হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব-০১

0
22

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#সুমাইয়া_সুলতানা
#সুচনা_পর্ব

নিজের স্বামীর বুকে অচেনা অজানা মেয়েকে দেখে স্তব্দ হয়ে গেল অধরা। চোখ দু’টো জলে টইটুম্বর হয়ে গিয়েছে। বুকের ভিতর অসহ্য এক ব্যথা হানা দিয়েছে। হাত, পাঁ দু’টো কাঁপছে অবিরত। ক্রমাগত রাগে ফুঁসছে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে এগিয়ে গেল তাদের নিকট। অধরাকে দেখে মাহিম বাকহারা হয়ে গিয়েছে। ওকে কিছু বলবে, তার আগেই নরম হাতের শক্ত এক থা*প্পর পড়ল তার গালে। মাহিম গালে হাত দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্ত্রীর পানে।

” ছিঁহ! ”

বলেই কাঁদতে কাঁদতে দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে গেল অধরা। মাহিম’কে কিছু বলার সুযোগ দিল না। ওর চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহিম। বুকের ভিতর চিনচিন ব্যথা করছে তার। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রমনির দিকে তাকালো সে। মেয়েটিও ওর দিকে অশ্রুভেঁজা চোখে তাকিয়ে আছে। কি বলবে? কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। মাথা নিচু করে নিল সে। মাহিম তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে সেখান থেকে চলে আসলো।

কিছুক্ষণ আগে,,

মাহিমের আজকে অফ ডে ছিল। অধরা কিছুদিন ধরে বায়না করছিল সে ঘুরতে যাবে। অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয়না। হবে কি করে ? মাহিম তো ছুটি পায়না অফিস থেকে। তাই ভাবলো আজকে কোথাও থেকে ঘুরে আসা যাক। দূরে কোথাও যাবেনা। আশেপাশেই কোথাও যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। অধরা তিনটা ক্লাস করেই বেরিয়ে এসেছে। ভার্সিটির চত্বর পেরিয়ে গেইটের কাছে এসেই, মাহিমকে ফোন করল। মাহিম তখন ল্যাপ্টপে অফিসের কিছু কাজ করছিল। কল রিসিভ করতেই ওপর পাশ থেকে অধরা চঞ্চল কন্ঠে বলে উঠলো,

” মাহিম, চলো আজকে কোথাও থেকে ঘুরে আসি। অনেক দিন যাওয়া হয়না। বোরিং ফিল করছি। ”

” তুমি এখন কোথায় ? আর আমি একটু কাজ করছিলাম অফিসের। ”

ল্যাপ্টপের দিকে তাকিয়ে, হাত চালাতে চালাতে কথাটা বললো। সহসা রেগে গেল অধরা। কটমট কন্ঠে বলল,

” সারাক্ষন শুধু কাজ আর কাজ। তুমি থাক তোমার কাজ নিয়ে। আমি একাই যাব। তোমাকে যেতে হবে না। ”

বলেই কল কেটে দিয়েছে। ফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দ পেয়ে তাকিয়ে দেখলো মাহিম কল করেছে। সেটা দেখে কিঞ্চিত হাসলো সে। তবে মুখটাকে যথেষ্ট গম্ভীর ভাব রেখে কল রিসিভ করে, ঝাঁজালো কন্ঠে বলল,

” সম্যসা কি? ফোন দিয়েছ কেন? বললামতো তোমাকে যেতে হবে না। ”

” আরে আরে রেগে যাচ্ছ কেন? আমিতো এমনি বলছিলাম। আচ্ছা বলো, কোথায় আসতে হবে। ”

” আমাদের কল্যণীর পাশেই যে পার্কটা আছে। সেখানেই এসো। আমি অপেক্ষা করছি। ”

” তুমি পার্কে চলে গিয়েছ ? ”

” না। আমি এখন গাড়িতে। আর অল্প কিছু পথ বাকি আছে। তুমি জলদি এসো। ”

” আচ্ছা। ঠিক আছে। তুমি ওয়েট কর। আমি রেডি হয়ে আসছি। ”

কল কেটে দিয়ে, ল্যাপ্টপ অফ করে, মাহিম তৈরী হতে লাগলো। তৈরি হয়ে গাড়ি নিয়ে পার্কের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেল। অধরা পার্কে পৌঁছে গিয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে, পার্কের ভিতরে প্রবেশ করল। ভাবলো, মাহিমের আসতে তো কিছুক্ষন লেট হবে। তাহলে ততক্ষনে চারপাশটা ঘুরে দেখা যাক। অধরা পার্কের বাম দিকটায় চলে গেল। সেখানে সুইমিং পুল রয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা বাচ্চাদের সুইমিং পুল। এদিকে,, মাহিম সেখানে পৌঁছে অধরাকে খুঁজতে লাগল। কোথাও দেখতে না পেয়ে, অধরার নাম্বারে কল করার জন্য পকেট হতে ফোন হাতে নিতেই পেছন থেকে কেউ কাঁপা কন্ঠে ডেকে উঠলো,

