হামিংবার্ড পর্ব-১৫+১৬

0
39

#হামিংবার্ড
#পর্ব_১৫_১৬
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

[পর্বটি সেনসেটিভ। সমস্যা হলে এড়িয়ে যাবেন। ]

সময়টা বিকেলবেলা। হালকা কমলা রঙের আভা যেন নেমে এসেছে চারপাশে। গাড়ির ভেতর পাশাপাশি বসে আছে অরা আর আরিশ। আরিশ মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, আর অরার দৃষ্টি জানালার কাচ পেরিয়ে হারিয়ে গেছে অজানা কোনো গন্তব্যে। তার পরনে সাদা থ্রিপিস, খোলা চুলগুলো কাঁধে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে, কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ, চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে কোমল লিপস্টিকের ছোঁয়া।

আরিশের পরনে বরাবরের মতোই কালো রঙের শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট! অরার হালচাল সুবিধার ঠেকছে না আরিশের। কিছু একটা ভাবছে মেয়েটা। বাড়িতে কেউ কিছু বলছে? না-কি অন্য কিছু? আরিশের ভাবনা ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। অরাকে নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই। সকালবেলা ঘুম ভেঙে সামনে তাকালেই এতটুকু একটা মেয়েকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পায় আরিশ। কী স্নিগ্ধ, সুন্দর, মায়াময় লাগে তখন অরাকে, সেটা শুধু আরিশই জানে। অরার এই স্নিগ্ধ মুখখানাই আরিশের ভালোলাগার কারণ হয়ে উঠছে আজকাল। কিন্তু আরিশ সে বিষয় মনকে মোটেও প্রস্রয় দেয় না। বরং মনকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করে।

” আর কতদূর? ”

নিচু স্বরে জানতে চায় অরা। আরিশ মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে অরার এলোমেলো চুলগুলো আলতোভাবে গুছিয়ে দেয়। তারপর বলে,

” আর পাঁচ মিনিট। ”

” আচ্ছা। ”

আরিশ তাকায় তার দিকে, চোখে আধো মজা, আধো কৌতূহল।

” ঘটনা কী, হামিংবার্ড? শপিং করা নিয়ে আজ এতো আগ্রহ! জামাকাপড় নিয়ে তো তোমার মাথাব্যথা নেই। তাহলে? ”

অরা শুকনো ঢোক গিলল। অরা যে আজ পালিয়ে যাওয়ার মতলব করেছে, লোকটা কি কোনোভাবে সেটা বুঝতে পেরে গেলো? অরার অস্বস্তি হচ্ছে। কিছুতেই ধরা পড়া যাবে না, হুহ্।

” সাবিহা আপুর কথায় খারাপ লেগেছিল অনেক। সেজন্য তাড়াতাড়ি দামী শাড়ি পরতে হবে, সেজেগুজে বাড়িতে ঘুরতে হবে। সবাই দেখবে আর লুচির মতো ফুলবে। ”

অরার ভঙ্গিমা, কণ্ঠের ভেতরে ছেলেমানুষি অভিমানের ছায়া দেখে আরিশ হেসে ফেলল। এই চঞ্চল, কথার ফুলঝুরি মেয়েটা এতদিন ধরে চুপ করে ছিল? কেন? ভয় পায় সে? হয়তো।

গাড়িটা ধীরে থামিয়ে আরিশ বলে,

” ওকে, মাই লিটল বার্ড। লেটস গো ফর শপিং। আমরা পৌঁছে গেছি। ”

অরা আশেপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলো শপিংমলের সামনেই আছে কি-না । তারপর খুশিমনে বলল,

” চলুন, চলুন। ”

” ওয়েট!”

হঠাৎ আরিশ অরার হাত টেনে ধরল। অরার চোখে প্রশ্ন। আরিশ কিছু না বলে, তার ঠোঁটে আলতো করে কিস করলো একটা । অরার মেজাজ খারাপ লাগছে।

‘বাড়ির বাইরে, গাড়ির ভেতর এসেও এসব! আর মাত্র কিছুক্ষণ। তারপর আর নাগালেই পাবেন না। ‘

মনে মনে কত কথা ঘুরপাক খাচ্ছে, তবুও চুপচাপ রইলো অরা। নিজের চিন্তার গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছে যেন। আরিশ গাড়ি থেকে নেমে অরার দিকে এগিয়ে এল। গা ঝাঁকিয়ে হালকা হাসি ছুঁড়ে সে গাড়ির দরজা খুলে অরার সামনে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল— রাজকীয় কুর্নিশের ভঙ্গিতে।

” এসো হামিংবার্ড। ”

অরা স্বাভাবিকভাবেই আরিশের হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে আসে। শপিংমলের কাঁচের দরজা ঠেলে একসাথে ভিতরে ঢুকে পড়ে তারা। আলো ঝলমলে পরিবেশ, হালকা এসির ঠান্ডা হাওয়া আর মানুষের কোলাহল—সব কিছুতেই যেন একটা বর্ণিল জীবন্ততা।

প্রথমেই থ্রিপিসের দোকানে ঢোকে তারা। দোকানের দেয়ালে সারি সারি ঝুলছে রঙিন, জমকালো থ্রিপিস—আরিশ একটু বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলে না। বাজারে এখন পাকিস্তানি থ্রিপিসের চল বেশ। দোকানদারও সেই মোতাবেক একের পর এক পাকিস্তানি থ্রিপিস বের করে দেখাতে শুরু করে।

