#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-২২
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
আজিজ তালুকদার থম মেরে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখে কোন কথা নেই। কপালে চিন্তার ভাঁজ। তবে তার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই সে আসলে কি ভাবছে। শাহেদ অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছে। কথার মাঝখানে সে এক দু’বার আজিজ সাহেবের প্রতিক্রিয়া বোঝারও চেষ্টা করলো। কিন্তু বুঝতে পারলো না। এতো বড় সত্যিটা জানার পর আজিজ সাহেবের কি মত তা শাহেদের জানা দরকার। মানুষকে নিজের কথার আয়ত্বে আনতে পারা তার এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আজিজ সাহেবের মতো শক্ত মানুষকেও সে ম্যানিপুলেট করার ক্ষমতা রাখে। তারই প্রচেষ্টায় শাহেদ বিরতিহীন ভাবে বলে যেতে লাগলো,
‘ভাইজান, এই ছেলে কতো বড় চতুর বুঝতে পারছেন? এতো বড় সত্যি আমাদের থেকে লুকিয়ে রাখছে৷ আর লুকোবেই না কেন! জানে তো সত্যিটা জানলে আর তালুকদার বাড়ির মেয়ে পাবে না। আমার তো মনে হয় এরা শুধু মিথ্যাবাদীই নয় এর সাথে লোভীও। ছি ছি আমি ভাবতেও পারছি না। শেষমেশ কিনা একটা পতিতার ছেলে!’
শেষের কথাটা শুনে আজিজ সাহেব দাঁতে দাঁত চেঁপে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। আসমা আর জমিরন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যটা গ্রহণ করতে তাদেরও কষ্ট হচ্ছে। শাহেদ বলে,
‘আমাদের তালুকদার বাড়ির একটা মান সম্মান আছে। আমাদের বাপ দাদার আমলেও কোনদিন এমন ঘটনা ঘটে নাই। তারা কেউ উচ্চবংশীয় সম্বন্ধ ছাড়া আত্মীয়তা করতেন না। সবাই সম্মানের চোখে তাদেরকে দেখতো। এই ঘটনা যদি জানাজানি হয় আমাদের বংশের এতোদিনের মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে। লোকে শুনলে থু থু ছিটাবে, একটা পতিতার ছেলের সাথে কিনা তালুকদার বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে! আমার ভাবতেই গা গুলাচ্ছে ভাইজান। আপনি কিভাবে এমনটা করতে পারলেন! বিয়ে দেওয়ার আগে একটু তো ভালোমতো খোঁজ খবর নিয়ে নিবেন। একটা মাত্র মেয়ে আমাদের। কই একটু দেখে শুনে বড় ঘরে বিয়ে দিবেন তা না দিলেন তো দিলেন একটা ছোট ঘরে বিয়ে। তাও সবটা মেনে নিয়েছিলাম যাক বিয়ে তো হয়েই গেছে। এখন আর কি করার! কিন্তু এখন আবার এই কি কাহিনী বের হয়ে এলো! না জানি আরো কতো কেচ্ছা কাহিনী আছে এদের ভেতরে। আপনি রাগের মাথায় এই বিয়েটা দিয়ে যে কতো বড় ভুল করলেন! এর থেকে ভালো ছিল মেয়েকে কেটে গাঙে ভাসিয়ে দেওয়া।’
শাহেদ একটু থামলো। বোঝার চেষ্টা করলো আজিজ সাহেবকে আবার বেশি বেশি বলে ফেলছে কিনা! নিজেকে একটু ধাতস্থ করে বলল,
‘ভাইজান, একটু ভেবে দেখেন। এই খবর যদি সমাজে ছড়ায় তাহলে আমাদের মুখে কেমন কালিটা লাগবে। মানুষ হাসবে। এতদিনের সব সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে। এই যে আপনি যে সামনে নির্বাচনে দাঁড়াবেন, এই খবর জানাজানি হলে আর জীবনেও চেয়ারম্যান হতে পারবেন! মান সম্মান বলতে আর কিছু থাকবে না। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী জয়নাল খাঁ তো তখন আরও আকাশে উঠবে। ভাইজান, একটু ভালো মতো ভেবে দেখেন। সবাই জানতে পারলে কি অবস্থাটা হবে আমাদের বংশের। এখনও সময় আছে। এই খবর জানাজানি হবার আগেই এর দফারফা করে ফেলেন। আমাদের ধারা দেখতে শুনতে গ্রামের মধ্যে সেরা। ও’র জন্য এরপর একটা উপযুক্ত পাত্র খুঁজতে খুব বেশি সময় লাগবে না। অন্তত আর যাই হোক একটা পতিতার ছেলের কাছে আমাদের মেয়েকে আর রাখা যাবে না।’
শাহেদ খুব বেশি চিল্লাপাল্লা করতে থাকে। আজিজ সাহেব এখনও চুপ হয়ে আছেন। আসমা সেই নিশ্চুপতায় শঙ্কিত বোধ করেন। না জানি এবার কি হয়!
