হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব-০৮

0
16

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#সুমাইয়া_সুলতানা
#পর্বঃ৮

ঢাকায় ফিরে সবাই পড়াশুনায় ব্যস্ত হয়ে গেল। সামনে তাদের ইয়ার ফাইনাল এক্সাম। পুরোদস্তে কনসনট্রেট করতে হবে। মাহিম আর ইভার সম্পর্কও বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছে। বাড়িতে এসে বাবা, মাকে ইভার কথা জানিয়েছে মাহিম। তারা কোনো আপত্তি করেননি। কেন করবে? এক মাত্র ছেলে তার। বড় আদরের। সংসারতো আর তারা করবেন না। ছেলে ভালো থাকলেই তাদের শান্তি। ছেলের খুশিই তাদের কাছে প্রধান। মাহিমকে ওর মা জামিলা বলেছেন তিনি ইভাকে দেখতে চান। সে বলেছিল আগে পরীক্ষাটা শেষ হোক। তারপর নিয়ে আসবে বাড়িতে। দেখতে দেখতে তাদের পরীক্ষার দিন চলে আসলো। সব গুলো পরীক্ষা ভালোই হয়েছে তাদের। লাস্ট পরীক্ষার দিন ইভাকে পরীক্ষা শেষে ওদের বাসায় নিয়ে আসলো। মাহিমের মায়ের ভীষণ পছন্দ হয়েছে ওকে। আজকেও লাল রঙের থ্রি’পিছ পড়েছে ইভা। ওড়না দিয়ে মাথায় ঘুমটা টানা। ইভার কপালে আলতো চুমু এঁকে দিয়ে থুতুনিতে হাত রেখে জামিলা বললেন,

” মাশা আল্লাহ। মেয়েতো নয়, যেন পরী। আমার ছেলের পছন্দ আছে। ”

লাজুক হাসে ইভা। মাহিম সুর টেনে বলে,

” ওতো পরীই। আমার লাল পরী। ”

” থাম তুই। ইভা মা, তোমার বাবা কি করে? তোমার বাবার সাথে আমাকে কথা বলিয়ে দিও তো। তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবো। তোমাদের বিয়েটা দিয়ে দিলেই আমাদের শান্তি। বাড়ির বউকে, আমার ঘরের লক্ষীকে যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে আসতে চাই। ”

ইভার মুখটা মলিন হয়ে গেল। চোখ দুটো টলমল করছে। জামিলা মাথায় হাত রেখে শুধান,

” কি হয়েছে মা? মুখটা ওমন শুকিয়ে গিয়েছে কেন? আমার কথায় কষ্ট পেলে নাকি?

” তেমন কিছু না আন্টি। আসলে আমার মা নেইতো তাই আপনার আদর পেয়ে মায়ের কথা মনে পড়েগিয়েছে। ”

” কষ্ট পেওনা মা। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। তোমার আমার মধ্যে কত মিল। তোমার মা নেই। আর আমার মেয়ে নেই। তাইতো আমাদের দুজনের বন্ডিংটা ভালো মানাবে। কি বলো? ”

মাথা নাড়িয়ে জামিলাকে জড়িয়ে ধরলো ইভা। মাহিম দাঁড়িয়ে ওর মা’কে দেখছে। এমন মা সবার হয়না। একবারো জানতে চায়নি। মেয়েটা কে? পরিবার কেমন? বংশ কেমন। ফ্যামিলি স্ট্যাটাস কেমন? কিচ্ছু জানতে চায়নি। শুধু ছেলের পছন্দের উপর ভরসা করে সম্মতি দিয়েছেন।

” তোরা কথা বল। আমি তোদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছি। ”

” না না আন্টি। আপনাকে এত কষ্ট করতে হবে না। আমি কিছু খাবো না। ”

” কোনো কথা নয়। কষ্ট কিসের? তোমরা বসো আমি এক্ষুনি আসছি। ”

” আমিও আপনার সাথে যাই? আপনাকে হেল্প করবো। তাহলে দ্রুত কাজ শেষ হয়ে যাবে। ”

” তা কি করে হয়। তুমি আমাদের বাড়ির অতিথি।”

” আমিও যাবো আপনার সাথে। চলুন। ”

