে। এত ভালো রেজাল্ট নিয়ে ঘরে বেকার বসে থাকা ঠিক হবে না। এই ভেবে সাবিনা বারণ করেননি। দিনকে দিন যে সাবিনা মুখে স্বীকার না করেও প্রতিনিয়ত যে নিপুণের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ অওরে যাচ্ছে সেটা নিপুণ গভীর ভাবে টের পাচ্ছে। নিপুণ বহুদিন পর মা মা গন্ধ পেয়েছে শাশুড়ীর থেকে। এতে শক্ত নিপুণ মুহূর্তেই ইমোশনাল হয়ে পড়ে, চোখ জোড়া তার ছলছল করে উঠে। মানুষটা তার সমস্ত খামতি জেনেও তাকে ভালোবেসে যাচ্ছে। এই বুঝি মায়ের ভালোবাসা? মায়েরাই যে সন্তানের সমস্ত দাগ নিজের মমতা দ্বারা মুছে দেয়। সাবিনাও কী তাই?

নিশাত মামা বাড়িতে থেকেই তার কোর্সগুলো কমপ্লিট করেছে। রেজাল্ট হাতে পাওয়ার পর বেশিদিন লাগেনি তার ভিসা পেতে। অস্ট্রেলিয়ায় থাকা নিপুণের মামারা খুব দ্রুত হাতেই সব সেরেছেন। নিশাতের ফ্লাইট সামনের সপ্তাহে। সুপ্ত একদিন দাওয়াত করে আনলো নিশাতকে। নিপুণ সেদিন নিজ হাতে ভালো-মন্দ রান্না করলো। এক টেবিলে পুরো পরিবার একসাথে বসে সেদিন খেয়েছিল। ভোজনের পুরো সময়ে সকলে নিপুণের রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। তৃপ্তিতে সেদিন নিপুণের চোখে জল ভরে এসেছিল।

আজ নিশাতের ফ্লাইট। এয়ারপোর্টের দিকে নিপুণ এবং সুপ্ত রওনা হয়েছে। নিপুণের মুখ জুড়ে কষ্ট বিচরণ করছে। যেই ভাইকে এতদিন নিজের কাছে আগলে রেখেছিল সেই ভাই আজ তার দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যাবে। কবে ফিরবে নিপুণের কাছে তা জানা নেই। সুপ্ত একমনে নিপুণের দিকে চেয়ে আছে। নিপুণ সেই নজর লক্ষ্য করে গোমড়া মুখে বলল,
–“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

সুপ্ত হাসলো। নিপুণের নাক আলতো ছুঁয়ে বলল,
–“যাকে ভালোবাসি তাকে দেখলে কোনো ক্ষতি আছে?”

নিপুণ তাকালো সুপ্তের দিকে। বলল, “যদি থাকে?”
সুপ্তর নজর গভীর হলো। ঘোর লাগা গলায় বলল, “ক্ষতি থাকলেও আমি তোমাকেই দেখব।”

নিপুণ লাজুক হাসলো। এই হাসিটাই যে সুপ্ত দেখতে চেয়েছিল। এয়ারপোর্ট এসে নিপুণ নিজের ভাইকে জড়িয়ে খুব কাঁদলো। নিশাত যেন আজ বেশ বড়ো হয়ে গিয়েছে। কেমন বাচ্চাদের মতো করে কাঁদতে থাকা নিপুণকে জড়িয়ে ধরে বড়োদের মতো সামলে নিচ্ছিল। অবশেষে নিপুণকে এক আকাশ মায়ায় জড়িয়ে নিশাত টার্মিনাল দুই দিয়ে এয়ার্রপোর্টের ভেতরে চলে গেলো।

ইলেকশন একপ্রকার দরজায় কড়া নাড়ছে। সুপ্তের ব্যস্ততার সাথে দিন পার হলেও নিপুণ তাকে যথেষ্ট সামলে নিচ্ছে। স্বামী বাইরে ইলেকশনে দাঁড়িয়েছে আর স্ত্রী ঘরে বসে তার স্বামীকে নিয়ে রিপোর্ট লিখছে। সুপ্ত যখন বাড়ি ফিরে ঘুমানোর আগে নিপুণের রিপোর্ট লেখা দেখে তখন মুচকি হেসে বলে,
–“রিপোর্টার ম্যাম কী তার স্বামীর প্রশংসা লিখতে ব্যস্ত?”