অরা মনোযোগ দিয়ে একেকটা দেখে যাচ্ছে। কাপড়ের কাজ, রঙের সুর, কাঁথির সূক্ষ্মতা—সবকিছুর মাঝে যেন কোথাও নিজের গা ঢাকা ইচ্ছে লুকিয়ে রেখেছে সে। তার চোখে কোনো উত্তেজনা নেই, কিন্তু অদ্ভুত এক স্থিরতা আছে। আরিশ অরার মনের ভাবনা বুঝতে চেষ্টা করছে। হঠাৎ অরা বলে ওঠে,

“আমার এত দামী পোশাক লাগবে না,”
নরম স্বরে বলে অরা।

“চুপ। ভালো ভালো ড্রেস নাও।”

আরিশর গলা শক্ত হয়ে ওঠে,

“তাজরিন খান আরিশের স্ত্রীর দিকে যেন কেউ আঙুল তুলতে সাহস না করে।”

অরার চোখের কোণে কিছু নরম আলোর ঝলক খেলে যায়, কিন্তু সে চুপ থাকে।
দোকানী আবুল হাসান, বয়স চল্লিশ কি পঁইতাল্লিশ, ভদ্রলোকের চেহারায় আন্তরিকতা। হাতে মেরুন রঙা একটা থ্রিপিস তুলে এনে বললেন,
” আপু এগুলো দেখতে পারেন। মেবি, আপনাকে সুন্দর লাগবে।”

আরিশের কপালে তৎক্ষণাৎ ভাঁজ পড়ে। মুখ না ঘোরালেও, ভেতরে রক্ত ধীরে ধীরে টগবগ করে উঠল। সে অরার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল।

“চলো,” গলার স্বর কড়াতালের মতো।

“কিন্তু কোথায়? ড্রেস তো কিনিনি এখনো…”
অরার চোখে বিস্ময়।

“হ্যাঁ, কিনবে। কিন্তু অন্য শপিংমলে।”

আর কোনো কথা বলেনি আরিশ। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো অরার হাত ধরে।

বেচারা আবুল হাসান থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মাথায় কিছুই ঢুকলো না। সে তো শুধু বলেছিল– সুন্দর লাগবে…তাতেই এমন বিদায়?

শপিংমলের কাচের দরজা আবার স্লাইড করে বন্ধ হয়ে গেলো। তার পেছনে রয়ে গেল কিছু বিস্ময়, আরিশের চোখে লুকিয়ে থাকা একরাশ ঈর্ষা।

সারা বিকেল কেটে গেলো এক শপিংমল থেকে আরেকটায় ঘুরতে ঘুরতে। তিনটে, পাঁচটা, সাতটা দোকান… কিন্তু শেষমেশ জামাকাপড় কেনা তো দূরের কথা, কোথাও এক জায়গায় মন বসলো না আরিশের।

প্রতিটা দোকানের সেলারের মুখে একই কথা—
“এটা ট্রাই করতে পারেন!”
“মাশা-আল্লাহ, আপু। আপনি ভীষণ সুন্দর।”

এই কথাগুলোকেই যেন তীক্ষ্ণ বর্শার মতো মনে হয় আরিশের কাছে। এই চটকদার প্রশংসা, অপরিচিত কারও চোখে অরাকে পরীর সাথে তুলনা করা—এসবই যথেষ্ট তার মেজাজ বিগড়ে দেওয়ার জন্য।
সে কিছু বলেনি। কেবল মুখে ঠান্ডা এক অভিব্যক্তি, চোখে অনাহুত কুয়াশা।

গাড়ি চলছে। জানালার বাইরের আলো আধার একটানা পিছিয়ে যাচ্ছে। অরা পাশের সিটে চুপ করে বসে আছে। মাথার ভেতর এক রাশ অস্থিরতা।
সে ভেবেছিল, যেভাবেই হোক, আজই পালাবে। কিন্তু লোকটা কোথাও কিছু কিনলো কই? জামা-কাপড়, ব্যাগ, কিছুই তো নয়।

“মন খারাপ করতে হবে না, বাসায় ফিরে অনলাইনে সব ড্রেস অর্ডার করে দেবো। তুমিও পছন্দ করে নিবে।”

অরা কিছু বলল না। জানালার কাচের ওপারে সূর্যটা একটু একটু করে গলে যাচ্ছে। পোশাক নিয়ে তার কোনো ভাবনা নেই, কোনো আগ্রহও নয়।
এই মুহূর্তে সে যেন একদম অন্য জগতে। হঠাৎ মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার, চোখে শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস—
“আইসক্রিম!”

আরিশ চমকে তাকায়। রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা আইসক্রিমের গাড়ি দাঁড়িয়ে, রঙিন ছাতার নিচে এক বুড়ো লোক ঠাণ্ডা মিষ্টির গন্ধ ছড়াচ্ছে। আর ঠিক তখনই, হুট করে আরিশের মনে পড়ে যায় তার ছোটোবেলার একটা সন্ধ্যা।

____________

“মা, আমাকে একটা আইসক্রিম কিনে দেবে?”

ছোটো আরিশ গাড়ির জানালা দিয়ে আইসক্রিমওয়ালার দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করে চলেছে বারবার। কাঁচের ওপারে লাল-সবুজ রঙের আইসক্রিম গাড়ি, আরেকটু পরেই তা দৃষ্টিসীমা পেরিয়ে যাবে। তবুও মা ব্যস্ত, ফোনে কথা বলছেন। হাসছেন, কারো সঙ্গে খুব আনন্দে গল্প চলছে।

আরিশ মায়ের হাতটা টেনে ধরে। চোখে পানি টলমল করে বলে,
“ও মা, দাও না কিনে? গাড়ি তো চলেই গেলো… দোকানটা পেছনে পড়ে গেলো মা…”

মা বিরক্ত হয়ে একবার তাকান, ঠোঁটে বিরক্তি মেশানো স্বর:
“সারাক্ষণ শুধু খাই খাই করিস! দেখছিস না কলে কথা বলছি?”