__________________________________________
আকাশটা কেমন যেন গুমোট হয়ে আছে। রোদের তাপে খুব একটা জোর নেই। একটা শঙ্খ চিল ডানা মেলে শুদ্ধ’র মাথার উপরের আকাশ দিয়ে গোল গোল চক্কর দিচ্ছে। শুদ্ধ’র সেদিকে কোন নজর নেই। সে গভীর মনোযোগের সাথে ভ্রুকুটি করে একটা সরু বাঁশের মাথায় রশি দিয়ে খুঁটি বাঁধছে। বাড়ির পাশে একটা লম্বা পেঁপে গাছ হয়েছে। তার আগা ভর্তি শুধু পেঁপে। খালি হাতে নাগাল পাওয়া দুষ্কর। তাই এই ব্যবস্থা। ধারা এসে সেই সময় দরজা পাশে দাঁড়ায়। শুদ্ধকে দেখতেই তার চোখের কোণে পানি জমে। গতকাল রাতে শুদ্ধ’র ফোন বিক্রির ব্যাপারটা জানতে পারার পর থেকে ধারা স্থির হতে পারছে না। বাঁশের খুটি বাঁধা হলে সেই দড়ি কাটবার জন্য শুদ্ধ একটা কাঁচির প্রয়োজন অনুভব করে। কাঁচি ঘরের সামনে ‘ওডা’র উপরেই রেখে ছিল শুদ্ধ৷ ধারার সামনে দিয়ে সেটা আনতে গেলে ধারা অস্ফুট স্বরে শুদ্ধকে কিছু বলার চেষ্টা করার আগেই শুদ্ধ না তাকিয়েই চলে আসে। পুনরায় পেঁপে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে নিজের কাজে মন দেয়। ধারাও তৎক্ষণাৎ শুদ্ধ’র পেছন পেছন চলে এসে ভেজা গলায় বলে উঠে,
‘আমি জানি আমি অনেক বড় ভুল করেছি। আপনাকে অনেক বড় আঘাত করেছি। ক্ষমা চাইবার মতোও আমার কোন মুখ নেই…..
