হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব-০৩

0
19

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#সুমাইয়া_সুলতানা
#পর্বঃ৩

অধরা শাওয়ার নিয়ে বের হতেই মাহিমও ফ্রেস হতে ওয়াশরুমে চলে যায়। তোঁয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হয়ে দেখে, অধরা খাবার রুমে নিয়ে এসেছে। বেডের পাশে ছোট্ট টেবিলটাতে খাবারের বাটি গুলো রেখে জগ থেকে পানি ঢালছে গ্লাসে। মাহিম গিয়ে বিছানায় বসে। অধরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত টেনে পাশে বসায়। প্লেটে খাবার বেড়ে তরকারি দিয়ে ভাত মেখে এক লোকমা স্ত্রীর মুখের সামনে ধরল। অধরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে স্বামীর পানে। সবসময় অধরাই মাহিমকে খাইয়ে দিত। কিন্তু আজ প্রথম মাহিম নিজে ওকে খাইয়ে দিতে চাচ্ছে। ছলছল চোখে তাকিয়ে খাবারটুকু মুখে পুরে নেয়। অধরাকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিল। পানি খাইয়ে মুখ মুছিয়ে দিল প্রিয় অর্ধাঙ্গীনির। অধরা উঠে গিয়ে খাবারের প্লেট, বাটি রেখে আসলো। রুমে এসে দেখে মাহিম বিছানায় শুয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল কিয়ৎকাল। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে বলল,

” কি ব্যাপার? শুয়ে পড়েছ যে! আমার প্রশ্নের উত্তর গুলো বলবেনা ? ”

” বলবো। আমি এখন অনেক টায়ার্ড। কিছুক্ষণ রেস্ট নিবো। তারপর তোমাকে সব কথা বলবো। তুমি নিশ্চই টায়ার্ড ফিল করছো ? এসো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও। ”

” ঘুমাবো না আমি। আর না তোমাকেও ঘুমাতে দিবো। কোনো রেস্ট ফেস্ট চলবে না! আগে আমাকে সবটা খুলে বলো তারপর ঘুমিও। ”

মাহিম অধরাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের উপর ফেললো। অধরা টাল সামলাতে না পেরে হুমরি খেয়ে মাহিমের বুকের উপর পড়ল। কিঞ্চিত রাগ নিয়ে সরে যেতে চাইল, তবে পারলোনা। মাহিম ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। অধরা কিছু বলতে নিলেই মাহিম ওর ঠোঁটের উপর হাত দিয়ে চুপ করতে বললো। অগত্যা সে চুপ করে রইল। মাহিম অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে। অধরা সেদিকে তাকিয়ে রয়। কি নিশপাপ চেহারা। ঘুমালে কেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগে দেখতে। জোড় ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে যায়। হাসি পায় অধরার। মাহিমের মাথার সিলকি চুলে হাত বুলিয়ে কপালে অধরের আলতো ছোয়া দিয়ে সেও ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।

**********
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে বেলকনিতে চলে যায় মাহিম। অধরা দু’কাপ কফি নিয়ে এসে মাহিমের হাতে এক কাপ ধরি দিয়ে বেতের চেয়ারে বসে পড়ে। কাপে চুমুক দিয়ে মাহিম বলে উঠলো,

” অস্থায়ী জীবনেই চিরস্থায়ী হলো মানুষের সুন্দর ব্যবহার যা মৃত্যুর পরও সবার স্মৃতিতে থেকে যায়। ভালোবাসাও তেমন। যাকে সত্যিকারের ভালোবাসো তাকে কখনো ভুলে থাকা যায় না। হ্যাঁ! প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে হয়ত দুরত্ব এসে যায় অথবা ভাগ্যের কাছে হেরে যায়। তবে ভালোবাসা তার নির্দিষ্ট জায়গাতেই থেকে যায়।”

” আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিনা। প্লিজ আর কোনো হেয়ালি করোনা। এবার আমাকে বলো সবটা। ”

মাহিম কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়ে অধরার পাশে গিয়ে বসে। দূর আকাশে দৃষ্টি রেখে ডুব দেয় পুরোনো স্মৃতির পাতায়। যেখানে আছে হাসি, কান্না, ভালো লাগা আনন্দময় কিছু মুহূর্ত। আছে কিছু তিক্ত অনুভুতির অভিজ্ঞতা।

