হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব-০৭

0
15

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#সুমাইয়া_সুলতানা
#পর্বঃ৭

ট্রেনে করে ঢাকায় ফেরবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। মাহিমদের আরো একদিন থাকার কথা ছিল। ইভারা ফিরে যাবে বলে প্লান ক্যান্সেল করে ওদের সাথেই ফিরবে বলে মনস্থির করল। এতে অবশ্য কারো কোনো প্রবলেম নেই। এ’কয়দিন বেশ ভালো ভাবেই এনজয় করেছে ওরা। মাহিম, ইভার দুজনের সিট দুই জায়গায় পড়েছে। ইভার পাশের সিটটা সোমার। মাহিমের সাথে আলভীর সিট পড়েছে। সোমাকে ডেকে সিট পাল্টানোর জন্য বলে। সে মুচকি হেসে সম্মতি জানায়। সাকিবের পাশে কোনো ফ্রেন্ডের সিট পড়েনি। বয়স্ক একজন লোকের সিট। পৃথিবীতে এত এত মেয়ে থাকতে শেষে কিনা একজন দাদুর বয়সি লোক তার পাশে? বয়স্ক দাদু না হয়ে বয়স্ক দাদি হলেও চলতো। কপাল খারাপ হলে যা হয়। এ নিয়ে সাকিবের আফসোসের শেষ নেই। ইভা আর মাহিমের বাকি বন্ধুদের সিট ট্রেনের অন্য বগিতে পড়েছে। এই বগিতে ওরা পাঁচজন। মাহিম গিয়ে ইভার পাশের সিটে বসে পড়ে। জানালার সাথের সিটটাতে ইভা বসে আছে চুপ চাপ। মাহিম তাকায় ইভার দিকে। সে ট্রেনের জানালা দিয়ে একধ্যানে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। ঝকঝক শব্দ করে ট্রেন ছুটে চলেছে। ট্রেন থেকে মনে হচ্ছে মাঠ-ঘাট-গাছপালা গুলো দৌঁড়াচ্ছে। বাইরের দিকে চক্ষু স্থির। কয়েকটা পাখি আকাশে পাখা মেলে ট্রেনের গতির সাথে তালমিলয়ে পাশাপাশি চলে আবার পিছিয়ে পড়ে। মনে হয়, সারা পৃথিবী যেন ঘুরছে, আর ওরা স্থির হয়ে বসে আছে। জানালার ধারে বাতাসের গতিবেগের কারণে ইভার চুল এলোমেলো হয়ে যায়। মাহিম হাত বাড়িয়ে আলতো স্পর্শ করে চুল গুলোকে ইভার কানের পিঠে গুজে দেয়। চমকায় সে। এতক্ষণে মাহিমকে লক্ষ করেছে। একবার দৃষ্টি মলিয়ে পরপর নজর ফিরিয়ে পুনরায় নেত্র যুগল বাইরের প্রকৃতি দেখায় মন দেয়। ট্রেন থেকে শূন্য মাঠ দেখা যায়। কিছুদিন আগেও এখানে সোনালি ধান ছিল। একটি বাড়ি দ্রুত চলে যায়। সেখানে গরু আর মহিষ বাঁধা ছিল। দূরে একটি ইটের বাড়িও চোখে পড়ে। অনেক টিনের ঘরের চালে সূর্য চিকচিক করে। পুকুরে গ্রামের বউ-ঝিরা কাজে ব্যস্ত সেটাও চোখে পড়ে। গ্রাম বাংলার রূপ যে এত সুন্দর তা এর আগে ইভার চোখে এভাবে আর ধরা পড়ে নি। সেজন্যই হয়তো কবি লিখেছিলেন-

” বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি,
তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে চাই না আর—”

জীবনানন্দের এই ভাষ্য যে কতটা সত্য, আজ ট্রেনে ভ্রমণ করাকালীন, বুঝতে পারছে ইভা। চোখ বন্ধ করে আলগোছা মাহিমের কাঁধে মাথা রাখলো। চমকায় মাহিম। পরে হেসে এক হাতে আগলে নেয় তার লাল পরীকে। অপর হাতটি ইভার হাতের উপর রাখে। দুজনে কেউ কিছু বলছেনা। নিরবতা ভেঙে ইভা বলল,

” আমার ভীষণ ভয় করছে। আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি আমি জানি না। তবে আমার মন বলছে সমাপ্তিটা অনেক যন্ত্রণার হবে। ”

” এসব তুমি কি বলছো? কেনই বা এসব নিয়ে ভাবছো? এমন কিছই হবেনা। ভরসা রাখো আমার উপর। বলেছিতো তোমার বাবার সাথে কথা বলবো আমি। আমার কষ্ট হয় ইভা। প্লিজ এভাবে আর কক্ষনো বলোনা। ”

মাহিমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখে ইভা। ওর কান্না পাচ্ছে। অজানা এক ভয় মনের ভেতর দানা বেঁধেছে।

” তুমি বুঝতে পারছোনা মাহিম। আমার বাবা তেমন সুবিধার না। তিনি নিজের স্বার্থের জন্য সব কিছু করতে পারে। নিজের মেয়েকে বলি দিতেও দু’বার ভাব’বেননা। ”

ইভার মাথায় চুমু খেয়ে আসস্ত করে বলল,

” যদি তোমার বাবা আমাদের সম্পর্ক মেনে না নেন। তাহলে তোমাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাব। বিয়ে করে ফেলবো আমরা। একবার বিয়ে হয়ে গেলে তিনি আর কিছু করতে পারবেননা। আমার বাবা-মাকে নিয়ে কোনো টেনশন নেই। আমার পছন্দই তাদের পছন্দ। ”

” তুমি সবকিছু যতটা সহজ ভাবছে ততোটাও সহজ হবেনা আমাদের পথচলা। ”

” তুমি শুধু আমার হয়ে থেকে যাও। বাকি যত বাঁধা বিপদ আছে, আমি একা হাতে সব সামলে নিবো। চিন্তা করোনা। ”

ইভা, মাহিমের দিকে তাকায়। চোখে চোখ রেখে বলে,

” আমাকে ভালোবাসার অপরাধে তোমাকে এক আকাশ সমান কষ্ট পেতে হবে। জানিনা ভাগ্যে কি আছে। ”

” যা হবে ভালোর জন্যই হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন। আমরা কখনো আলাদা হবোনা। বিশ্বাস রাখো। ”

ম্লান হাসলো ইভা। ওর মনের অবস্থা বোঝাতে পারছেনা মাহিমকে। কেন ও এতটা আতঙ্কিত হয়ে আছে। বোঝাতে পারছেনা ওর হৃদয়ের ব্যাকুলতা।

**********
আলভীর মন অনেক ফুরফুরে ছিল। পাশে ইভার ফ্রেন্ড বসে আছে। মেয়েটা রাগ’চটা হলেও দেখতে ভীষণ সুন্দরি। চঞ্চল প্রক্রিতির মেয়ে। সেটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। তবে মেজাজ খারাপ হলো একটা বিষয়ে। এসেছে থেকে মেয়েটা চুপ করে আছে। একটা কথাও বলেনি। তারউপর কিছুক্ষণ পরপর মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছে। সঙ্কোচে হয়তো বলতে পারছেনা। আলভীর অস্বস্তি লাগছে। সোমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

” এনি প্রবলেম? লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখছিলেন কেন? এভাবে আমার দিকে তাকাবেন না প্লিজ। আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে।”

সোমা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” কোথায় লুকিয়ে দেখছিলাম? মিথ্যে কথা বলার জায়গা পাননা। আর তাকালেই বা কি? ছেলে মানুষ কি এত লজ্জা পায় নাকি? ”

” পায়তো। এই যে আমি। আপনি আমার দিকে তাকালে আমিতো লজ্জায় লাল, নীল, বেগুনি হয়ে যাই। উফফ! ”

বলেই দুই হাতে নিজের মুখটা ঢেকে নিল। সোমা বিরক্ত হয়। বিরবির করে বলে,

” ছেলেরা যে এত্ত ঢং করতে পারে এটাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। সত্তসব। ”

” এ্যাই মনে মনে কি বিরবির করছেন? ”

” বলছিলাম আপনি কত হ্যান্ডসাম। যেকোনো মেয়েই আপনাকে দেখে ফিদা হয়ে যাবে। ”

ওদের পিছনের সিটেই সাকিব বসেছে। আলভীকে খোঁচা দিয়ে বলল,

” সে আর বলতে। ওকেতো যে মেয়েই দেখে সে মেয়েই ক্রাস খায়। আর এমন ক্রাস খায়। প্রপোজ করলে ভাইয়া ডেকে চলে যায়। ”

আলভী কটমট করে উঠে। সোমা খিলখিল করে হাসতে থাকে। আলভীকে খোঁচাতে পেরে বেশ খুশি সে। হবে নাই বা কেন? ব্যাটা কি সুন্দর মেয়েদের সাথে বসে গল্প করছে। তার পাশেতো জুটেছে এক বৃদ্ধ। সেই কখন থেকে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ওরো ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু কানের কাছে এমন শব্দ হলে ঘুমানো যায় নাকি? অসহ্য! আলভী বলল,