এতে নিপুণ মুচকি হেসে বলে,
–“সেটা বাইরের মানুষকে বলা নিষিদ্ধ।”

ইলেকশনে বিপুল ভোটে সুপ্ত বিজয়ী হলো। কয়েকদিনের মাথায় প্রার্থী থেকে সংসদ সদস্যও হয়ে গেলো সে। মিনহাজ সাহেব এত খুশি হলেন যে মাহমুদকে নিয়ে পুরো এলাকা জুড়ে মিষ্টি খাওয়ালেন। সাবিনা এতিমখানার বাচ্চাদের বিরিয়ানি বাটলেন। তাতে সাহায্য করেছে সাবিনার দুই পুত্রবধূ। ছেলের এত বড়ো সফলতায় এই আয়োজনগুলো না করলে চলে? এতদিনে সাবিনাও নিপুণের সাথে বেশ সহজ হয়ে এসেছে।

এত সুন্দর, হাসি-খুশি সময়গুলো। কিছুদিন পরেই সুপ্ত এবং নিপুণের বিয়ে উপলক্ষ্যে বিরাট রিসিপশন। সে নিয়ে বাড়ির বড়োরা আয়োজনে বেশ ছোটাছুটিতে ব্যস্ত। নিপুণ প্রতিদিনের মতোই সুপ্তের আসার অপেক্ষা করছে। সুপ্তের ক্লান্ত মুখে হাসি ফুটতে দেখলেই নিপুণের ভেতরটা শান্তিতে ফুরফুরে হয়ে যায়। আজও সেই ক্ষণের অপেক্ষায় সে।

নিপুণের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে কলিংবেল বেজে ওঠে। নিপুণ তড়িঘড়ি করে গিয়ে দরজা খুলে। দরজা খুলে প্রবেশ করে সুপ্ত। তবে আজ তার মুখে হাসি নেই। তাকে কেমন রাগচটা লাগছে আজ। নিপুণের মন খারাপ হলো, সঙ্গে অস্থিরতা জেঁকে ধরলো তাকে। তবে সহসা কোনো প্রশ্ন করলো না নিপুণ। সুপ্ত সোজা রুমে চলে যায়। নিপুণ দ্রুত ঠান্ডা সরবত নিয়ে যায় সুপ্তের নিকট। সুপ্ত তখন গায়ের ফর্মাল শার্টটা খুলছে। শার্ট খুলতেই দেখা যায় ভেতরের সেন্ডো গেঞ্জি গায়ে ঘামে লেপ্টে আছে। এসিটা আগেই ছাড়া ছিল বিধায় গরমে বেশি ছটফট করতে হলো না সুপ্তের। নিপুণ সরবত এগিয়ে দিতেই সুপ্ত সেটা জোরপূর্বক হেসে নিয়ে নিলো। ঢকঢক করে এক বসাতেই খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষ হতেই খুব নরম গলায় সুপ্ত বলল,
–“গোসলটা সেরে আসছি।”

নিপুণ এতক্ষণ যাবৎ সুপ্তের মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করছিল যে তার কী হয়েছে। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। সুপ্ত নিপুণকে পাশ কাটিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। নিপুণ তার অপেক্ষায় বিছানায় বসে রইলো। উদ্দেশ্য, সুপ্ত গোসল সেরে বের হলেই ঠান্ডা মাথায় প্রশ্ন করবে।