তারপর আবার ফোনে মনোযোগ।
হাসি, গল্প—আরিশ যেন তার জীবনের বাইরের কেউ।

আরিশ তখন চুপ করে যায়। ভেতরে কোথাও যেন একটা ছোট্ট কিছুর মৃত্যু হয়। সেদিনের পর, সে আর কখনো আইসক্রিম চায়নি। না কারো কাছে, না নিজের কাছে।

____________

” আইসক্রিম খাবে, হামিংবার্ড?”
” হ্যাঁ। ”
” তুমি বসো, আমি গিয়ে নিয়ে আসছি। ”

অরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মুচকি হেসে বলল,

” ঠিক আছে। ”

আরিশ গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলো।কিন্তু পরক্ষণেই আবার দাঁড়াল। গলা উঁচিয়ে শুধালো,

“কোন ফ্লেভারের?”
আরিশ জিজ্ঞেস করতেই অরা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর নিচু স্বরে বলে,

“ভ্যানিলা একটা… আর চকলেট একটা।”

বলেই নিজেই থমকে যায় অরা। এই কথাটা তো আইসক্রিম খাওয়ার জন্য বলা হয়নি তার।
ওর মুখ থেকে এই কথাগুলো বেরিয়ে এল কেবল—কারণ ওর পালানোর একটা পথ দরকার।
একটা সুযোগ। একটু সময়।

আরিশ লক্ষ্য করছে অরার মুখ। সেই চঞ্চল মেয়েটা এখন যেন অদ্ভুত রকম শান্ত। চোখে অদ্ভুত এক ছায়া। এই মেয়ে কিছু লুকোচ্ছে। আরিশ সেটা বুঝতে পারছে, কিন্তু ঠিক ধরে ফেলতে পারছে না।

” ওকে। বসো, আসছি। ”

আরিশ চলে যেতেই,অরা আর দেরি করলো না। খুব সাবধানে গাড়ি থেকে নেমে গেলো।

ক্লান্ত শরীরে স্কুলব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাসার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নয়না। লোকটা কি চলে গেছে? না-কি আছে? মকবুলের মুখোমুখিও হতে চায় না নয়না। কিন্তু কী আর করার! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নয়না। পরপর দু’বার কলিংবেল বাজালো। খানিকক্ষণ বাদে দরজা খুলে দিল মকবুল। নয়না চমকাল। উনি কেন দরজা খুললেন? কিন্তু কিছু বলতে পারলোনা। হয়তো মা রান্নাঘরে সেজন্যই!
” আসো মামুনি। সারাদিন স্কুলে অনেক ধকল গিয়েছে নিশ্চয়ই। ”

নয়না মকবুলকে পাশ কাটিয়ে বাসার ভিতর প্রবেশ করে, নিজের রুমের দিকে এগোতে এগোতে বলে,

” তেমন কিছু না। ”

মকবুল দরজা আঁটকে দিলো। ঠোঁটের কোণে তার বিশ্রী হাসির ঝিলিক। রোকসানা মল্লিক গিয়েছেন বাজারে, কিছু কেনাকাটা করতে। বাড়িতে মকবুল একা, অথচ নয়না সেটা জানে না।

রুমে ঢুকে কাঁধের ব্যাগটা টেবিলের ওপর রাখল নয়না। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে মায়ের কাছে সবকিছু বলে দিতে। কিন্তু নয়নার সাহস হয় না। ভয়, লজ্জা, আত্মগ্লানি সবকিছু ঘিরে ধরে তাকে। এসব ভাবতে ভাবতে ওড়না খুলে বিছানায় ছুড়ে ফেলল নয়না। মাথাটা ভীষণ ধরে আছে নয়নার। গোসল করলে যদি ভালো লাগে সেজন্য ওয়াশরুমের দিকে এগোল সে। কিন্তু আচমকা পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরাতে চমকাল নয়না। পুরুষালি স্পর্শ! আঁতকে উঠল নয়না।
” কে! কে?”

চিৎকার করে উঠতেই মকবুল বিশ্রীভাবে হেসে বলল,
” মামুনি আমি, তোমার মকবুল চাচ্চু। ”

ভয়ে, ঘৃণায়, রাগে থরথর করে কাঁপছে নয়নার শরীর। মকবুলের নোংরা স্পর্শে কান্না পাচ্ছে।

” ছাড় বলছি! শয়তানের বাচ্চা! তুই এখনও শয়তানই আছিস। মা কোথায়? মা! মা! মা আআ…..”

মকবুল নয়নাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে শক্ত করে থুতনি চেপে ধরে, অন্য হাতে নয়নার গলা চেপে ধরে বলে,
” বাসায় কেউ নেই মামুনি। আর এভাবে বলছ কেন? শয়তানি বলে না এটাকে। চুপচাপ মেনে নাও সব। নয়তো….. ”

নয়না মকবুলের পায়ে লাথি মারে, ধস্তাধস্তি করতে শুরু করে। মকবুলও নয়নাকে জোর করতে থাকে।

” আমার কিছু হলে আমার বাবা-মা তোকে খুন করে ফেলবে হারামির বাচ্চা। ছাড়……..”