রশি বাঁধা থেকে শুদ্ধ’র হাত থেমে যায়। তবে সে পেছনে ঘুরে না। ধারার কণ্ঠ কান্নামাখা। তার চোখ ভর্তি পানি। বুকে ভীষণ যন্ত্রণা। একটু থেমে সে বলতে থাকে,
‘আমার মায়ের প্রথমেই দুটো মেয়ে হয়। সবসময় ছোট থেকে দেখে এসেছি রাতুল হওয়ার আগ পর্যন্ত পরপর দুটো মেয়ে হওয়ায় মাকে কতোটা কথা শুনতে হতো। অপয়া শব্দটাও নামের সাথে লেগে গিয়েছিল। একটা ছেলে জন্ম না দিতে পারায় দাদী কতো কিছুই না বলতো! ছোট থেকেই তাই সবসময় চাইতাম আমার নিজের কাজের জন্য যেন বাড়িতে কোন ঝামেলা না হয়। মেয়ে হয়েছে বলে আবারও যেন কোন কথা না শুনতে হয় আমার মাকে। সবসময় সবার মন রক্ষা করে চলার চেষ্টা করতাম। কারো কথার বাইরে যেতাম না। কাউকে কোন অভিযোগ করার সুযোগ দিতে চাইতাম না। অন্তত আমার কারণে কারো যেন কোন সমস্যা না হয় সেই চেষ্টা করতাম। কিন্তু এরকম ভাবে সবার মন যুগিয়ে চলতে চলতে আমি কবে কখন এরকম হয়ে গেলাম আমি নিজেও জানি না। হয়ে গেলাম আমি এমনই। আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমি তার মান রাখতে পারিনি। আপনাকে প্রচুর আঘাত করেছি। আমাকে প্লিজ মাফ করে দিবেন। এরকম চুপ করে থাকবেন না। আপনি কথা না বললে আমার খুব ক…….’
ধারা আর ও’র কথা শেষ করতে পারলো না। ও’র কথার মাঝেই হঠাৎ সেই বাড়ির উঠোনে আজিজ সাহেবের ডাক শোনা গেলো। তার সাথে আছে শাহেদও। হঠাৎ নিজের বাপ চাচার আগমনে ধারা অবাক হয়ে গেলো। শব্দ পেয়ে খোদেজাও বেড়িয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। শাহেদ ধারার অবাক মুখের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ধারা, চল! তোকে আর এই ছোট ঘুপচি ঘরে থাকতে হবে না। তোকে আমরা নিতে এসেছি। এই
ছেলে যে তোর শ্বাশুড়ির আসল ছেলে না তা কি তুই জানিস!’
ধারা হতভম্ব হয়ে গেলো। খোদেজা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তাকে কোন সময় না দিয়েই আজিজ সাহেব এবার ক্ষুব্ধ গলায় বলে উঠলেন,
‘এই কাজটা আপনি ঠিক করেননি। এভাবে একটা পতিতার ছেলের সাথে আপনি আমার মেয়ের বিয়ে করিয়ে নিলেন!’
আজিজ সাহেবের কথা শুনে ধারা স্তব্ধ। সেই বাকরুদ্ধ ধারাকে কিছু বুঝে উঠার সুযোগ দেওয়ার আগেই আজিজ সাহেব মেয়ের হাত খপ করে ধরলেন। নিজেকে ধাতস্থ করে ধারা কিছু বলার জন্য অস্ফুট স্বরে ‘বাবা’ বলে ডাকতেই আজিজ সাহেব তাকে টেনে নিজের সাথে নিয়ে যেতে লাগলেন। ধারা অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে অপর হাত শুদ্ধ’র দিকে বাড়ানোর চেষ্টা করে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নড়লো না। তার বুকে একধরনের চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হলো, তবুও বাইরে তার আঁচ পড়তে দিলো না। ধারাকে নিয়ে চলে গেলে খোদেজা শুদ্ধ’র কাছে এসে বিচলিত স্বরে বলল,
‘এইটা কি হইলো মাহতাব? তুই বউরে আটকে রাখলি না কেন?’
