#হামিংবার্ড
#পর্ব_১৯
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
[ পর্বটি সেনসেটিভ। মানসিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। নিজ দায়িত্বে পড়বেন। ]
ডুপ্লেক্স বাড়িটির সামনে এসে গাড়ি থামাল আকাশ। গাড়ির পাশের সিটে বসে আছে অরা—চোখেমুখে ভয়, আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা সবকিছু একসঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত চাপা অস্থিরতা তৈরি করেছে। তার নিঃশ্বাসগুলো যেন বুকের ভেতর আটকে আছে।
আকাশ এক চিলতে হাসি নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে অরার পাশের দরজাটা খুলে দিলো।
“বের হয়ে আসুন, মেমসাহেব।”
মিষ্টি কণ্ঠে বলল সে।
“আমার ছোট্ট কুটিরে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।”
আকাশের এমন মধুর আচরণে, মুহূর্তের জন্য হলেও, ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসির রেখা ফুটে উঠল অরার। কিন্তু সে হাসি ছিল যেন ক্ষণিকের রোদ্দুর—ম্লান, কাঁপা।
আকাশ হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অরার হাত ধরে তাকে গাড়ি থেকে নামাতে চায়। সেই বাড়িয়ে দেওয়া হাতটার দিকে তাকিয়ে কিছুটা থমকে গেল অরা। মনে হলো, যদি আরিশ কোনোভাবে দেখে ফেলে? সেই চিন্তায় বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল, গলা শুকিয়ে এল। আকাশের চোখে কৌতূহল। মেয়েটার মুখে এমন ভয়ার্ত ছায়া কেন? আতঙ্কের গভীরতা আকাশের অভিজ্ঞ চোখে স্পষ্ট। তবু সে কিছুই জিজ্ঞেস করল না।
অরা তাকে কিছুই বলেনি, কেবল ফোন করে বলেছিল, নিতে আসতে। আকাশও কোনো কারণ জিজ্ঞেস করেনি। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই, শুধু নির্ভরতায়, গাড়ি নিয়ে চলে এসেছিল খান বাড়ির গেটের সামনে। আকাশ জানে, অরা যদি চায়, একদিন নিজেই সব বলবে। তাই সে অপেক্ষা করছে। নিশ্চুপ, ধৈর্যের সাথে।
“অরা? কী হয়েছে? এসো!”
আকাশের কণ্ঠে উদ্বেগের ছোঁয়া। চমকে উঠে হুঁশে ফেরে অরা। চারপাশটা যেন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে। নিজের মনেই বারবার বলছে—‘আরিশ এখন অনেক দূরে। সে কিছুতেই এখানে আসতে পারবে না। না, পারবে না।’
এই নিজেকে বোঝানোর মধ্যেই ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে আকাশের হাতে নিজের হাত রাখল অরা। আকাশ তার সেই কাঁপা হাতটা নরম করে ধরল। চোখেমুখে প্রশান্তির ছাপ, যেন বলতে চায়,
‘আমি আছি।’
হালকা একটা হাসি নিয়ে অরাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনল সে।
মাটিতে পা রাখতেই অরা ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে নিল। কোনো কথা না বলে, চুপচাপ পাশে পাশে হাঁটতে লাগল দু’জন। নীরব দুপুরের ভেতর দিয়ে তারা এগিয়ে চলল ডুপ্লেক্স বাড়িটির সীমানার দিকে।
“দেলোয়ার ভাই, অরা কার সঙ্গে গেছে?”
পড়ন্ত বিকেলের নরম আলোয় গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ। তার মুখ থমথমে, চোখে ঘোলা রাগের ছায়া। এলোমেলো চুল, অগোছালো পোশাক অসাবধানেই প্রমাণ দিচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে সে শুধু ছুটেই বেড়িয়েছে। চোখেমুখে ক্লান্তি, কিন্তু দৃষ্টিতে আগুন। দুপুর থেকে শহরের সম্ভাব্য প্রতিটা জায়গা খুঁজেছে সে— অরার বাবার বাড়ি, বন্ধুবান্ধবদের বাসা, এমনকি কলেজ অবধি! তবুও কোথাও অরার কোনো হদিস পায়নি। যেন মেয়েটা এক নিমিষে হাওয়া হয়ে গেছে। শেষ অবধি হাল ছেড়ে খান ভিলা ফিরেছে সে। ভেতরটা অজানা এক ভয় আর ক্রোধে ভরে আছে।
আর এসেই গেটের দারোয়ান দেলোয়ারকে চেপে ধরল।
দেলোয়ার কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে আরিশের দিকে।
“আমি কীভাবে বলব, স্যার!”
কণ্ঠটা কাঁপছে তার।
“আমি তো জানি না, উনি কার সঙ্গে গেছেন। কেউ এলে নামও বলেননি। আমি তো… আমি তো শুধু গেট খুলেছি।”
আরিশ দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু শরীর তার কাঁপছে রাগে।
মনে পড়ল—তামান্না! হ্যাঁ, সে নিশ্চয়ই কিছু জানে। সব সময় তো অরার ছায়ার মতো লেগে থাকে! আর কোনো কথা না বলে দেলোয়ারকে পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল আরিশ। দরজা খোলা ছিল। তালহা সদ্যই ফিরেছে বাসায়।
আরিশকে এমন তেতে উঠে, হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে দেখে তালহার চোখে ভীষণ অবাক ভাব।
“ভাইয়া! কী হয়েছে? এনি থিং রং?”
কিন্তু কোনো উত্তর নেই। আরিশ কেবল কণ্ঠে বজ্র গর্জন এনে চিৎকার করে উঠল,
“তামান্না! তামান্না! এদিকে আয়, ফাস্ট!”