মকবুল নয়নার কোনো কথা শোনে না। সে এখন জানোয়ারে পরিণত হয়েছে। কিশোরী নয়নার শরীরে তার স্পর্শ গাঢ় হতে থাকে। নয়নাও নিজেকে ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণ লড়াই করতে থাকে।

এতক্ষণ পাগলের মতো ড্রাইভ করছিল আরিশ। অরাদের বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে সে। আইসক্রিম কেনা শেষে গাড়ির কাছে আসতেই দেখে, অরা নেই! অরাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। সবকিছু এলোমেলো লাগছে তার। কিছুটা সময় লাগলেও আরিশের বুঝতে অসুবিধা হয় না অরা কোথায় যেতে পারে। তাই দেরি না করে তখুনি অরাদের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়েছিল আরিশ। সময় নষ্ট না করে গেট পেরিয়ে সোজা বাড়ির দরজায় পৌঁছে গেলো আরিশ। কলিংবেল বাজাল কয়েকবার কিন্তু দরজা খুলছে না কেউ। মেজাজ হারাচ্ছে আরিশ। অরা না হয় দরজা খুলবে না, কিন্তু রোকসানা মল্লিক?

আশেপাশে তাকাতেই হঠাৎ অরার দিকে নজর গেলো আরিশের। অরাকে দেখা মাত্রই আরিশ তার দিকে তেড়েমেড়ে গেলো।

” এই মেয়ে! তোমার সাহস তো কম না! তুমি আমাকে বোকা বানিয়ে পালিয়ে এসেছ!”

অরার দুই কাঁধে আরিশের হাতের চাপ, ব্যথায় চোখ সংকুচিত হয়ে আসছে অরার। কিন্তু অরা সেদিকে খেয়াল না করে বলল,

” আপনি প্লিজ দরজাটা ভেঙে ফেলুন। আমার মনে হচ্ছে বাসায় কিছু ঠিক নেই। আমি এসেছি মিনিট পাঁচেক হবে, কলিংবেল বাজালাম কেউ দরজা খুলল না। মা’কে কল দিলাম বলল, বাসায় নেই উনি। মকবুল চাচা আছে বাসায়। নয়না! ওর এতক্ষণে বাসায় ফেরার কথা। চাচা সুবিধার না…. নয়না! আরিশ… নয়না!”

অরা কিছু বলতে পারছে না আর। ভয়ে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে তার। আরিশ আপাতত সবকিছু ভুলে অরাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।

” শান্ত হও। আমি দেখছি। ”

ওদের কথা শেষ হতেই ঘরের ভেতর থেকে জোরেশোরে শব্দ হলো। মনে হলো বাসনকোসন ফ্লোরে পড়েছে। অরার চোখ বড় হয়ে গেছে। আরিশ ইশারায় তাকে আস্বস্ত করলো। অরাকে একপাশে দাঁড় করিয়ে দরজায় লাথি মারতে লাগলো। পরপর কয়েকবার লাথি মারার পরেও দরজা ভাঙল না। অরা কাঁদছে। আরিশ ওর মুখের দিকে তাকাল। তারপর আরেকটা লাথি। দরজা ভেঙে গেলো। আরিশ দ্রুত পায়ে বাসার ভিতর প্রবেশ করলো, অরা পিছুপিছু।

“বাঁচাও! কে এসেছ? বাঁচাও প্লিজ!”

ভাঙা গলায় চিৎকার করে উঠলো নয়না।

অরা শব্দের উৎস খুঁজতে রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে গেলো, আর পেছন পেছন আরিশও।

শরীরের পোশাক ছেঁড়া , হাতে একটা ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নয়না। ওর চোখে আতঙ্কের ছায়া। সামনে দাঁড়িয়ে আছে মকবুল—অসুস্থ, লোলুপ চেহারায়। অরা এক দৌড়ে গিয়ে নয়নার সামনে আড়াল হয়ে দাঁড়াল। আরিশ এগিয়ে গিয়ে মকবুলকে ধরে মারতে শুরু করল।

“নয়না! কিচ্ছু হয়নি বোন, কিছু না… শান্ত হ, আমি আছি তোর পাশে, কিছুই হবে না তোর…”

নয়না জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ওর নিঃশ্বাসের ভারে ঘরটা যেন গুমোট হয়ে উঠেছে। ভয়ে, দুঃসহ যন্ত্রণায় অরাকে জড়িয়ে ধরে আছে সে। অরা নিজের ওড়না খুলে নয়নার গায়ে জড়িয়ে দেয়, স্নেহে, শীতে কম্বলের মতো।

ওদিকে আরিশ মকবুলকে টেনে বসার ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। মুখে তার আগুন, রাগ, ঘৃণা।

“এই বয়সে এসে একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে এসব করার সাহস হয় তোর? তোকে আজ জন্মের শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো, হারামজাদা! আই উইল কিল ইউ। ”

আরিশের ঘুষি, লাথিতে দেহটা কেঁপে ওঠে মকবুলের।

এরমধ্যে রোকসানা মল্লিক ফিরলেন বাজার থেকে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই থমকে দাঁড়ালেন। ঘরের ভেতর অস্বাভাবিক এক উত্তেজনা। নয়নার চোখে পানি, গায়ে অরার ওড়না জড়ানো, আরিশ তেতে আছে রাগে। মকবুল ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে কাতরাচ্ছে।

“কি হচ্ছে এখানে? আরিশ, তুমি কেন মারছো ওকে?”

