হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব-০৯

0
17

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#সুমাইয়া_সুলতানা
#পর্বঃ৯

ইভাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো মাহিম। গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে ইশারা করলো বসতে। ইভা মুচকি হেসে বসে পড়ে। মাহিমও গিয়ে পাশে ড্রাইভিং সিটে বসে পরে। ড্রাইভার সাথে আসতে চাইলে মাহিম না করে দেয়। বলে, সে নিজেই পারবে। দুজনেই সিট ব্যাল্ট লাগিয়ে নেয়। মাহিম গাড়ি স্টার্ট দেয়। গাড়ির জানালা লাগানো ছিল। ইভা খোলার জন্য বলতেই মাহিম খোলে দিল। গাড়ি ছোটার তালে তালে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। গাড়ি যেদিকে যাচ্ছে, বাতাস তার বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসছে। জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে ইভা। ওর চুল বাঁধা ছিল। মাথা থেকে ওড়নাটা সরিয়ে চুল গুলো খুলে দিল মাহিম। ইভা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মাহিম স্মিথ হাসে। বাতাসে ইভার চুল গুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এক হাতে বাড়িয়ে মুখের সামনে আসা অবাধ্য চুল গুলো কানের পিঠে গুজে দেয় সে। হাত বাড়িয়ে ইভার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। অন্য হাতে ড্রাইভিং করছে মাহিম। হাতটা মুখের সামনে নিয়ে আলতো চুমু খায়। ঈষৎ কেঁপে উঠে সে। ডাগর ডাগর নেত্র যুগল প্রেমিক পুরুষের মুখশ্রীতে নিবদ্ধ। হাত ছাড়াতে চায়। মাহিম আরো শক্ত করে ধরে থাকে। কন্ঠ খাঁদে এনে ফিসফিস করে বলল,

” তুমি বড্ড আনরোমান্টিক লাল পরী। এইটুকুতেই কাঁপাকাঁপি করো। আমি ভাবছি বিয়ের পর বাসর রাতে তোমার অবস্থা কি হবে? ”

” তুমি নাকি মেয়েদের সাথে কথা বলাতো দূরে থাক, আশেপাশেও ঘেঁষতে না? এখন তবে আমার সাথে এমন করছো কিভাবে। ”

” সব মেয়ে আর তুমি এক হলে নাকি? তুমিতো আমার লাল পরী। আমার ভালোবাসা। আমার জীবনের প্রথম প্রেম। প্রথম অনুভুতি। তোমাকে দেখলেই কেন যেন আমার প্রেম প্রেম পায়। আমার কি দোষ বলো? ”

” নিজেকে সংযত করুন মিস্টার মাহিম। এতটা উতলা হওয়া ঠিক না। হার্টের প্রবলেম হতে পারে।”

” তুমিই তো আমার হার্ট। প্রবলেম হলে সেটার মেডিসিনও তুমিই দিবে। ”

” বাহ! কাব্যিক হয়ে গিয়েছো দেখছি। ”

” হবো না? প্রেমে পড়লে সবাই আমার মতো একটু আধটু কাব্যিক হয়ে যায়। ”

গুলশান একে’র কাছাকাছি আসতেই চিৎকার করে গাড়ি থামাতে বললো ইভা। চমকে তড়িৎ বেগে ব্রেক কষলো মাহিম। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই সে হাত দিয়ে ইশারা করল। ওদের থেকে কিছুটা দূরেই রাস্তার ওই পাশে ফুসকার গাড়ি। সে ফুসকা খাবে। মাহিম তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে বলল,

” ফুসকা খাবে সেটা বললেই হতো। এভাবে চিৎকার করার কি আছে। ভয় পাইয়ে দিয়ে ছিল। নট ফেয়ার ইভা । ”

” সরি সরি। বুঝতে পারিনি। এক্সাইটেড হয়ে এমনটা করে ফেলেছি। ”

” ওকে নামো। আজ দেখবো তুমি কত ফুসকা খেতে পারো। তবে রেস্ট্রুরেন্ট থেকে কিনে দিব। ও গুলো ভালো না। ”

” আমি ওই গাড়ি ওয়ালা কাকুর থেকেই ফুসকা খাবে। অন্য কোথাও থেকে কিনে দিলে খাবো না। ”

বলেই গাল ফুলালো ইভা। মাহিম মিটিমিটি হেসে হাত দিয়ে ইভার ফোলা গালে আলতো আঘাত করতেই গাল আবারও স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। বলল,

” তুমি যেটা বলবে সেটাই হবে। এবার খুশি? ”

ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করতেই ইভা ফিক করে হেসে ফেলে। মাহিম, ইভার হাত ধরে এগিয়ে যায় ফুসকার গাড়ির দিকে। গুলশান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার একটি অভিজাত এলাকা এবং থানা। এটি একটি সমৃদ্ধ আবাসিক ও ব্যবসায়িক এলাকা। এখানে কয়েকটি পাঁচ তারকা হোটেল, উচ্চমানের রেস্তোরা, শপিং সেন্টার, বিলাসবহুল বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট, প্রতিষ্ঠিত এবং সুপরিচিত বেসরকারী ইংরেজি-মাধ্যম, আন্তর্জাতিক স্কুল, ব্যাঙ্ক, দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির সদর দপ্তর, সদস্যদের ক্লাব, বেশকিছু দূতাবাস এবং হাই কমিশন রয়েছে এই এলাকায়। গুলশানে অনেক বাংলাদেশি ও আন্তর্জাতিক কোম্পানির অফিস রয়েছে। ইভা খুশি খুশি মনে এগিয়ে গিয়ে ফুসকা-ওয়ালাকে বলল,

” কাকু বেশি ঝাল দিয়ে ‘দু’ প্লেট ফুসকা দিন তো। টক’টাও একটু বেশি করে দিয়েন। ”

মাহিম চোখ বড় বড় করে তাকায়। সে ঝাল খেতে পারেনা। তাই বলল,

” আমি ঝাল একদম খেতে পারিনা। আমার’টায় ঝাল দিতে মানা করো। ”

ইভা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মাহিম নিজেই বলল,

” চাচা আপনি এক প্লেট ঝাল ছাড়া বানান। ”

ক্ষীপ্ত হয়ে ইভা বলল,

” ঝাল ছাড়া কেন বানাবে। বেশি ঝাল দিয়েই বানাবে। ”

” বললাম না আমি ঝাল খেতে পারিনা। ”

” তোমার জন্য ওর্ডার করেছে কে? আমি তো নিজের জন্য’ই দু প্লেট ওর্ডার করেছি। তখন কত জ্ঞান দিলে এসব ফুটপাতের খাবার খাওয়া ঠিক না। ভেবেছি তুমি খাবেনা। তাই শুধু নিজের জন্যই বলেছি। তোমার খেতে ইচ্ছে করলে আলাদা ভাবে ওর্ডার দাও। ”

মাহিম হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ইভা মুখ বাঁকায়। মাহিম হেসে ফেলে। সে আর নিজের জন্য ফুসকা অর্ডার করেনি। ইভা খাচ্ছে সে তাকিয়ে আছে তার লাল পরীর দিকে। মাহিমর হাতে ইভার আরেক প্লেট ফুসকা। ইভার প্লেটের গুলো শেষ করে মাহিমের হাত থেকে প্লেট নিয়ে সেই ফুসকা গুলোও খেতে থাকে। মাহিমের মুখের সামনে একটা ধরতেই কিছু না বলে ফুসকাটা খেয়ে নেয়।আসলে সে ইভার হাতে খাওয়াটা মিস করতে চায়না। ইভা গোলগোল নেত্রে তাকিয়ে রইল। মুখে আরেকটি ফুসকা ঢুকিয়ে চিবোতে চিবোতে বলল,

” তুমিনা ঝাল খেতে পারোনা। এখন খাচ্ছো কিভাবে? ”

” তুমি নিজ হাতে খাইয়ে দিলে। বিষও অমৃত মনে করে খেতে রাজি আছি লাল পরী। ”

লাজুক হাসে ইভা। খাবের শেষে টাকা দিয়ে গাড়ির কাছে আসতে আসতে মাহিম বলল,

” আমি আর অপেক্ষা করতে পারবো না ইভা। রেজাল্ট দেওয়ার পরপরই তোমার বাবার সাথে কথা বলে বিয়ে করে নিবো আমরা। আমার লজ্জাবতীর এত লজ্জা কোথায় যায় তখন দেখবো। ”

গাড়ির দরজা খুলে হাসি মুখে পিছনে তাকাতেই চমকে গেল। ইভা নেই। সহসা মুখভঙ্গি বদলে গেল তার। পা দুটো যেন অবস হয়ে গিয়েছে। স্থির লোচনে চেয়ে রইল ইভার দিকে। একজন মধ্য বয়স্ক লোক লাল পরীকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ইভার চিৎকারে হুস ফিরে মাহিমের। দৌঁড়ে যায় সেদিকে। লোকটার থেকে ইভাকে ছাড়াতে চাইলেই খপ করে লম্বা বডি বিল্ড’র অধিকারী দুজন লোক মাহিমকে ধরে ফেলে। মাহিম ছোটাছুটি করছে। লোক দুটোকে আ’ঘাত করতে চাইতে’ই তারা নাক বরাবর ঘু’ষি দেয়। মাহিমের নাক ফেটে র’ক্ত পড়তে থাকে। ইভা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। পেটে কয়েকটা ঘু’ষিও পড়ে শক্ত হাতের। ইভাকে বড় জিপ গাড়িতে বসিয়ে মধ্য বয়স্ক লোকটা মাহিমের সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছু না বলেই মাহিমের গালে সজরে থা*প্পর বসিয়ে দেয়। শার্টের কলার ধরে মৃদু হেসে লোকটা বলে,