**** অতীত ****

দিনটা ছিল শুক্রবার। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে পিকনিক করতে বন্ধুদের সাথে এসেছে মাহিম। মাহিম সহ তিনজন ছেলে ফ্রেন্ড আলভী, সাকিব। আর দু’জন মেয়ে ফ্রেন্ড মোনা, মিম। ১২০ কিলোমিটার (৭৫ মাইল) দীর্ঘ এই সৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতটি পৃথিবীর দীর্ঘতম অখন্ডিত সমুদ্র সৈকত। এ সমুদ্র সৈকতের বৈশিষ্ট্য হলো পুরো সমুদ্র সৈকতটি বালুকাময়, কাদার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। কক্সবাজার বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি শহর, মৎস্য বন্দর এবং পর্যটন কেন্দ্র। এটি চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার সদর দপ্তর। কক্সবাজার তার নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের জন্য বিখ্যাত। এখানে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্র সৈকত। মনকে ফ্রেসনেশ করার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হলো ট্রাভলিং করা। সে জায়গাটা যদি হয় সমুদ্র বা পাহাড় তাহলে তো কোনো কথাই নেই। গোধূলি বিকেলে পাঁচজন বন্ধু এক সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে সমুদ্র সৈকতের নিকটে। আলভী কোকের বোতলে চুমুক দিয়ে বলল,

” আমি বিয়ের পরও ভার্জিন থাকতে চাই। যেহেতু সবসময় ভার্জিনি থাকবো তাহলে আর বিয়ে করেতো কোনো লাভ নেই। সেজন্য আমি অলওয়েজ সিঙ্গেল থাকতে চাই। ওসব মেয়েদের প্রতি আমার কোনো ইন্ট্রেসট নেই। ”

সাকিব দুঃখি দুঃখি মুখ করে বিদ্রুপ হেসে বলল,

” শা*লা আমিতো লোক লজ্জ্বার ভয়ে বলি সিঙ্গেল। আসলে কোনো মেয়ে আমাকে চয়েজ করেনা। ”

” মামা তোর আর আমার ফাটা কপাল বুঝলি! আয় দু’জনের কপাল এক সঙ্গে ঘষা দেই! মাহিমকে দেখ কত মেয়ে ওর পিছনে ঘুরে কিন্তু কাউকেই নাকি ওর মনে ধরেনা। বলি কি তোর পছন্দ না হলে, আমাদের লাইনটাও তো একটু ক্লিয়ার করে দিতে পারিস?”

ওদের কথা শুনে মনা, মিম হাসতে হাসতে শেষ। মনা হাসি থামিয়ে বলল,

” তোদের মতো ছা’গলদের পছন্দ করবে কেউ ভাবলি কি করে ? এত যে ভাব নিচ্ছিস! সেদিন তো দেখেছি প্রিন্সিপাল স্যারের মেয়েকে পটানোর জন্য তোরা দু’জন আদা জল খেয়ে নেমে পড়েছিস। আবার স্যারকেও ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছিলি। ”

সানভী জিভ কে’টে চোরা চোখে চেয়ে বলল,

” দূর! তেমন কিছু না। উনি আমাদের প্রিন্সিপাল। আমাদের উচিত স্যারের খেয়াল রাখা। ”

” স্যারের খেয়াল রাখা নাকি তার মেয়ের ? হুম! ”

মাহিম বিরক্ত মুখে ধমকে বলল,

” থাম এবার তোরা। তখন থেকে কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে চলেছিস। এবার একটু মুখটা বন্ধ কর। ”

সাকিব আয়েশ করে বালুর মধ্যে বিছিয়ে রাখা চাদরে টানটান হয়ে শুয়ে, মাথার নিচে হাত দুটো রেখে বলল,

” তোর মতো আমরা রসকসহীন না বুঝলি। ব্যাটা খারু’শ! ”

মাহিম বুঝতে পেরেছে এদের প্যান’প্যানানি থামবে না। অগত্যা নিজেই সেখান থেকে উঠে চলে আসলো। পিছন থেকে মনা ডেকেছে কয়েকবার সে শুনেনি। তাই তারা নিজেরাই বসে নিজেদের মতো একে অপরের সাথে গল্প করতে লাগল। মাহিম হাঁটতে হাঁটতে ওদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছে। দু’হাটুর উপর ঝুঁকে দু’হাত তার উপর রেখে ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। তখনি খিলখিল করে কয়েকজন মেয়ের হাসির আওয়াজ শুনতে পেল। ভ্রু কুঁচকে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ওমনি থমকে গেল সে। কুঁচকে যাওয়া ভ্রু সটান হলো। বুকের ভিতর কেমন ভালো লাগা ছেয়ে গেল। চারপাশে কতশত প্রেমময় প্রজাপতিরা উড়তে লাগলো। সম্মুখে থাকা মেয়েদের মধ্যে লাল রঙের থ্রি পিছ পড়া মেয়েটিকে মাহিমের কাছে, যেন লাল পরী লাগছে। তার হাসিতে যেন মুক্তো ঝরছে। লম্বা খোলা চুল গুলো হাওয়ার তালে দুলছে। সাথে দুলছে পাতলা উড়নাটি আচল। অল্প পানিতে নেমে খালি পায়ে বালুর মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে। আর সেই প্রাণ খোলা মন মাতানো হাসি দিচ্ছে। যা মাহিমের বুকে কেমন তুফান তুলে দিয়েছে। বুকের মধ্যে ধ্রীম ধ্রীম আওয়াজ বৃদ্ধি পাচ্ছে। লাইফে কত মেয়ে দেখেছে ও কিন্তু কখনো তো এমন অদ্ভুত ফিল হয়নি। এতটা অস্থির লাগেনি। তাহলে আজ কেন এমন লাগছে ? কেন এই মেয়েটাকে দেখার এমন সব কিছু এলোমেলো লাগছে। কত প্রশ্ন মাহিমের মস্তিষ্কে! তবে সেগুলোর উত্তর নেই তার কাছে। লাল জামা পড়া মেয়েটি হঠাৎ চেয়ে দেখলো মাহিম সেই কখন থেকে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে তার মুচকি হাসি। ওমনি ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলে তার। মাহিমের দিকে এগিয়ে গিয়ে আঙুল উঁচিয়ে বলল,