শুদ্ধ কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে পেছনে ঘুরে বলল, ‘রাখা তাকে যায়, যে থাকতে চায়। ধারার নিজস্ব কোন ইচ্ছা অনিচ্ছা নেই। সে তাই করবে, যা তাকে করতে বলা হবে।’
__________________________________________
রাতুল একটা সমস্যা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে আছে। স্কুল থেকে ক্রিকেট খেলে সে উপজেলা পর্যায়ে খেলার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এদিকে বাবা বলে দিয়েছে ক্রিকেট খেলে সময় নষ্ট করা যাবে না। ক্রিকেট রাতুলের খুব প্রিয়। বাবাকে সে ভয় পায় সত্য। কিন্তু ক্রিকেটও ছাড়ার কথা ভাবতে পারছে না। কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতে সে শুদ্ধকে ফোন দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত মনে করলো। তার দুলাভাই ভীষণ বুদ্ধিমান। এটা সে প্রথম দেখাতেই বুঝতে পেরেছিল৷ রাতুল মাঝে মধ্যেই তার কাছে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য ফোন দেয়। রাতুল নিশ্চিত, সব সমস্যার মতো এই সমস্যার সমাধানও তার দুলাভাইয়ের নিকট থাকবে। এই ভেবে সে বাড়িতে সবসময় থাকা ফোনটা হাতে নেয়। শুদ্ধ’র নাম্বার বের করে তাতে কল দেয়। হঠাৎ শুদ্ধ’র ফোনে ধারাদের বাড়ি থেকে কল এসেছে দেখে শুদ্ধ অবাক হয় না। সে জানে কে হবে? এর আগেও রাতুল এই নাম্বার দিয়ে অনেকবার ফোন করেছে। শুদ্ধ কল রিসিভ করে ফোন কানে নেয়। রাতুল খুশিমনে কিছু কথা বলার পর যখনই তার সমস্যার কথা তুলতে যাবে তখনই তাদের বাসায় আগমন ঘটে তার বাবা আর চাচার। সাথে ধারাও। বাড়িতে তাদের পা পড়তেই একধরনের হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। আজিজ সাহেবের মাথা প্রচুর গরম। হঠাৎ আকস্মিক কোলাহলে ভয় পেয়ে রাতুল ঝট করে ফোন কান থেকে নামিয়ে সেই সোফার উপরে ফেলে রেখেই সেখান থেকে চলে যায়। ধারার অবস্থা একদম পর্যুদস্ত। আসমা আর জমিরন উদ্বিগ্ন হয়ে এগিয়ে আসে। আজিজ সাহেব ধারার কাছে এসে দায় ছাড়া স্বরে বলতে থাকে,
‘ধারা, তোমার বিয়ে ওখানে দিয়ে আসলেই অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। তবে ব্যাপার না। এখনও সব ঠিক করা যাবে। তুমি ঐ ছেলেকে ছেড়ে দিবে।’
ধারা ঝট করে ও’র বাবার মুখের দিকে তাকায়। অশ্রু জমা স্তব্ধিত দুটি চোখ অপলক চেয়েই রয়। আজিজ সাহেব বলতে থাকেন,
‘কালকে সকালে আমি উকিলকে আসতে বলবো। তার সাথে কথা বার্তা হবে। কিভাবে কি করতে হবে জানা যাবে। তারপর তুমি ঐ ছেলেকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে।’
ধারা ক্ষণবিলম্ব না করেই দ্রুত বলে উঠে, ‘না।’
কখনো হয়তো মেয়ের মুখে না শব্দটা শুনেনি বলেই আজিজ সাহেব সাথে সাথেই কথাটা ধরতে পারেন না। উত্তর ‘হ্যাঁ’ মনে করে তিনি মাথা দুলিয়ে উঠতেই হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পান। দ্রুত ঘুরে বলে উঠেন,
‘কি?’
বাবার দিকে তাকিয়ে ধারা স্পষ্ট করে বলে,
‘আমি তাকে ছাড়তে পারবো না।’
আজিজ সাহেব মাত্রাতিরিক্ত অবাক হয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করে বলেন,
‘কেন?’