তালহা কেঁপে উঠল। ভাইয়ের এমন রূপ সে সচরাচর দেখে না। যত রাগীই হোক, তালহার সঙ্গে এমন তর্জন-গর্জন কখনো করেনি সে।
ভেতরে ভেতরে একটা অজানা আশঙ্কা জন্ম নিচ্ছে তালহার বুকেও।
আরিশের ডাক শুনে নিজের ঘর থেকে প্রায় দৌড়ে বসার ঘরে এল তামান্না। চেহারায় আতঙ্ক, চোখে বিস্ময়। দরজার চৌকাঠেই দাঁড়িয়ে গেল কয়েক সেকেন্ড আরিশের হাতে ধরা পিস্তল দেখে। ওটা সে চেনে। আগেও দেখেছে। লাইসেন্সধারী অস্ত্র, জানে সে। তবু আজকের পরিস্থিতি একেবারে আলাদা।
আজ সেই পিস্তলের হ্যান্ডেলে যেন জমে আছে ক্রোধের আগুন। আরিশের মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আজ কিছু একটা ঘটবে।
তামান্নার মুখ শুকিয়ে এলো। ঠোঁট কাঁপে, গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না। তবে কথা বলতেই হবে। নয়তো আরিশ আরো রাগান্বিত হয়ে যাবে নিশ্চিত।
“জি ভাইয়া…”
কণ্ঠটা খুব নিচু, যেন একটা বাতাসও তা ছিন্ন করে ফেলতে পারে।
“অরা কোথায় গেছে? কার সঙ্গে?”
তামান্না একটু পেছনে সরে যায়। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে তার। কপাল বেয়ে নেমে আসা ঘামের ফোঁটাগুলো তার ভেতরের অস্থিরতাই জানান দিচ্ছে। কণ্ঠ রুদ্ধ, কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে।
“আমি জানি না ভাইয়া… ভাবি শুধু বললেন, একটু বের হবেন। আমি… আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি।”
আরিশ সামনে পা বাড়াল, একধাপ।
“বাড়িতে সবাই থাকতেও অরা এভাবে পালিয়ে গেল কীভাবে?”
তার চোখদুটো ঠিক যেন শিকারির চোখ। ভয় নয়, বরং অন্যদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দিতে চায় যেন।
সাবিহা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণায়। ঠোঁট চেপে রেখেছে—ইচ্ছে করছে অনেক কিছু বলতে, ঝাড়ি দিতে। কিন্তু মুখ খোলেনি, অন্তত এখনো না।
তালহা কেমন গুটিয়ে আছে। এতক্ষণে সবকিছু তার স্পষ্ট হয়ে গেছে—অন্তত অরার সিদ্ধান্তের ধরনটা।
সোফায় বসে থাকা তাসলিমা খাতুন ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে নিচুস্বরে নিজের মনেই বললেন,
“ভালোই হয়েছে, আপদ বিদায় হয়েছে। এখন অন্তত সাবিহার সাথে আরিশের কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আছে ।”
তার মুখের সেই অতৃপ্ত আত্মতুষ্টি যেন ছায়ার মতো বসে আছে ঘরের প্রতিটি কোণে।
তালহা এগিয়ে এসে গলা নরম করে বলল,
“ভাইয়া… ভাইয়া শান্ত হও। দেলোয়ার ভাইকে ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করে দেখো। ভাবি যে গাড়িতে গিয়েছেন, কোনোভাবে গাড়ির নম্বর দেখেছিল কি না। সেই সূত্রে হয়তো…”
হঠাৎ করেই আরিশ থেমে গেল। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে ঠান্ডা হাসি খেলল। তালহা চমকে গেল। এই অদ্ভুত হাসি সে চেনে না। আরিশ মনেই মনে কিছু হিসেব কষছে। দেলোয়ার তো কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। গাড়ির নম্বরের কথা। কিন্তু তখন তার রাগের আগুনে কিছুই মুখ ফুটে বলতে পারেনি বেচারা।
চোখজোড়া হঠাৎ জ্বলে উঠল আরিশের।
“তালহা, দেলোয়ারকে ডেকে আনো। এখনই।”
ঘরে মুহূর্তেই শীতল একটা চাপা স্রোত নেমে এলো। যেন ঝড়ের ঠিক আগের মুহূর্ত।
মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না—এই খবরটা শুনেই যেন শরীরটায় হঠাৎ করে ঝাঁকুনি খেয়েছে রোকসানার। বুক ধড়ফড় করছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নয়নাও পাশেই বসে আছে, চোখেমুখে গভীর দুশ্চিন্তা। মেয়েটা যেন এক লহমায় বড় হয়ে গেছে।
অফিস থেকে ফেরার পরপরই সোলাইমান মল্লিক সব শুনেছেন। রোকসানাকে শান্ত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। তাঁর কণ্ঠে ভরসা, শান্ত এক দৃঢ়তা।
“তুমি ভেঙে পড়ো না, রোকসানা। দেখবে, অরা ঠিক ফিরে আসবে। আমি আছি, না?”
একটা সত্যি কথা আছে, প্রকৃত সঙ্গী কেবল সুখে পাশে থাকে না, সঙ্গীর দুঃসময়ে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। সোলাইমান মল্লিক যেন সেই কথারই জীবন্ত উদাহরণ। বিয়ের আগ থেকে আজ পর্যন্ত রোকসানার সমস্ত উত্থান-পতনে, টানাপোড়েনে, সোলাইমানই থেকেছেন তার ছায়াসঙ্গী হয়ে। কখনো হাতটা ধরে পাশে থেকেছেন, কখনো এক বাক্যে মনটা হালকা করে দিয়েছেন। এই মুহূর্তে, যখন রোকসানার ভিতরটা তীব্র ভয় আর দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়ছে, সোলাইমানের কণ্ঠটাই তার একমাত্র ভরসা।
“কী হয়েছে বলো তো, অরা? দুপুর থেকে কিছু খেলেও না। ”
আকাশের কণ্ঠে নরম উদ্বেগ। ঘরটা নিঃশব্দ, কেবল হালকা বাতাসে পর্দা দুলছে। মুখোমুখি বসে আছে আকাশ আর অরা। আকাশের দৃষ্টি অরার দিকে নিবদ্ধ, আর অরার চোখে একরাশ ভয়, হতাশা আর অসহায়তা।
আকাশ, বাবার একমাত্র ছেলে। মাকে হারিয়েছে খুব ছোট বয়সে। মা হারানোর শোক কেবল বাবার ছায়াতলে এসে শান্ত হয়েছে কিছুটা। তখন থেকেই তাদের ছোট্ট সংসার—বাপ আর বেটা। সেই সংসারে আলো হয়ে কাজ করেন লতা খালা। রান্না, ঘরের কাজ—সবই তিনিই সামলান।
অরার দিকে তাকিয়ে আকাশ আবার বলল,
“কিছু হয়নি বলছো, কিন্তু মুখটা দেখে তো তা মনে হয় না। এত ভয় কিসের, অরা? তুমি কাঁপছো প্রায়!”