জামিলা হেসে ফেললেন। তিনি রান্না ঘরে চলে গেলেন। তার পিছু পিছু ইভাও গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে মাহিমের দিকে একবার তাকালো। সে কটমট করে তাকিয়ে চোখ রাঙালো। ইভা পাত্তা দিলো না। চলে গেল। জামিলা রান্না করছে পাশে ইভা দাঁড়িয়ে এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে। জামিলা মাহিমের ছোট বেলার কথা বলছেন। ইভা মিটিমিটি হাসছে। রান্নার ফাঁকে কফি বানিয়ে ইভার হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি। মাহিমকে দিয়ে আসার জন্য বললেন। সে মুচকি হেসে মাহিমের রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেল। এসে দেখে মাহিম মুখ গোমড়া করে বসে আছে। ইভা গিয়ে পাশে বসলো। কফিটা ছোট্ট টেবিলে রেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

” তাড়াতাড়ি কফিটা খেয়ে নাও। নাহলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। মুখটা এমন প্যাঁচার মতো করে রেখেছো কেন? কোনো মেয়ে ছ্যাঁকা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে নাকি?

মাহিম হ্যাঁচকা টান দিয়ে ইভাকে নিজের কাছে আনলো। বিছানায় চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” খুব মজা তাইনা! মায়ের সাথে যাওয়ার কি দরকার ছিল। আমার সাথে থাকলে কি হতো? ”

” ছাড়ো। কি করছো কি? দরজা কিন্তু লাগানো নেই। কেউ এসে পড়বে ওঠো। ”

” কেউ আসবেনা। আমাকে ইগনোর করার জন্য তোমাকে কি শাস্তি দেওয়া যায় বলতো? ”

ইভা মোচড়ামুচড়ি করছে। মাহিমকে মৃদু ধা’ক্কা দিয়ে সরাতে সরাতে বলল,

” কিসের শাস্তি? আমিতো কোনো অন্যায় করিনি। তোমাকে ইগনোর’ই বা করলাম কখন? মায়ের সামনে ওভাবে তোমার সাথে থেকে গেলে মা কি ভাবতো? আমার লজ্জা করছিল। তাই চলে গিয়েছিলাম। ”

” লজ্জা পেয়েছো তাইতো? তাহলে আরেকটু লজ্জা দেই কেমন? ”

” ক..কি করবে? ”

মাহিম বাঁকা হেসে ইভা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দিয়েছে। ইভা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। কি হয়েছে বুঝতে পেরে মাহিমকে সরাতে চেষ্টা করে। মাহিম ইভার হাত দুটো মুঠো বন্দি করে অপর হাত দিয়ে ইভার ঘাড়ের পেছনে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে কিস করছে। ইভার নিঃশ্বাস আটকে আসছে। উমমম উমমম শব্দ করতেই মাহিম ছেড়ে দিল। শোয়া থেকে ওঠে বুকে হাত দিয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে ও। নিজেকে স্বাভাবিক করে মাহিমের পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে কটমট করে বলল,

” কি করলে এটা? অসভ্য কোথাকার। ”

মাহিম চোখ টিপে বলে,

” কি করেছি বুঝতে পারছো না? আবার বুঝাবো?”

” ধ্যাঁত! ”

মাহিন শব্দ করে হাসলো। ইভা লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। মাহিম হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিলো। ইভাও চুপ করে মাহিমের বুকের ধুপধুকানি শুনতে লাগল। কিছুক্ষণ পর জামিলা এসে খাবারের জন্য ডেকে গেলেন। ডাইনিং টেবিলে এসে দেখে ইতোমধ্যে মাহিমের বাবা খাবার খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। ওরা এসে চেয়ারে বসে পড়লো। ইভা মাহিমের বাবা হানিফ’কে সালাম দিল। জামিলা খাবার পরিবেশন করছেন। ইভা বলল,

” আন্টি আপনিও বসে পড়ুন। সবাই এক সাথেই খাই। ”

” বসবো। তোমরা খাওয়া শুরু করে। ”

হানিফ খাবার খেতে খেতে বললেন,

” আন্টি বলছো কেন? মা বলো। এখন থেকেই মা-বাবা বলার অভ্যাস করে নাও। কিছুদিন পরতো এমনিতেই ডাকতে হবে। ”

” জ্বি? ”

” কি জ্বি জ্বি করছো। যা বলেছি মনে থাকবে তো?”