ধারা বিনা দ্বিধায় বলল,
‘আমি শুদ্ধকে ভালোবাসি।’
এই পুরো কথোপকথনটিই ফোনের ওপার থেকে শুনলো একজন। শুনে পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো সে। শরীরের প্রতিটি লোমকূপের এক শিহরিত অদৃশ্য কম্পন একদম স্থির করে ফেললো তাকে।
চলবে,
#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-২৩
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
কানে ফোন নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুদ্ধ। এই মুহুর্তে কর্ণগোচর হওয়া প্রতিটা কথাই কি সত্যি? কিছুক্ষণের জন্য তার সবকিছু কল্প ভ্রম বলে মনে হলো। কিন্তু না, চোখের সামনেই তো একটা নীল রঙের পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াচ্ছে। হিমেল হাওয়া গায়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে চলে যাচ্ছে। স্বপ্ন তো রঙিন রঙের হয় না। গরম, ঠান্ডা, কোন ব্যাথার অনুভুত হয় না। তার মানে সবই বাস্তব! যেই ধারা নিজের কোন ক্ষুদ্র পছন্দ অপছন্দের কথা তার পরিবারের কাছে বলতে পারে না, সেই ধারা কিনা শুদ্ধ’র জন্য আজ নিজের বাবার কথার বিরুদ্ধে গেলো! অবশেষে সে নিজের মতামত সবার সামনে উপস্থাপন করতে পারলো! ফোনের ওপাশ থেকে আরো অনেক কথা হতে লাগলো। আজিজ সাহেব বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললেন,
‘তোমার মাথা ঠিক আছে? কি বলছো জানো!’
আজিজ সাহেবের ক্ষুব্ধ গলায় ধারা খানিক কেঁপে উঠলো। চোখ বন্ধ করে একটু গভীর শ্বাস টেনে কম্পিত স্বরে বলল,
‘জানি। আমার মাথা পুরো ঠিক আছে। আমি আমার মনের কথাই বললাম।’
‘ঐ ছেলে একটা পতিতার সন্তান! আর তুমি তার কাছে থাকতে চাইছো!’
ধারা এবার অধৈর্য স্বরে বলে উঠলো,
‘তাতে কি হয়েছে বাবা? উনি তো কোন ভুল করেননি। সে তো ঠিক আছে। এখন তার আসল মা কে তাতে কি আসে যায়!’
‘ঐ ছেলে আমাদেরকে ঠকিয়েছে। বিয়ের আগে কেন বললো না সত্যিটা?’
‘শুদ্ধ যদি জানতো তাহলে অবশ্যই বলতো। শুদ্ধ কখনো কাউকে ঠকাতে পারে না। উনি খুব ভালো মানুষ। তাকে আমি বিশ্বাস করি৷ আর যদিও বা সত্যটা লুকানো থাকে তবুও এই সত্য জানা না জানায় আমার কিছু যায় আসে না। যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে আমি তাকে চিনি, জানি। আমি জানি সে কতোটা ভালো। সে ভালো থাকলেই আমার কাছে যথেষ্ঠ। তার আশেপাশের ব্যাপার আমার কাছে ম্যাটার করে না। প্রত্যেকটি মানুষেরই একটা নিজস্ব আলাদা ব্যক্তিত্ব থাকে৷ জন্ম পরিচয়ে কি হয়? আসল পরিচয়টা তো তার ভেতরের গুণগুলো দিয়েই হয়। তার নিজের কর্ম দিয়ে হয়। আর শুদ্ধ’র সেখানে কোন খাদ নেই।’
আজিজ সাহেব আসমার দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘তোমার মেয়ের কি হয়েছে? পাগল হয়ে গেলো নাকি!’