রোকসানা আঁতকে উঠলেন।

“তোমার এই দেবর কী করেছে দেখো আগে, তারপর কথা বলবে!”
অরা গর্জে উঠল। শান্তশিষ্ট অরা যেন বাঘিনী হয়ে গেছে।

রোকসানার মুখ শুকিয়ে গেল। এমনকিছু ঘটতে পারে দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। নয়নার বিধস্ত মুখ, ভেজা চোখ রোকসানার বুকে অসহ্য যন্ত্রণার সুচ ফুটিয়ে দিচ্ছে।

“তুই কী করেছিস, মকবুল? তুই কী করেছিস আমার মেয়ের সাথে?”
রাগে কাঁপছেন রোকসানা, তেজী গলায় বললেন রোকসানা।

মকবুল কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু মুখ খুললেই আরিশের লাথি।

চলবে,

#হামিংবার্ড
#পর্ব_১৬
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

[দুর্বল হৃদয়ের পাঠকদের জন্য এটি অস্বস্তিকর হতে পারে। নিজ দায়িত্বে পড়ুন।]

“তুই কী করেছিস, মকবুল? কী করেছিস তুই আমার মেয়ের সঙ্গে?”
রোকসানার গলা থরথর করে কাঁপছে রাগে। চোখে যেন আগুন। তিনি তেড়েমেড়ে এগিয়ে এলেন মকবুলের দিকে, যেন ছিঁড়ে ফেলবেন তাকে।

মকবুল কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু মুখ খুললেই আরিশের লাথি। ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে তার। বারবার আরিশের কাছে কাকুতিমিনতি করে যাচ্ছে সে। আরিশের চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। আর ঠিক তখনই নয়না অরার কোল থেকে ধপ করে পড়ে যায়। অজ্ঞান।

রোকসানার মনোযোগ এক ঝটকায় মেয়ের দিকে ঘুরে যায়।
“নয়না!”
ছুটে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন তিনি।

“মা, নয়নাকে ঘরে নিয়ে চলো।”

রোকসানার কণ্ঠে কান্না আর ভয় মিলেমিশে এক অসহায়তা। অরা কাঁপতে কাঁপতে নয়নাকে সামলানোর চেষ্টা করে।

“আমি পারছি না একা ধরে রাখতে মা।”

“চল, আমি ধরছি।”

রোকসানা মেয়ে আর অরার ভর নিয়ে নয়নাকে টেনে তোলেন। তার চোখে শুধু একটাই প্রশ্ন—
এ মেয়েটা ঠিক হবে তো?

“চল মা, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিচ্ছু হয়নি।”

অরার কণ্ঠে সান্ত্বনার ছোঁয়া, কিন্তু গলায় একরাশ শঙ্কা।

“আপনারা নয়নাকে রুমে নিয়ে যান।”

আরিশ ঠান্ডা গলায় বলে। চোখে তখনো আগুন।

“এই জানোয়ারটার বিচার আমি করছি।”

অরা একবার তাকায় মকবুলের দিকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নয়নাকে বুকে আগলে রুমের দিকে এগিয়ে যায়।

মকবুল আরিশের পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
মকবুল আরিশের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদে, ভিজিয়ে ফেলে মেঝে।

“বাবা গো! একটা ভুল হয়ে গেছে। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে গিয়েছিলাম। আমি পাপ করেছি, তবু মাফ করো। এই বয়সে শরীর সইছে না আর। এত মার খেতে পারছি না বাবা!”

আরিশ থমকে যায় এক মুহূর্ত। চোখ নামিয়ে দেখে— এই লোকটাই নয়নার সর্বনাশ করতে চেয়েছিল।
গর্জে ওঠে তার বুকের ভেতর থেকে এক পশুর ডাক।
“তুই মানুষ না, মকবুল। তুই একটা ঘৃণ্য কীট!”

সে সজোরে ঘুষি বসিয়ে দেয় মকবুলের মুখে। আবার রক্ত। মকবুল ছিটকে পড়ে যায়, মুখে গোঙানি। আরিশ দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে, কিন্তু তার ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

“বিশ্বাস কর, শয়তান যদি সত্যিই কথা বলতে পারত, তবে সেও তোকে দেখে বলত— ‘আমি না, এই জানোয়ারটা করেছে সব!’ তুই নিজের পাপ শয়তানের ঘাড়ে চাপাতে চাইছিস? ছি… তোর মতো ঘৃণ্য কিছু আর হয় না।”

আরিশ থমকে দাঁড়াল এক মুহূর্ত, চোখে তীব্র ঘৃণা।

জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

“এই বয়সে নাকি মারধর সইছে না! অথচ এতটুকু একটা মেয়ের ওপর হাত ঝাঁপিয়ে পড়তে তোর কোনো কষ্ট হয়নি, তাই না?”

চোখদুটো লাল, কণ্ঠে বিদ্যুৎ আরিশের।
“বাস্টার্ড!”

আরেকটা ঘুষি মেরে আরিশ মকবুলকে প্রায় অচেতন করে ফেলল। মকবুল ফ্লোরে পড়ে রইল নিঃশ্বাস নিচ্ছিল কষ্টে। নিজে উঠে দাঁড়ানোরও শক্তি নেই তার। আরিশ কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলল। সংক্ষিপ্ত কথায় জানিয়ে দিল— ‘তুলে নিয়ে যেতে হবে’।
মকবুলকে আপাতত ঘরের পেছনের খোলা মাঠে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হলো। আগামীকাল থানায় যোগাযোগ করা হবে।