অরা মাথা নিচু করে রাখে, চুপচাপ। আকাশ তার নীরবতা বুঝতে পারছে।
“শোনো, আমি জানি না তোমার স্বামীর সঙ্গে কী হয়েছিল, কী হচ্ছে এখনও। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছি, তুমি সুখী নও, অরা। তোমার চোখেই তো সেই কথা লেখা আছে।”
আকাশের কণ্ঠ নরম, কিন্তু দৃঢ়। অরার দু’চোখ ছলছল করছে। শব্দহীন কান্নার বুদবুদে যেন ভিজে আছে তার চোখের কোণা। ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কথা বলতে পারছে না। কীভাবে বলবে? কীভাবে সে বলবে যে তার স্বামী—আরিশ, একজন খুনি! এক বিকৃত মানসিকতার সাইকো, যার প্রেম মানে দখল, আর ভালোবাসা মানে শারীরিক নির্যাতন। প্রায় রাতে, ঘুমের আগে একটাই রুটিন—বৈবাহিক ধ*র্ষণ! অরার শরীর, মন কিছুই যেন তার নিজের ছিল না। এই সত্যি আকাশকে কীভাবে বলবে সে?
আকাশ তার নির্জনতা বুঝতে পেরে শান্ত কণ্ঠে বলে,
“দেখো অরা আমরা তো বন্ধু, তাই না? বন্ধুদের মাঝে লুকোচুরি থাকার কথা নয়। আমি যদি তোমার কোনো কাজে আসি, তবেই তো বন্ধুত্বের মানে হয়।”
সে এক হাত বাড়িয়ে অরার মাথায় আলতো করে হাত রাখে, আশ্বাসের মতো স্নেহে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
“রনি কল করেছিল। আরিশ নাকি সব জায়গায় তোলপাড় করছে তোমার খোঁজে।”
এই কথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল অরার শরীরে।
সে আচমকা নড়েচড়ে বসে পড়ল, গলা শুকিয়ে এসেছে ভয়ে।
“যদি এখানে চলে আসে?!”
তার চোখে আতঙ্ক ঝলসে ওঠে। আকাশ শান্ত গলায় বলে,
“আসলেও কিছু করতে পারবে না, অরা। তুমি চাইলে কেউ তোমাকে জোর করে কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না। আমি আছি তোমার পাশে।”
অরা তাকিয়ে থাকে আকাশের চোখে। তার ঠোঁটে একটা তিক্ত হাসি ফুটে ওঠে—ছায়া আর কান্নায় মিশ্রিত। আরিশ না-কি জোর করবে না!
“তুমি জানো না, উনি কেমন। ” অরার গলা যেন কান্না চাপা দেয়ার চেষ্টায় রুদ্ধ।
“যেমনই হোক, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। আচ্ছা, তুমি বাবার বাড়ি গেলে কেমন হয়? বাই এনি চান্স, তোমার হাসবেন্ডকে তারা সাপোর্ট করে?”
অরা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। একটাও শব্দ বেরোল না ঠোঁট থেকে। তার চোখের পাতার নিচে লুকানো ভয় আকাশের চোখে স্পষ্ট। সে উঠে দাঁড়াল।
আকাশও উঠে দাঁড়িয়েছে।
“আকাশ, আমি এখানে থাকব না। আমি চাই না তোমার সাথে কিছু হোক। আরিশ কেমন আচরণ করতে পারে, তুমি জানো না।”
আকাশ তার কাঁধে হাত রাখল।
“ধুর, বোকা! ঝামেলা হবে কেন? রাগ করলে দু’টা কথা শুনিয়ে যাবে, এই তো!”
অরা কিছু বলল না। শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। তার দু’পায়ে যেন শক্তি নেই আর। আকাশ তাকে বোঝাতে চায়, কিন্তু অরার দুঃস্বপ্নের বাস্তবতা সে কল্পনাও করতে পারে না। ঠিক তখনই বড়সড় একটা আওয়াজ! দুজনে একসাথে চমকে উঠল!
“বসার ঘর থেকে হলো আওয়াজটা!”
অরার গলা কাঁপছে। নিঃশ্বাস টানাটানা। আকাশ শান্ত গলায় বলল,
“ভয় পেও না। হয়তো লতা খালা কিছু ফেলে দিয়েছেন। চলো, দেখে আসি।”
তারপর ওর হাতটা শক্ত করে ধরল। অরা কিছু বলল না কেবল গলা শুকিয়ে গেছে। আকাশের সাথে ধীরে ধীরে পা ফেলল সে। তারা দুজনে করিডোর পেরিয়ে বসার ঘরের মুখে পৌঁছাল। দম আটকে আসা মুহূর্ত! সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আরিশ। দেয়ালের পাশে, এক ধাপ সামনে।
তার চোখ দুটো তীব্র। অস্বাভাবিকভাবে স্থির।
মাথা সামান্য নিচু। ঠোঁট সোজা রেখা। একটা ম্লান, ভয়ার্ত নিঃশ্বাস যেন হাওয়ায় জমে আছে।
অরার মুখ কেঁপে উঠল। হাতটা এখনও আকাশের হাতে! অথচ ও এতটাই হতবাক, যে হাত সরিয়ে নিতে ভুলে গেছে। আকাশ থমকে গেল। আরিশ ধীরে ধীরে সামনে এগোল।
“হামিংবার্ড, ফিরে চলো। আমরা বাসায় যাচ্ছি।”
আরিশের কণ্ঠে হিমশীতলতা অরার শরীর দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। এই লোক তো সহজে চুপ থাকে না! তার নীরবতা যেন আরও ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে।
“অরা আপনার সঙ্গে ফিরতে চায় না।”
আকাশের দিকে তাকাল আরিশ। ঠাণ্ডা চোখে আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে নিলো। অরা তৎক্ষণাৎ আকাশের হাত ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে সরে গেল।
“স্বামী-স্ত্রীর কথায় তৃতীয় ব্যক্তির ঢোকা মানা- এটা কেউ শেখায়নি তোমায়?”