” মা…মাহিম ! ”

অতি পরিচিত সেই কন্ঠ কানে বাজতেই তড়িৎ গতিতে পিছন ফিরে তাকালো মাহিম। সেই চেনা মুখ । চেনা কন্ঠ। সেই একই অনুভুতি। মাহিম কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু ওর গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। হাত, পাঁও কেমন অবশ হয়ে আসছে। বিষ্ময় চোখে তাকিয়ে আছে সম্মুখের মেয়েটির দিকে। মেয়েটির আগের মতো সৌন্দর্য নেই। চোখ দু’টো যেন গর্তে ঢুকে গিয়েছে। চোখের নিচে কালো দাগ দেখা যাচ্ছে। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। গলার কাছে চামড়ার উপর হাড় দেখা যাচ্ছে। নাদুস নুদুস মেয়েটা শুকিয়ে কি অবস্থা হয়েছে। চোখ, মুখের এ কেমন বেহাল দশা ? ওর ভাবনার মাঝেই মেয়েটি মাহিমের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে তাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে। হু হু করে কেঁদে উঠে মেয়েটি। মাহিমের পিঠের শার্ট খাম*ছে ধরে। বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কান্না করছে সে। মাহিম যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়েছে। সে এখনো এই ঘোড় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সব কিছু স্বপ্নের মতো লাগছে। দীর্ঘ ছয় বছর পর, ভালোবাসার মানুষটিকে দেখে সে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। চোখ দু’টো জ্বলছে ভীষন। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তবে তার অক্ষিকুটুর জলে টইটুম্বর হয়ে আছে। যেকোনো সময় নোনা জল গড়িয়ে পরবে। আর ঠিক সেই মুহুর্তেই অধরার আগম ঘটে সেখানে। হাতে একটা কোণ আইস্ক্রিম। খেতে খেতে এদিকেই আসছিল। হাসি হাসি মুখে মাহিমের পানে তাকাতেই সহসা হাসিটা নিঁভে গেল। মুখ জুড়ে অন্ধকার নেমে এলো যেন। নিজ স্বামীর বুকে পর-নারী দেখে বুকের ভেতরটা অসহ্য ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল। হাত থেকে আইস্ক্রিমটা পড়ে গেল। মেয়েটিকে বুক থেকে তোলার জন্য তার কাঁধে হাত দিয়ে মাথা তুলল মাহিম। এতক্ষন নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। মাথা উঠাতেই কান্না ভেজা স্ত্রীর মুখশ্রী নজরে এলো। অধরা তাদের দিকে ছলছল নয়নে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওমনি সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল তার। বুকের ব্যথাটা দ্বি’গুণ বেড়ে গিয়েছে। মাহিম’কে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই কাঁদতে কাঁদতে দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে আসলো। পাশে থাকা মেয়েটির কথা ভুলে সেও ছুটলো বউ’য়ের পিছু।

**********
পারিবারিক ভাবেই মাহিম আর অধরার বিয়ে হয়েছিল। মাহিমের মা ওকে পছন্দ করে ছেলের বউ করে নিয়ে এসেছিলেন। তেমন ঝাঁকঝমক ভাবে বিয়ে হয়নি। খুব সাদা মাটা ভাবেই বিয়ে হয়েছে তার। মাহিম ওকে অনেক ভালোবাসে। সম্মান করে। কখনো ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে বলেনি। অধরার ভালো লাগা, খারাপ লাগা সবকিছু নিয়েই বেশ সচেতন মাহিম। কারো সাথে রিলেশন না থাকায় বাবা-মার কথায় বিয়ে করেছিল মামিমকে। বিয়ের আগে তেমন একটা কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠেনি। তবে যতটুকুই বলেছে তাতে মাহিমের পার্সোনালিটি খুব ভালো লেগেছিল অধরার। লম্বা-চওড়া, পেটানো শরীর, সাদা সুন্দর, সুদর্শন মানুষটার প্রতি এক ভালো লাগা কাজ করেছিল। মুগ্ধ হয়েছিল তার কথা এবং আচরণে। ভার্সিটে যাওয়ার পরপরই বিয়ে হয়ে যায় ওর মাহিমের সাথে। কথা ছিল অনার্স কমপ্লিট করেই শশুর বাড়ি যাবে। ততদিন অধরা নিজের বাড়িতেই থাকবে। কিন্তু মাহিম মানতে নারাজ ছিল। তার এক কথা, বিয়ে করেছি কি বউ ছাড়া থাকার জন্য নাকি ? আমার বউ আমার সাথে আমাদের বাড়িতেই থাকবে। মাহিমদের বাড়ি থেকে অধরার ভার্সিটি কিছুটা দূরেই। একা আসতে যেতে কিছুটা অসুবিধা হতো। তাই অধরার বাবা বলেছিলেন যাতে ভার্সিটি যাওয়ার সুবিধার্থে সেখানেই থাকবে। শশুরের কথায় দ্বিমত প্রকাশ করে মাহিম। বললো,, অধরাকে ভার্সিটিতে সে নিজে গিয়ে দিয়ে আসবে। তবুও বউকে নিজের বাড়িতেই নিয়ে যাবে। যাবে মানে যাবেই। অতঃপর সকলে তার কথা মেনে নেয়। মাহিমের এমন পাগলামিতে অধরা কিঞ্চিত লজ্জা পেয়েছিল। মুখে তার লাজুক হাসি নিয়ে দৌঁড়ে নিজ রুমে চলে যায়। মাহিম সে দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকে মিটিমিটি হাসতে লাগলো।