শাহেদ উদ্গ্রীব হয়ে ধারার কাছে এসে বলল,
‘ধারা, কি বলছিস তুই এগুলো? আমরা তোর ভালোর জন্যই যা করার করছি।’
ধারা কেঁদে ফেলে বলল, ‘আমি শুধু তার কাছেই ভালো থাকবো। আর কোনভাবেই না।’
আজিজ সাহেব হুংকার ছেড়ে বললেন,
‘বিয়ে করে এই মেয়ের আস্পর্ধা বেড়ে গেছে! বড়দের সামনে কিসব কথা বলে যাচ্ছে।’
ধারা কাঁদতে লাগলো। শাহেদ মোলায়েম স্বরে বলল, ‘কাঁদে না ধারা। দেখ, আমি বুঝতে পারছি। এতোদিন তুই ও বাড়িতে ছিলি তাই এভাবে হুট করে সিদ্ধান্ত হওয়ায় তোর একটু মায়া লাগছে। ব্যাপার না। আস্তে আস্তে দেখবি সব ভুলে যাবি। একটু সময় যেতে দে।’
আজিজ সাহেব বললেন, ‘ধারা, আমি যা বলছি তুমি তাই করবে। পৃথিবীর ভালো মন্দ তুমি এখনও জানো না। এতো বড়ও হয়ে যাও নি।’
ধারা বলল, ‘যদি বড়ই না হয়ে থাকি তাহলে আমাকে বিয়ে কেন দিয়েছিলেন বাবা? আমি এমন কি বড় অন্যায় করে ফেলেছিলাম! এখন যখন আমি আমার স্বামীর কাছে থাকতে চাইছি তখন বলছেন তাকে ছেড়ে দিতে! যখন ইচ্ছা সবাই বলবেন বিয়ে করতে, যখন ইচ্ছা বলবেন ছেড়ে দিতে….এভাবে কিভাবে হয় বাবা? আমার নিজেরও তো কিছু ইচ্ছা অনিচ্ছা আছে।’
আজিজ সাহেব গর্জে উঠে বলে উঠলেন,
‘ব্যাস! অনেক বেশি বলে ফেলেছো। এখানেই থেমে যাও। তুমি আর ঐ বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে না। না মানে না। আর একটাও কথা না। আসমা, তোমার মেয়েকে ভেতরে নিয়ে যাও।’
আজিজ সাহেব খুব বেশি ক্ষেপে আছেন। শঙ্কিত হয়ে আসমা দ্রুত ধারাকে ধরে রুমে নিয়ে যেতে চায়। ধারা যেতে চায় না। সে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, ‘না বাবা। আপনি এটা করতে পারেন না। আমি শুদ্ধ’র কাছেই থাকতে চাই। আমি তাকে ছাড়বো না। কোনদিনও ছাড়বো না।’
আজিজ সাহেব ভ্রুকুটি করে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। ধারাকে ভেতরে নিয়ে গেলে শাহেদ এসে ভাইকে বলে, ‘ভাইজান, ধারাকে নিয়ে এতো মাথা
ঘামাবেন। বাচ্চা মানুষ তো৷ আবেগী হয়ে পড়েছে। একটু সময় গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। আমরা যা ঠিক করেছি আপনি সেদিকে মনোযোগ দেন। ধারাকে এখন বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঐ ছেলেকে ডিভোর্স দেওয়াতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব এই ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে পারলেই হলো।’
আজিজ সাহেব আর কোন জবাব দেন না। একবার শাহেদের দিকে দৃষ্টিপাত করে তিনি গটগটিয়ে রুমে চলে যান।
রুমে বসে ধারা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। জীবনের সমস্যাগুলো যেন কমার নামই নিচ্ছে না। একের পর এক জট লেগেই যাচ্ছে, লেগেই যাচ্ছে। ধারা অসহায় বোধ করে। শুদ্ধ’র কথা খুব বেশি মনে হতে থাকে তার। ঠিক তখনই তার ফোনটা বেঁজে উঠে। সে উঠায় না। বারবার বাজতেই থাকে৷ শেষমেশ বিরক্ত হয়ে নাম না দেখেই কানে তুলে বলে, ‘হ্যালো!’