একবার অরার দিকে তাকাল আকাশ। অরা ভয়ে কাঁপা গলায় বলল,
“আপনি চলে যান। আমি যাব না।”
“হামিংবার্ড, ডোন্ট মেইক মি অ্যাংগ্রি । তুমি জানো, আমি রেগে গেলে তা ভালো কিছু হয় না।”
আরিশের গলায় নীরব হুমকি। আকাশ সেটা বুঝে অরার হাত শক্ত করে ধরল। চমকে উঠল অরা। আরিশ তখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে-মুখে অদ্ভুত এক অস্থিরতা—অরার গা কাঁটা দিয়ে উঠল।
“দেখুন অরা আপনার সাথে যেতে চায় না, তবুও কেন জোর করছেন?”
আকাশ একধাপ এগিয়ে বলল, গলায় স্পষ্ট দ্বিধা আর সাহসের মিশেল।
“ও তো বলেছে, যাবে না। প্লিজ, অরাকে একা থাকতে দিন। আমি ওকে ওর বাবার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব। তারপর… ওর ইচ্ছে হলে আপনার কাছে ফিরবে।”
হঠাৎ কোনো রকম পূর্বাভাস না দিয়ে আরিশ পকেট থেকে পিস্তল বের করে আকাশের কপালে ঠেকাল।
লোহার ঠাণ্ডা মাথা ঠেকতেই আকাশের দম আটকে এল। অরার মুখ ফ্যাকাশে। গলা শুকিয়ে গেছে।
“আকাশ!”
এক চিৎকারে সে পেছনে সরে গেল, চোখে আতঙ্ক জমে গেল।
“প্লিজ, আকাশকে কিছু করবেন না!”
অরার গলায় কান্না। গলার স্বর যেন ভেঙে পড়েছে।
আরিশ শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“ওকে ধরতে তো আসিনি আমি।
তুমিই আমাকে বাধ্য করলে, অরা।”
আকাশ হতবাক। তবু গলায় সাহস জড়ায়,
“আপনি ভুল করছেন! এটা অপরাধ! আপনি জানেন না, আপনি কী করছেন।”
“চুপ!”
আরিশের চোখে আগুন। সে এক পলক দেখল আকাশের দিকে। তারপর ঠিক করল নিশানা—এক নিঃশ্বাসে ট্রিগার টেনে ধরল। একটা বিকট শব্দ!
আকাশের হাত দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। সে এক পা পিছিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খেলো। গুলির জ্বালা শরীর ছুঁড়ে ফেলে দিল তাকে।
অরা ফ্লোরে বসে পড়ল। কান্নায় গলা আটকে আসছে। হাত দিয়ে মুখ ঢেকেছে সে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। আরিশ দাঁড়িয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে সেই তৃপ্তির হাসি।
“আমার ছোট্ট পাখিকে যে হাত স্পর্শ করে, সেই হাতের পরিণতি তো এমনই হওয়ার কথা।”
আরিশের কণ্ঠে বরফের মতো ঠাণ্ডা ভয়।
“হামিংবার্ড! তুমি জানো না? তোমার শরীরে হাওয়া ছুঁয়ে গেলেও সেই হাওয়াটুকু সহ্য করতে পারি না আমি? সেখানে এ তো আস্ত একটা পুরুষ মানুষ!”
অরা ভয়ে কাঁপছে, চোখ অশ্রুভেজা। আকাশ তার দৃষ্টিতে কষ্ট আর অনুতাপ নিয়ে তাকিয়ে আছে।
রক্তে ভেজা হাত চেপে ধরে আছে।
আরিশ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল আকাশের দিকে।
তার চোখে আগুন—না, অন্ধকার। যে অন্ধকারে প্রতিনিয়ত অরা তলিয়ে যাচ্ছে।
পরপর কয়েকটি ঘুষি মারল সে আকাশের মুখে।
আকাশ চিৎকার করে উঠল, চোখে-মুখে ব্যথার ছাপ। সোফায় লুটিয়ে পড়েছে ও।
“আরিশ, থেমে যান! প্লিজ!”
অরা আর সহ্য করতে পারল না। দৌড়ে গিয়ে আকাশের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াল।
“ওকে ছেড়ে দিন, আরিশ।”
অরার কণ্ঠ দৃঢ়, চোখ-মুখে তীব্র অভিমান আর রাগ।
আরিশ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অরার চেহারার বদলটা তার নজর এড়ায় না।
“আমার কলিজায় হাত দিয়েছে সে—তাকে কীভাবে ছেড়ে দিই বলো?”
আরিশের কণ্ঠ তীক্ষ্ণ, ঠোঁটে বিকৃত একরকমের রাগী তৃপ্তি।
“আপনি আর কিছু করবেন না ওকে!”
অরা এবার সামনে এসে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আরিশ তা না শুনেই আকাশকে আরেকটা ঘুষি মারে। এসব আর সহ্য হচ্ছে না অরার।
রাগে, দুঃখে, ঘৃণায় সে দৌড়ে গিয়ে আরিশের কলার চেপে ধরল।
“আপনার মতো পশুর সঙ্গে আমি থাকতে চাই না জানেন কেন? কারণ আপনি মানুষ নন।
একটা স্বাভাবিক মানুষ এরকম আচরণ করে না, আরিশ!”
হঠাৎ করেই আরিশের চোখ-মুখ বদলে গেলো।
চোখজোড়া রক্তবর্ণ, ঠোঁটের কোণে বিকৃত এক অদ্ভুত হাসি—সব মিলিয়ে ওকে এখন ভয়ংকর দেখাচ্ছে। অরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরিশ তাকে ঝাঁপটে জড়িয়ে ধরল। ছটফট করছে অরা, নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে বারবার।
কিন্তু আরিশ শান্ত। অদ্ভুতভাবে শান্ত। তার কপালে, গালে, ঠোঁটে একের পর এক চুমু এঁকে দিচ্ছে।তারপর আবারও বুকের মাঝে চেপে ধরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল সে একটা অস্বাভাবিক স্বস্তির নিঃশ্বাস।
অরা ভয়ে, লজ্জায় কাঁপছে। নিজেকে ছুঁড়ে ফেলতে চাইছে এই আতঙ্ক থেকে, এই অন্ধকার থেকে।
“চলো, বাসায় ফিরি।”
আরিশের কণ্ঠে দৃঢ়তা।
“আমি যাব না আপনার সাথে। আপনি শুনতে পাচ্ছেন?”