সুপ্ত কখনোই গোসল সারতে দেরী করে না। এবারও করেনি। সে চুল মুছতে মুছতে শুধু একটি টাউজার পরে বেরিয়ে এলো। গিয়ে বসলো বিছানায়, নিপুণের পাশে। নিপুণ সুপ্তের হাত থেকে গামছাটা নিয়ে নিজ উদ্যোগেই সুপ্তের ভেজা চুল মুছে দিতে লাগল। সুপ্ত তখন একমনে নিপুণের মুখপানে তাকিয়ে৷ নিপুণ সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করল,
–“কী হয়েছে আপনার? এমন রেগে আছেন কেন?”

এবার কোনোরূপ রাগ প্রকাশ পেলো না সুপ্তের মুখজুড়ে। সে যেন নিপুণের সংস্পর্শে এসে একদম শিথিল হয়ে গিয়েছে। সুপ্ত গলা নামিয়ে বলল,
–“তোমার বাবা এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে।”

নিপুণের ব্যস্ত হাত হঠাৎ থমকে গেল। ভীষণ রকম চমকে চাইলো সুপ্তের দিকে। সুপ্তের নজর তখনো স্থির। নিপুণ অবাক গলায় বলল,
–“কেন?”

–“টাকা চাইতে। বিশ লাখ টাকা না দিলে তুমি যে ডিভোর্সী সেটা সবার সামনে ফাঁস করে দিবে। সঙ্গে এও বলবে তুমি..”

নিপুণের কোনো ছেলের সাথে গভীর সম্পর্ক আছে সেটা মুখে বলার সাধ্য সুপ্তের নেই। এবার নরম সুপ্ত গরম হলো, কপালের রগ গুলো স্পষ্ট ভেসে উঠল তার। নিপুণের সেসব শুনে সমস্ত দেহ গুলিয়ে এলো। চোখ-মুখে প্রকাশ পেলো নিদারুণ ঘৃণা। সেই ঘৃণা সুপ্ত দেখল। ভেবেছিল নিপুণ ভয় পাবে, কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। বরং মনে হলো নিপুণ নিজেও ক্ষেপে গিয়েছে। নিপুণ বলল,
–“এই বেয়াদব লোককে অফিসে কেন ঢুকতে দিয়েছেন?”

সুপ্ত হাসে। হেসে বলে,
–“লোক বাজে হলেও আমার শ্বশুর হয়। আমার একটা প্রেস্টিজ আছে না? সুপ্ত কখনো শ্বশুরকে খাতিরযত্ন ছাড়া ফিরতে দিবে?”

নিপুণের পিলে চমকে উঠল যেন। সুপ্তের মুখে খাতিরযত্নের কথাটা কেমন যেন শোনালো। তবুও নিপুণ বেশি প্রশ্ন করেনি আর। সে রাত দুশ্চিন্তায় নিপুণের ঘুম হলো না। নিজের জন্য নয়, সুপ্তের জন্য। যদি কোনো কারণে ওই লোকের জন্য সুপ্তের রেপুটেশন নষ্ট হয় তবে সে তাকে কী জবাব দিবে?

পরেরদিন সুপ্ত যখন তৈরি হচ্ছিল তখন সুপ্তের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নিপুণ। আমতা আমতা করে নিপুণ বলল,
–“আমাকে থানায় নিয়ে যাবেন?”

সুপ্তের ভ্রু কুচকে যায় থানার কথা শুনে। বলল,
–“কেন?”
–“মামলা করতে যাব।”
–“কার নামে?”
নিপুণ কিছুটা সময় নিয়ে বলল, “আমার নরপশু বাবার নামে।”

সুপ্ত অবাক হলো। অস্ফুট স্বরে বলল,
–“আরে বউ, কুল কুল। অস্থির হওয়ার দরকার নেই।”

–“কেন নেই? এই লোক আবারো আমার সুখ নষ্ট করতে এসেছে। আমার মাকে মেরে এই লোকের শান্তি হয়নি!”