ইভা কিছুটা লজ্জা পেয়েছে। মাথা নিচু করে হালক হাসলো। ইভার সইসই সম্মুখ চেয়ারে মাহিম বসেছে। মাহিম চেয়ারটা একটু পেছনে নিয়ে পা বাড়িয়ে ইভার পায়ে পা দিয়ে হালকা স্লাইড করছে। ইভার পুরো মনোযোগ খাবারে। হোস্টেলে থেকে বাহিরের খাবার খেয়ে এতদিন পর রুচি সম্মত খাবার পেয়ে তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে। খুব ভালো রান্না করেন জামিলা বেগম। মায়ের হাতের রান্না এমনি হয় বুঝি? প্রশ্ন করে নিজের মনকে। মন উত্তর দেয়, হয়তো। হঠাৎ পায়ে কিছুর আলতো স্পর্শের নড়াচড়া উপলব্ধি করে ভ্রু কুঁচকালেন হানিফ। টেবিলের নিচে উঁকি দিয়ে দেখলেন মাহিম তার পায়ে পা দিয়ে গুতো দিচ্ছে আর ইভার দিকে চেয়ে হাসছে। ইভার পাশের চেয়ারে তিনি বসেছেন। ভদ্রলোক গলা খাকারি দিয়ে বললেন,

” আমি কারো প্রেমিকা নই যে, পায়ে স্লাইড করলে শুরশুরি লাগবে। প্রেমিকের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি উপহার দিবো। চারপাশে নজর রেখে কাজ করা ভালো। নিশানা ভুল হলে বিপদ। আমার পায়ের উপর থেকে কারো পা’টা যদি সরাতো তাহলে শান্তি মতো খাবারটা খেতে পারতাম। ”

বাবার কথায় হোচট খায় মাহিম। কাশি উঠে যায়। জামিলা পানি ঢেলে ছেলের নিকট এগিয়ে দেন। পিঠ চাপড়াতে থাকেন। গ্লাসে চুমুক দিয়ে পুরো গ্লাস ফাঁকা করে শুকনো ঢোক গিলে বাবার দিকে তাকায়। তিনি নিজের মতো খাচ্ছে। বুঝতে পেরে কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলো ইভা। জামিলা স্বামীকে শাসিয়ে বললেন,

” খাওয়ার সময়ও ছেলেটাকে শান্তি দিবেনা। এরকম উদ্ভট কথা বলার কি দরকার ছিল? ”

” আমি ওকে শান্তি দেই না! নাকি ও আমার শান্তি হারাম করতে চাচ্ছে? জিজ্ঞেস করো তোমার ছেলেকে। আমার পায়ের উপর পা দিয়ে ধা”ক্কা দিচ্ছিল কেন? ”

অবাক হয়ে স্বামীর পানে তাকান জামিলা। পরম মুহূর্তেই বুঝতে পেরে তিনি ঠোঁট চেপে হাসেন। মাহিম মাথা নিচু করে আছে। বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আমতা আমতা করে মাহিম বলল,

” আমার খাওয়া শেষ। ইভা তোমার খাওয়াও দ্রুত শেষ করো। তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছেনা? চলো তোমাকে ড্রপ করে দিচ্ছি। ”

কথাটা বলে আর এক সেকেন্ডও ব্যয় করেনি মাহিম। তড়িৎ বেগে প্রস্থান করলো। জামিলা স্বামীর দিকে তাকিয়ে কটমট করে বললেন,

” শান্তি হয়েছে এবার! ছেলেটাকে ঠিক মতো খেতেও দিলেনা। তুমি পারোও বটে। ”

” আরেএ আমি আবার কি করেছি? ”

” চুপ করো তুমি। ”

ভদ্রলোক আর কিছু বললেনা। তার বউ রেগে গেলে সর্বনাশ। তাকে ফেলে ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবে। বউ ছাড়া থাকতে পারেননা তিনি। তার চেয়ে বরং চুপ থাকাই ভালো।

**********
” আমি কিছু শুনতে চাইনা। ওদের উপর কঠোর ভাবে নজর রাখো। প্রতিটা সেকেন্ডের ইনফরমেইশন চাই আমার। আমার নাকের উপর দড়ি দিয়ে এত দিন ধরে এসব চলছে। অথচ আমি কিছু জানিই না। মাস শেষে মাইনে দিয়ে তোদের রেখেছি কিসের জন্য? কোথায় যায়? কি করে? এসব কত দিন ধরে চলছে। সব খবর চাই আমার। কোনো ভুল হলে একটাকেও বাঁচতে দিবো না। মাইন্ড ইট। ”

এতটুকু বলেই ফোন কে’টে দিলেন লিটন পাটোয়ারি। অপর পাশ থেকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না। রাগে হচ্ছে তার ভীষণ। ক্রোধে শরীর কাঁপছে। গলা থেকে টাই খুলে দূরে ছুড়ে মা’রেন। চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারন করেছে। টেবিলে থাকা কাঁচের গ্লাসটা তুলে দেয়ালে ছুড়ে মারেন। মুহূর্তেই কাঁচের গ্লাসটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বদ্ধ ঘরে, নিস্তব্দ পরিবেশে কাঁচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ শুনা গেল।

চলবে,,,,,