অরা নিজেকে ওর কাছ থেকে কোনোমতে ছাড়িয়ে দূরে সরে দাঁড়াল।
ওদিকে আকাশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
আরিশ ঠান্ডা একটা হাসি হাসল। ধীরে ধীরে পিস্তলটা তুলে আকাশের দিকে তাক করল।
আঁতকে উঠল অরা।
“কি করছেন আপনি?”
“দেখতে থাকো!”
আরিশের কণ্ঠে ভয়ঙ্কর নির্লিপ্ততা।
“আরেকটা খুন করতে যাচ্ছেন?”
অরার গলা কেঁপে উঠল।
“খুন তো আগে করিনি। তবে তোমার জন্য, খুনও করতে পারি আমি।”
আকাশের দিকে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল অরা। আরিশ তখন কাউন্টডাউন শুরু করেছে।
“ওয়ান… টু…”
“থামুন!”
অরা চিৎকার করল।
“চলুন, আমি যাব আপনার সাথে।”
আরিশের ঠোঁটে তৃপ্তির বিস্তৃত হাসি ফুটে উঠল।
এক মুহূর্তও দেরি না করে, সে অরার হাত ধরে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।
পেছনে পড়ে রইল রক্তাক্ত আকাশ—নির্বাক, নিস্তেজ। আরিশ চলে যেতেই লতা খালা ছুটে এলেন তার দিকে।
বসার ঘরে থমথমে নীরবতা। তালহা আর তামান্না মাঝে মাঝে একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে চিন্তিত, ভীত। আজ অরার ভাগ্যে কী আছে, কেউ জানে না।
কিন্তু অরা এমন করল কেন? তালহা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না, আর তামান্না চুপচাপ প্রার্থনা করছে—শুধু অরার জন্য।
ডাইনিং টেবিলে বসে সাবিহা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে আঙুর চিবোতে ব্যস্ত। আরিশ যেন রাগের মাথায় অরাকে গুলি করে বসে—এই ইচ্ছাই যেন ওর চোখেমুখে লেখা।
হঠাৎ বাইরে গাড়ির শব্দে চমকে উঠল সবাই।
তামান্না বসা থেকে উঠে দাঁড়াল, তাড়াতাড়ি দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তালহা পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে উঁকি দিচ্ছে।
আরিশ এগিয়ে আসছে… আর পাশে মাথা নিচু করে হাঁটছে অরা। ওর চোখে জল, মুখটা ফ্যাকাশে। যেন আত্মা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চায়। হাতে এক চিলতে কাঁপুনি। শরীরটা নিস্তেজ, যান্ত্রিকভাবে হাঁটছে কেবল।
তামান্না দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, চোখ আটকে গেছে অরার মুখে। তালহা পেছন থেকে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এল।
“তোমরা এসেছ! যাক, আলহামদুলিল্লাহ।”
তালহার কণ্ঠে স্বস্তির মিশ্রণ, কিন্তু আরিশের মুখে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া নেই। চোখে একরকম স্থির শূন্যতা। সে একটুও না থেমে অরার হাত ধরে সোজা সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দিকে রওনা হলো। তালহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেও তামান্নার ঠোঁট ফসকে বেরিয়ে এল,
“আল্লাহ ভাবিকে রক্ষা করো। কে জানে আজ কী অপেক্ষা করছে ওর কপালে!”
“মানে?” তালহা ঘুরে তাকাল, কণ্ঠ থমথমে।
“ভাইয়া কি ভাবিকে মানে ভাবি মা’কে মারধর করে, তামান্না?”
তামান্না কাঁপা চোখে তাকাল ওর দিকে। চুপ করে থাকলে আরও বাজে কিছু ভেবে ফেলবে তালহা, এমন ভাবনায় কথাগুলো বেরিয়ে এল,
“ভাইয়ার ডাক্তার দেখানো উচিত, তালহা ভাই। আপনি কয়েকদিন থাকুন, সব বুঝে যাবেন।”
তালহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আরিশের ছোটোবেলা, বর্তমান, তার অস্থিরতা সম্পর্কে তালহাও একটুআধটু শুনেছে। কিন্তু সমস্যা এতদূর গড়িয়েছে সেটা জানতো না। চোখ তুলে সিঁড়ির দিকে তাকাল তালহা। ধীর পায়ে উঠে যাচ্ছে আরিশ আর পেছনে মৃতপ্রায় পাখির মতো হাঁটছে অরা।
ঘরে ঢুকেই দরজা ধাক্কা দিয়ে আটকে দিলো আরিশ। অরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে, চোখে আজ অদ্ভুত এক জেদ যেন আগের সেই কুঁকড়ে যাওয়া অরা আর নেই।
“ওই ছেলের সঙ্গে কেন গিয়েছিলে, হামিংবার্ড?”
আরিশ দুই হাতে অরার গাল ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করল ধীরে।অরার চোখে চোখ রেখে সোজাসাপটা উত্তর,
“তোমার কাছে আর থাকতে চাই না। বাবার বাড়ি গেলে আবার জোর করে টেনে আনতে। তাই আকাশের সাথে গিয়েছিলাম।”
আরিশ এক হাতে তার কোমরে শক্ত করে ধরে ফেলল, আরেক হাতে চিবুক তুলে বলল,
“তাতে কী লাভ হলো, ছোট্ট পাখি?”
অরা চোখ নামাল না। ঠান্ডা গলায় বলল,
“আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, একজন সাইকোপ্যাথের পক্ষে সব সম্ভব। যে একটা খুন করতে পারে, সে আরও অনেক কিছুই পারে।”
আরিশের হাত শক্ত হতে লাগল। কোমরে, চিবুকে অরা ব্যথা পাচ্ছে। চোখে জল চিকচিক করছে।
“আমি কাউকে খুন করিনি।”
চাপা গলায় বলল আরিশ।
“মিথ্যে বলছেন!”
