হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব-০২

0
18

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#সুমাইয়া_সুলতানা
#পর্বঃ২

বাড়ির কাছে আসতেই দারোয়ান বাড়ির মেইন গেইট খুলে দিলেন। সিট বেল্ট খুলে গাড়ি পার্ক করেই হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির প্রবেশ করল মাহিম। ওর মা জামিলা বেগম এসে দরজা খুলে দিতেই সে জিজ্ঞেস করলো,

” অধরা কোথায় মা? ও কি বাড়িতে এসেছে? ”

হাঁপাতে হাঁপাতে কথা গুলো বললো সে। জামিলা ভ্রু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকালেন। বললেন,

” কেন? বাড়িতে আসবেনা তো কোথায় যাবে? কিছু কি হয়েছে ? ”

মাহিম জবাব দিল না। কিছু না বলে দ্রুত গতিতে নিজের রুমের দিকে পাঁ বাড়াল। এসে দেখে দরজা বন্ধ। জোড়ে জোড়ে দরজায় হস্তাঘাত করছে। আর অধরাকে ডাকছে। ছেলের পিছু পিছু তিনিও এলেন। ছেলের কাঁধে হাত রাখতেই সে পেছন ফিরে মায়ের দিকে তাকালো। তিনি বললেন,

” ও বাবা কি হয়েছে তোদের মধ্যে বলনা আমায়। সব কিছু ঠিক আছে তো? বাড়িতে এসেই মেয়েটা সেই যে দরজা বন্ধ করল। এখনো খোলার নামিই নেই। দুপুরে খাবারের জন্য ডাকলেও আসেনি। কোনো কথাও বলেনি। কি হয়েছে বলতো? ”

মাহিম চোখ বুঝে লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,

” কিছু হয়নি। তুমি খেয়েছো? বাবা খেয়েছে? ”

” তোর বাবা খেয়েছে। আমি খাইনি। তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ”

” তুমি খেয়ে নাও মা। গিয়ে রেস্ট কর। ”

” তুই খাবি না ? বউ’মাও তো না খেয়ে আছে। ”

” আমি পরে খাবো। তুমি খেয়ে নাও। টেনশন করোনা। সব ঠিক আছে। অধরা একটু আমার উপর রেগে আছে। আমি ওকে সামলে নিব। তুমি বেশি চিন্তা করলে প্রেসার আবার বেড়ে যাবে। কথা শুনো আমার। ”

জামিলা আর কিছু বললেন না। তিনি খেয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। এদিকে মাহিম পড়েছে বিপাকে। বউ তার দরজা খুলছে না। অনেক ডাকাডাকি করেও লাভ হয়নি। রাগে দরজায় মুষ্টিবদ্ধ করে ঘুষি দিল নিজের স্বর্বস্ব শক্তি দিয়ে। হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই মুখে এক চিলিতে হাসি ফুটে উঠল। পকেটে হাত দিতেই কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি পেয়ে গেল। আর এক মুহূর্তও দেড়ি করল না। রুমের এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল। অধরা বালিশে মুখ গুজে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ, মুখ ফুলে গিয়েছে। ফুঁপানোর আওয়াজ ভেসে আসছে। থেমে থেমে শরীর মৃদু কেঁপে কেঁপে উঠছে। মাহিম নিশব্দে এগিয়ে যায় বউয়ের নিকট। বিছানার এক পাশে বসে অধরার কাঁধে হাত ছোয়ায়। এক ঝটকায় কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে দেয় অধরা। ক্ষী’প্ত হয়ে মাহিমের শার্টের কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” আমাকে এভাবে ঠকালে! কেন করলে এমন ? কেন এভাবে ধোঁকা দিলে? কেন আমর বিশ্বাস নিয়ে ছিনিমিনি খেললে? কি দোষ আমার? কেন এভাবে আমাকে মর”ণ যন্ত্রণা দিলে? বলো কে সেই মেয়ে ? তার সাথে তোমার কি সম্পর্ক? উত্তর দাও! ”