” মাম্মাকি ব্যাটা। মাম্মার কোলে ফিরে যাও। ইভাকে ভুলে যাও। আর কক্ষনো ভুলেও ওর দিকে নজর দিও না। ”

মাহিম জোড়ে শ্বাস নিয়ে বলল,

” আমি ইভাকে ভালোবাসি। সারাজীবন থাকবো বলে প্রতিজ্ঞা করেছি আর আপনি বলছেন ভুলে যাবে। অসম্ভব। ”

লোকটা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

” ভালো ভাবে বোঝাচ্ছি। কথা শোন। ইভার থেকে দূরে থাকলেই তোমার জন্য মঙ্গল। ”

” আপনি কেন বঝতে চাচ্ছেন না? কে আপনি? আমাকে থ্রেট দেওয়ার আপনি কে? আপনাকে জিজ্ঞেস করে কি আমি কাউকে ভালোবাসবো? ”

মাহিমের কথায় লোকটা পৈশাচিক হাসে। কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলে,

” নো। আমি সেটা বলি নি। ইভাকে রেখে পৃথিবীর যে কোনো মেয়েকে ভালোবাসতে পারো। তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি কে সেটা তোমার না জানলেও চলবে। যেটা বলেছি সেটা মাথায় রেখো। ”

” যদি না মানি। কি করবেন আপনি? ”

লোকটা হো হো করে হেসে ওঠে। এক হাতে মাহিমের গাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলল,

” আমি কি করতে পারি সেটার সম্পর্কে তোমার কোনো আইডিয়া নেই। ”

বলেই মাথা দিয়ে জোড়ে হিট করলো মাহিমকে। মাহিম মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। কিন্তু ইভা সহসা চিৎকার করে লোকটির উদ্দেশ্যে বলল,

” মাহিমকে মে’রোনা বাবা। আমি তোমাকে হাত জোড় করে বলছি। একটা আ’ঘাতও করো না। ওর কোনো দোষ নেই। আমি প্রশ্রয় না দিলে, আমি সারা না দিলে আমাদের সম্পর্ক হতো না। আমি কোনোদিনও ওর সাথে কথা বলবো না। যোগাযো রাখবো না। ছেড়ে দাও ওকে। প্লিজ বাবা। প্লিজ। ”

রক্তিম চোখে তাকায় ইভার দিকে। ক্রোধে জর্জরিত হয়ে বলে,

” তোর অনেক সাহস বেড়ে গিয়েছে তাইনা? তোর ডানা কা*টার সময় এসে গিয়েছে। তোর ব্যবস্থা আমি পরে করছি। তার আগে এটাকে দেখে নেই। ”

কাঁপা গলায় ইভা বলল,

” তু..তুমি যা বলবে সব শুনবো আমি। তবুও মাহিমকে যেতে দাও বাবা। ”

” ওকে। ডান। ”

মাহিমের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। শার্টের কলার ঠিক করে দেয়। কাঁধে ময়লা ঝেরে ফেলার মতো করে হাত নেড়ে বলল,

” যা হয়েছে ভুলে যাও। আজকে তোমার সাথে কি হয়েছে সেটাও মন থেকে মুঁছে ফেল। খারাপ মুহূর্ত নিয়ে পড়ে থাকলে জীবন রসাতলে যাবে। তার থেকে বরং সব ভুলে নিজের মতো করে ভালো থাকার চেষ্টা করো। দ্বিতীয় বার দুঃসাহস দেখাবার চেষ্টা করো না। ঠিক আছে? ”

লোকটা ইভাকে নিয়ে চলে গেল। মাহিমকে ধরে থাকা লোক দুটো ওর হাত ছেড়ে দিয়েছে। তারাও গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ে। ইভা গাড়ি থেকে মাহিমের মুখের দিকে তাকায়। ওর চোখ দুটো ভয়ংকর লাল হয়ে আছে। সে হতভাগ, অসহায় চোখে তার দিকেই চেয়ে। ইভার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। চোখের পানি বাঁধ মানছে না। ইভা মাহিমের নজর থেকে আড়াল হয়ে গিয়েছে। সব কিছু এখনো মাহিমের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে না হচ্ছে সবটা কেমন এলোমেলো লাগছে। মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে। লোকটা ইভার বাবা। তিনি ইভাকে ভুলে যেতে বলেছেন। সেটা কি আজো সম্ভব? কি করে? মাহিম পারবে না ওর লাল পরীকে ভুলতে। ম’রে যাবে ও। থাকতে পারবে না লাল পরীকে ছাড়া।

চলবে,,,,,