ওপাশ থেকে একটা স্পষ্ট ভরাট গলায় কেউ বলে উঠে, ‘ধারা!’
একমুহূর্তের জন্য ধারা থমকে যায়। মন প্রাণ জুড়ে এক শীতল শিহরণ বয়ে যায়। সেই চেনা ডাক! আজ কতদিন পর ধারা শুনতে পেলো শুদ্ধ’র সুমিষ্ট সুস্পষ্ট কন্ঠস্বর। ধারা চোখ বন্ধ করে ফেলে। আত্মায় পানি ফিরে আসে তার। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। শুদ্ধ আবারো ডেকে উঠে, ‘ধারা, শুনছেন?’
আর সময় নষ্ট না করে ধারা চটজলদি বলতে থাকে, ‘শুদ্ধ….শুদ্ধ, প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন। আমি আর কখনোই এমন করবো না। আমার উপর আর রাগ করে থাকবেন না। আমাকে ক্ষমা করে দিন।’
শুদ্ধ ধারাকে থামিয়ে বলল, ‘কিসের জন্য ক্ষমা চাইছেন আপনি?’
‘ঐ পরীক্ষার ব্যাপারটার জন্য….
শুদ্ধ আবেগ্লাপুত থেকেই মৃদু হেসে বলল,
‘আপনি এখনও ঐ ব্যাপারেই পড়ে আছেন! যেখানে এতো বিরাট কিছু হয়ে গেছে। আমাকে নিয়ে এতো বড় একটা সত্য বেড়িয়ে এসেছে….
শুদ্ধ’র কথার মাঝেই ধারা বলে উঠলো, ‘ঐ সবে আমার কিছু যায় আসে না।’
শুদ্ধ একটু নাক টেনে আবারো হাসলো। বলল,
‘আপনি আজকে আমাকে অবাক করে দিয়েছেন ধারা। আপনি আজ আপনার বাবার সামনে যা বললেন।’
শুদ্ধ একটু থামে। ধারা অবাক হয়৷ শুদ্ধ কিভাবে জানলো? ধারার মনের ভাব বুঝতে পেরে শুদ্ধ বলে, ‘আমি শুনেছি। সবটাই শুনেছি। আমি তখন আপনাদের বাড়ির ফোনে অন স্পিকারে ছিলা। আপনি আজকে যা বললেন, আপনি শিওর তো?’
‘হুম।’
‘সত্যি?’
‘এর থেকে বেশি শিওর আমি আমার জীবনে আর কখনো হইনি।’
‘এই কথা জানাজানি হলে আপনাকেও অনেক কথা শুনতে হবে। পারবেন তো ধারা আমার সাথে থাকতে?’
ধারা ক্ষণবিলম্ব না করেই বলল, ‘পারবো।’
‘ভেবে চিন্তে দেখবেন ধারা। এতো তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই।’
‘ভাবাভাবির আর কোন প্রশ্নই উঠে না। আমার মন কি চায় আমি জানি।’
শুদ্ধ’র ঠোঁটের কোনায় তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে। সে নরম কণ্ঠে বলে, ‘এতো কনফিডেন্ট!’
ধারা বলে, ‘আপনিই তো বলেছিলেন, নিজের উপর সবসময় বিশ্বাস রাখতে।’
শুদ্ধ কণ্ঠ স্বাভাবিক করে টেনে বলে, ‘হুম! আমি আরও অনেক কিছু বলেছিলাম তা কি মনে আছে?
‘কি?’
‘এই যে, যাই হয়ে যাক সবসময় ঠিকমতো খাওয়া….