” তোর অবস্থাতো আমার থেকেও জ*ঘণ্য। মনে আছে, একবার আমাদের ভার্সিটিতে একজন নিউ স্টুডেন্ট এসেছিল। ক্যান্টিনে বসে খাবার খাচ্ছিল। পাশে মেয়েটির বড় ভাই বসা ছিল। বাজি ধরে মেয়েটাকে প্রপোজ করতে গিয়েছিলি। মেয়েটির ভাই ছিল গু*ন্ডা টাইপের। তুই গিয়ে তাকে বললি, এ্যাই ছেলে ফোট এখান থেকে। আমি এখন আমার গালফ্রেন্ডের সাথে টাইম স্পেন্ড করবো।ভালোয় ভালোয় কে”টে পড়। নয়তো! তারপর মেয়েটার ভাই তোকে গাছের সাথে বেঁধে রাম ধোঁলাই করেছিল। আর মেয়েটি তোকে পঁচা ডিম ছুড়ে মেরেছিল। নেহাত ঠিক সময় মাহিম এসে ছিল। নয়তো সেদিন তোর রক্ষে ছিলনা। ”

সোমা অবাক হয়ে শুনতে থাকে। সিরিয়াস হয়ে বলে,

” সত্যি এমন হয়েছিল ওনার সাথে? ”

” আলবাত হয়েছে। মিথ্যা কেন বলবো? ”

সোমা শব্দ করে হেসে ফেলে। সাকিব আমতা আমতা করে বলল,

” ও..ওইটা একটা মিসআন্ডাসট্যান্ডিং ছিল। আমি কি জানতাম নাকি ওই ব*জ্জাত ছেলেটি, মেয়েটির ভাই! ”

” যাক অস্বীকার যে করিসনি এটাই অনেক। ”

বলেই হাসলো। সাকিব আর কথা বাড়ালো না। একে কোনো বিশ্বাস নেই। মুখ ফঁসকে কে জানে কখন আবার কি ভুল বা”ল বলে বসে। তাও আবার মেয়েদের সামনে। একা থাকলেও একটা কথা ছিল। প্রেস্টিজকে আর নিচে নামানো যাবেনা। চোখ বুঝে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। আদো এই বুড়োর ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ আওয়াজে ঘুমাতে পারবে কিনা সন্দেহ! তবুও একবার চেষ্টাতো করাই যায়। এদিকে ওদের দুজনের কথা শুনে সোমার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গিয়েছে। ওদের বগিতে একজন বাদাম ওয়ালা ছিল। বাদাম খাবে না কি জিজ্ঞেস করতেই সে না করে দিল। আলভী শুনলো না। পঞ্চাশ টাকার বাদাম কিনে জোড় করে সোমার হাতে ধরিয়ে দিল। সোমা বলল,

” এত বাদাম কে খাবে? ওয়েট আমি ইভাদের কিছুটা দিয়ে আসি। ”

যেতে নিলেই আলভী হাত টেনে ফের বসিয়ে দেয়। সোমা ভ্রু কুঁচকে তাকায়।

” আরে আরে! কি করছেন? অন্যের প্রাইভেসি কেন নষ্ট করতে চাচ্ছেন? ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দিন। আমি আছিতো। চলন দুজনে বাদাম খেতে খেতে গল্প করি। ”

সোমা বসে পড়ে। মিনমিন করে বলল,

” হুম। বলছিলাম কি আমাকে আপনার সিটে বসতে দিবেন? না মানে জানালার পাশে বসতে ইচ্ছে করছে। ”

” ওহো। তখন, তাহলে এ’কথাই বলতে চাচ্ছিলেন?আগে বললেই হতো। আমি কি না করতাম নাকি? আমার মন অনেক বড়। মেয়েদের যেকোনো কাজে হেল্প করার জন্য ওল’ওয়েজ রেডি থাকি আমি।”

সোমা ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। একটা ছেলে এতটা বাচাল হয় কি করে? স্মিথ হেসে মাথা নাড়াল। সিট বদলে বাদাম খাচ্ছে আর কথা বলছে। সোমা তেমন কিছুই বলছেনা। আলভী নিজেই যা বলার বলছে। সোমা চুপ করে শুনছে। মাঝে মাঝে হু, হ্যাঁ বলে উত্তর দিচ্ছে। সোমা লক্ষ করেছে আলভী ছেলেটা অনেক ফানি। হাসি খুশি থাকতে পছন্দ করে। একেকটা হাস্যকর কথা বলছে। সোমা শুনছে আর মিটিমিটি হাসছে।

চলবে,,,,

( ভুলত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।)