চিৎকার করে কথা গুলো বললো সে। মাহিম অধরার চোখের দিকে তাকিয়ে ওকে মানানোর স্বরে শান্ত কন্ঠে বলল,

” মাথা ঠান্ডা করো অধরা। আমার কথা শুনো। আমাকে সবকিছু পরিষ্কার করে বলার সুযোগ দাও। আমি তোমাকে সবটা বলছি। তুমি শান্ত হও প্লিজ।”

” কি শুনবো তোমার কথা ? হ্যাঁ! কি শুনবো? কি বলার আছে তোমার? সবটাতো নিজের চোখেই দেখেছি। এখন আসছ নাটক করতে? আমাকে ভুল বা”ল বুঝাতে? ”

” নাহ। আমি কোনো নিজের জন্য সাফাই গাইতে আসিনি। আমি তোমাকে শুধু সত্যিটা জানাতে চাই। দয়াকরে আমাকে ভুল বোঝার আগে আমার পুরো কথাটা শোন। ”

অধরা তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

” জানি। এখন তুমি বলবে মেয়েটাকে তুমি জানোনা। তাকে তুমি চেনোনা। মেয়েটা হয়তো ভুল করে বা মজা করে তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। কি তাইতো ? ”

” নিজেই একা বকবক করবে! নাকি আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিবে ? তাছাড়া তুমি যেমনটি ভাবছো তেমন কিছুই না। ”

” আমি একদম সঠিক ভাবছি। কত দিন ধরে চলছে এসব? হ্যাঁ! কত দিন ধরে চলছে? মেয়েটাকে যদি তুমি নাই চিনবে আর আমি যা ভাবছি তা যদি সত্য না হয় তাহলে মেয়েটা যখন তোমার বুকে মাথা রেখে ঝাঁপটে জড়িয়ে ধরেছিল, তখন তাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে কেন দাওনি? কি হয় সে তোমার? নাকি মজা নিচ্ছিলে ? ”

মাহিম চিৎকার করে উঠল। সহসা ধমকে বলল,

” ব্যাস! মেয়েটাকে নিয়ে আর একটাও বাঁজে কথা বলবেনা তুমি। নিজের লিমিট ক্রস করোনা। নয়তো এর পরিণাম অনেক ভয়ংকর হবে। ”

” বাহ বাহ বাহ! চমৎকার। এখন ওই মেয়েটার জন্য আমাকে ধমকাচ্ছো? কথা শোনাচ্ছ! আমার থেকে বেশি ওই মেয়েটা তোমার কাছে বড় হলো? থাকবো না আমি তোমার সাথে। আজি চলে যাব বাবার বাড়ি। ”

” বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে অধরা। মেজাজ খারাপ করোনা। আগে আমার কথা শোন। তারপর যেখানে খুশি চলে যেও। আমি তোমাকে আঁটকাবো না। ”

অধরা চেঁচিয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

” তা কেন আটকাবে! আছে’তো এখন অন্য কেউ। আমাকে আর তোমার লাগবেনা। আমিতো এখন পুরনো হয়ে গিয়েছি। আমাকে তো ভালো লাগবেনা। নতুন নতুন শরীর চাই এখন তোমার। মেয়েটির সাথে অবৈধ সম্পর্ক কত দিনের ? আচ্ছা! শুধু কথা বলা। জড়িয়ে ধরা পর্যন্তই নাকি আরো গভীরে চলে গিয়েছে এই সম্পর্ক? নষ্টা একটা মেয়ে! ছেলের দেখলেই চিপকাতে ইচ্ছে করে। বস্তির পঁচা আবর্জনা। বস্তি থেকে উঠে এসেছে। এদের মতো মেয়ের ঠিকানা পতিতালয়ে হওয়া উচিত। ”