এক মুহূর্ত চুপ। তারপর আরিশ অরার গলায় আলতো করে চুমু খেলো। অরার শরীর শিউরে উঠল ঘৃণায়। আরিশ থেমে থেমে আরও দু’বার চুমু খেলো, তারপর হঠাৎই তার কাঁধে দাঁত বসাল।
ব্যথায় হালকা চেঁচিয়ে উঠল অরা। কাঁধ থেকে ধীরে ধীরে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
” কী দিচ্ছি না তোমাকে? টাকাপয়সা? সময়? আর কী দরকার তোমার? তারপরও আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে, পালিয়ে গেলে? কেনো হামিংবার্ড? ”
অরা আরিশকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে ফেলল। আচমকা ধাক্কা দেওয়াতে আরিশও টাল সামলাতে পারেনি।
” টাকা, আদর এসবের বাইরেও মানুষের জীবনে আরো কিছু আছে। আর সময়? কীসের সময়? সারারাত জোর করে সময় কাটানোর কথা বলছেন? ”
অরাকে এভাবে কথা বলতে দেখে আরিশের বুকে চিনচিন ব্যথা করছে। মাথাটা কেমন ঝিমিয়ে যাচ্ছে, চোখের সামনে ভাসছে কিছু দৃশ্য! এভাবেই আরিশের মা তার বাবার সাথে ঝগড়া করতেন৷ বিনা কারণে ভদ্রলোককে অপবাদ দিতেন, গলা উঁচিয়ে কথা বলতেন, সবকিছু দেওয়ার পরেও সন্তুষ্ট হতেন না। দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভাসতেই হঠাৎ করে হিংস্র হয়ে উঠল আরিশ। চোখের পলকে অরাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় ছুড়ে ফেলল। পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো অরার ওপর। তার ঠোঁট, গলা, বুকে আরিশের কঠিন স্পর্শ সহ্য করতে পারছে না। অরা ব্যথায় ছটফট করছে কেবল।
” অ্যাম আই নট ইনাফ ফর ইউ? ডু ইউ স্টিল ওয়ান্ট মোর, হামিংবার্ড? নাকি দু’দিন ছাড় দিয়েছি বলেই আকাশের….. ”
আরিশের কণ্ঠ থেমে গেল অরার আচরণে। সে থাপ্পড় মেরেছে আরিশকে। রাগে আর ঘৃণায় অন্ধ হয়ে কাজটা করে ফেললেও, আরিশের দৃষ্টি এখন অরার ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে।
আরিশের রাগ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠল। অরা কাঁদছে। আরিশ কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। চমকে উঠল অরা। লোকটা কী করবে এখন? আর রাগের মাথায় সে-ই বা কী করল? আরিশের গায়ে অরা হাত তুলেছে ! বিছানায় বসে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো সে। আরিশ নিশ্চয়ই আরো ভয়ংকর হয়ে ফিরবে। হোলও তাই!
মিনিট পাঁচেক পর আবার ঘরে ফিরে এল আরিশ। তার হাতে হ্যান্ডকাফ, রুমাল। আসন্ন ঘটনা আচঁ করতে পেরে পিছনে সরে বসতে লাগলো অরা। আরিশকে আপাতত মানুষ রুপী শয়তান মনে হচ্ছে অরার।
” কী করছেন? কী করবেন! ”
আরিশ কিছু বলল না, অরার খুব কাছে এগিয়ে গেলো। এসির ভেতরেও অরা ভয়ে ঘামছে, বারবার জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে। কিন্তু আরিশ চুপচাপ নিজের কাজে করতে অগ্রসর হলো। অরার হাতের কবজিতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দিলো সে।
” এই হাত দিয়ে মেরেছ আমাকে। আপাতত আটচল্লিশ ঘন্টা এভাবেই থাকতে হবে তোমাকে। ”
” আমি প্রয়োজনে আত্ম// হত্যা করবো। তবুও আপনার সাথে থাকব না। আপনি বদ্ধ উন্মাদ একজন মানুষ। আমার মা! মা কীভাবে পারলো আপনার মতো উন্মাদের সাথে আমাকে বিয়ে দিতে! ”
অরার কণ্ঠে রাগ, ঘৃণা সবকিছু যেনো মিলেমিশে আছে। আরিশের চোখদুটো শান্ত, তবে লাল হয়ে আছে। অরার কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না তার। এই মেয়েটা আজ তাকে, নিজের মায়ের দেওয়া আঘাতের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। আরিশ রুমাল দিয়ে অরার মুখ বেঁধে ফেলল। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। এভাবে যন্ত্রণা দেওয়ার থেকে মে* রে ফেললেও তো পারে! আরিশ শান্তভাবে অরার কোলে মাথা রাখল। সোজা হয়ে শুয়ে অরার মুখের দিকে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে বলল,
“তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, হামিংবার্ড? তুমিও আঘাত করলে আমাকে? বলো তো, মানুষকে ধরে রাখে কী? ভালোবাসা? যত্ন? নাকি শুধু টাকা? শারীরিক আর আর্থিকভাবে সবটুকু দিতে চেয়েছি তোমায়, তবুও কেন যেন হারিয়ে ফেলছি। বলো না, কী করলে তুমি থাকবে আমার পাশে?”