নিপুণ মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেললেও সুপ্ত যেন অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। লোকটাকে খারাপ ভেবেছিল ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে এতটা নিম্ন? নিপুণের মা তো মূর্ছা গিয়েছেন আজ বহু বছর। এত বছর এই লোক খোলা হাওয়ায় দিব্যি ঘুরে বেড়িয়েছে। কী করে?

সুপ্ত কালকে আপ্যায়ন বলতে নিপুণের বাবাকে এক জায়গায় বেঁধে বেধড়ক পেটিয়েছে লোক লাগিয়ে। সুপ্ত ভাবত পৃথিবীর ইতিহাসে সেই একমাত্র জামাই যে কি না এই পর্যায়ের খাতির-যত্ন করেছে। এখনো বাঁধা অবস্থাতেই আছে এক গুপ্ত জায়গায়। নিপুণকে বলেনি, নিপুণ শুনলে খারাপ ভাববে তাই। কিন্তু এখানে যে ঘটনা ভিন্ন।

সুপ্ত নিপুণকে বিছানায় বসিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,
–“এত বড়ো ঘটনা আর তুমি আমাকে আজ বলছ?”

নিপুণ কিছু বলতে পারলো না। নিজের বোকামীতে সে নিজেই লজ্জিত৷ যদি বহু আগেই এই লোককে সত্যি বলে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিত তবে নিপুণের জীবনটা এতখানি নরক হতো না, পদে পদে নিপুণকে এতকিছু সহ্যও করতে পারত না। সে চাইলেই নিশাতকে নিয়ে এক হাসি-খুশি জীবন মামার বাড়িতে কাটাতে পারত। কিন্তু আফসোস, তার ভয় তার চিন্তাশক্তিকে কোথায় পুঁতে রেখেছিল যেন। সুপ্ত সব জেনে নিলো নিপুণের থেকে। এরপর সুপ্ত নিপুণের মামার বাড়িতে খবর পাঠালো। বহুদিন পর মাটিচাপা দেওয়া কেসের আবারও তদন্ত শুরু হলো।

|পরিশিষ্ট|

নিপুণের জীবন থেকে কয়েকটি বছর ফুরিয়ে গিয়েছে। নিপুণের বাবা এখন সর্বোচ্চ শাস্তি ভোগ করছে। সুপ্ত এখন সফল রাজনীতিবিদদের একজন। মাঝে দিয়ে গুরুতর এক্সিডেন্ট হয়েছিল তার শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্রে। কিন্তু বহু দোয়ায় সে আবারও ফিরেছে মায়ের কোলে, নিপুণের কাছে।

রিসিপশনের দিনই নিপুণের ডিভোর্সের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায়। সুপ্ত সেদিন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বজ্রকণ্ঠে বলেছিল, “নিপুণের অতীত কী তাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। নিপুণ এই সুপ্তের নামে নিজেকে লিখে বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে। এর চাইতে বেশি কিছু আমি চাই না, জানি না। আমি আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। বর্তমানে নিপুণ আমার বউ, আমার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট। এর চাইতে বেশি কথা উঠলে আমি কাউকে ছাড় দিব না। মাথায় রাখবেন সবাই।”
সেদিন সকলের সমালোচনায় নিপুণ যতটা ছোটো হয়েছিল, সুপ্ত তার থেকেও বেশি সম্মান দিয়ে নিপুণকে উপরে উঠিয়ে দিয়েছে। জীবনের সাপোর্টিভ হাসবেন্ড যেই মেয়েরা পায়, তারা ভাগ্যবতী। সেই ভাগ্যবতীর খাতায় নিজেকে পেয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল তার।