বিছানায় অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে নয়না। অরা বসে আছে তার পাশে। ডাক্তার এসেছে, আরিশই কল করে আনিয়েছে। ঘরের এককোনায় মাথা নিচু করে গম্ভীর মুখে বসে আছেন সোলাইমান মল্লিক। নিজের মেয়ের এই অবস্থার জন্য কোথাও না কোথাও নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে তার। কারণ দিনশেষে মকবুল তো সোলাইমানেরই বন্ধু ছিলো! রোকসানাও খুব ভেঙে পড়েছে। মেয়েটার সাথে ছোটো থেকে এরকম হয়ে এসেছে অথচ আজ! আজ সর্বনাশ ঘটতে ঘটতে, বেঁচে যাওয়ার পর সবকিছু জানতে পারলেন তিনি৷ আরিশ মকবুলের মুখ থেকেই স্বীকারোক্তি নিয়েছে, রেকর্ড করে রেখেছে সব। আপাতত আজকের রাতের জন্য নয়নাদের বাড়ির পেছনে খোলা মাঠে হাতপা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে তাকে। আগামীকাল সকালে আরিশ থানায় কল করবে।

নয়না বিছানায় নিস্তেজ পড়ে আছে। চোখ বন্ধ, নিঃশ্বাস খুব ধীরে চলছে। মাথার পাশে একটা ছোট্ট টেবিলে স্যালাইন ঝুলছে। আরিশ ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে, হাত মুষ্টিবদ্ধ, মুখে তীব্র রাগ তার। বাবামায়ের উচিত সন্তানদের দিকে খেয়াল রাখা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়েরা তাদের পরিচিত কিংবা আত্মীয়য়ের মাধ্যমেই যৌন হয়রানির স্বীকার হয়৷ আর এসব নির্যাতনের কথা গোপন রাখার ফলেই একদিন বড়সড় বিপদ ঘটে।

ডাক্তার স্টেথোস্কোপ সরিয়ে বললেন,
” প্রেশার খুব লো। ও এখন শকে আছে। ভালো হয়েছে সময়মতো ওকে বাঁচানো গেছে। নাহলে পরিস্থিতি অন্যরকমও হতে পারতো।”

সোলাইমান বসা থেকে উঠে মেয়ের বিছানার দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে গলা ধরে আসা স্বরে বললেন,

” ঠিক হয়ে যাবে তো? এসব কিছু মনে রাখবে না তো? মানে ও স্বাভাবিক থাকবে তো?”

” এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। ওর মানসিক অবস্থা খুব ভেঙে পড়েছে। ট্রমা কিভাবে মোকাবিলা করবে সেটা সময়ই বলবে। কিন্তু সাবধানে থাকতে হবে। কাউন্সেলিং লাগতে পারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে। চিন্তার কিছু নেই আপাতত। ”

নয়নার মা কান্না চেপে বসে আছেন বিছানার পাশে।
চোখে অশ্রু, মুখে স্তব্ধতার ছাপ। ডাক্তার ঔষধ কিছু ঔষধ লিখে বেরিয়ে যান। আপাতত নয়না মানসিকভাবে যেমন বিধস্ত তেমনই শারীরিকভাবে দূর্বল।

সোলায়মান ফ্লোরে বসে পড়ে নয়নার হাত ধরে ফিসফিস করে,
” আমার ভুলের জন্যই আজ এত বড় সর্বনাশ হতে চলেছিল নয়না। আজ থেকে যদি দরকার হয়, আমি তোর ছায়া হবো। কেউ আর তোর দিকে চোখ তুলে তাকাতেও পারবে না। কেউ না। ”

সোলাইমান নিঃশব্দে কাঁদছেন। আরিশ হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলো একবার, রাত ন’টা পেরিয়ে গেছে। অরা বসে আছে চুপচাপ, মুখে কথা নেই। তাদের দুই বোনের জীবনটায় কেনো এমন হচ্ছে?

” আপনারা শক্ত থাকুন। বিপদ ঘটেনি, নয়না ঠিক আছে। মানসিক যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে সেটা আপনাদের সাপোর্ট পেলেই সেড়ে যাবে। কিছুদিন বাসার ভিতরে রাখবেন নয়নাকে। লোকজনের কথা শুনলে মানসিকতা খারাপ হয়ে যেতে পারে। ”

এতকিছুর মধ্যে আরিশের এমন মনোভাব দেখে অবাক হয়েছে অরা। লোকটার মনে মায়া দয়াও আছে তাহলে! রোকসানা আরিশের দিকে এগিয়ে গেলেন। জড়িয়ে ধরলেন বুকে। আরিশ একটু কেঁপে উঠল, যেন মায়ের ছোঁয়া! কথায় বলে না? মাসির শরীর থেকে মায়ের গন্ধ আসে? আরিশের বেলায়ও তেমন হয়। এজন্যই আরিশ রোকসানার থেকে আরো দূরে সরে থাকে সবসময়। কিন্তু এই মুহুর্তে আরিশ দূরে সরতে পারলো না। আজ তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন অসহায় মা। যার মেয়ে তারই সামনে জ্ঞান হারিয়ে, বিধস্ত অবস্থায় শুয়ে আছে।

” তুই না এলে নয়নার কী হতো জানি না আরিশ। তোকে কী বলব জানি না আমি। শুধু বলব, অরাকে ভালো রাখিস বাবা। অতীতে যা হয়েছে ভুলে যা। পৃথিবীর সব নারী একরকম হয় না বাবা। ”

আরিশ কিছু বলল না। বলার ইচ্ছেও করছে না। কিন্তু নয়নার দিকে তাকিয়ে মায়া হলো তার।

” কিছু হতোনা নয়নার। মকবুলের শাস্তির বিষয়টা আমি দেখব। ”

রোকসানা আরিশকে ছেড়ে দিয়ে, সোলাইমান মল্লিকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।

” দেখো তুমি এরকম করে থেকো না। মেয়েটা জ্ঞান ফেরার পর তোমাকে এমন দেখলে আরো কষ্ট পাবে। ”