ওপাশ থেকে হঠাৎ শুদ্ধ’র কথা থেমে যায়। ধারা কান থেকে ফোন নামিয়ে দেখে তার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। ধারা একটু বিরক্তির সাথে ফোনটা ঝাঁকি দেয়। বাড়িতে আবারো শাহেদ আর আজিজ সাহেবের জোরালো গলার আওয়াজ শোনা যায়। প্রসঙ্গ ঐ একই। শুদ্ধ’র থেকে ধারাকে ছাড়িয়ে নেওয়া। শুদ্ধ’র সাথে কথা বলে যা একটু মনটা হালকা হয়েছিল, বাবা চাচার সেই কথা শুনতে পেরে ধারা আবারো কাঁদতে থাকে। বালিশে মুখ গুঁজে অশ্রু লুকায়। সে রাতে আর ধারা খেতে আসে না। আসমা অনেক ডাকাডাকি করে। কিন্তু লাভ হয় না। ধারার সাথে ঘুমাতে জমিরন বিবিকে পাঠানো হয়। ধারার অবস্থা ভালো না। রুমে একা ঘুমোতে দেওয়া ঠিক হবে না। ধারাদের বাড়িটা পাকা দোতলা ধরণের। নিচ তলা পুরো কম্প্লিট হলেও দোতলায় শুধু ভেতরের টুকু ঠিক করা হয়েছে। বাইরের কাজ এখনো বাকি। বেলকনিতেও গ্রিল লাগানো হয়নি। সেই খোলা বারান্দায় অন্ধকারের মধ্যে বসে বসে ধারা আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদে। একটা সময় ছিল যখন ও বাড়িতে ধারার যেতে ইচ্ছে করেনি। বিয়ের আগের রাতটিতেও ঠিক এভাবেই বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কেঁদেছিল ধারা। তবুও ধারাকে যেতে হয়েছিল। আর এখন একটা সময় যখন ধারা ও বাড়িতে যাবার জন্যই কাঁদছে। আগে অচেনা যেই পুরুষটির কথা ভাবনায় এনে ধারা ভয় পেতো, আজ তার বিরহেই ধারা ব্যাকুল। তাকে একটি বার চোখের দেখা দেখার জন্যই তার মন উৎকণ্ঠিত। সময় কিভাবে পাল্টায়! ধারা ধীর পায়ে উঠে নিজের রুমের দিকে তাকায়। কতো সুন্দর পাকা ঘর, নজরকাড়া দেয়ালের রং, আরামদায়ক বিছানা, বিভিন্ন প্রসাধনী। তবুও ধারার মন টানছে সেই একছেয়ে টিনের বেষ্টন, কাঠের পাটাতন, সাধারণ বিছানা, আর সেই অসাধারণ মানুষটির প্রতি। তার নিজের চিরচেনা রুমটিই আজ তার বড় অচেনা ঠেকে। এই কক্ষে সব থেকেও নেই। বড্ড খালি। ভালোবাসা শুন্য। ধারার ইচ্ছা করে ছুটে এখান থেকে বেড়িয়ে পড়তে।
জমিরন বিবি অনেকক্ষণ যাবৎ ধারার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ধারাকে এমন উদাস মনে রুমের দেয়ালে নজর বুলাতে দেখে তিনি খেঁকিয়ে উঠে বলেন, ‘এই ছেমড়ি, ঘুমাইলে ঘুমা। নইলে বাত্তি নিভাইয়া বইয়া থাক। এই আলোতে আমার ঘুম আহে না।’
ধারা লাইট বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। পাশ ফিরে নিরবে অশ্রু বিসর্জন করে৷ যাতে ঘুমন্ত দাদীর অসুবিধা না হয়। রাত গভীর হতে থাকে৷ একসময় ঘুমিয়ে যায় ধারা। মাঝ রাতে হঠাৎ একটা শক্ত হাত তার মুখ চেঁপে ধরে। ধারার ঘুম ভেঙে যায়। মুখ দিয়ে অস্ফুট আতর্নাদ করতে গিয়েও সে ব্যর্থ হয়। স্পষ্ট করে তাকিয়েও অন্ধকারে একটা মানুষের অস্পষ্ট অবয়ব ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।
চলবে,