নিপুণ এবং সুপ্তের এখন ফুটফুটে একটি মেয়ে আছে। দুই বছর বয়সী, নাম তার শায়েরী। কবির কবিতার মতোই তার মুখমন্ডলের বর্ণনা, চোখ জুড়ে মায়ার মোহনা। বাবা-মায়ের রূপের আধো আধো ভাগের এক পূর্ণ ফুল যেন শায়েরী। শায়েরীর বয়স এবার তিন বছর। টুকটুক করে সারা ঘর মাতিয়ে রাখে সে মাহমুদের ছেলের সাথে। মাহমুদের ছেলে গত বছর স্কুলে ভর্তি হয়েছে। শায়েরী বাবার মতোই বেশ চটপটে এবং চঞ্চল হয়েছে। আর সুপ্তের সাথেই শায়েরী বেশি মিশে থাকে। বাবাই যেন শায়েরীর দুনিয়া। বাবাকে সারাদিন কল করে এটা সেটা বলবে। আর বাবা বাড়ি আসলেই বাবার গা ঘেঁষে থাকবে। সাবিনা, মিনহাজ সাহেব সবারই চোখের মণি এখন একজনই; শায়েরী।

শায়েরীকে নিয়ে এই প্রথম বিদেশ ভ্রমণ নিপুণ, সুপ্ত। নিশাতের সাথে দেখা করতে এবার বেশ লম্বা ছুটিতেই এসেছে তারা। নিশাত এবার হাইয়ার স্টাডিস করছে। যুবক বয়সে পা দেওয়া নিশাতও বেশ সুদর্শন হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া আসার পর সবচেয়ে খুশি বোধ হয় শায়েরীই হয়েছে। তার ছুটাছুটি যেন কমার বদলে আরও বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়া আসার পর ঘরে যে থাকাই যাচ্ছে না। শায়েরীকে নিয়ে নিপুণের মামারা সময় পেলেই ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে। সে কী প্রাণোচ্ছল খুশি শায়েরীর।

রাতে শায়েরী ঘুমে কাত আর নিপুণ অন্ধকারে বিরাট কাঁচের জানালা ভেদ করে হলদে আলোয় রাঙিয়ে থাকা অদূরের শহর দেখছে। এমতাবস্থায় সুপ্ত এসে নিপুণকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। নিপুণের আবেশে চোখ বুজে আসলেও সে সুপ্তের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রইলো। সুপ্ত ভাবলো,
–“কী ভাবছ বউ?”

আনমনে নিপুণ বলল,
–“ভাবছি, আপনি আমার জীবনে না আসলে আমার কী হতো!”

সুপ্ত হাসলো। নিপুণের মাথায় চুমু দিয়ে বলল,
–“আমিও ভাবি তুমি আমার জীবনে না আসলে কী হত।”

–“কেন? আপনি তো দিব্যি থাকতেন, অন্য কাউকে ভালোবেসে।”

সুপ্ত হাসলো। হাতের বাঁধন শক্ত করে বলল,
–“আমাকে সবার মাঝে গুলিয়ে ফেলো না নিপুণ।”

নিপুণও হেসে উত্তর দেয়, “তা তো আমি জানি।”
দুজনের মধ্যে নীরবতা। সুপ্ত একসময় বলল,
–“তোমাকে অনেক ভালোবাসি নিপুণ। তুমি আমার জীবনে এসে আমাকে পূর্ণতা দিয়েছ। পূর্ণতা অতিমাত্রায় বাড়িয়ে দিয়ে শায়েরীকে উপহার দিয়েছ। আমাদের সেই হলুদ শহরের জীর্ণশীর্ণ প্রেম আজ অত্যন্ত সুখ দিয়েছে আমায়। থ্যাঙ্কিউ।”

নিপুণ সুপ্তের হাত আগলে বলল,
–“হলুদ শহরের প্রেমে আমি সাথ দিতে না পারলেও আল্লাহ যতদিন হায়াতে রাখে ততদিন শায়েরীকে নিয়ে আপনার পাশে ছায়ার মতো রইব নেতা সাহেব।”

সমাপ্ত~~