কথাটা বলতেই মাহিম সজোড়ে থা*প্পর বসিয়ে দিল অধরার তুলতুলে গালে। মাথা তুলে মাহিমের দিকে তাকানোর আগেই আরেকটা থা*প্পর পড়লে গালে। মাহিম র*ক্ত চক্ষু নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। হতভম্ব হয়ে তাকাল মানুষটির দিকে। গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে চেয়ে রইল। বিয়ের পর এই প্রথম তার গাঁয়ে হাত তুলেছে মাহিম। গাঁ’য়ে হাত তোলা’তো দূরে থাক কখনো উচ্চস্বরে কথাও বলেনি। আজ সেই মানুষটা একটা মেয়ের জন্য ওর গাঁ’য়ে হাত তুললো? এতটা অধঃপতন হয়েছে তার ? এতটা! বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব করল সে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। মাহিম চিৎকার করে বলল,

” তোমার এত বড় সাহস কিভাবে হলো ওকে নিয়ে বাজে কথা বলার? কাকে নষ্টা বলছো তুমি? কাকে বস্তির মেয়ে বলছো? কাকে পতিতালয়ের সাথে তুলনা করছো? ওই মেয়েটাকে! আরেহ সে তো একটা পবিত্র ফুল। সে যদি বস্তির মেয়ে হয় তাহলে মেয়ে শব্দ’টাকেই অপমান করা হবে। জানতে চাও মেয়েটার সাথে আমার কিসের সম্পর্ক? জানতে চাও কোন অধীকারে সে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল? জানতে চাও কেন আমি তাকে বুক থেকে শত চেয়েও সরাতে পারিনি? তাহলে শোন,, সেই মেয়ে আমার ভালোবাসা। আমার জীবনের একটা অংশ। আমার জীবনের চরম সত্যি। হ্যাঁ! আমি ভালোবাসি তাকে। আমার প্রথম ভালোবাসা সে। আমার প্রথম অনুভুতি। আমার প্রথম প্রেম। ”

অধরা অবাক হয়ে মাহিমের দিকে তাকিয়ে আছে। বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেনা। কেউ যেন ওর হৃদয়টা ছু”ড়ির আ’ঘাত করে র*ক্তাক্ত করে দিয়েছে। শব্দ করে কেঁদে উঠল। অসহায় কন্ঠে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

” আমাকেন কেন ঠকালে মাহিম? কি দোষ করেছিলাম আমি? আমিতো তোমাকে সত্যি ভালোবেসেছিলাম। যদি ওই মেয়েটাকেই ভালবেসে থাকো তাহলে আমাকে কেন বিয়ে করেছ? এক সাথে তো তুমি আমাদের দু’জনকেই ঠকালে। কেন করলে এমন? কেন? কেন? ”

” আমি তোমাদের কাউকেই ঠকাইনি। নিয়তি আজ আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। আমি তোমাকে ভালোবাসি এটা যেমন সত্যি। ঠিক তেমনি ইভাকেও আমি ভালোবাসি। আমিতো ইভাকে নিয়েই ভালো থাকতে চেয়েছিলাম। সুখে সংসার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায় হলো না। ভাগ্যের কাছে আমি হেরে গিয়েছি। ”

অধরার হেঁচকি উঠে গিয়েছে কাঁদতে কাঁদতে। মেঝেতে বসে বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে চাদর খামছে কান্না করছে। ওর দিকে তাকিয়ে মাহিম নিজেকে শান্ত কারার চেষ্টা করে। অধরার তো কোনো দোষ নেই। যেকোন মেয়েই নিজের স্বামীর বুকে অন্য নারীকে দেখলে এভাবেই রিয়্যাক্ট করবে। এটা স্বাভাবিক। অধরা যে তাকে অনেক ভালোবাসে। চোখে হারায়। সেটা খুব ভালো করেই জানে মাহিম। কষ্টের মাঝেও হালকা হাসে সে। ওর অক্ষিকোটরেও জলে ভরে উঠেছে। মাহিম নিজেও স্ত্রীকে ভীষন ভালোবাসে। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে হাটু গেড়ে অধরার সামনে বসে। কাছে টেনে নেয় অর্ধাঙ্গীনিকে। মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরে বুকে। অধরা ছোটার জন্য ছটফট করছে তবে মাহিমের শক্ত বাধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারলো না। হাল ছেড়ে স্বামীর বুকেই পড়ে রইল। ওর কান্নার গতি বাড়লো। মাহিম অধরার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কান্নার বেগ কিছুটা কমে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে শান্ত হলো অধরা। বুঝতে পেরে মাহিম দু’হাতের তালু দিয়ে স্ত্রীর গালে আলতো স্পর্শ করে কপালে চুমু খায়। অধরার চোখ পুনরায় ভিজে উঠেছে। মাহিম ওর চোখে চোখ রেখে বলল,