সোলাইমান চোখের জল মুছে, নয়নার দিকে তাকায়। আরিশ অরার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করল, কিন্তু অরা মাথা নেড়ে ‘না ‘ বলল। আরিশ চোখ পাকাল। অরা মাথা নিচু করে ফেলল শুধু।

” আচ্ছা তামান্না তোমার বাড়িতে কেউ নেই? ”

বসার ঘরে সোফায় বসে আছে তালহা, তামান্না ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার সাজিয়ে রাখতে ব্যস্ত। তামান্না ও তাসলিমা নিজেদের ঘরে আছেন। কাজ করতে করতে উত্তর দিল তামান্না,

” না ভাইজান। থাকার মধ্যে ছিলো, একটা ভাই আর মা। বাবা তো সেই কবেই মারা গিয়েছিলেন, তখন আমি খুব ছোটো। ভাই আমার থেকে পাঁচ বছরের বড়ো। একটা মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে বাড়ি ছেড়েছে সে। শুনেছি তার শ্বশুর অনেক বড়লোক। এতটাই বড়লোক যে, আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেনি ভাই। ওর আত্মসম্মানে লাগত সেজন্য। এমনিতেই নানান রোগশোকে আক্রান্ত ছিলেন মা। তার ওপর ভাইয়ের এমন সিন্ধান্তে অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। তারপর একদিন হঠাৎ তিনিও…….”

তামান্নার গলা ভারী হয়ে এসেছে। দু-চোখ জল গড়িয়ে পড়ছে গালে। তালহা বিষয়টা বুঝতে পেরে তামান্নার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

” আমি দুঃখিত। প্লিজ তুমি কেঁদো না! আমরা কেউই চিরস্থায়ী নই। সবাই একদিন মা*রা যাবো। ”

” হুম। ”

গাড়ির হর্নের আওয়াজে নড়েচড়ে উঠল তামান্না। হাতের কাজ ফেলে রেখে দরজার দিকে এগোল সে। তালহা ওর পেছন পেছন যাচ্ছে।

” ভাইয়া, ভাবি এসেছে , শিওর। ”

” ভাবি?”

তামান্নার কথায় হেসে উঠল তালহা। মাথা চুলকে বলল,
” ভাবি মা এসেছে। ভাইয়া বরাবর ওভার পজসিভ ছিলো, ভাবি মা’র ক্ষেত্রে সেটা আরে বেশি। ”

তামান্না কিছু বলল না। আর কেউ না জানলেও অরার প্রতি আরিশের আচরণ কেমন সেটা তামান্না ভালো করে জানে।

খোলা আকাশের নিচে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে মকবুল। আশেপাশে কিছু নেড়ি কুকুর বসে আছে। কেনো যে নয়নার সাথে আজ এমন করতে গেলো সেই ভেবেই আফসোস হচ্ছে তার। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গেছে। শরীর দূর্বল। আরিশের অত মার খেয়ে শরীরের প্রতিটি গাঁটে গাঁটে ব্যথায় ছেয়ে গেছে।

” আপনাকে এভাবে বেঁধে রেখেছে কে! ”

আচমকা কারো কণ্ঠস্বর শুনে চমকাল মকবুল। সেই সাথে খুশিও হলো বটে। সামনে তাকাল, অন্ধকারে অস্পষ্ট সব। মকবুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আটাশ/ উনত্রিশ বছর বয়সী একজন যুবক। হাতে ফোন, ফ্লাশলাইট জ্বলছে। পরনে তার কালো রঙের টি-শার্ট, সাথে জিন্স। তবে মুখে মাস্ক! আপাতত ফোনের ফ্লাশলাইটের আলোতে এতটুকুই দেখতে পেলো মকবুল।

” আ..মা..কে বাঁচাও, বা..বা। আমি ভুল করে..ছি।”

কথা জড়িয়ে যাচ্ছে মকবুলের। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল এতটুকুই। যুবক মকবুলের দিকে এগোল। ফোন মাটিতে রেখে দ্রুত মকবুলকে মুক্ত করতে লাগলো সে।

বিছানার মাঝখানে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে অরা। পরনে গোলাপি রঙের থ্রিপিস, খোঁপা করা চুল, কানে গলায় কোনো গয়না নেই এখন। সামনের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলল সে। আরিশ দাঁড়িয়ে আছে, হাতে দড়ি। আজকে যা করেছে তাতে শাস্তি কতটা ভয়ানক হবে সেসব ভেবেই চোখে জল এসে যাচ্ছে অরার। ওভাবে পালিয়ে গিয়ে নিজ বাড়িতে যাওয়ার মতো ভুল কীভাবে করল সে, সেসব ভেবেই খারাপ লাগছে অরার। অবশ্য বাড়িতে গিয়েছিল বলেই আজ নয়না বেঁচে গেলো। নয়নার কথা মনে পড়তেই বুকটা খা খা করে উঠল অরার। বোনটাকে রেখেই চলে আসতে হলো। আরিশ কিছুতেই তাকে রেখে এলোনা।

” কী দেখছ হামিংবার্ড? ভয় লাগছে? ”

অরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

” দড়ি দিয়ে কী করবেন?”

আরিশের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি। সে এগিয়ে এলো অরার দিকে, অরা একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছে কেবল। কিন্তু পিছিয়ে আর যাবে কোথায়!