মাহিম, অধরা তাদের বিয়ের প্রায় দু’বছর হয়ে গিয়েছে। কখনো মাহিমের মধ্যে খারাপ কিছু নজরে পড়েনি। যথেস্ট ভদ্র মানের ছেলে মাহিম। মেয়েদের সাথে ফ্লাট করার মতো ছেলে সে নয়। এতটুকু খুব ভালো করেই জানে সে। আজ সেই চেনা পরিচিত ভালোবাসার মানুষটাকে কেমন অচেনা লাগছে। স্বামীর বুকে অন্য কোনো নারীকে দেখলে প্রতিটা মেয়েরি খারাপ লাগবে। আর সে স্বামী যদি হয় সখের পুরুষ, তাহলে’তো কষ্টটা আরো তীব্র হয়। ভয়ংকর ষন্ত্রণার দিতে থাকে বুকের ভেতর। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে মেয়েটাকে মাহিম চেনে না। সে ইচ্ছে করেই ওর স্বামীকে জড়িয়ে ধরেছে। হতেই তো পারে মেয়েটার কোনো কু’মত্লব ছিল। এখানে হয়তো মাহিমের কোনো দোষ নেই। পরম-মুহূর্তেই আবার ভাবে, মাহিম কি পারতো না মেয়েটিকে দূরে সরিয়ে দিতে ? মেয়েটি নাহয় ইচ্ছে করে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। সে তো পারতো মেয়েটিকে ধা*ক্কা দিয়ে নিজের কাজ থেকে সরিয়ে দিতে। কেন সে কিছু বললো না? কেন চুপ করে ছিল? তবে কি মেয়েটির সাথে মাহিমের কোনো সম্পর্ক আছে ? বা কখনো ছিল? কথা গুলো ভাবতেই শব্দ করে কেঁদে উঠলো অধরা। বাড়ি ফিরেই রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে একমনে কথা গুলো ভাবছে আর কেঁদেই চলেছে সে। এভাবে দরজা বন্ধ করায় শাশুরি ওকে জিজ্ঞেস করেছিল কি হয়েছে, দরজা কেন বন্ধ করেছে? ও কিছু বলেনি। দরজাও খোলেনি। মাহিমের মা ভেবেছেন হয়তো ছেলে আর ছেলের বউয়ের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে কথা না বলাই ভালো। তাদের ব্যাপার তারাই মেটাক। তাই তিনি আর কথা বাড়াননি। চলে আসেন ওদের রুমের দরজার কাছ থেকে। তাছাড়া বিয়ের পর এই প্রথম অধরাকে কান্না মুখে দরজা আটকাতে দেখলেন তিনি। অধরা কখনো এমন করেনি। মাহিমের সাথে কোনো দিন রাগা”রাগি হয়েছিল বলেও মনে পড়ছেনা। সব কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তিনি রান্না ঘরে চলে গেলেন। দুপুরের রান্না করছিলেন তিনি ঠিক তখনি দরজায় বেল বাঁজতেই দরজা খুলে দেখেন মলিন মুখে, কান্না ভেঁজা চোখে অধরা দাঁড়িয়ে আছে। অধরা কিছু না বলে তাকে পাশ কাটিয়ে রুমে চলে যায়। অধরার এমন আচরণ ওনার মাথায় ঢুকলো না। দরজা আটকে অধরাকে ডেকে কিছু বলবেন,, কিন্তু সেটা আর হলো না। এসে দেখে সে বেড রুমের দরজা বন্ধ করে আছে। কতবার ডেকেছেন তবে সে দরজা খুলেনি।

#চলবে….