” হ্যালো মিস্টার! প্রবলেম কি আপনার ? সেই কখন থেকে আমাদের দিকে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছেন। মতলব কি শুনি ? ”

মেয়েটির কথায় ঘোর কাটে মাহিমের। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। কাছ থেকে মেয়েটিকে যেন আরো বেশি মোহময় লাগছে। মাহিম গলা খাঁকারি দিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

” আমি কেন আপনাদের দিকে তাকাতে যাবো? আমার ঠেকা পড়েছে! তারমানে আপনিও আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। নয়তো কিভাবে বুঝলেন, যে আমি আপনাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কি ম্যাডাম! প্রেমে পড়ে গিয়েছেন নাকি? ”

” ওহো যাস্ট শাট’আপ ইডিয়ট! কি বলতে চাইছেন আপনি? আমি আপনার দিকে তাকিয়েছি! ফা*লতু কথা না বলে নিজের রাস্তা মাপেন। ”

মাহিম বেশ ভাব নিয়ে বলে,

” হয়! হয়! আমার মতো হ্যান্ডসাম, স্মার্ট ছেলেদের দেখলে সব মেয়েরাই বাহানা খুঁজে কথা বলার জন্য। ডোন্ট ওয়্যারি লাল পরী। আমি কিছু মনে করিনি। ”

” লাল পরী! কে লাল পরী? এই শুনুন লজ্জা করেনা এভাবে মেয়েদের মতো পায়ে পা মিলিয়ে ঝগড়া করতে? ”

লাল পরীর দিকে হালকা ঝুঁকে, মাহিম ফিচলে হেসে বলল,

” তারমানে আপনি শিকার করছেন, যে মেয়েরা ঝগড়ুটে হয়? ”

” আপনি একটা বিরক্তিকর মানুষ। আপনার সাথে কথা বলাই উচিত নয়। ”

বলেই রিসোর্টের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো । পিছন থেকে মাহিম ডেকে উঠলো,

” হেই লাল পরী তোমার নাম কি সেটাতো জানাই হলোনা। নামটা অন্তত বলে যাও। ”

মেয়েটি ঘাড় কাতকরে মাহিমের দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কেটে চলে যায়। ওর সাথে থাকা বন্ধুরা এসে জিজ্ঞেস করলো ,

” কিরে ইভা এতক্ষণ ধরে ওই ছেলেটার সাথে কি কথা বলছিলি? তুই চিনিস তাকে?

” আরে নাহ! আজকেই প্রথম দেখলাম। ছেলেটা চরম বেয়া*দপ। বাদদে এসব কথা। পা ব্যথা করছে। চল রিসোর্টে ফিরে যাই। ”

পাশ থেকে ওর বান্ধুপি সোমা বলে উঠলো,

” যাই বলিস দোস্ত। ছেলেটা কিন্তু দেখতে পুরোই হিরোদের মতো। আমিতো ক্রাস খেয়ে গেলাম। ”

ইভা কিছু বললোনা। সে চুপ চাপ হাঁটছে। এরা এমনি। যাকে তাকে দেখে ক্রাস খাওয়ার অভ্যাস আছে। ওরা সেখান থেকে চলে যেতেই মাহিম সেই জায়গায় এসে দাঁড়াল। বলল,

” তাহলে লাল পরীর নাম ইভা। নাইছ নেই’ম। ”

ইভাদের কাছ থেকে কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল মাহিম। ওর বন্ধুরা যখন তার নাম ধরে ডেকে ছিল। তখনি শুনে নিয়েছিল।
লাল পরী তোমার উপর আমার নজর পড়ে গিয়েছে। আমার চোখের আড়াল হওয়া অত সহজ নয়। যেই মাহিমের পিছনে হাজার হাজার মেয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার দিকে তুমি ফিরেও তাকাওনি। তোমার মধ্যে কিছু তো স্পেশল্ আছে। ইন্ট্রেস্টিং। মনে মনে কথা গুলো ভেবে ঠোঁট কামড়ে হাসে মাহিম।

চলবে……