” দড়ি দিয়ে কী করে, বলো তো? ”

অরা চমকায়, থমকায়। আরিশ কি তাকে বেঁধে কিছু করতে চলেছে! অরা আতংকে এদিকওদিক তাকিয়ে বিছানা থেকে উঠে দৌড় দিতে চাইলে আরিশ ক্ষিপ্ত গতিতে ধরে ফেলল তাকে। অরা ঠুকরে কেঁদে উঠে বলল,

” আমি একটা মানুষ। দয়া করুন। প্লিজ এরকম করবেন না! ”

আরিশ অরাকে কোলে তুলে নিয়ে কিছুটা ঝুঁকে বিছানায় ছেড়ে দিল। ভাগ্যিস বিছানাটা বেশ নরম। নয়তো অরার কোমর আস্ত থাকত না।

” আই নিড দিস, হামিংবার্ড। ভালোবাসা চাই না, যা চাই সেটা জোর করেই আদায় করে নেবো। ”

অরা কিছু করতে পারছে না। আরিশ তার হাতদুটো খাটের মাথার ওপরে তুলে বেঁধে ফেলেছে।

” প্লিজ! প্লিজ!”

বড্ড করুণ শোনাচ্ছে অরার গলা। আরিশ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের মতো এগোলো। অরার শরীর থেকে ওড়না সরিয়ে ফেলল। তারপর নিজের টি-শার্ট খুলে ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে বলল,

” আর ইউ রেডি ফর দিস?”

অরা কেঁদে বলে,

” না।”

আরিশ হাসে। অরার বুকে মাথা রেখে শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

” এখানে ঘুমাব আজ। সারারাত আমাকে এভাবেই সহ্য করতে হবে তোমাকে। নড়তেও পারবে না৷ ”

অরা কিছুটা অবাক হলো। শুধু বুকে মাথা রাখার জন্য এতকিছু করলল আরিশ?

” শুধু এটুকুই? ”

” আরো কিছু চাও? তুমি বললেই সবকিছু….. ”

” না, না,না। তা বলিনি। ”

” উফ! কী ধুম তানানানা করছ? ”

অরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আরিশ অরার পেটে হাত রেখে শুয়ে আছে বুকে। ক্লান্ত লাগছে বেশ। মনে হচ্ছে অরার বুক কোনো শান্তির স্থান। যেখানে মাথা রাখতেই কেমন শান্তি শান্তি লাগছে।

” কিছু না। ঘুমান। ”
” গুড নাইট, ছোট্ট পাখি। ”
আরিশ অরার বুকের মাঝখানে একটা কিস করে। নাক দিয়ে দুষ্টমি করে কিছুক্ষণ। একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ে, ওভাবেই দু’জন।

রাত তিনটা। শহরের একেবারে প্রান্তে পুরনো জাহাজঘাটের পাশে পরিত্যক্ত কারখানা। ছায়া আর শীত মিশে আছে বাতাসে। যেখানে মানুষের পা পড়েনি বহুবছর!

চেয়ারে বসে আছে মকবুল—তবে স্বেচ্ছায় নয়।
তার শরীরটা রশিতে এমনভাবে বাঁধা যেন পেশিগুলো চিৎকার করে উঠছে। মুখে গোঁজা জমাট কাপড়, চোখ দুটো ফুঁসে উঠছে ভয়ে। জ্ঞান হারিয়ে ছিলো এতক্ষণ। মকবুল কিছু বুঝতে পারছে না। যতদূর মনে পড়ে অচেনা যুবক তাকে খোলা মাঠ থেকে মুক্ত করার পর ধরে ধরে একটা গাড়িতে উঠে বসেছিল। কিন্তু তারপর?

হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। শুধু তার নিঃশ্বাসটা কুয়াশার ভেতর থেকেও শোনা যাচ্ছে। এটাই সেই যুবক! কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন? আর তাকেই বা বেঁধে রেখেছে কেনো?

“জানিস, মকবুল ধর্ষণের বিচার আদালতে হয় না এখন, এজন্য আমি নিজেই একেকটা ধর্ষককে নিজের আদালতে শাস্তি দেই।”

মকবুল আঁতকে উঠল যুবকের কথায়৷ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা কি তার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করবে? মকবুল কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,
” কে তুমি? আর আমাকে এখন কেনো নিয়ে এসেছ?”

কোনো উত্তর পেলো না মকবুল। যুবকটি ঠোঁটে হালকা একটা নির্মম হাসি নিয়ে ধীরে ধীরে ঘরের এক কোণায় এগিয়ে গেল। সেখান থেকে তুলে আনল একটা পুরনো ধাতব হুক। তার চোখে মুখে কোনো রাগ নেই, বরং অদ্ভুত এক প্রশান্তি।

চেয়ারে বসা মকবুলের হাত-পা শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধা। নড়ারও উপায় নেই। চোখে-মুখে আতঙ্ক জমে উঠেছে। সে জানে কিছু একটা ঘটতে চলেছে, কিন্তু ঠিক কী, তা আন্দাজ করতে পারছে না।

যুবক নিঃশব্দে তার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় মকবুলের পায়ের নখের নিচে হুকটা ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে উল্টো করে তুলতে শুরু করল। মকবুল দম নিয়ে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। তার শিরাগুলো ফুলে উঠল, মুখ বেগুনি ছায়া নিলো যন্ত্রণায়। সে যেন হাওয়ায় ঝুলে থাকা এক মৃতপ্রায় দেহ—নড়তে পারছে না, কাঁদতে পারছে না, শুধুই অসহায়।

হুকটা একটানে উল্টো করে তুলে নিতেই কয়েক ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। যুবক তাকিয়ে রইল—শান্ত, স্তব্ধ। যেন এটাই প্রাপ্য ছিল মকবুলের।

” তোর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি মকবুল। অপেক্ষা কর, সবে তো শুরু! ”

চলবে,