আরিশকে এমন ভাঙা, নিঃসঙ্গ দেখেনি অরা আগে কখনো। কিছুটা হতচকিত হয়ে গেছে মেয়েটা—কী বলবে, কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না।
চলবে,
#হামিংবার্ড
#পর্ব_২০
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
আরিশকে এমন ভাঙা, নিঃসঙ্গ দেখেনি অরা আগে কখনো। কিছুটা হতচকিত হয়ে গেছে মেয়েটা—কী বলবে, কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না।
আরিশ একটু থেমে আবারও বলতে লাগলো,
“জানো হামিংবার্ড, আমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না। আমার কাছে সবকিছুই চাহিদা দিয়ে মাপা হয়হতে পারে সেটা আর্থিক, মানসিক, কিংবা শারীরিক। সবকিছুর ভেতরেই একটা প্রয়োজন লুকিয়ে থাকে। এই যে তোমার সঙ্গে জেদ ধরি, রাগ করি, তবুও কেমন একটা অনুভব হয় ভেতরে। কেন হয়, নিজেই জানি না।”
অরা কিছু বলতেও পারছে না। হাত বাঁধা, মুখও। শুধু আরিশের আধপাগলের মতো কথা শুনে যাচ্ছে। একটু-আধটু মায়া লাগছে ভদ্রলোকটার জন্য। কারণ, এই মুহূর্তের আরিশ অন্য সময়ের আরিশ থেকে একদম আলাদা। আরিশ অরার দিকে দৃষ্টিপাত করল। অরা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। মুচকি হাসল আরিশ।
“কথা বলতে চাও?”
অরা মাথা নাড়ল।
আরিশ শোয়া থেকে উঠে বসল। তারপর অরার মুখ থেকে রুমালটা সরিয়ে দিয়ে আবার তার কোলেই মাথা রাখল।
এতক্ষণ মুখ বাঁধা থাকার ফলে, অরা কিছুক্ষণ ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলল।
” আমার সাথে থাকবে না, হামিংবার্ড?”
চোখে চোখ রেখে নিচু স্বরে শুধালো আরিশ। অরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কত্ত মায়া নিয়ে জিজ্ঞেস করছে লোকটা! চোখে অসহায়ত্ব, কণ্ঠে হারিয়ে ফেলার আকুতি, বাচ্চাদের মতো কেমন কেমন করে তাকিয়ে আছে সে। অরা দোটানায় পড়ে গেলো। এই কঠিন, পাগলাটে পুরুষটির মধ্যেও একটা শিশুসুলভ মানুষ আছে। আরিশ ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় আবারও জিজ্ঞেস করলো। অরা ভাবনার অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। কী বলবে সে? মায়ের কাছে যতটুকু শুনেছিল, আরিশের ছোটোবেলা খুব খারাপভাবে কেটেছে। সেজন্য না-কি লোকটার মানসিক অবস্থা এমন। আসলেই কি তাই? তাহলে ডাক্তার দেখাচ্ছে না কেন সে? ডাক্তার দেখালেই তো সুস্থ হয়ে যেত। অরা কি একবার চেষ্টা করবে? হাসফাস লাগছে অরার।
” ছোট্ট পাখি? বলো?”
আরিশের সবকিছু খারাপ লাগলেও এই ডাকগুলো দারুণ লাগে অরার। ছোট্ট পাখি, হামিংবার্ড! ভীষণ কিউট ডাকনামগুলো। লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলল অরা। আরিশের দিকে দৃষ্টিপাত করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
” থাকব, থাকব আপনার সাথে। ”
অরার এমন জবাব আশা করেনি আরিশ। ফলশ্রুতিতে কিছুটা অবাকই হয়েছে সে। আনন্দে বিমোহিত হয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো সে,
” সে এগেইন, হামিংবার্ড। প্লিজ?”
” আপনার সাথে থাকব আমি, যাবো না। ”
অরা নিজের সাথে যুদ্ধে করে যাচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে এই লোকের সাথে একদিনও থাকবে না সে। কিন্তু পরক্ষণেই মায়ের কথা, আরিশের এমন অসহায়ত্বের কথা ভেবে মনে হচ্ছে – একবার চেষ্টা করা দরকার। হয়তো যত্ম, ভালোবাসা আর ঠিকঠাক চিকিৎসা পেলে মানুষটা ঠিক হয়ে যাবে। আরিশ খুশিতে অরার মাথা নিচু করে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। অকস্মাৎ এহেন কান্ডে যথারীতি চমকাল অরা। বিয়ের পর থেকে কতবার আরিশ তাকে এভাবে ছুঁয়েছে তার হিসেব নেই। কিন্তু বেচারি কখনো কোনো কিছু অনুভব করতেই পারেনি। পারবে কীভাবে? আরিশের ছোঁয়া তো স্বাভাবিক নয়, যেন একেবারে আগ্নেয়গিরির লাভা!
” যাক কেউ তো আমার সাথে থাকবে বলল! আচ্ছা হামিংবার্ড, তুমি ভয়ে বললে না তো?”
” উঁহু! ”
” কী হলো? ব্যথা পেয়েছ?”
” আরে না। বললাম যে, ভয়ে বলিনি। ”
” তাহলে? ”
” বিয়ে হয়েছে আপনার সাথে। আমারও একটা চেষ্টা করা উচিত বলে মনে হলো।”
আরিশ উঠে বসলো। অরার হাতের দিকে তাকাল একবার।
” তাহলে একেবারে থাকার কথা বলোনি?”
অরা চুপ করে গেলো। আরিশ ধীরে ধীরে অরার হাত থেকে হ্যান্ডকাফ খুলতে লাগলো।
” যাইহোক, এখন আছো সেটাই যথেষ্ট। আর হ্যাঁ সব সময় আমার মেজাজ একরকম থাকবে না৷ তাই পরবর্তীতে এমন মারামারির চিন্তাও করবে না হামিংবার্ড। ”
শুকনো ঢোক গিলে বলল সে,
” আসলে, মানে…. আমি বুঝতে পারিনি তখন। সরি!”