” আমার উপর কি তোমার একটুও বিশ্বাস নেই? একটুও ভরসা করতে পারলেনা? এত দিন আমার সাথে থেকে এই চিনলে আমায়? ”

অধরার গাল বেয়ে অশ্রু কণা নামলো। মাহিম দু’হাতে চোখের জল মুছে দিয়ে স্ত্রীর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

” আমার পুরো কথাটা না শুনেই একের পর এক নিজের মতো কথা বলেই যাচ্ছ, বলেই যাচ্ছ। আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ? আমার কথাটা শোনা কি জরুরী ছিলনা? আগে আমার কথা শুনতে পরে তোমার যা মন চায় বলতে। তুমি তখন ওসব বলেছ বলে রাগের মাথায় তোমাকে আ’ঘাত করে ফেলেছি। সরি। ক্ষমা করে দাও আমায়। আর কখনো তোমার উপর হাত তুলবোনা। এবারের মতো মাফ করে দাও। প্লিজ বউ। প্লিজ। আমি তোমাকে কোনো কষ্ট দিতে চাইনি। ট্রাস্ট মি! তোমাকে কষ্ট দেওয়ার কথা আমি কল্পনাও করতে পারিনা। ”

মাহিমের চোখের দিক তাকায় অধরা। মুখটা মলিন হয়ে আছে। তার চোখেও জল। অধরা বলে উঠলো,

” তুমি যে কাউকে ভালোবাসতে সেটা আমায় কোনদিন বললেনা কেন? ”

” কে বলেছে বলতে চাইনি! আমি তোমাকে অনেক বার বলার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। পরিস্থিতিও সঙ্গ দেয়নি। তোমার মনে আছে? আমাদের বাসর রাতে আমি তোমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলাম। তুমি বলেছিলে এখন কিছু শুনতে চাওনা। আরেকদিন ছাঁদে যখন চন্দ্রবিলাস করছিলাম তখনও বলতে চেয়েছিলাম। তুমি শুনতে চাওনি। এভাবে অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম তোমাকে আমার আর ইভার কথা বলার, পারিনি। তুমি শুনতে চাওনি। এরপর আমিও এ ব্যাপার্টা মাথা থেকে বের করে দিয়েছিলাম। তারমানে এইনা আমি তোমাকে ঠঁকিয়েছি। ”

অধরা মাথা নিচু করে নিল। নরম কন্ঠে বলল,

” আসলে তখন তোমার বুকে অন্য নারীকে দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। রাগ, কষ্ট, অভিমান সবটা মিলিয়ে তোমাকে ওসব কথা বলে ফেলেছিলাম। ”

মাহিম অধরাকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় অগোছালো চুলের ভাঁজে কয়েকটা চুমু খেয়ে বলল,

” আমি বুঝতে পেরেছি। শুধু তুমি না। যেকোন মেয়েই এমনটি করতো। ”

বুক থেকে মাথা তুলে মাহিমের দিকে তাকিয়ে বলল,

” আমি সবটা শুনতে চাই। সব কিছু জানতে চাই, তোমার আর ইভার ব্যাপারে। ”

” হুম। আজকে তোমাকে এতদিনের না বলা কথা গুলো সবটা বলবো। সবটা জানাবো। তার আগে ফ্রেস হয়ে খেয়ে নিতে হবে। এসেই কান্না কাটি শুরু করেছো। ড্রেসটাও তো চেইনজ্ করোনি। ”

অধরা আর কথা বাড়ালো না। কাবাড থেকে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।

চলবে…….

( ভুলত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন। )