” আমি বুঝতে পারিনি দেখতে ছোটো মরিচ হলেও যথেষ্ট ঝাল আছ তুমি। আমার সামনেই শুধু জড়সড় হয়ে থাকো। ”
অরা হাত নাড়াচাড়া করছে। একটু সময় আটকে ছিলো তাতেই কেমন লাগছে। যদি সত্যি সত্যি আটচল্লিশ ঘন্টা এভাবে হাত আটকা অবস্থায় থাকত, তবে? অরার বেখেয়ালি মনোভাব দেখে আরিশ তাকে কোলে তুলে বসাল। তবে অরা এটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।
” কী করছেন? ”
ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো অরা। মুচকি হাসল আরিশ। অরার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দেওয়ার পরিবর্তে, আরও কিছু চুল কপালে এনে রাখল সে। চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে অরার ঠোঁটের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। অরার হৃৎস্পন্দনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরিশকে এভাবে কাছে আসতে দেখে কেমন অস্থির লাগছে তার। এই মুহুর্তে আরিশকে থামাবে কীভাবে সেটাই বুঝতে পারছে না সে৷ অরা এখনও এসবের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত না৷
” শুনুন। ”
” হুম। ”
” জোর করবেন? ”
[ Stories of Tasmia Tasnin Priya পেইজে ফলো দিয়ে রাখুন। ]
অরার প্রশ্নে থেমে গেলো আরিশ। কপালে কপাল ঠেকাল। বলল,
” নাহ। তুমি যখন চেষ্টা করবে, আমিও চেষ্টা করবো সবকিছু ঠিকঠাক রাখতে। তুমি নিজে থেকে না চাইলে কখনোই আর জোর করবোনা আমি। ”
আরিশের এমন জবাব আশাতীত ছিলো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অরা। তবে আজ দুঃখে নয়, আরিশের আচরণে খুশিতে কেঁদে ফেলেছে মেয়েটা। একটা সময় জীবনসঙ্গী নিয়ে কত-শত স্বপ্ন দেখত অরা৷ উপন্যাস, গল্প, মুভি দেখে দেখে ভাবত গল্পের নায়কের মতো টক্সিক, পজেসিভ, ওয়াইল্ড রোমান্স করবে এমন কাউকে বিয়ে করবে সে। অথচ বাস্তবে যখন সেটা হলো তখন অরা বুঝতে পারলো, কল্পনা আর বাস্তব আলাদা। বাস্তব আলাদা, কঠিন। উপন্যাসের পাতায় নায়কদের এমন টক্সিক, ওভার পজেসিভ চরিত্র পড়ে হৃদয়ে প্রেম জাগলেও বাস্তবে কেবল বিতৃষ্ণা জাগে মনে। জীবন দূর্বিষহ হয়ে ওঠে। অরাকে এভাবে কাঁদতে দেখে আরিশ বুকে জড়িয়ে নিলো তাকে। অরা ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
” আপনি প্লিজ এমনই থাকুন। রাত পেরিয়ে ভোর হতেই দুঃস্বপ্নের মতো হারিয়ে যাবেন না প্লিজ। আমার খুব কষ্ট হয়, ভয় লাগে। আমি, আমি……. ”
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে মেয়েটা। আরিশ অরার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
” শান্ত হও। আমি এমনই থাকব। তুমি শুধু আমার অপছন্দের কাজগুলো থেকে দূরে থেকো। আমি মাঝে মধ্যে চাইলেও নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আর একটা বিষয় হলো, তুমি ভীষণ কিউট, পাখি। এই যে দেখো, তোমার জন্য কতটা শান্ত হয়ে গেছি আমি! ”
অরা নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। এতদিন আরিশের থেকে এত এত যন্ত্রণা পেয়েছে যে, আজ হঠাৎ তার এত কোমল ব্যবহারে অরার মনে দাগ কেটেছে। অরা চুপচাপ আরিশের বুকেই মাথা রেখে বসে রইলো। আরিশ একা একা অনেকক্ষণ কথা চালিয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারল, অরা ঘুমিয়ে গেছে। মেয়েটা আসলেই বাচ্চা! কেমন কোলেই ঘুমিয়ে গেলো…………
সকালের আলোটা ধীরে ধীরে শহরের বুক চিরে উঁকি দিচ্ছে। আধো ঘুমন্ত রাস্তার ওপর দিয়ে প্রথমে কিছু পত্রিকা বিক্রেতা, দুধওয়ালা, আর ক্লান্ত ভ্যানচালকেরা নীরবভাবে চলতে শুরু করেছে। ফুটপাথের চায়ের দোকানে ধোঁয়া উঠছে, তপ্ত লাল চায়ের সঙ্গে জেগে উঠেছে শহরের চিরচেনা গুঞ্জন।
ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর হর্ন, অফিসগামী মানুষের হন্তদন্ত দৌড়, আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভেসে আসা হকারদের হাঁকডাক সব মিলিয়ে শহর যেন এক প্রাণবন্ত কোলাহলে জেগে ওঠে।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে আকাশ। হাতের গুলিটা বেশ যন্ত্রণা দিয়েছে তাকে। আকাশের বাবা ছেলের এমন পরিণতিতে ভীষণ রেগে গেছেন। গতকাল আকাশের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে আরিশের কাছে যেতে পারেনি। কিন্তু আজ ভোরের আলো ফুটতেই থানায় চলে গেছেন তিনি।
ঘরটা শান্ত, নিস্তব্ধ। যেন ঘুম আর নীরবতায় মোড়া এক টুকরো সকাল। জানালার পর্দা হালকা হাওয়ায় দুলছে, আর তার ফাঁক গলে ঢুকে পড়া রোদ একপ্রকার নরম আলোর চাদর ছড়িয়ে দিয়েছে ঘরের ভেতর। অরা এখনো ঘুমিয়ে, শরীরটা একটু গুটিয়ে রাখা। চুলগুলো এলোমেলো, বালিশের কোণে ছড়িয়ে আছে। হঠাৎ করেই একফালি রোদ এসে পড়ল তার চোখেমুখে। চোখের পাতার ওপর উষ্ণ আলো পড়ে অরার মুখে মিশে গেল একটা অদ্ভুত কোমলতা। যেন সূর্য নিজেই তার ঘুম ভাঙাতে এসেছে নিঃশব্দে। আরিশ কিছুক্ষণ আগে জেগে উঠেছে। সে এক কোণে চেয়ারে বসে তাকিয়ে আছে অরার দিকে, চোখে মুগ্ধতা। কেমন করে যে রোদটাও তার ছোট্ট পাখিটাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, সেটাই দেখছে সে। রোদ ছুঁয়ে ছুঁয়ে অরার গাল, নাক, কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে এগোচ্ছে আরিশ। খুবই ক্ষিপ্ত গতিতে সবগুলো জানালা আঁটকে দিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল সে। এতক্ষণে শান্তি! রোদ কেনো স্পর্শ করবে অরাকে? তাও বন্ধ ঘরের মধ্যে?
চলবে,